বঙ্গের পুনর্জাগরণ – কী এবং কেন (দ্বিতীয় কিস্তি)

0
799

 

“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হ’তে কখন আপনি

তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী”

এই পঙক্তিগুলি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন ১৩১২ বঙ্গাব্দের (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ) ভাদ্র মাসে – অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে। বঙ্গদেশের মাতৃমূর্তির যে ধ্যান গুরুদেব এ গানে করিয়াছেন তাহাতে দেখিতে পাই বাঙালির এক অতি পরিচিত দেবীর অপরূপ চিত্র – “ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,/ দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ”; এবং সেই বঙ্গমাতৃকার মন্দির স্বর্ণনির্মিত – “তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে”! কে এই দেবী? যেটুকু বা সন্দেহ থাকিলেও থাকিতে পারে তাহারও নিরসন গুরুদেব করিয়া দিয়াছেন – “তোমার মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি,/ তোমার আঁচল ঝলে আকাশতলে রৌদ্রবসনী”; অভাগিনী বঙ্গজননী কিরূপে এমন ঐশ্বর্যশালিনী হইতে পারেন সেই সংশয় কবিগুরু নির্বাপিত করিলেন এইভাবে – “কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ, কোথা সে তোর মলিন হাসি –/ আকাশে আজ ছড়িয়ে গেল ওই চরণের দীপ্তিরাশি!” কবির মনে বিস্ময় জাগাইয়া, আবালবৃদ্ধবনিতার হৃদয় মথিত করিয়া, বর্ষার অশনি কাটিয়া যুগে যুগে আশ্বিনের পুণ্য শুভ্র মাসে যে দেবীর চরণপাতে বঙ্গদেশের সামান্য ধূলিকণা হইতে সুউচ্চ আকাশের পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ অবধি দীপ্ত হাসি খেলিয়া যায়, সেই রাজরাজেশ্বরী দেবী দুর্গার মূর্তি ছাড়া আর অন্য কোনো রূপে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গমাতাকে কল্পনা করিতে পারিলেন না – তাঁহার পরিবার ও সমাজ তাঁহাকে যে সুগম্ভীর নিরাকার একেশ্বরবাদী ব্রহ্মোপাসনার সংস্কার দিয়াছিল, সেই ব্রাহ্ম সংস্কার তাঁহার সহজাত বাঙালি কল্পনাশক্তিকে রোধ করিতে পারে নাই। ভবদারা দুর্গা/কালী ছাড়া আর কাহারি বা হাতে একইসঙ্গে জাজ্বল্যমান উদ্যত খড়গ এবং শঙ্কাহরণ অভয়বরদান দেখিতে পাই? সে আর কোন্‌ দেবী যাঁহার দুই নয়ন সন্তানের পানে প্রসন্নদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকে, অথচ ললাটের তৃতীয় নেত্র অগ্নিবর্ষী হয়? আর কাহার মুক্ত কুঞ্চিত কেশরাজির শোভা শারদীয় গগনের পুঞ্জ মেঘের সহিত তুলনীয়? রবীন্দ্রনাথ শুধু দেবী মহামায়ার নামখানিই উল্লেখ করিতে যা বাকি রাখিয়াছেন, আর দেবীর যাহা কিছু গুণলক্ষণ ষড়ৈশ্বর্য তাহার সবই এই গানের কথায় উপস্থিত করিয়াছেন। কবিগুরুর ইঙ্গিতখানি স্পষ্ট। বাঙালি হিন্দু যুগ যুগ হইতে তাহার পুণ্য মাতৃভূমিকে আপন পরিচয়ের সহিত সমার্থক এই এক সিংহবাহিনী দশভুজা দনুজদলনী দেবীরূপে কল্পনা করিয়া আসিতেছে, তা সে ঋষি বঙ্কিমের “মা যা হইবেন” অথবা রবীন্দ্রনাথের স্বদেশমাতৃকা – যিনিই হউন না কেন। এই রূপেই স্বদেশ বাঙালির নিকট চিরকাল প্রতিভাত হইয়াছে, এই রূপেই দেশমাতৃকাকে বাঙালি পূজা করিয়া আসিতেছে, এই দেবীর আগমনী উৎসব উদ্‌যাপনকে কেন্দ্র করিয়াই বাঙালি দেশসেবাব্রত এবং স্বজাতির প্রতি আপন প্রীতিকর্তব্য পালন করিয়াছে।

অপরদিকে ভারত রাষ্ট্রের সহায়তায় আপনার পূর্ব পাকিস্তান নাম ঘুচাইয়া নবগঠিত মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্র বাংলাদেশ কিন্ত বঙ্গদেশের এই ধ্যানমূর্তি স্বীকার করিতে পারে নাই। এই দেশাত্মবোধ-উদ্দীপক গানের একেবারে প্রথম পঙক্তিতেই অধুনা হিন্দু-খ্যাদানো সে রাষ্ট্রের বিভ্রান্তিকর নাম ‘বাংলাদেশ’ শব্দের সরাসরি প্রয়োগ ঘটিয়া থাকিলেও “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” গানে কিন্তু কোথাও সে নামের উল্লেখ নাই। এতদ্‌সত্ত্বেও পরবর্তী গানটিকেই ওই মুসলমানপ্রধান দেশের প্রণেতাগণ আপন জাতীয় সঙ্গীত বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন, “আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে”-কে জাতীয় গান হিসেবে ভাবিতে বুঝি তাঁহাদের ইসলামী সংস্কারে বাধিয়াছিল। অতীতের পানে ফিরিয়া চাহিলে দেখিতে পাই যে ইহা একরকম ইতিহাসের ক্রূর পরিহাস বটে, কারণ কার্জন-প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হইলে পর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজ স্বভাবগত মহান হৃদয়বত্তা এবং জন্মসূত্রে প্রাপ্ত হিন্দুসুলভ ঔদার্যে এই গান গাহিয়াই মুসলমানের হাতে ভ্রাতৃত্বের দ্যোতক রাখী পরাইতে উদ্যত হইয়াছিলেন। এই পর্যবেক্ষণ হইতে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরসূরি কাহারা বহন করিতে পারে আর কাহারা পারে না তাহার একখানি আভাস পাওয়া যায় বৈকি।

এই ইতিহাসের নিরিখে দেখিলে বুঝা কঠিন নহে যে পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান আধুনিক কালে ‘বাংলাদেশ’ নামটি কেবল গায়ের জোরে আত্মসাৎ করিয়াছে। এ নাম ধারণ এবং বহন করিবার যোগ্যতা সে রাষ্ট্রের নাই, কারণ এই নামের ভিতরে যে ঐতিহাসিকতা নিহিত রহিয়াছে তাহার উত্তরাধিকার অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্র অস্বীকার করিয়াছে। কীরূপে অস্বীকার করিল? জাতিগতভাবে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে গণহত্যা, গুপ্তহত্যা, ধর্ষণ, গুম করা এবং লুণ্ঠন করিয়া ভয় দেখাইয়া তাহাদিগকে আপন জন্মভূমি হইতে তাড়াইবার মাধ্যমে। এইরূপ নানাবিধ অপকর্ম-অত্যাচার দ্বারা, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের মুহূর্তে যে হিন্দু জনগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ ছিল, তাহা ধারাক্রমে ১৯৭১-এ নবগঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ২০ শতাংশেরও কম এবং অধুনা ৮ শতাংশেরও কমে আসিয়া ঠেকিয়াছে। ভারতবর্ষের ইতিহাস এবং পৃথিবীর ইতিহাস অনুসরণ করিলে দেখা যাইবে যে বাংলাদেশকে বাংলাদেশ বলিয়া চিহ্নিত করা গিয়াছে তাহার বিশিষ্ট শিল্পরীতির দ্বারা, তাহার গৌরবমণ্ডিত সাংখ্য-তর্ক-ন্যায়-বৈশেষিক-নব্যন্যায়-তন্ত্রাগম-ভক্তিদর্শন পরম্পরাগুলির দ্বারা, তাহার বিশিষ্ট বাংলা রচনারীতি-কাব্য-সঙ্গীত-কলা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়া – যে সংস্কৃতি গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের প্রতিরোধ, পাল-সেন-মল্ল রাজন্যবর্গের হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতার সহস্র বৎসরের যত্নলালিত শাসন-বিবর্তনের ফল। বঙ্গদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের আইডেন্টিটি, বা তাহার নিজস্ব পরিচয় তাহার বিশুদ্ধ ভারতবর্ষীয় সমাজের মধ্যে বিধৃত, যে সমাজ বৈদিক আস্তিক এবং নাস্তিক বিবিধ ধার্মিক পরম্পরা হইতে সংগৃহীত উপাদানগুলির সংমিশ্রণ এবং তর্কবিতর্কের ফল। বাংলাদেশের স্থানমাহাত্ম্য এবং বাংলা ও বাঙালির নাম তীর্থ এবং তীর্থযাত্রী ভক্ত-কর্মীর কর্মের মতোই পবিত্র – ইহা আরবি-পারসিক মরু-সংস্কৃতির দ্বারা আত্মসাৎ করিবার ভক্ষ্যবস্তু নহে, জবরদখল করিবার পতিত ভূসম্পত্তি নহে।

এই স্থলে কেহ কেহ প্রশ্ন তুলিবেন যে বঙ্গদেশে ইসলামের প্রবেশ ঘটিবার কারণে বিবিধ বিবর্তন ও আদানপ্রদানের মাধ্যমে বাউল-ফকির পরম্পরাগুলিরও তো উদ্ভব ঘটিয়াছে – সেগুলিও বাংলার নিজস্ব সম্পদ, নহে কী? ইহার উত্তরে বলা চলে যে বাউলদের মধ্যে অধিকাংশই বৈষ্ণব পরম্পরায় দীক্ষিত, তাঁহাদের সঙ্গীতে সে পরম্পরার ছাপ স্পষ্ট। কাজেই তাঁহাদের সম্প্রদায় দেশজ ভাবের বিরোধী নহে। ফকির-দরবেশদের কথা স্বতন্ত্র। তাঁহাদের সিংহভাগই সূফী মতাবলম্বী, এবং ইঁহাদের অনেকেই কোরান ও হাদিস মানিয়া চলেন। বাংলা ভাষাতেই তাঁহারা কথা বলিয়া থাকেন এবং গানও সেই ভাষাতেই গাহিয়া থাকেন বটে, কিন্তু কেবল ভাষা বাংলা বলিয়া তাহার ভাব বাঙালি হইবে এমনটা জোর দিয়া বলিতে পারি না।

বঙ্গদেশ ও বঙ্গসংস্কৃতি ঠিক কী – তাহা যাচাই করিবার কষ্টিপাথরটি দেশজ-ভূমিজ হওয়া উচিত ছিল, আন্তর্জাতিক কিংবা বিদেশী নহে। বিশেষ করিয়া দেশভাগোত্তর কালে আকাদেমিক এবং গণমাধ্যমকেন্দ্রিক আলোচনায় আমরা বিদেশী সংস্কৃতিতত্ত্ব অথবা নৃতাত্ত্বিক মানদণ্ডে দেশের সংস্কৃতির মূল্যায়ণ করিয়া আসিতেছি। সংস্কৃতিচর্চায় এবং মানবীয় বিদ্যায় (হিউম্যানিটিজ-এ) এই অভিমুখ বিভ্রান্তি উদ্রেককারী, অতএব অনুচিত।

কিন্তু যাহা ঘটা উচিত নহে তাহাও জগতে প্রায়শঃ ঘটিয়া থাকে। প্রথমতঃ দেশভাগের কালে ক্ষুদ্র স্বার্থসর্বস্ব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অপদার্থতার কারণে বাঙালি হিন্দুর পবিত্র মাতৃভূমির সিংহভাগ বিজাতীয় ধর্ম ও আদর্শের পতাকাতলে অদ্যাবধি  লুটাইতেছে, তদুপরি ক্রমে সেই মাতৃভূমির ‘বাংলাদেশ’ নামখানিও অপরে আত্মসাৎ করিয়া লইয়াছে। পাঠক মনে রাখিবেন, দেশভাগের পূর্ব অবধি বাংলাদেশ অথবা বঙ্গদেশ নামের দ্বারাই বাঙালি হিন্দু আপনার মাতৃভূমিকে চিরকাল চিহ্নিত করিয়া আসিয়াছে। সে নাম লুণ্ঠিত হইয়াছে, কিন্তু এই লুণ্ঠনক্রিয়া সম্পন্ন করিবার জন্য যাহা কিছু আবশ্যক ছিল, তাহা রাতারাতি ঘটে নাই। কয়েক শতাব্দী ধরিয়া এই প্রক্রিয়া চলিয়া আসিতেছে, ধর্মান্তরণের মাধ্যমে এবং বাঙালি হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়ের মাধ্যমে। ১৯৪৭-এ দেশভাগ এবং দেশভাগের ফলে বাঙালি হিন্দু জীবন ধন মান যাহা কিছু হারাইয়াছে তাহা এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ারই চূড়ান্ত ফল। বাঙালি হিন্দুর সমাজ এখন এক ঘোর অন্ধকারের মধ্যে নিমজ্জিত হইয়াছে। তাহার জাতীয় দেবতা আদ্যাশক্তি মহামায়া এই দেশ এবং দেশবাসীর মধ্যে নিজের প্রকাশকে একেবারে সঙ্কুচিত করিয়া লইয়াছেন।

এখন প্রশ্ন হইতেছে, তবে উপায় কী? এই দীর্ঘতরা নিবিড় তমিস্রা কাটাইয়া বঙ্গভূমে বঙ্গজননী দুর্গার স্বমহিমায় পুনঃপ্রকাশ ঘটাইতে হইলে বাঙালি হিন্দুর পক্ষে কী করা আবশ্যক? কী না করিলেই নয়? অতঃপর সেই চিন্তায় অভিনিবেশ করা যাউক।

প্রথমতঃ, তাহাকে সত্যনিষ্ঠ হইতে হইবে। সত্যনিষ্ঠা, সত্যকথন এবং সত্যবদন হিন্দু সভ্যতা ও হিন্দু ধর্মের মূল। সত্য কী? সত্য অর্থাৎ সদ্‌বস্তুর বিরাজমান অবস্থা, বিদ্যতা, তাহার জ্ঞান। জগত যেরকম তাহাকে সেইরূপে স্বীকার করাই সত্যের মুখোমুখি হইবার প্রথম ধাপ। জগত যে প্রকারে আপনাকে প্রকাশ করিতেছে, তাহাকে সেইরূপে স্বীকার না করিয়া তাহাতে স্বকপোলকল্পিত ধারণা ও ব্যক্তিগত আদর্শকে আরোপ করিলে সত্যনিষ্ঠ হওয়া যায় না। কেহ যদি অসি হস্তে করিয়া আমাকে মারিতে উদ্যত হয় তবে তাহার মধ্যে মঙ্গল নহে, অমঙ্গলকে লক্ষ্য করাই সত্যনিষ্ঠ হওয়া। মনু বলিয়াছেন “বেদো অখিলো ধর্মমূলম্‌”, বেদই ধর্মের মূল। সেই বেদ কী আজ্ঞা করিয়াছেন? “সত্যং বদ ধর্মং চর”। “সত্যমেব জয়তে নানৃতম্‌”। বেদান্ত শিক্ষারম্ভের প্রাক্কালে প্রতিজ্ঞা করিতেছেন (এবং একাধারে শিক্ষার্থীকেও প্রতিজ্ঞা করাইয়া লইতেছেন) “সত্যং বদিষ্যামি ঋতং বদিষ্যামি।” বাঙালি হিন্দু আপনার ধর্মের এই আজ্ঞা পালন করা বন্ধ করিয়াছে, বহুদিন হইল সে আপন প্রতিজ্ঞা পালন করে নাই। এক দীর্ঘ যুগব্যাপী বাঙালি হিন্দু আপনার অস্তিত্বের চারিপাশে মিথ্যার একখানি সূক্ষ্ম অথচ দুর্ভেদ্য আবরণ তৈরি করিয়া রাখিয়াছে। তাহার সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব, রাজনৈতিক অস্তিত্ব, ধর্মীয় অস্তিত্ব – সমস্তই মিথ্যার এই দুর্ভেদ্য বর্মের দ্বারা আবৃত। বাঙালি হিন্দু ভাবিয়াছে, বিজাতীয় ধর্মসম্প্রদায় কিংবা শাসককুল যাহা শুনিতে পছন্দ করে না, উহাদিগকে তাহা না শুনাইলেই আপন অস্তিত্বরক্ষা করা যাইবে, আপনার কার্যসিদ্ধি ঘটিবে। ভুল। সত্য শুনিতে অথবা শুনাইতে অপ্রীতিকর ঠেকিলেও তাহা সত্যই রহিয়া যায়। আপনার অস্তিত্বের সুরক্ষার কারণে সত্যকে অস্বীকার করা অধর্মাচরণ। সত্যকে অস্বীকার করিয়া মিথ্যার মধ্যে আশ্রয় লইলে ধর্মের যে হানি ঘটে, সময় আসিলে ধর্ম তাহার শোধ সুদে আসলে তুলিয়া লয়। তাহাই হইয়াছে। সম্প্রীতিরক্ষা জীবনের চরম উদ্দেশ্য নহে, জীবনের চরম উদ্দেশ্য যাহা তাহা সাধন করিবার জন্য সম্প্রীতি রক্ষা আবশ্যক। কিন্তু অপরে অন্যায় আবদার এমনকী ক্রমাগত গা-জোয়ারি, উৎপীড়ন ও অত্যাচার করিতে থাকিলে উহা উপেক্ষা করিয়া সম্প্রীতি রক্ষার নামে আপনার ভীরুতা অকর্মণ্যতা ঢাকিবার চেষ্টা কাহারও মনে করুণার উদ্রেক করে না। ইহাতে দুষ্কৃতের প্রশ্রয় দেওয়া হয়। ইহা অধর্ম। উহাকে অধর্ম বলিয়া স্বীকার করিয়া উহার প্রতিরোধ করিবার মতো উন্নত মেরুদণ্ড চাহি – জাতীয় পুনর্জাগরণের ইহা প্রাথমিক শর্ত।

এই শর্তটি পূরণ করিতে হইলে শুধু শাসকের অন্যায়কে অন্যায় বলিবার সাহস থাকিলেই চলিবে না, পলিটিকাল কারেক্টনেস-এরও ঊর্দ্ধে উঠিতে হইবে। পলিটিকালি কারেক্ট কথা বলিবার অথবা লিখিবার নিমিত্ত আমাদিগকে সত্যনিষ্ঠা বিসর্জন দিতে হয়। সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে আলোচনা এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ইহা এক মহামারীর আকার ধারণ করিয়াছে। এই কথা শুধু যে পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এমন নহে। সমগ্র ভারতবর্ষ এমন কী পাশ্চাত্যে এমন অবস্থা দাঁড়াইয়াছে যে লোকে মুখ খুলিবার আগে সাতবার ভাবিয়া শেষমেশ নিজেই নিজের বক্তব্যকে সেন্সর করিয়া থাকে। ইহাতে পলিটিকাল কারেক্টনেস বজায় থাকে বটে, কিন্তু বক্তব্যের সত্যটি হারাইয়া যায়। ইদানীং দুনিয়াশুদ্ধ হুজুগ উঠিয়াছে যে কেহ কাহাকেও বাক্যের দ্বারা, অথবা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দের দ্বারা আঘাত করিতে পারিবে না। ইহা বড়োই ভালো শোনায় বটে, কিন্তু আমরা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি – তাহা হইলে কী সাংবাদিক/গবেষকগণ – যাঁহাদের কাজ সত্যের অনুসন্ধান করা (অন্ততঃ খাতায় কলমে তত্ত্বগতভাবে তাহাই) কঠিন প্রশ্ন করা হইতে বিরত থাকিবেন? যাহাতে সম্প্রদায়বিশেষের মনে আঘাত লাগিতে পারে, অথবা কোনো বিশেষ লিঙ্গের ব্যক্তির মনে আঘাত লাগিতে পারে, এমন প্রশ্ন অথবা বাক্য কী তাঁহারা আপন রচনায় অথবা সাক্ষাৎকারে সযত্নে এড়াইয়া চলিবেন? যদি তাঁহারা এমন করিয়াও থাকেন, তাহা হইলেও এ কথা নিশ্চিত করিয়া কী প্রকারে বলিব যে কোনো না কোনো কথায় কেউ না কেউ কখনোই আহত/ক্ষুণ্ণ হইবেন না?

(ক্রমশঃ)

 

Previous articleমুজিবের “মিথ”
Next articleবঙ্গের বাগদাদি
শ্রীজিৎ দত্ত
শ্রীজিৎ দত্ত ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্র বিষয়ে গবেষণারত। পড়াশোনা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছুদিন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতীতেও পড়াশোনা করেছেন। ইন্ডিয়াফ্যাক্টস, প্রাজ্ঞতা, স্বরাজ্য, মাইইন্ডমেকার্স, টপইয়াপ্স ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত ভারততত্ত্ব বিষয়ে লেখালেখি করেন। পেশা অধ্যাপনা, ধ্যানজ্ঞান সঙ্গীত। যোগাযোগ – sreejit.datta@gmail.com