কোলকাতা কুরআন পিটিশন এবং আতঙ্কিত সরকারী ব্যবস্থা

0
1529

তাঁদের আপন ধর্মমত সম্বন্ধে, বিশেষতঃ তাঁদের পয়গম্বর সাহেব সম্বন্ধে কোন প্রকাশ্য আলোচনা প্রতিহত করতে ভারতের মুসলমানরা প্রায়ই ভারতীয় দণ্ডবিধির (Indian Penal Code বা I. P. C.)  সাহায্য নেন, আরও সঠিকভাবে বললে এর অন্তর্গত দুটি অনুচ্ছেদের, ১৫৩এ এবং ২৯৫এ। পয়গম্বরের বচন এবং কর্মকে সমালোচনা করার দায়ে বহু প্রকাশিত লেখার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে ফৌজদারী কার্যবিধির (Criminal Procedure Code বা Cr. P.C.) অনুচ্ছেদ ৯৫ এর আওতায়। মুসলিম সম্প্রদায়ের সরব এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহিংস প্রতিবাদের ফলে কর্তৃপক্ষ সাধারণতঃ এইসব নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মুসলমানেরা ধারণাই করতে পারেনি যে আইনের ঐ একই ধারাতেই তাদের পবিত্র গ্রন্থ কুরআনের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারির আবেদনও করা যেতে পারে।

পরিস্থিতির এই আমূল পরিবর্তনের কৃতিত্বের দাবিদার কোলকাতার চাঁদমল চোপরা। তিনিই ১৯৮৫ সালের ২৯শে মার্চ কোলকাতা হাইকোর্টে একটি আবেদন (রীট পিটিশন) দাখিল করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যে কুরআনের প্রকাশনা ভারতীয় দণ্ডবিধির অনুচ্ছেদ ১৫৩এ এবং ২৯৫এ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। কারণ কুরআন “হিংসায় ইন্ধন দেয়, সার্বজনীন শান্তিভঙ্গ করে, আপন ধর্মমতের কারণে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা এবং বিদ্বেষের বাতাবরণ সৃষ্টি করে, এবং ভারতের অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়কে অপমান করে।” ফৌজদারী কার্যবিধির অনুচ্ছেদ ৯৫ অনুযায়ী, তিনি আদালতের কাছে দাবি করেন যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কারণ দর্শাতে বলা হোক যে কেন কুরআনের মুদ্রিত প্রত্যেকটি প্রতিলিপি, তা মূল আরবী ভাষাতেই মুদ্রিত হোক বা অন্য যে কোন ভাষাতেই হোক, বাজেয়াপ্ত করা হবে না।

১৯৮৫ সালের এপ্রিল-মে মাসে এই মামলা কুরআনে বিশ্বাসী (মোমিন) এবং অবিশ্বাসীদের (কাফির) মধ্যে যথেষ্ট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলির শিরোনাম দেখলে বোঝা যায়, ধর্মমতের ইতিহাসে এই মামলা ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এক পৌ?ত্তলিক প্রথমবার কোন আব্রাহামীয় সম্প্রদায়ের সৃষ্টিকর্তার পাঠানো কিতাবকে প্রশ্ন করার সাহস দেখাল। এখানেও ফুটে ওঠে পাশার দান পাল্টে যাবার কথা। এতদিন কেবলমাত্র কোন না কোন আব্রাহামীয় কিতাবধারী সম্প্রদায়েরই অখণ্ড অধিকার ছিল পৌত্তলিকদের শাস্ত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার বা তাদের পুস্তকভাণ্ডার ভস্মীভূতকরণের।

এই আবেদনটি কোলকাতা হাইকোর্ট অগ্রাহ্য করে। যদিও আবেদনের বিষয়গুলি একইভাবে প্রাসঙ্গিক থেকে গেছে। কুরআনের রাজ্যে কাফিরদের কি গতি তা কাফিরদের জানার অধিকার থেকে কোন আইনরক্ষকই বঞ্চিত করতে পারে না, নয় কি?

আইনের সীমাবদ্ধতা আছে বিশেষতঃ আমাদের মত দেশে যেখানে আইনের মূলভিত্তি আজও ইসলামীয় এবং বৃটিশ এই দুই বিদেশী শাসন থেকে প্রাপ্ত। সাম্রাজ্যবাদী শাসনকর্তারা তাঁদের নিজেদের প্রয়োজনেই আইনের এই ভিত্তি দিয়েছিলেন। অধিকন্তু আইনের দরবার হয়ত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক বা আধ্যাত্মিক বিচারের জন্য উপযুক্ত জায়গা নয়ও। কেহই নিশ্চয়ই বলবেন না যে কুরআনের উপর মুক্ত স্বাধীন পর্যালোচনা এখনকার আইনের অসম্পূর্ণতার বা অপর্যাপ্ততার কারণে বন্ধ হওয়া সমীচীন।

কুরআনের যে সূরা এবং আয়াতগুলি চাঁদমল চোপরা তাঁর আবেদনে উদ্ধৃত করেছিলেন, সেগুলি এই বিতর্কে কোন গুরুত্বই পেল না। বরং এই বিষয়টিই বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়াল, কোন বহুসংখ্যক মানুষের দ্বারা পবিত্র বলে মান্য কোন বই কি আদালতে বিচারযোগ্য? পরবর্তী সময়ে জানতে পারলাম যে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবেএই পিটিশনটি পড়েন নি তাঁরা চাঁদমল চোপরার আবেদনের বিষয়ের গুরুত্ব সম্বন্ধে মোটেই অবহিত ছিলেন না। সর্বদা মনে করি জনগণের অচেতন থাকা অন্যায় এবং জনগণের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জানার পূর্ণ অধিকার আছে। আরও মনে করি, একমাত্র সচেতন জনগণেরই রায় করার অধিকার আছে যে কখন কোন একটি পুস্তক, যুক্তির আলোকে, নীতির দর্পণে এবং আধ্যাত্মিকতার বিচারে, ধর্মীয় গ্রন্থ বলে অভিহিত হতে পারে। ঠিক এই কারণেই আমরা এই আবেদনটি এবং এই সম্বন্ধীয় অন্যান্য নথি প্রকাশ করছি।

এই আবেদনটি জানার জন্য সংক্রান্ত ঘটনাবলীকে জানা একান্ত প্রয়োজন। বোধ করি কম  লোকই জানেন, কেন আবেদনটি করা হল, কিভাবে এই আবেদনটি প্রথম ক্ষণ থেকই রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে পতিত হল এবং কিভাবে হাইকোর্টকে চাপ দেওয়া হল।

 

হিমাংশু কিশোর চক্রবর্তীর উদ্যোগ

চাঁদমলের এই ঘটনাবর্তে পদার্পণের আগে, কোলকাতারই হিমাংশু কিশোর চক্রবর্তী পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্র সচিবকে ১৯৮৪ সালের ২০ই জুলাই এটি চিঠি লেখেন এবং সেই চিঠিতে তিনি দৃষ্টিপাত করেন কুরআনের কিছু সূরার প্রতি যার কারণে কুরআনের প্রকাশনা ভারতীয় দণ্ডবিধির অনুচ্ছেদ ১৫৩এ এবং ২৯৫এ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ হওয়া উচিত। তাঁর চিঠির তিনটি পরিশিষ্ট অংশ ছিল যেখানে তিনি কুরআনের কিছু সূরাকে উদ্ধৃত করেন। ৩৭টি সূরাতে নিষ্ঠুরতার, হিংসার এবং সার্বজনীন শান্তিভঙ্গের ইন্ধন, ১৭টিতে ধর্মমতের কারণে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা এবং বিদ্বেষের বাতাবরণ সৃষ্টির প্রয়াস, এবং ৩১টিতে অন্যান্য ধর্মমতকে এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসে হস্তক্ষেপের নমুনা ছিল। তিনি বলেন যে মূল আরবী সহ যে কোন ভাষায় প্রকাশিত কুরআনের সমস্ত প্রতিলিপিকে ফৌজদারী কার্যবিধির অনুচ্ছেদ ৯৫ এর আওতায় বাজেয়াপ্ত করার জন্য।

হিমাংশুবাবুর লেখা চিঠিতে পড়লে তাঁর নিবিড় কুরআন চর্চা প্রতিভাত হয়। কিভাবে জাগ্রত হল তাঁর কুরআনের প্রতি এই আগ্রহ? পূর্ব পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) সাবেক বাসিন্দা হিমাংশুবাবু ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে দেশভাগের সময় এবং পরবর্তীকালে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি আচরণের মধ্যে এক বিশেষত্ব বারংবার খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে মুসলমানদের প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতারা এই ধরণের আচরণকে সমর্থন করেন ইসলামের আদর্শের অঙ্গ হিসাবে। তখন থেকে তিনি এই বিশ্বাসবাদের চর্চা করতেন এর স্বরূপ জানার জন্য  যা এই ধরণের আচরণের উদ্গাতা। তিনি কুরআন পড়ে নিশ্চিত হন যে তিনি এই বিশ্বাসবাদের আকরের সন্ধান পেয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব হিমাংশুবাবুর এই পত্রের প্রাপ্তিস্বীকারটুকুও করেননি। তাই তিনি আবার ১৯৮৪ সালের ১৪ই আগষ্ট তাঁর পূর্ববর্তী পত্রের কথা মনে করিয়ে একটি পত্র পুনরায় পাঠান যাতে পূর্ববর্তী পত্রটিও পরিশিষ্ট রূপে ছিল। দীর্ঘ ছয় মাসেও মিলল না কোন জবাব। এই সময় তাঁর মোলাকাৎ হয় চাঁদমল চোপরার সঙ্গে। চোপরা সাহেবও কুরআনের চর্চায় ব্রতী ছিলেন। তিনি বিস্মিত হন যে বাংলাদেশের হিন্দুরা ধীরে ধীরে হলেও নিয়মিতভাবে এবং নিশ্চিতভাবে তাঁদের পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি থেকে উৎখাতিত হচ্ছেন। অথচ ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য বহু বলিদান করেছিল।

চাঁদমল ছিলেন জৈনপরম্পরার মানুষ এবং সনাতন ধর্মের অন্য পরম্পরার মত সত্য, অহিংসা, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, এবং অপরিগ্রহের অনুশীলন করতেন। তাঁর কাছে এটাই বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল কিভাবে অন্য কোন ধর্মের কোন মানুষ এই আদর্শের পরিপন্থী কোন আচরণ করতেও পারে, তাও আবার নিজের বিবেকের দর্পণে পরিষ্কার থেকে। তিনি তাঁর প্রশ্নের হয়ত বা উত্তরও খুঁজে পেয়েছিলেন কুরআনের সংস্পর্শে এসে। তিনিও নিশ্চিত হয়েছিলেন হিমাংশুবাবুর সিদ্ধান্তগুলির সত্যতা সম্বন্ধে।

চাঁদমল সার্বজনীন স্বার্থে যা করা সঠিক মনে করেছিলেন তা পুনঃপ্রতিপন্ন হল হিমাংশুবাবুর সঙ্গে আলাপচারিতায়। তখন তিনি ১৯৮৫ সালের ১৬ই মার্চ ঐ স্বরাষ্ট্র সচিবকে আবার চিঠি লিখলেন হিমাংশুবাবুর দাবির যৌক্তিকতা জানিয়ে। তিনি তাঁর চিঠিকে যেন বিচারের দাবির নোটিশ হিসাবে মানা হয় এই কথাও সেখানে বললেন। তিনি স্পষ্ট লিখলেন যে যদি সাত দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয় তবে  তিনি আইনি পরামর্শানুসারে ব্যবস্থা নেবেন।

চোপরা সাহেবের চিঠির কোন প্রাপ্তিস্বীকারপত্রও এল না। অগত্যা তিনি ১৯৮৫ সালের ২৯শে মার্চ তাঁর বিখ্যাত রীট পিটিশনটি কোলকাতা হাইকোর্টে দাখিল করলেন ভারতীয় সংবিধানের ২২৬ নং পরিচ্ছেদ মোতাবেক। অন্য একজন জনস্বার্থব্রতী ভদ্রলোক শীতল সিং তাঁর সাথে পিটিশনের সহ-আবেদনকর্তা হিসাবে যোগ দিলেন। আবেদনের যুক্তিগুলি হিমাংশুবাবু যা দিয়েছিলেন, তাই রইল কিন্তু সেগুলি উপস্থাপন করা হল আইনী ব্যবস্থার সঠিক বিধিতে।

এই রীট পিটিশনটি বিচারপতি শ্রীমতী পদ্মা খাস্তগীরের কাছে ১লা এপ্রিল আসে। তিনি এই বিষয়টির উত্থাপনের জন্য ৮ই এপ্রিল তারিখ নির্ধারণ করেন। যাই হোক, দুইবার স্থগিত হবার পর অবশেষে ১২ ই এপ্রিল  বিচারপতি বাদীপক্ষের বক্তব্য  শোনেন। ঐদিন মাননীয়া বিচারপতি বিবাদীপক্ষ অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে  আপন যুক্তি পরিবেশন করে এফিডেভিট বা হলফনামা পেশ করার জন্য ৩রা মে অবধি সময় দেন এবং সেই এফিডেভিটের উপর নিজ প্রতিযুক্তির হলফনামা ১৭ই মের মধ্যে পেশ করতে বাদীপক্ষকে নির্দেশ দেন। এরপর এই বিষয়টি ২৭শে মে পর্যন্ত মুলতুবি করার পরিকল্পনা করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হলফনামায় বলা হল যে “পবিত্র কুরআন একটি স্বর্গীয় গ্রন্থ এবং পৃথিবীর কোন শক্তি এর বিচার করতে অপারগ। কোন আদালতই এর বিচারে অসমর্থ। …বৃটিশ শাসনে এবং স্বাধীনতাউত্তরকালে কখনই এরকম কোন আবেদনপত্র ভারতের কোন আদালতে দমা পড়েনি।”  যাই হোক, কোন অজ্ঞাতকারণবশতঃ, বিচারপতি শ্রীমতী খাস্তগীর  এই মামলা থেকে ২রা মে অব্যাহতি চেয়ে নেন। ৭ই মে, পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারেল হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে এই মামলাটি অন্য কোন বিচারপতির এজলাসে স্থানান্তরিত করার আবেদন জানান এবং ১০ই মে প্রধান বিচারপতি অন্য এক বিচারপতি বিমল চন্দ্র বসাকের এজলাসে এই রীট পিটিশনটি শুনানির জন্য পাঠান।

 

কেন্দ্রীয় সরকারের আতঙ্ক

ইতিমধ্যে পরিস্থিতি সঙ্গীন হয়ে পড়ে। কোলকাতার দ্য টেলিগ্রাফ সংবাদপত্র ৯ই মে ইউ এন আইয়ের সূত্র উদ্ধৃত করে সংবাদ পরিবেশন করে যে, কেন্দ্রীয় সরকার কুরআনের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে কোলকাতা হাইকোর্টে জমা পড়া এই রীট পিটিশনে হস্তক্ষেপ করতে মনস্থির করেছেন। সরকারী বয়ানে আরও বলা হয় যে আইনমন্ত্রী (শ্রীঅশোক সেন)  প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী দিতে  তৎক্ষণাৎ  কোলকাতা আসছেন। কেন্দ্রীয় সরকার এই পিটিশনটি সম্পূর্ণ খারিজ করার দাবী করতে চলেছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাটর্ণী জেনারেলও এই মামলায় যোগদান করার জন্য প্রস্তুত।

দ্য টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রের নিজস্ব প্রতিনিধি আরও সংযোগ করেন যে বিচারপতি খাস্তগীর প্রাদেশিক সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে কারণ দর্শাতে বলেছেন যে কেন কুরআনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে না। এই কারণ দর্শানোর নির্দেশের ফলে বার এসোশিয়েশনে ভীষণ বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। মুসলমান আইনজীবীরা এক অভূতপূর্ব বৈঠক করেন এবং বিচারপতি খাস্তগীরকে এই আবেদনটি শুনানির জন্য গ্রহণ করার জন্য ভর্ৎসনা করার প্রস্তাবও পেশ করেন। সেই প্রস্তাবটি যদিও প্রয়োজনীয় ভোটের অভাবে পরাস্ত হয়।

১০ই মের দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হল যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপর একইরকম চাপ আসছে। সংবাদপত্রটির মতে, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু আজ (৯ই মে) কুরআনের কিছু অংশকে আপত্তিজনক বলে দাখিল করা রীট পিটিশনটিকে “এক ঘৃণ্য কার্য” বলে বর্ণনা করেছেন। ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক অনিল মুখার্জ্জীর প্রশ্নের উত্তরে শ্রী বসু আরও বলেন যে ধর্মসংক্রান্ত বিষয় বলে আদালতের উচিত ছিল এই পিটিশনটিকে তৎক্ষণাৎ খারিজ করা। তিনি আরও জানান যে প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে এই বিষয়ে অনুসূচিত করার পর উভয়ের মধ্যে  বার্তালাপ চলছে। শ্রী বসু পরিশেষে বলেন যে, “আমি ইতিমধ্যেই অ্যাডভোকেট জেনারেলকে বলেছি কোলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলতে।” জ্যোতি বসুর খেয়াল হয়নি যে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য  করে তিনি আদালতের অবমাননা করছেন। আদালতও তাঁকে এই আইনভঙ্গের জন্য ভর্ৎসনা করেনি।

এই বিষয়টি লোকসভাতেও ১০ই মে উত্থাপন করেন দুইজন সাংসদ, একজন কংগ্রেস (আই) এবং অন্যজন সি  পি  আই (এম) এর। ১১ই মের দ্য স্টেট্সম্যান এর মোতাবেক, লোকসভার অধ্যক্ষ বলরাম জাখর তাঁদের সঙ্গে একমত হন যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাখর বলেন যে দেশে ইতিমধ্যে অনেক সমস্যা আছে এবং এমন কিছু নিয়ে কথা বলার দরকার নেই যাতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে। স্পষ্টতঃ জাখর  সমস্যা আসতে পারে ভেবে ভয়ভীত ছিলেন এবং তিনি সত্য-মিথ্যা নীতি-অনীতি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। বাস্তবে, তাঁর এই মন্তব্যের মাধ্যমে প্রকারান্তরে তিনি মুসলমান জনতাকে রাস্তায় নেমে উৎপাত বাধানোর আমন্ত্রণই দিচ্ছিলেন। আইন দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ আর ভরদ্বাজ সাংসদদের প্রতি বলেন যে, “যে মুহূর্তে এই রীট পিটিশনটি সরকারের গোচরে আসে, সরকার সেই মুহূর্ত পিটিশনটিকে খারিজ করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করেছে।” তিনি আরও জানান যে সরকার অ্যাটর্ণী জেনারেলকে কোলকাতায় প্রেরণ করছে এই পিটিশনটি  খারিজ করার উদ্দেশ্যে।

পাকিস্তানের সরকার এবং রাজনীতিবিদরা এতদ্ সত্ত্বেও ভারত সরকারের কুরআনকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিয়ে খুশি ছিলেন না। দ্য টেলিগ্রাফ ১৪ই মে ইসলামাবাদ থেকে পি টি আই এর প্রেরিত এই খবরটি প্রকাশ করে: পাকিস্তানের ধর্মীয় এবং সংখ্যালঘু দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মকবুল আহমেদ খান বলেছেন যে কুরআনের বিরুদ্ধে গৃহীত কোলকাতা হাইকোর্টের পিটিশনটি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার নিকৃষ্টতম নিদর্শন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জিয়া-উল-হককে এক ঊর্দু পত্রিকা উদ্ধৃত করে জানায় যে এই মামলা সংক্রান্ত সব ঘটনাবলীর বিশদ বিবরণ আনয়নের প্রয়াস চলছে। খান সাহেব আরও অভিযোগ করেন যে  সংখ্যালঘুদের ধর্মমত এবং জীবন ভারতে নিরাপদ নয় এবং ভারত সরকারের ধর্মমতের স্বাধীনতা রক্ষায় পাকিস্তানকে অনুসরণ করে চলা উচিত। তিনি এও বলেন যে যদি সেকুলারিজমের জন্য কুরআনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, তবে হিন্দুদের ধর্মীয় পুস্তকগুলিকেও নিষিদ্ধ করা উচিত। এই “ঘৃণ্য কার্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে”  জিয়াপন্থী রাজনীতিবিদ মৌলানা কৌসর নিয়াজি  অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্সের সভাপতি জনাব শরিফুদ্দিন পীরজাদাকে অনুরোধ করেছেন মুসলমান জগতের ধ্যান  এইদিকে আকর্ষণ করবার জন্য। তিনি সরকারী স্তর থেকে  ভারত সরকারকে  প্রতিবাদ জানাতে বলেছেন এবং পাকিস্তানের ধর্মীয় নেতাদের প্রতি আবেদন করেছেন শুক্রবার প্রতিবাদ দিবস হিসাবে পালন করতে। তাই দেখা যাচ্ছে এই বিষয়টিকে ধর্মীয়  রাষ্ট্র পাকিস্তান ভারতকে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার বিষয়ে জ্ঞানদান করার একটা উপলক্ষ্য করল। যে পাকিস্তান তাদের হিন্দু সংখ্যালঘুদের পুরোপুরি দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে এবং বাকিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রেখেছে, ভারতের একজনও পদস্থ ব্যক্তি সেই মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভারতের প্রতি এই অপমানের কোন প্রত্যুত্তর করে নি।

 

সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির স্ববিরোধিতা

কেন্দ্রীয় এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার আতঙ্কিত হয়েছিল এই মনে করে যে বিচারপতি পদ্মা খাস্তগীর এই রীট পিটিশনকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এই মনে করাটাও সর্ববাদীসম্মত ছিল না। দ্য টেলিগ্রাফ ১০ই মে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে বলা হয় যে বিচারপতি খাস্তগীর পিটিশনটি গ্রহণ করেছেন কিনা এ নিয়ে তীব্র মতভেদ আছে দুই পক্ষে। এক পক্ষে আছেন প্রধান বিচারপতি সতীশ চন্দ্র এবং বিচারপতি খাস্তগীর, অন্য পক্ষে আছেন অ্যাডভোকেট জেনারেল স্নেহাংশু আচার্য এবং বহুসংখ্যক উকিলের মধ্যে। প্রথম পক্ষের মত এই যে চাঁদমল চোপরা ও শীতল সিংয়ের পিটিশনটি গ্রহণ করা হয় নি। কিন্তু দ্বিতীয় পক্ষ এই মতের সাথে সহমত  নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে বিতর্ক চরমে ওঠার মূল কারণ বিচারপতি খাস্তগীরের এই “অভিসন্ধিমূলক” পিটিশনটি তৎক্ষণাৎ খারিজ না করে শুনানির জন্য গ্রহণ। বিচারপতি খাস্তগীর দ্য টেলিগ্রাফকে জানান যে তিনি পিটিশনের উপর ঙলফনামা জমা দেবার নির্দেশ দিয়েছেন কারণ তিনি কোন বিচারপ্রার্থীকেই পরিহার করতে চান না। দেখা যাচ্ছে, ভারতে ইসলামীয় সাম্রাজ্যবাদের সমস্ত সহায়করা, যেমন কমিউনিস্ট, সোসিয়ালিস্ট, নেহেরুবাদী সেকুলারিস্ট, গান্ধীবাদী, সবাই সমস্ত বিচারবিভাগীয় পদ্ধতিকে জলাঞ্জলি দিচ্ছিলেন ইসলামকে সমর্থন করার অভিলাষে। এর কারণ কি নিহিত আছে তাঁদের এই উপলব্ধিতে যে তাঁদের সকলের সাধারণ শত্রু হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতি আর তাকে প্রতিরোধ করার সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র হল ইসলাম?

পশ্চিমবঙ্গ ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির এই  স্ববিরোধিতা আবিষ্কারে অক্ষম হয়েছিলেন। যদি এই পিটিশনটি গ্রহণ করা হয়ে থাকে, তবে এটি বিচারাধীন বিষয় এবং তাঁদের মন্তব্য আদালত অবমাননা মাত্র। যদি তা না হয়ে থাকে, তবে বিচারপতি খাস্তগীরের এর গ্রাহ্যতা নিয়ে সিদ্ধান্ত অবধি তাঁদের  অপেক্ষা করা প্রয়োজন ছিল। স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান যে উত্তরোত্তর মুসলমান প্রতিবাদের আতঙ্ক বহু স্থানে যুক্তির বাণীকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অশোক সেন, দ্য টেলিগ্রাফের ১০ই মের খবর অনুযায়ী, অ্যাডভোকেট জেনারেলকে জানিয়েছিলেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের এই মামলায় শরিক হওয়া আবশ্যক কারণ ভারতের সর্বত্র মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের পীড়ার কারণ হতে পারে এই মামলা এবং আন্তর্জাতিক  ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে। বোঝাই যাচ্ছে রাজনীতির বিবেচনাই আইনী যুক্তির উপরে স্থান পাচ্ছে।

সরকারের নীচ বৃত্তি

আরও তিরস্কার্য্য ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগকে পিটিশনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার যাতে তাঁদের মানহানি করা যায়। দ্য টেলিগ্রাফের ১০ই মের সংস্করণ রিপোর্ট করল যে গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী চাঁদমল চোপরা এবং শীতল সিং তাঁদের  প্রদত্ত ঠিকানার স্থায়ী বাসিন্দা নন। ৫৫ বৎসর বয়সী চাঁদমল চোপরা  তাঁর বয়ানে বলেছিলেন  যে ২৫ বড়তলা স্ট্রীট তাঁর ঠিকানা। এই ঠিকানায় তাঁর একটি ঘর থাকলেও তিনি সেখানে কিন্তু থাকেন না। ৫০ বৎসর বয়সী শীতল সিং পূর্বতন সামরিক কর্মী এবং হায়দ্রাবাদের বাসিন্দা। তিনি মাঝে মধ্যেই কোলকাতা শহরে আসেন এবং উত্তর কোলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলের ১ সদ্রুদ্দিন স্ট্রীটে থাকেন। এই ঠিকানাটি একটি আর্য সমাজী মন্দির মাত্র। তাঁদের দুইজনের নামের পুলিশের ফাইলে বা গোয়ন্দা বিভাগের খাতায় কোন অভিযোগ নেই। ইহা দিবালোকের মতই স্পষ্ট যে পুলিশের ফাইল তন্ন তন্ন করে ঘাঁটা হয়েছিল যাতে চাঁদমল চোপরা এবং শীতল সিংয়ের চরিত্রহানি করার মত কিছু আবিষ্কার করা যায়। ভারতের কোন সর্বজনীন  ক্ষেত্রে  খ্যাতমান কোন একজন ব্যক্তিও  একটি সামান্য প্রশ্ন  জিজ্ঞাসাও করলেন না যে কেউ হাইকোর্টে কোন রীট পিটিশন দাখিল করেছেন বলেই তাঁর পুলিশী ফাইল খোঁজা কি আইনী বা বৈধ।

মুসলমান জনতার যুদ্ধং দেহি রূপ

পশ্চিমবঙ্গ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আতঙ্কের অবশ্যম্ভাবী ফল ইহাই হল যে ভারতে এবং অন্যত্র মুসলমান জনতাকে ইন্ধন যোগাল এই উপমহাদেশের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিরা। মুসলমান জনতা রাস্তায় সহিংস প্রতিবাদে নির্গত হল। দ্য স্টেট্সম্যানের ১৩ই মের সংস্করণ ঢাকা থেকে ১২ই মে পাঠানো এই রিপোর্টটি ছাপল:  ঢাকা থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী শহর চাঁপাই নবাবগঞ্জে বিক্ষোভে পুলিশের গুলিচালনায় অন্ততঃ ১২ জন নিহত হয়েছেন এবং ১০০ জন আহত হয়েছেন। মৌলবাদী সংগঠন জামায়াতে-ইসলামীর আনুমানিক এক হাজার বিক্ষোভকারী  কুরআনের নিষিদ্ধ করার দাবী জানিয়ে  কোলকাতা হাইকোর্টে  দাখিল করা দুইজন ভারতীয় নাগরিকের এক মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। শহরের প্রধান কর্তা জানান যে বিক্ষোভকারীরা ইঁট ছুড়তে শুরু করলে এবং সরকারী সম্পত্তিতে আগুন দিতে শুরু করলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। এর আগে শুক্রবার ১০ই মে রাজধানী ঢাকাতে ২০ হাজার জামায়াতে-ইসলামীর সমর্থক বিক্ষোভ দেখান।  ঢাকার এই বিক্ষোভকারীরা, অন্য এক রিপোর্ট মোতাবেক, ভারতের দূতাবাসের প্রবেশের চেষ্টায় ছিল এবং পুলিশ তাদের আটকায়।

১৪ই মের দ্য স্টেট্সম্যানে প্রকাশিত হয় বিহারের রাঁচি থেকে ১৩ই মের এই রিপোর্ট:  কুরআনের উপর দাখিল করা রীট পিটিশনে ক্ষুব্ধ মুসলমানেরা গতকাল এবং আজ পর পর দুইদিন শহরের মূল রাজপথের উপর বিক্ষোভ দেখায়। প্রতিবাদকারীরা ব্যানার ও কালো পতাকা প্রদর্শন করে এবং সরকারবিরোধী শ্লোগান দিতে থাকে। গতকাল প্রতিবাদকারীরা কিছু দোকানে ইঁট ছোঁড়ে এবং ব্যবসায়ীদের দোকান বন্ধ করতে বলে। আজ মিছিল বার হওয়া মাত্র অধিকাংশ ব্যবসায়ী তাঁদের দোকান বন্ধ রাখেন।

এই একই দিনে মুসলমান জনতা কাশ্মীর উপত্যকার  শ্রীনগরে ব্যাপক হিংসায় অংশগ্রহণ করে। প্রসঙ্গতঃ, এর চার বৎসরের মধ্যে ইসলামীয়  সাম্রাজ্যবাদের নির্লজ্জ ঠিকেদার বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং ভারতের প্রধান মন্ত্রী হলে শ্রীনগর হয়ে ওঠে ভারতে ইসলামীয় সন্ত্রাসবাদের মূল ঠিকানা। ১৪ই মের দ্য টেলিগ্রাফ রিপোর্ট করছে যে: “কুরআনের উপর নিষেধাজ্ঞার পিটিশনকে কেন্দ্র করে জনতা সি পি আই সদর কার্যালয় ভাঙচুর করলে পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালায়। একটি সেতুতে আগুন লাগাবার চেষ্টা করা হয়। শহরের অন্যান্য প্রান্তে হিংসার উদ্গীরণ হয়। বিক্ষোভকারীরা কালো এবং সবুজ পতাকা সহযোগে বিক্ষোভের সময় পুলিশের উপর ইঁটবর্ষণ করে। দোকান-বাজার এবং সিনেমা হলগুলি বন্ধ ছিল। কর্তৃপক্ষ সাবধানতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ করে দেয়।  বিক্ষোভে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে শ্লোগান ওঠে।” এর চেয়ে অধিক পরিহাসের বিষয় আর কি হতে পারে যে ইসলামীয় প্রতিটি বিষয়ের চিরকালীন সমর্থক ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টিকে (সি পি আই) হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের সাথে একাসনে বসিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীরা। তবে জনতা তো জনতাই, তারা যা করে তার দায়িত্ব নিশ্চয়ই তাদের যাঁরা চালান তাঁদের উপরেই বর্তায়।

এই জনবিক্ষোভের মাঝেই দ্য টাইম্স অফ ইণ্ডিয়া ডঃ রফিক জাকারিয়ার কুরআনের প্রশংসাসূচক তিনটি প্রবন্ধ ছাপায়। বাস্তবে এ ছিল মুসলমানদের নরম  করার জন্য গৃহীত পন্থা। অভিজ্ঞ মহলের মতে এই প্রবন্ধগুলি ছিল কর্তৃপক্ষের নির্দেশের ফলশ্রুতি।

 

হাইকোর্টের শীঘ্রতা

কোলকাতা হাইকোর্টে এরপর যা হল, তাও কম নাটকীয় নয়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, বিচারপতি খাস্তগীর চাঁদমল চোপরাকে ১৭ই মে পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন আপন প্রতিযুক্তির হলফনামা পেশ করার জন্য। ১২ই মে মধ্যরাত্রে যখন তিনি এই হলফনামা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন, তিনি হঠাৎ একটি বার্তা পেলেন যে এই বিষয়টি ১৩ই  মে বিচারপতি বিমল চন্দ্র বসাকের এজলাসে উত্থাপিত হবে।  পরের দিন চোপরা সাহেব যখন আদালতে আসেন, বিচারপতি বসাক আগেকার আদলতের নির্দেশটি বাতিল করে নেন এবং তাঁকে নতুন করে একটি আদালতের আবেদনপত্র পেশ করতে বলেন। চাঁদমলের সামনে অন্য কোন বিকল্প না থাকায় তিনি মাননীয় কর্তৃপক্ষের কথামত কাজই করেন।

অন্যপক্ষে ভারতের অ্যাটর্ণী জেনারেল এবং পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারেল আদালতে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে আসেন। তাঁদের সঙ্গের মোটা মোটা তথ্যপুঞ্জই সেই প্রস্তুতির সাক্ষ্য দেয়। চোপরা সাহব মুলতুবির  অনুরোধ জানান কারণ তিনি খুব কম সময়ের নোটিশই পেয়েছিলেন এবং তাতে  এই বিষয়ের শুনানি নিয়ে বলাও ছিল না। কিন্তু তাঁর অনুরোধ খারিজ হল। ভারতের অ্যাটর্ণী জেনারেল এবং পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারেলকে বলা হল তাঁদের যুক্তি পেশ করতে। তাঁরা আত্মবিশ্বাসের সাথে তা সমাপন করলেন। প্রস্তুতির অভাব সত্ত্বেও চোপরা জবাব দেবার জন্য তাঁর যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। বিচারপতি বসাক তারপর রীট পিটিশনকে খারিজ করলেন এবং তাঁর রায় পরবর্তী এক সময় দেবেন বললেন।

১৭ই মে বিচারপতি বসাকের রায় বেরুল। এই সুদীর্ঘ নথিটি পূর্ণ ছিল ফৌজদারী ও  সাংবিধানিক বিধির উপর পূর্ববর্তী বহু মামলার অজস্র উদাহরণে। নথিটিতে ইসলামের গভীরতা এবং ভারতের সেকুলারিজম দর্শনের উপরেও কিছু অনুচ্ছেদ ছিল। এতদতিরিক্ত ছিল সনাতন অজ্ঞাত অপার্থিবের সম্বন্ধে কিছু অভিব্যক্তি। আমাদের মত সামান্য ব্যক্তির দ্বারা কৃত কোন সারসংক্ষেপ মাননীয় বিচারপতির মহত্ত্ব সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিতে পারে। সেই কারণে এই পুস্তকে দ্বিতীয় ভাগে পূর্ণ নথিটিই সন্নিবিষ্ট হল।

 

রায়ের পরবর্তী কাহিনী

এই রায়েও শেষ হয় নি আখ্যান যদিও কোলকাতা হাইকোর্টের সিদ্ধান্তে এই বিষয়টি পরিসমাপ্ত ধরাই স্বাভাবিক। বিচারপতি বসাক এই রীট পিটিশনটি গ্রহণ করার জন্য বিচারপতি খাস্তগীরের সমালোচনা করেন। তিনি রায় দেন: “এই আবেদনটি গ্রহণ করা হয়েছে আদালতের ক্ষমতা এবং এক্তিয়ারের প্রতি নজর না দিয়েই। এতদ্ সত্ত্বেও হলফনামা দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর দ্বারা এই ধারণা আসা স্বাভাবিক যে মামলার কোন পৃষ্ঠভূমি আছে, যদিও সেই পৃষ্ঠভূমি নিয়ে কোন নিরীক্ষণ করা হয় নি। আদালতের উচিত ছিল এই সমস্ত ব্যাপারে আরও পর্যবেক্ষণশীল হওয়া। নতুবা এর ফলে সস্তায় প্রচারের আলো আকর্ষিত হবে  কিন্তু অকথনীয় দুর্ভোগও  আসবে  এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিপর্যয় হবে। এই পিটিশনটি দাখিল করা মাত্র খারিজ করা কর্তব্য ছিল।”

কিছু মুসলমান নেতা এই বক্তব্যের ভিত্তিতে বিচারপতি পদ্মা খাস্তগীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার দাবি জানায়। যেমন, জম্মু এবং কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী গুলাম মহম্মদ শাহ। তিনি একমাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটাবার পর ২০শে মে দেশে ফেরেন। ঐদিনই তিনি শ্রীনগরের ইকবাল পার্কে এক জনসভায় ভাষণ দেন। দিল্লীর নবভারত টাইম্সের উদ্ধৃত করা ২২শে মের এক পি টি আই রিপোর্ট অনুযায়ী শাহ বলেন, “যে বিচারপতি এই  পিটিশনটি দাখিল করতে দিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক।”

এই জনসভা ছিল কাশ্মীর উপত্যকার ক্রমাগত হিংসার শেষ পরিণতি যদিও রীট পিটিশনটি ১৩ই মে খারিজ হয়ে যায়।  কাশ্মীরের মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতারা তাঁদের পিটিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পরিধি আরও বাড়িয়েছিলেন এবং কিছু চিরকালীন মুসলমান  “অভাব-অভিযোগের প্রতি” দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ১৮ই মের দ্য স্টেট্সম্যান শ্রীনগর থেকে আগের দিনের রিপোর্ট দেয়: ইউ এন আই এবং পি টি আইয়ের রিপোর্ট মোতাবেক পুলিশ জানাচ্ছে যে ইঁট বর্ষণকারী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি এবং কাঁদানে গ্যাস চালালে একজন ব্যক্তি নিহত হয় এবং তিনজন গুরুতর আহত হয় শ্রীনগরের ফতেহ্ কদলে। আওয়ামী অ্যাকশন কমিটির  সভাপতি মিরওয়াজ মৌলভী ফারুক এবং অন্যান্য নেতাদের ডাকা একদিন হরতালে আজ শ্রীনগর স্তব্ধ হয়ে যায়। এই নগরীতে ও উপত্যকার অন্য শহরগুলিতে দোকান-বাজার বন্ধ ছিল। যানবাহন ছিল বিরল। ব্যাঙ্ক এবং সরকারী দপ্তরখুলি খোলা ছিল, কিন্তু স্কুল-কলেজ ছিল বন্ধ। পুলিশ মুখপাত্র জানান যে কুরআনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য, মুসলিম দেওয়ানী বিধিতে হস্তক্ষেপ এবং দেশে হিংসাবৃদ্ধির কারণে  হরতাল পালিত হয়।

ইতিমধ্যে চাঁদমল চোপরা ১৯৮৫ সালের ১৮ই জুন একটি পুনঃবিচারের আবেদন পেশ করেন। তিনি বলেন যে যেইসব অনুমানের উপর রায়টি প্রদত্ত হয়েছিল, সেগুলি নির্ভুল নয়। তিনি এক-এক করে আটটি কারণ দেখান যার কারণে রায়টি পুনরালোচিত হতে পারে। সাধারণ বিচারপদ্ধতি অনুসৃত না হয়ে এই পুনঃবিচারের আবেদনটি আবার সেই বিচারপতি বসাকের এজলাসেই ২১শে জুন প্রেরিত হয়। তিনি এই আবেদনের কারণগুলি অনুসন্ধান না করেই ঐদিনই  তুচ্ছ কোন কারণের ভিত্তিতে তাকে বাতিল করে দিলেন। তিনি একটা ব্যাপারেই নরমপন্থা দেখালেন যখন তিনি লিখলেন যে “পুনঃবিচারের কারণগুলি সঠিক হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।” এই পিটিশনটিও পুস্তকের দ্বিতীয় ভাগে সন্নিবিষ্ট হল।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Voice of India এর কাছে আমরা অনুবাদ প্রকাশের অনুমতির জন্য ঋণী।