বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

নবম পর্বের পর

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

পরে ১৯৪৮-এর ১৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সমর্থনে পরিপূর্ণ গভর্নর জেনারেল হন নাজ়িমুদ্দিন। এই পদ অধিকারের পর নাজ়িমুদ্দিনের কাজ ছিল প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানকে সমর্থন দিয়ে গদিতে টিঁকে থাকা[33]। তাঁর দায়িত্বপূর্ণ উক্তিতে ঝরে পড়ে ইসলাম আনুগত্যের অসামান্য নিদর্শন যা বলা বাহুল্য পাকিস্তানেরই আদর্শ, “I do not agree that religion is a private affair of the individual nor do I agree that in an Islamic state every citizen has identical rights, no matter what his caste, creed or faith be …” — Governor-General Khawaja Nazimuddin, 1948–49 [34] এরপর ১৯৪৯ সালে একটি পার্লামেন্টারি কমিটি (Basic Principles Committee) গঠন করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানকে নীতিনির্দেশ রচনার দায়িত্ব দেন। ১৯৫০ সালে সরকারিভাবে ঘোষণা করেন, “Pakistan would remain incomplete until the whole of Kashmir is liberated.”[36]

বাঙালী হলেও এমন পাক ও ইসলাম আনুগত্যের পরবর্তী পুরস্কার হল লিয়াকত আলি নিহত হলে নাজ়িমুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী পদ ও মুসলিম লীগের সভাপতিত্ব দুটোই সামলানোর অনুরোধ করা হয় এবং তিনি তা সাদরে গ্রহণও করেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে মৌলবাদের ভিত্তি পোক্ত করে তোলেন এবং প্রশাসনে বেছে বেছে তেমন ব্যক্তিকে বহাল করেন। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ রাজের অধীনে ডোমিনিয়ন থেকে প্রজাতন্ত্রী (republic) রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানকে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাতে বাঙালীর কী উপকার হয়েছিল, তার সাক্ষ্য পরবর্তী রক্তাক্ত ইতিহাস দিয়েছে।

মুসলিম লীগের বাংলা শাখার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সুহ্‌রাবর্দির ক্ষমতা কিছুটা খর্ব হয়েছিল, তাই হয়তো ভারত ভাগের পরেও কিছুদিন কলকাতায় থেকে গিয়েছিলেন। গান্ধীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে শান্তির জন্য নাকি আবেদনও করেন! তবে ৫ মার্চ ১৯৪৯-এ পাকিস্তানেই চলে যান। পুরো অবিভক্ত বাংলার শাসনভার না পেয়ে এবার বাংলার অধিকাংশ ভূখণ্ডের ওপর পাকিস্তান ফেডারেশনের আধিপত্য বজায় রাখতে সুহ্‌রাবর্দিও যথেষ্ট আন্তরিক হয়ে পড়েন। কিন্তু জিন্নার মৃত্যুর পর পূর্ববঙ্গের গভর্নর জেনারেল হয়ে কে. নাজ়িমুদ্দিন একদা হারের বদলা নিয়ে সুরাবর্দিকে মুসলিম লীগ ছাড়তে বাধ্য করেন। নাজ়িমুদ্দিন দ্বারা মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর মৌলানা ভাসানির মতো মৌলবাদী ইসলামবেত্তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১৯৪৯-এ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন[9]। তারপরেই মুসলিম একতার পরিবর্তে বাঙালী জাতীয়বাদের (Bengali nationalism) প্রবক্তা হয়ে যান[8]। ১৯৫০ সালে রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী নাজ়িমুদ্দিনের বিরোধিতায় কমিউনিস্টপন্থী রিপাবলিকান পার্টি ও অন্যান্য বাম দলগুলোর সঙ্গেও হাত মিলিয়ে গড়ে তোলেন ইউনাইটেড ফ্রন্ট (United Front):1968–1969[56]। এরপর ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের মাতৃভাষা হিসাবে নাজ়িমুদ্দিন উর্দুকে ঘোষণা করায় বাঙালী মুসলমানরা প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ফলে নাজ়িমুদ্দিন ও মুসলিম লীগের জনসমর্থন জোর ধাক্কা খায়। আর সুরাবর্দির আওয়ামি লীগ বাঙালী জাতিসত্তার প্রতিনিধি হয়ে ওঠে।

এই সময় শুধু পূর্ববঙ্গ নয়, পাকিস্তানের পশ্চিম দিকেও চারটি প্রদেশের ভাষাগত দাবি দাওয়া উঠেছিল। উপরন্তু ১৯৫১-র জনগণনায় ধরা পড়ল করাচির ৫৭% বাসীন্দা ভারত থেকে আগত পরিযায়ী মানুষ। তার ওপর ক্রমাগত মৌলবাদে উস্কানির ফলে ১৯৫৩ সালে জামাত-এ-ইসলামি আহমদিয়া মুসলিমদের আক্রমণ করে তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে অমুসলিম বলে ঘোষণার দাবি জানায়। পশ্চিম পাকিস্তানে, বিশেষত পাঞ্জাবে এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে নাজ়িমুদ্দিনের প্রত্যক্ষ মদত ছিল। আর এদিকে বাংলার সফল ভাষা আন্দোলনের ফলে উর্দুপন্থীদের পরাজয় সামগ্রিকভাবে নাজ়িমুদ্দিনের অপদার্থতা সূচিত করে, যার ফলে গভর্নর জেনারেল মালিক গুলাম Government of India Act, 1935 প্রদত্ত সংরক্ষিত ক্ষমতা (reserve powers) প্রয়োগ করে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নাজ়িমুদ্দিনকে বরখাস্ত করেন।[47]:289[49]:132

১৯৫৩-৫৪-র নির্বাচনের সময় ইউনাইটেড ফ্রন্ট (United Front)-কে সমর্থন করায় মুসলিম লীগের হার হল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে সম্পূর্ণ দমিয়ে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়েছিল পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই, তারই রাজনৈতিক মঞ্চ এই ইউনাইটেড ফ্রন্ট। বলা যায় বাঙালী জাতিগত ভাবাবেগ চালিত ইউনাইটেড ফ্রন্ট (‘Pan-Bengali United Front alliance) গঠন করে ১৯৫৪-র নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী নুরুল আমিনকে কার্যত উড়িয়ে দিয়েছিলেন সুহ্‌রাবর্দি[2]। তবে পাকিস্তানের সরকার গড়তে মুসলিম লীগকে সমর্থন জানান। বিনিময়ে নাজ়িমুদ্দিনকে হটিয়ে মহম্মদ আলি বোগরা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে সুরাবর্দি প্রতিভা মন্ত্রকে (Ministry of Talents) আইন ও বিচার মন্ত্রীত্ব (Minister of Law and Justice) এবং পাকিস্তানের সংবিধান রচনার দায়িত্ব দুটোই লাভ করেন। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রকও পেয়েছিলেন। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার নাজ়িমুদ্দিনকে পরোক্ষভাবে ক্ষমতাচ্যুত করেন সুরাবর্দি। তবে তখনও ছিলেন বিরোধী নেতা। ১৯৫৫ পর্যন্ত এই পদ অলংকৃত করার পর যখন কিছু মতানৈক্যের জেরে মুসলিম লীগ তার নিজের প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলির বিরুদ্ধেই অনাস্থা প্রস্তাব (no confidence) আনে, তখন সুরাবর্দি সমর্থন জানিয়ে জালি বোগরার পদচ্যুতি নিশ্চিত করেন। এরপর শুরু হল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পরবর্তী ইনিংস। দরকাষাকষিতে জিতে ১৯৫৬ সালে নিজেই আওয়ামি লীগ, মুসলিম লীগ ও ইউনাইটেড ফ্রন্ট – এই তিন দলের জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসেন। অর্থাৎ তিন-তিন বার সুরাবর্দি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রশাসনিক প্রধানের পদচ্যুতি ঘটিয়ে নিজে ক্ষমতা দখলে সফল হন।
প্রশাসনিক প্রধান হয়ে অর্থনৈতিকভাবে বিশেষ করে শক্তি সংরক্ষণ সংক্রান্ত ও সামরিক সংস্কারের ব্যাপারে আমেরিকার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ানের বিপক্ষে চলে যান[10]। সেই সঙ্গে চিনের সঙ্গে ঘণিষ্ঠতা বাড়াতে ‘ওয়ান চায়না’ নীতি (One-China policy) গ্রহণ করেন। শত সহস্র মানুষের হত্যাকারী একজন খুনী চিনের প্রতি কূটনৈতিক স্বার্থে অনুরক্ত ছিল বলেই কি পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা এখনও পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ বলতে অজ্ঞান? কিন্তু সেই সময় ধনতান্ত্রিক আমেরিকাকে পাশে পেতে সুরাবর্দি তো সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার বিরুদ্ধেও গিয়েছিলেন। কে জানে? এইসব বাঙালীদের মানসিকতা বোঝা দুঃসাধ্য নয়, অসাধ্য মনে হয়। অথচ পরবর্তীকালে এই সোভিয়েত ইউনিয়ান ভারতের পাশে না দাঁড়ালে ভারতের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করা রীতিমতো কঠিন হয়ে যেত।
যাই হোক, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে দুই পাকিস্তানের মধ্যে খানিক সমতা বিধানের জন্য পূর্ব পাকিস্তান যেমন একটি প্রদেশ, তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি রাজ্যকে সংযুক্ত করে একটি একক (One-Unit) পশ্চিম পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব দিলে তা পাকিস্তানি জাতীয়বাদের পরিপন্থী পদক্ষেপ হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়ে[11]। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬-য় তৎকালীন রাজধানী করাচিতে পাকিস্তানের ন্যাশনাল আ্যাসেম্বলি (National Assembly) কক্ষে গভর্নরের সামনে শপথ গ্রহণের সময় নিজের ‘ওয়ান ইউনিট’ গড়ার অবস্থান থেকে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের দিকে সরলেও ক্ষমতা লাভের পর পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি একক (One-Unit) রাজ্যে পরিণত করার ওপর পুনরায় জোর দেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান নিজের চারটি রাজ্য – পাঞ্জাব, সিন্ধ, বালোচিস্তান ও পখ্‌তুনখোয়ারের সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা অব্যহত রাখতে একত্রীকরণের বিরুদ্ধে ছিল[60]। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান পূর্ব-পশ্চিম মিলিত ভোটারের (joint electorate) পক্ষে হলেও পশ্চিম পাকিস্তান পৃথক ভোট গ্রহণের (separate electoral system) পক্ষে ছিল। মানে শুধু হিন্দু ভারত থেকে পৃথক হয়ে স্বস্তি নেই, ‘হিন্দু ভেজালযুক্ত’ বাঙালী মুসলিমদের থেকেও উর্দুভাষী উন্নত মুসলিমদের পৃথক অবস্থান চাই। মুসলমান বাঙালীরা সম্ভবত সেদিন থেকে টের পেতে শুরু করেছিল ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও পাকিস্তানের সঙ্গে আত্মীয়তা সম্ভব নয়। মতভেদ তুঙ্গে ওঠে। তার ওপর পাকিস্তানে পারমাণবিক শক্তি সঞ্চয় নিয়েও মতভেদ শুরু হয়। পাকিস্তানের আর্মি কমান্ডার লেফটেনান্ট জেনারেল আয়ুব খানকে আরও তিন বছর দায়িত্বে থাকার অনুরোধ জানাতে হয়। কিন্তু ওয়ান ইউনিট ও জয়েন্ট ইলেক্টোরেট ছাড়াও পূর্ব-পশ্চিমে অভিন্ন রাজস্ব ব্যবস্থা লাগুর বিরুদ্ধেও পশ্চিম পাকিস্তান তাঁর ওপর খেপে ওঠে।

ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে ১৯৫৭-য় রাষ্ট্রপতি ইস্কন্দর মির্জ়ার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব এনে কৌশল করতে গিয়ে নিজেই বিপাকে পড়েন সুরাবর্দি। পার্লামেন্টের আস্থা জয় করে রাষ্ট্রপতি প্রতিশোধ নিতে পারেন আশঙ্কা করে নিজেই পদত্যাগ করে সরে যান। কার্যত তিনি লেফটেনান্ট জেনারেল আয়ুব খান দ্বারা পদচ্যুতই হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে মৌলানা ভাসানিকেও অসন্তুষ্ট করে ছিলেন। অতঃপর কলকাতা গণহত্যার নায়কের মধ্যে বাঙালী জাতিসত্তার আবেগ প্রবলতর হল। অর্থাৎ বিষাক্ত খুনে সাম্প্রদায়িকতাই পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী জাতীয়তাবাদের রূপকার হয়ে উঠেছিল। আর এই জাতীয়তাই এখনও বৃহত্তর ও অখণ্ড বাংলার স্বপ্নকে জিইয়ে রেখে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় এমনকি আলিবর্দি-সিরাজের সুবে বাংলার মানচিত্রে শামিল বিহার, উড়িষ্যা রাজ্যের ওপরও দখল চায়।

এই নয়া বাঙালী জাতিসত্তার সঙ্গে আদতে পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালীর কোনও সম্পর্ক ছিল না। পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালীরা রিফিউজির মুখে জমিদারির গল্প শুনতে শুনতে নিজেদের জমি জিরেত জবর-দখল হতে দেখেছে। ওপার থেকে আসা সবর্হারা বাঙালীরাই অবৈধ ভোটাধিকার লাভ থেকে ক্রমশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেছে। আবার যারা সম্পদ স্বজন হারিয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছিল একদিন, তারাও এখন বেশিরভাগ হামলাকারীদের প্রতি আক্রোশ ভুলে ওদেশবাসীদের জন্য আবেগসিক্ত হয় আশ্রয়দাতা ‘এদেশী ঘটি’দের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়ে। স্বাধীনতা ও দেশভাগের সত্তর বছর পরেও ঠাকুরদারও ঠাকুরদার আমলে পূর্ববঙ্গ থেকে তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা পরিবারের এদেশে জন্মানো এ প্রজন্মের সন্তানও দেশের বাড়ি বলতে বোঝে বাংলাদেশের কোনও গ্রাম বা শহরকে; বিশ্বাস করে ‘এদেশী’রা অতিথি সৎকার, রান্নাবান্না, ভদ্রতা কিছুই জানে না। এদেশে খেয়ে পরে, উপার্জন করে, সম্পত্তির মালিক হয়ে, এদেশের মাটিতে ত্যাজ্য-বর্জ্য ত্যাগ করেও ‘ওরা এদেশী’ নয় বরং ‘এদেশী’দের প্রতি গভীর তাচ্ছিল্যপ্রবণ।

সহনশীলতা ও আত্ম-সমালোচনায় এদেশী হিন্দু বাঙালীরা আর একটু এগিয়ে। নিজেরা অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, কিন্তু পরধর্ম পর-সংস্কৃতির প্রতি অহেতুক শ্রদ্ধা না দেখালে নিজেদের উদার শিক্ষিত প্রগতিশীল বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। ‘এদেশী’ বা ‘ওদেশী’দের মধ্যে যারা বাঙালী জাতিসত্তা আঁকড়ে ‘অসাম্প্রদায়িক’ হিসাবে নিজেদের জাহির করতে চায়, তারা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ নয়, ‘হিন্দী’র আধিপত্যকে অনেক বেশি ঘৃণা করে। আর যারা ভারতীয় জাতীয়তাবোধে দীক্ষিত, তারা বাংলায় হিন্দীর মিশেল না দিয়ে কথা বলতে পারে না। এই দ্বন্দ্ব থেকে ভারতীয় বাঙালীর মুক্তি নেই! অখণ্ড বাংলার আবেগ ভুলতে না পেরেই ভারতীয় বঙ্গভূমি ‘পশ্চিমবঙ্গ’, যেখানে ভারতীয় পাঞ্জাব ‘পূর্ব পাঞ্জাব’ নয়, শুধু পাঞ্জাব।

একটা কথা মনে হয়, তখন বাঙালী মুসলমানেদের কেউ কেউ পাকিস্তানে থাকার জন্য জেদ না ধরে শুধু পূর্ববঙ্গ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে রাজি হলে তাদেরও এত রক্ত ঝরত না, মা বোনেরা বেঁচে যেত। হিন্দু মেয়েদের ওপর সেই সময় পাকিস্তানি সেনারাই সর্বাধিক অত্যাচার করেছিল; সেটা একটু হলেও কম হোত। সর্বোপরি কাশ্মীর নিয়ে সংঘাত থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার অপরাধে ভারতের প্রতি পাকিস্তানের এতটা বৈরিভাব তৈরি হোত না।

প্রসঙ্গত সেই সময় বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিও কিন্তু একতরফা হিন্দু বিনাশের পক্ষে রায় দিতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তী কালে হিন্দু বাঙালী কমরেডরা পূর্ববঙ্গে ধারাবাহিকভাবে হিন্দু হত্যা ধর্ষণ অপহরণ বাস্তু থেকে উচ্ছেদ ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করেও কোন উপায়ে আবিষ্কার করলেন, যে অবিভক্ত বাংলায় ইসলামের শাসন কায়েম হোত না বা হলেও সব বাঙালী ভালো থাকত, কিংবা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়নি, হয়েছে শুধুমাত্র হিন্দু নেতাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে, সেটা সত্যিই রহস্য।

তা হোক। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, আমাদের জাতিগত পরিচয় ভারতীয় হিসাবে বিকশিত হয়ে থাকলেও ভারতীয় জাতীয়তাবোধে সম্পৃক্ত হতে পারেনি, বরং লাগাতার কেন্দ্রীয় বৈষম্য ও বিভিন্ন রাজ্যে প্রাদেশিক জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়ে ক্রমশ যেন বাংলাদেশী জাতিসত্তা দ্বারা জারিত হচ্ছে, যাদের সঙ্গে সহাবস্থান যে সম্ভব নয়, তা প্রমাণিত।

চলবে