বঙ্গভাষাকে ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে গণ্য করা হবে না কোন্‌ যুক্তিতে?

0
3748

প্রথম কিস্তি

শ্রীজিৎ দত্ত

সম্প্রতি লোকসভায় কংগ্রেসের সংসদীয় দলনেতা শ্রী অধীররঞ্জন চৌধুরী মহাশয় ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে আলাদা আলাদা ক’রে চিঠি লিখে বঙ্গভাষাকে ভারতের অন্যতম একটি ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে সরকারী স্বীকৃতি দেবার জন্যে তদ্বির করেছেন। কিন্তু এই দাবীর সমর্থনে তিনি যে যৎসামান্য যুক্তি চিঠিগুলিতে দিয়েছেন, তাকে ঠিক যুক্তি বলা চলে না – তা নেহাতই আবেগের কথা। আবেগের রসে সরকারী কাঠামোর চিঁড়ে সাধারণতঃ ভেজে না – যদি বা কখনো কখনো সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘ’টে থাকে, তথাপি বঙ্গভাষার মতো সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী একটি ভাষার মর্যাদা পুনরুদ্ধারের বৈতরণীটি আমরা আবেগের ঠুন্‌কো ভেলায় চেপে পার করতে রাজি নই। সে ধরণের বৈতরণী পার বঙ্গভাষার আভিজাত্যের পক্ষে মানানসই হবে না। তাই আমরা যুক্তির তরবারিতে শান দেবো। এই লেখায় আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো যে বঙ্গভাষা ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে পরিগণিত হবার সপক্ষে যথেষ্ট সংখ্যক জোরদার যুক্তি-তথ্য রয়েছে। সেই যুক্তিগুলিকে আমরা এখানে একে একে তুলে ধরবো, এবং এতকাল যাবৎ বঙ্গভাষা ভারতের ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে সরকারী স্বীকৃতি ও প্রাপ্য মর্যাদা কেন পায়নি তার কারণগুলিও উদ্ধার করবার চেষ্টা করব। সে চেষ্টায় কিছু সদ্য-বঙ্গভাষাপ্রেমীদের ভণ্ডামির উদ্ঘাটন হয়ে থাকলে তা নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার।

জাতীয় শিক্ষা নীতি

অধীরবাবু যে এই বিষয়টিকে এখন প্রকাশ্যে এনেছেন তার কারণ সদ্য প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০-র ৪.১৭-৪.১৯ নং ধারাগুলিতে ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল ভাষা সংক্রান্ত কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে; এবং এই সুপারিশগুলির মাধ্যমে সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃতের মতো সুপ্রাচীন ধ্রুপদী ভাষা ছাড়াও বেশ কয়েকটি আধুনিক ভারতীয় ভাষার ক্লাসিকাল রূপগুলিকে পঠনপাঠনের আওতায় আনবার কথা বলা হয়েছে। এই তালিকায় তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম ও ওড়িয়া – এই ভারতীয় ভাষাগুলির ক্লাসিকাল রূপ ও ক্লাসিক সাহিত্যকে বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখবার প্রস্তাব রয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় ধ্রুপদী ভাষাত্রয় তথা পাঁচ-পাঁচটি আধুনিক ভারতীয় ভাষার ক্লাসিকাল রূপ ছাড়াও এই তালিকায় যোগ হয়েছে একটি বিদেশী ভাষা – ফার্সি। অথচ এই তালিকায় বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

কিন্তু জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ যে এই ভাষাগুলিকে ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল তালিকাভুক্ত করেনি, এই তালিকা নির্ধারণে জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ অথবা এই নীতির প্রস্তাবক কস্তুরীরঙ্গন কমিশনের বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই – সে তথ্য অধীরবাবুর কাছে অজ্ঞাত থাকবার কথা নয়। অধুনা ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল পর্যায়ে পড়ে এমন ভারতীয় ভাষার মধ্যে যে ভাষাগুলিকে সরকারী স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে তামিল সর্বপ্রথম এই স্বীকৃতি লাভ করে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে; এরপর সংস্কৃত এই স্বীকৃতি পায় ২০০৫ সালে, কন্নড় এই স্বীকৃতি পায় ২০০৮ সালে, তেলুগু ঐ একই বছরে অর্থাৎ ২০০৮ সালে, মালয়ালম ২০১৩ সালে, এবং সর্বশেষ ওড়িয়া ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০০৪-র সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪-র ফেব্রুয়ারি – এই দীর্ঘ সময়কালে কেন্দ্রে কাড়া ক্ষমতায় ছিল? ক্ষমতায় ছিল অধীরবাবুর দল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। তামিল থেকে শুরু ক’রে সংস্কৃত, কন্নড়, তেলুগু, মালয়ালম তথা ওড়িয়া – এই ছয়টি ভারতীয় ভাষার প্রত্যেকটিই কংগ্রেস জমানায় ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে সরকারী স্বীকৃতি লাভ করেছে। তখন অধীরবাবুদের বঙ্গভাষার কথা মনে পড়েনি? ক্ষণেকের তরেও না?

আরও মজার কথা হচ্ছে, এখন যিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন, সেই মাননীয়াও ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসচালিত ইউপিএ সরকারেরই রেলমন্ত্রীর পদে আসীন ছিলেন। ঐ কংগ্রেস জমানাতেই অধীরবাবু ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মনমোহন সিংহের সরকারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বে (রেল প্রতিমন্ত্রীর পদে) আসীন ছিলেন। খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের এত প্রতিপত্তিশালী পদে থাকাকালীন অধীরবাবুদের পক্ষে নিজের দল তথা নিজেদের সরকারের কাছে তদ্বির ক’রে বঙ্গভাষার জন্য ক্লাসিকাল স্বীকৃতিটি আগেভাগেই আদায় ক’রে নিতে পারাটা কি খুব কঠিন কোনো কাজ ছিল? ইউপিএ জমানার সেই বছরগুলিতে যখন নাকের ডগা দিয়ে মালয়ালম, এবং এমনকী পশ্চিমবঙ্গের ‘পাশের বাড়ি’র রাজ্যভাষা ওড়িয়াও ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে সরকারী স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছিল, তখন অধীরবাবুদের মন বঙ্গভাষার প্রতি অবিচারের কারণে একবারের জন্যেও উদ্বেল হয়ে ওঠেনি?

এখন অধীরবাবু বঙ্গভাষার অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এই কারণে দরবার করছেন – তাঁর এই উদ্যোগকে আমরা দু’হাত তুলে সাধুবাদ জানাই; তাঁর কর্মপ্রচেষ্টা শুধু স্বাগতই নয়, অতীব প্রশংসনীয়। তাঁর মতো গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় পদাধিকারী ডাকসাইটে নেতা আপন মাতৃভাষা বঙ্গভাষার হয়ে ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল মর্যাদার সরকারী স্বীকৃতি আদায় করবার জন্য লড়াই করছেন, ব্যাপারটি সংবাদমাধ্যমের নজরে এনে লোকচক্ষুর গোচরে আনতে পেরেছেন – বঙ্গভাষাভাষীদের পক্ষে এর চাইতে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে? তবে দুঃখের কথা এই যে, তাঁর এই গোটা কর্ম-আন্দোলনের মধ্যে একটুখানি চোনা প’ড়ে গিয়েছে – তাই একে আর সাধু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা যাচ্ছে না।এই চোনার উৎস – এনডিএ সরকারের দ্বারা ২০১৭ সালে মনোনীত কস্তুরীরঙ্গন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তৈরি জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০-কে এই ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল ভাষার তালিকা প্রস্তুত করবার জন্য দায়ী ঠাওরানো। আর এখানেই এই আপাত-সাধু উদ্যোগের চকমকে অথচ ঠুন্‌কো তবক-মোড়কের তলায় রাজনৈতিক ফায়দা তোলবার চেষ্টার দুর্গন্ধটি চাপা দেবার অপপ্রয়াস ধরা প’ড়ে যায়।

হঠাৎ উথলে ওঠা বাংলাপ্রেম

কোন্‌ ভাষা কোন্‌ মাপকাঠির বিচারে ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল ভাষা ব’লে গণ্য হবে আর কোন্‌ ভাষা গণ্য হবে না তা ঠিক করে দেবেন বামপন্থী শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক-লিখিয়েদের বরাবরের ইজারামহল সাহিত্য আকাদেমির কংগ্রেস আমলের বুদ্ধি-বেচে বেঁচে থাকা বুদ্ধিজীবীরা; আর সেই তালিকায় বঙ্গভাষাকে ঠাঁই না দেওয়া হ’লে তার দোষ বর্তাবে এনডিএ সরকার মনোনীত শিক্ষা নীতি গঠনকারী কমিশন তথা শিক্ষা নীতিটির উপর? জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ একেবারে নির্ভুল – এ একেবারেই আমাদের বক্তব্য নয়, কিন্তু হঠাৎ ক’রে কারো মাতৃভাষার প্রতি প্রেম উথলে উঠলে একটু একটু সন্দেহ জাগে বৈকি। তা মাতৃভাষাপ্রীতি দেরীতে জাগুক, তাতেও ক্ষতি নেই – সাহেবসুবোদের ভাষায় বলে “বেটার লেট দ্যান নেভার”। কিন্তু আমরা এই প্রশ্ন তুলতেই পারি যে, যাঁদের মাতৃভাষাপ্রীতি সদ্য সদ্য জাগ্রত হয়েছে, এই শিক্ষা নীতি প্রস্তাবিত হবার আগে অব্দি দীর্ঘ ষোলো বছর ধ’রে সেইসব সদ্যজাগ্রত বঙ্গভাষাপ্রেমী-আলোড়নকারীরা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন?
এখানে আমরা আরও জিজ্ঞাসা করতে চাই, ২০০৪ থেকে শুরু ক’রে ২০২০ – এত দীর্ঘকাল অবধি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত লিখিয়েরা, বুদ্ধিজীবীরা, ‘কবি’রা এই ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল ভাষার প্রশ্নে ঠিক কী করছিলেন? এই প্রশ্নে এতদিন তাঁদের অবস্থান ঠিক কী ছিল? তাঁরা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে অথবা না-খাটিয়ে তাঁদের ‘শিল্প’ তথা জীবিকার একমাত্র আশ্রয় বঙ্গভাষাকে ধ্রুপদী মর্যাদা দানের সরকারী স্বীকৃতি লাভের জন্য কীভাবে কোন্‌ কোন্‌ দরবারে তদ্বির করেছেন? ঠিক কী করছিলেন বঙ্গভাষার ডাকসাইটে অধ্যাপক-গবেষক-বিদূষক-সরকারী-বেসরকারি ভাষাবিদ-নাট্যকার-অভিনেতা-পরিচালকেরা? কোথায় ছিলেন বাংলা ভাষার অধিকারের দাবীতে কলকাতা শহরে অন্য ভাষার হোর্ডিং ভেঙে ফেলার দাবী তোলা, শান্তিনিকেতনে অশান্তির হিল্লোল-জাগানো বাঙালি বীরপুঙ্গব ‘কবি’রা? অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আপন মাতৃভাষার জন্য ধ্রুপদী মর্যাদা চেয়ে তদ্বির করবার চাইতে কলকাতা শহরে গায়ের জোরে অন্য ভাষার হোর্ডিং নামিয়ে ফেলবার কাজটি করা তাঁদের পক্ষে সহজতর, এবং কলকাতা বইমেলা-দাপানো বীরপুঙ্গব কবিদের পক্ষে সেকাজ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণও বটে, নহিলে ফুটেজ জুটিবে কেমনে? বঙ্গভাষার ধ্রুপদী তকমা লাভের প্রশ্নে প্রথমে বাম-আদরে পরিপুষ্ট ও তৎপরবর্তী ‘পরিবর্তিত’ জমানায় তৃণভোজী পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিরই বা ভূমিকা (অথবা ভূমিকার অভাব) কী ছিল, কেন ছিল – বাঙালি হিসেবে এইসব জবাবদিহি চাইবার অধিকারও আমাদের আছে বৈকি।

সংখ্যালঘু তোষণ ও ফার্সি

জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০-র অন্তর্ভুক্ত এই ৪.১৮ নং ধারাটি বিশেষ ক’রে বঙ্গভাষাভাষী ভারতীয়দের বিস্মিত আহত বোধ করবে। এই ধারায় সংস্কৃত, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম এবং ওড়িয়া – এই ছয়টি ‘ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল ভাষা’র অতিরিক্ত আরো তিনটি ভাষাকে ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষার সমমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এই তিনটি ভাষা হল পালি, প্রাকৃত ও ফার্সি। পালি ও প্রাকৃতের মতো প্রাচীন তথা সাহিত্য-দর্শন-বিষয়ক রচনাবলীর দ্বারা পুষ্ট ভাষাদ্বয় যে ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষা হিসেবে পরিগণিত হবে, তা না হয় সহজেই বোঝা গেল, কিন্তু ফার্সি?! সে ভাষা যে দেশগুলির ভাষা (ইরান, আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তান)১, তারা কি ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের ধ্রুপদী চরিত্রের রক্ষণাবেক্ষণ, প্রচার এবং প্রসার ঘটাবার লক্ষ্যে কিছু কম কাজ করেছে? খাস কলকাতা শহরের বুকে ফার্সি ভাষার প্রচার-প্রসারের জন্য নিবেদিত ‘ইরান সোসাইটি’ নামের একখানি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার পৃষ্ঠপোষকতা ক’রে গিয়েছেন সি. রাজাগোপালাচারী, মৌলানা আজাদ থেকে শুরু ক’রে ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র-হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়-শ্যামল কুমার সেন-পবিত্র সরকার-সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় অব্দি তাবড় কংগ্রেস-বাম নেতা তথা বাম-ঘেঁষা বুদ্ধিজীবীরা। ভারতবর্ষের মতো সুবিশাল বহুভাষাভাষী দেশে কি দেশীয় ভাষার অভাব পড়িয়াছে যে এখন বিদেশ থেকে ক্লাসিকাল ভাষা ধ’রে এনে সরকারী আনুকুল্যে তার প্রসার প্রচার সেবা করতে হবে, আবার বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক স্তরে দেশীয় ভাষা ফেলে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের সেইসব বিজাতীয় ‘ক্লাসিকাল’ ভাষা শিক্ষার জন্য বিশেষ উৎসাহ প্রদান করতে হবে? ফার্সির মতো একখানি বিজাতীয়, মোগল-পতনের পর থেকে ভারতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া ভাষা যদি ভারতের ক্লাসিকাল ভাষাগুলির সঙ্গে একাসনে বসবার সরকারি স্বীকৃতি ও সমান পৃষ্ঠপোষকতা পেতে পারে, তাহলে চর্যাপদ-বৈষ্ণব পদাবলী-শ্রীরাম পাঁচালী-শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের লিখিত সাহিত্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারা বেয়ে বিংশ-একবিংশ শতকের আধুনিকতা অবধি ব’য়ে চ’লে আসা সুপ্রাচীন বঙ্গভাষা সেই সমমর্যাদা পাবে না কেন? ঠিক কোন যুক্তিতে? আরও মনে রাখা দরকার, এই ৬+৩ = মোট নয়টি ভাষার মধ্যে (যার মধ্যে আবার একটি বিজাতীয় ভাষাও রয়েছে) একটিও কিন্তু নোবেল পুরস্কারের মতো বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি পাওয়া এ-যুগীয় সাহিত্যের উদ্ঘাটন এখনো ক’রে উঠতে পারেনি, যা বাংলাভাষার একজন কবি পেরেছেন। একথা বলবার অর্থ কখনোই এই নয় যে কোনো একটি ভাষাকে ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে পরিগণিত হ’তে গেলে সে ভাষার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার থাকতেই হবে – এই উল্লেখের তাৎপর্য শুধু এটুকুই যে তামিল, তেলুগু, মালয়ালম, কন্নড়, ওড়িয়া এবং ফার্সি যেসব যুক্তিতে ধ্রুপদী অথবা ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে, বঙ্গভাষার সপক্ষে সেসমস্ত যুক্তি তো আছেই – উপরন্তু বিশ্বজোড়া বন্দিত স্বীকৃত পুরস্কৃত সাহিত্য সম্পদও রয়েছে। তাহ’লে ভারতের ধ্রুপদী ভাষাগুলির তালিকায় বঙ্গভাষাকে গণ্য করা হবে না কেন?

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলার মতো সুমহান ঐতিহ্যশালী একটি ভারতীয় ভাষা থাকতে সেটিকে ফেলে বিদেশী ভাষা ফার্সিকে অন্য সব ধ্রুপদী/ক্লাসিকাল ভারতীয় ভাষাদের সঙ্গে একাসনে বসানো কেন? এর উত্তরও খুঁজে পাওয়া যাবে কংগ্রেসি রাজনীতিতে, আরও স্পষ্ট ক’রে বলতে গেলে এর উৎস হচ্ছে নেহরুপন্থী সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি। কংগ্রেস ও বামেদের এই তথাকথিত ‘সেকুলারবাদী’ রাজনীতি – যা আদতে চক্ষুলজ্জাহীন সংখ্যালঘু-তোষণের রাজনীতি – ফার্সি ও আরবি ভাষাদ্বয়কে ভারতের একটি বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে, তাদে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সমার্থক ব’লেই গণ্য করে, আর এই দুই ভাষাকে নানারকম ভাবে সরকারী উপঢৌকন-উৎকোচ দিয়ে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক সুরক্ষিত করবার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। বিজাতীয় ভাষা ফার্সিকে ক্লাসিকাল ভাষার মর্যাদা দেওয়াটা এইরকমই একটি সরকারী উৎকোচ, যার নজির ব্রিটিশ রাজের জমানাতেও মেলে। সেদিক দিয়ে দেখলে, এই সংখ্যালঘু তোষণের মাধ্যমে বিভেদের রাজনীতিও ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারই বটে। ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকেই আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত – এই তিন ভাষাকে ভারতে ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে সরকারী মর্যাদা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়ে আসছে। এই ভাষাত্রয়ের শিক্ষা ও পঠনপাঠনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, বিদ্যালয়-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এই ভাষাগুলি ও তাদের সাহিত্য বিষয়ে গবেষণার জন্য অনুদান তথা এগুলির অধ্যাপনার জন্য ‘চেয়ার’ প্রবর্তন, মাইনে করা পণ্ডিত নিয়োগ ক’রে এই ভাষা-সাহিত্যের পুঁথি উদ্ধার, পুস্তক সম্পাদনা ও প্রকাশনা – এ সবই ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে পরম্পরাক্রমে হয়ে চলেছে।

ম্যাক্স মূলার ও তাঁর সতীর্থরাও ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির দ্বারাই নিযুক্ত হয়েছিলেন। সংস্কৃতকে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াটা ছিল স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত, ইংরেজ তথা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের পণ্ডিতরাও (বিশেষতঃ জার্মান ও ফরাসী পণ্ডিতেরা) সংস্কৃত বিষয়ে গবেষণার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন (সেও স্রেফ সরল আকাদেমিক-আগ্রহ অথবা ভাষাপ্রীতির কারণে নয়; তবে সে প্রসঙ্গ বিরাট এবং ভিন্ন প্রসঙ্গ – তাতে অন্য কোনো সময়ে মনোনিবেশ করা যাবে); কিন্তু ফার্সি ও আরবি? এই দুই অ-ভারতীয় ভাষাকে ভারতবর্ষে ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে গণ্য ক’রে তাদের তেলা মাথায় (কারণ মুঘল ও অন্যান্য মুসলিম রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা) এত তেল ঢালা কেন? কারণ সেই একই – বশ্যতা কিনে নেওয়া। তোষণের দ্বারা বশ্যতা কিনে নেবার এই ট্র্যাডিশন দেশভাগের সাত দশক অতিক্রান্ত হবার পর আজও সমানে চলেছে।

(চলবে)