লিবারেল মনস্তত্ত্বের ডাইনোসর

বর্তমান প্রজন্মে ছোটদের বিনোদনের খোরাক হিসাবে ডাইনোসর নিয়ে চলচ্চিত্র, অ্যানিমেশন, বিনোদন পার্ক ইত্যাদি সমস্তই অত্যন্ত জনপ্রিয় বিষয়। অধুনাবিলুপ্ত এই সরীসৃপগুলি সকলের কাছেই অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই ডাইনোসর পূজা শুরু হয়েছিল স্টিভেন স্পিলবার্গের প্রথম সিনেমা  জুরাসিক পার্ক (Jurassic Park) ছবিটি তৈরী হবার পর থেকে। তারপর থেকে হলিউডও আমাদের এই ডাইনোসর পূজার ফসলকে সংগ্রহ করেছে নিয়মিত বহু ডাইনোসর কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র তৈরী করে। এই ডাইনোসর সিরিজের নবতম সংযোজনটি “জুরাসিক ওয়ার্ল্ড দ্য ফলেন কিংডম” (Jurassic World: The Fallen Kingdom) সম্প্রতি একদিন আমার পরিবারের সঙ্গে দেখতে গেছিলাম। ছবিটির শব্দ ও দৃশ্য সংক্রান্ত উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার আমার দুই খুদে বাচ্চা তো বটেই এমনকি আমিও খুব আনন্দের সঙ্গেই উপভোগ করলাম। ডাইনোসরগুলিকে একদম জীবন্তই মনে হচ্ছিল এবং প্রতি মূহুর্তের রোমাঞ্চকর দৃশ্যাবলী অবশ্যই দর্শকদের হৃৎকম্পন বাড়িয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। এই ছবিটি দেখার পর আমার মনে হয়েছে যে ভাগ্যিস এই ছবিটি 3D না হয়ে 2D ছিল। এই আতঙ্কপ্রদ ছবিটি যদি 3D হত তাহলে হয়ত আমার খুদে ছানাদের পক্ষে দেখাটা বেশ শক্ত হয়ে উঠত।

এই ছবির গল্পে দেখা যায় যে মধ্য আমেরিকা মহাদেশের এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি সঙ্কুল দ্বীপে (Isla Nublar) বিভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসরগুলি বসবাস করে অর্থাৎ এখানে একটি ডাইনোসর পার্ক তৈরী করা হয়ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে আগ্নেয়গিরিগুলি জেগে ওঠার ফলে ডাইনোসরের প্রজাতিগুলি পুনঃরায় ধ্বংস হতে বসেছে। এই ছবির নায়ক আওয়েন গ্র্যাডি (Owen Grady) অ্যামেরিকান নেভির প্রাক্তন কর্মী এবং ভেলোসিরাপটর (velociraptor) নামক ডাইনোসরের ট্রেনার ছিলেন। ছবির নায়িকা ক্লেয়ার ডিয়ারিং (Claire Dearing) ডাইনোসর পার্কের  প্রাক্তন অপারেশন ম্যানেজার ছিলেন এবং এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে ডাইনোসরদের সুরক্ষার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী দল তৈরী করেছেন তিনি।

অন্যদিকে  বেনজামিন লকউড (Benjamin Lockwood) ছিলেন ডাইনোসর পার্কের মালিক যাঁর প্রধান সহায়ক কর্মচারী ছিলেন এলি মিলস্ (Eli Mills)। এই এলি মিলস্ই ঘটনাক্রমে আওয়েন (Owen) এবং ক্লেয়ারকে (Claire) নিযুক্ত করেন আগ্নেয়গিরি সঙ্কুল ডাইনোপার্ক থেকে ডাইনোসরদের উদ্ধার করে আনার জন্য।  এই এলি মিলস্ নামক চরিত্রটিকে একটি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্খী ও নেতিবাচক দুর্জন হিসাবে এখানে দেখানো হয়েছে, যিনি ডাইনোসরদের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার জন্য বহু টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেবার প্রচেষ্টা করেন শুধুমাত্র নিজের ব্যবসাকে বাড়ানোর জন্য। এবং তিনি এই ডাইনোসর উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সাথে তার নিজের তৈরী একটি অস্ত্রধারী মিলিটারী তথা গুণ্ডাবাহিনীকেও পাঠান। এই গুণ্ডারা প্রথমদিকে স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে বলপূর্ব্বক ডাইনোসর গুলিকে বাজেয়াপ্ত করে নিতে সফল হয়েছিল কিন্তু পরে আবার poetic justice অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই ছবির নায়ক নায়িকারই জয় হয়। নানান রোমাঞ্চকর ঘটনার পর অবশেষে তারা ডাইনোসরগুলিকে মুক্ত করে দিতে এবং দুর্জনদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন।

এই ছবির দর্শন কিন্তু শেষ অবধি একান্তভাবেই হলিউডী দর্শন যেই দর্শনে মনে করা হয় যে, হলিউড আমেরিকার পথপ্রদর্শক। এ কথাটি একবার সরাসরিই বলেছিলেন জর্জ ক্লুনি। হলিউডের বাসিন্দারা বাস করেন আপন আপন মহার্ঘ্য প্রাসাদে প্রভূত বিত্তের মধ্যে। ফলে তাঁরা অনেক সময়ই বাস্তবতা থেকে বঞ্চিত। সেই বাস্তবতা বিহীন হলিউডী লিবারেল মতবাদের মনঃবিশ্লেষণই হল এই লেখার উদ্দেশ্য। অবশ্যই এই ব্যপারে আমি এই ছবির পেশাগত নৈপুণ্যের দিক থেকে কোন সমালোচনার দাবি রাখি না। কিন্তু বাস্তববুদ্ধির বিচারে এই নিয়ে শ্রোতাদের কাছে কিছু বলার ইচ্ছা রাখলাম।

এই ছবিতে দেখানো হয়েছে যে মার্কিন সেনেটে একটি বিতর্ক চলছে এবং তাতে একদল লোক বলছে ডাইনোসরদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে এবং তাদেরকে মানব সমাজে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আবার  অন্যদিকে আরেকদল লোক বলেছে একই মানব সমাজে ডাইনোসরদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয় তাই তাদের ধ্বংসই কাম্য। ডাইনোসর, বলা বাহুল্য এরকম একটি প্রাণী যা উন্নত সভ্যতাতে বিচরণ করার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এই অতিকায় দানবাকার প্রাণীগুলির এবং উন্নত প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন আধুনিক কালের মানুষদের একই ধরণীতলে স্বাভাবিকভাবে মুক্ত সহাবস্থান এককথায় অসম্ভব।

এই ডাইনোসর হয়তো প্রতীকী – অন্যান্য সমাজব্যবস্থার বাসিন্দাদের পশ্চিমী লিবারেলরা অনেকটা এইভাবেই দেখে থাকেন। আদিম, বুদ্ধিহীন, আবার মানব সভ্যতার মিউজিয়ামের জন্য প্রয়োজনীয়। তাই তাদের নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই। তাদের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবতে বা তাদেরকে নিজেদের সমপর্যায়ভুক্ত করতে পশ্চিমী লিবারেলদের ভীষণ আপত্তি। তাই তাদের জন্য লিবারেলদের যাবতীয় সহানুভূতিকেও  আন্তরিক বলে মনে হয় না। বরং মনে হয় নিজেদের লিবারেল পরিচয় আরও উজ্জ্বলতর করার জন্য বা নিজেদের পরিমণ্ডলে আপন নাম জাহির করার জন্যই লিবারেলরা ব্যাকুল।

যেমন  পশ্চিমী লিবারেলরা মুসলিম সমাজের মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল এটাই তাঁদের প্রচার এবং ভাবনা। উাদাহরণস্বরূপ ২০০১ সালে নেদারল্যাণ্ডসে এক আলোচনা সভায় এই নিয়ে বিতর্ক হচ্ছিল যে কারা বেশি উদারপন্থী  এবং প্রগতিশীল, মুসলিম সমাজ না পশ্চিমী সমাজ। সভার পশ্চিমী বক্তারা মোটামুটি সবাই মেনে নিয়েছিলেন যে পশ্চিমী সমাজ মুসলিম সমাজের থেকে প্রগতিশীলতায়  পিছিয়ে। অবশ্যই এই বিচার ছিল পক্ষপাতী কারণ যেগুলি পশ্চিমী সমাজে প্রগতিশীলতার মাপ কাঠি যেমন সমকামীদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অধিকার, নাস্তিকদের প্রতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে পক্ষপাতহীনতা এইসব পশ্চিমী সমাজে ভীষণভাবে প্রবল। অথচ অধিকাংশ মুসলিম সমাজে সমকামী বা নাস্তিকদের মৃত্যুদণ্ড বা তীব্র লাঞ্ছনা ছাড়া কিছুই জোটে না। সেই কারণে অধিকাংশ মুসলিম সমাজে ঘোষিতভাবে সমকামী বা নাস্তিক কেউই থাকেন না, ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের আন্দোলনও দেখা যায় না। এ থেকে নিশ্চয়ই ধারণা করা উচিত নয় যে মুসলিম সমাজে সমকামী বা নাস্তিকদের কোন সমস্যা নেই! অথচ লিবারেলরা তাই প্রচার করতে চান। কাজেই  কি করে বলা যায় যে লিবারেলরা অন্য সমাজ ব্য়বস্থার বাসিন্দাদের নিজেদের মত এক দৃষ্টিতে দেখেন? বরং মনে হয় তাঁরা মুসলিম সমাজকে  আদিম বুদ্ধিহীন ডাইনোসর প্রতিম বলে মনে করেন। এবং তাঁদের কাছে মুসলিম সমাজের প্রগতিশীলতার মাপকাঠি আলাদা।

ওই সভায় এই দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিবাদ করেন সোমালিয়া থেকে আগত আয়ান হিরসি আলি (তথ্যসূত্র: Infidel: My Life, Ayaan Hirsi Ali, Free Press, 2007 )। তিনি সরাসরি এই পক্ষপাতি বিচারকে কটাক্ষ করে বলেন যে, পশ্চিমীরা নিজেদের জন্য বহু ভলতেয়ারকে রেখেছেন তাঁরা কি মুসলিম সমাজের জন্য একজনও ভলতেয়ার দেবেন না? এই কথার তাৎপর্য হল যে, পশ্চিমী বাসিন্দাদের যেমন ভলতেয়ারের মত উদার চিত্ত হবার অধিকার আছে তেমনই মুসলিম সমাজের বাসিন্দাদেরও সেই সমঅধিকার আছে। তাঁদের ছেলে ভুলানো কথায় প্রগতিশীল বললে তাঁদের বাস্তবিক প্রগতিশীলতার যাত্রাকেই বাধা দেওয়া হয়।

লিবারেল কথাটির আক্ষরিক অর্থ উদারমনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ। কিন্তু এই কথাটি বর্তমানে চরিত্র বৈশিষ্ট্য হিসাবে যত না ব্যবহৃত হয় তার চেয়ে অনেক বেশী ব্যবহৃত হয় একটি খেতাব হিসাবে। ফলে তথাকথিত লিবারেলরা বর্তমান সময়ে তেমন উদার নন বরং আত্মপ্রশংসা প্রিয় অভিমানী মানুষ।  তাঁরা বিরোধীপক্ষের সমস্ত লোককেই দুর্জন এবং তাদের মতামতকে নেতিবাচক বলে গণ্য করেছেন। যেই ডাইনোসর মানুষের সভ্যতার পক্ষে বিপদজনক সেই ডাইনোসরকে মানবসমাজে স্থান না দেবার পক্ষে যৌক্তিকতাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই লিবারেল চিন্তাধারায় পুষ্ট ছবিটিতে ডাইনোসরদের অস্তিত্ববিরোধী সমস্ত চরিত্রগুলিকেই নেতিবাচক হিসাবে দেখানো হয়েছে। যাঁরাই লিবারাল নন তাঁরাই লোভী এবং পাষণ্ড। এই লিবারেলরাই আবার বিশ্বযুরে সন্ত্রাসবাদীদের পক্ষে কথা বলেন, সন্ত্রাসীদের মানবাধিকার নিয়ে তাঁরা ভীষণ চিন্তিত, কিন্তু সন্ত্রাসের স্বীকার হচ্ছেন যে সব মানুষ তাঁদের নিয়ে লিবারেলদের কোন মাথা ব্যথা নেই। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলাটা তাঁদের কাছে হয়ে দাঁড়ায় অসহিষ্ণুতা বা উগ্র জাতীয়তাবাদ।

ধরা যাক ডাইনোসরগুলি হল আজকের যুগের নাশকতাকারী সন্ত্রাসবাদী, সেক্ষেত্রে দেখা যাবে যে, এগুলির সৃষ্টিকর্তা উদার মানুষিকতার বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে অনেকটা বর্তমানযুগের লিবারেল বুদ্ধিজীবিদের একটা ভীষণ রকম মিল আছে। এই যেমন এই চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায় যে,  ডাইনোসরগুলি যতই ভীষণাকার, হিংস্র এবং মানবজাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট হোক না কেন কিন্তু তাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখাতেই হবে। এই ছিল বৈজ্ঞানিকদের দৃঢ় পণ। ঠিক তেমনই আমাদের সমাজের বর্ব্বর নরপিশাচরা যখন নিরীহ মানুষ এবং সভ্য সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভীষণভাবে ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে তখন এই বুদ্ধিজীবিরাই পরিষ্কারভাবে আন্দোলন করে জানায় যে তাদেরকে কোন রকম কঠোর শাস্তি দেওয়া যাবে না।

বাস্তবিক বিচারে যেমন ডাইনোসর ও আধুনিক মানব সমাজের সহাবস্থান হলে যে কোন একটির ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী ঠিক তেমনই বর্তমান যুগে বর্ব্বর নরপশুদের স্পর্ধা ও শক্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকলে আধুনিক মানবসভ্যতার বিনাশও নিশ্চিত।  এবং একই সঙ্গে বিলুপ্ত হবেন লিবারেলরাও। অথচ এই সত্য কখনই হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন না কেবলই আত্মপ্রশংসাপ্রিয় এই  লিবারেলরা।