চলতি হাওয়ার পরিপন্থী

0
720

হাই দিস ইজ কেটি, আই নিড টু টক টু ইউ ।

এরকম একটা মেসেজ কারো মোবাইলের পর্দায় ভেসে উঠলে কার ক্ষমতায় কুলায় সেটাকে ইগনোর করে? একদম ঠিক ধরেছেন, আমিও করি নি। প্রত্যুত্তরে নমস্কার লিখে ছেড়ে দিলাম। আশা করেছিলাম মহিলা যখন খুব কাঁচা খিস্তি দেবেনা হয়তো। ও হ্যাঁ ঐ শুয়োরের বাচ্চা কমিউনিস্টদের খিস্তিখাস্তা যখন প্রথম শুরু করেছি, সদ্য তার পরের ঘটনাই বলছি। যাই হোক এরপর আবার মেসেজ এলো, ঘটনার সারসংক্ষেপে যাই, মেয়েটি সাউথ কলকাতার দিকে থাকে, আমেরিকার একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করে। মাকে নিয়েই থাকে। বাবা নেই, সিপিএমের জোনাল নেতা এবং পার্টির বদান্যতায় স্কুলের মাস্টার ছিলেন। এছাড়া আর্টকালচার কর্তেন সব মাকুর মতই। এবং এও জানালো সে সিপিয়েমের একজন সক্রিয় সদস্য। এটা শোনার পর আমি হাতা গোটাতে শুরু করেই দিয়েছিলাম। কিন্তু বাধ সাধল মেয়েটির পরের মেসেজটি। ও লিখল ভোটের সময় সারাদিন খেয়ে না খেয়ে ইলেকশন ডিউটি দিই, পুজোর সময় পার্টির স্টলে বসি বন্ধুদের সাথে না বেরিয়ে। তোমার পোস্টটা দেখে আমি কষ্ট পেয়েছি, আমি ভাবতে পারি না একজন মানুষ এত বিদ্বেষ হয় কি করে? কমিউনিস্টরা কী দেশের গরিব মানুষদের কথাই বলে না? আমি একটু ঝটকা খেলাম। সত্যিই তো নিজেকে ওর জায়গায় বসিয়ে যদি ভাবা যায় তবে তো খারাপ লাগারই কথা।

আমি বললাম, “আমরা বাঙালি হিন্দুরা একটু উদারমনস্ক হই। আমরা তো পাঞ্জাবিদের মত নই। পাশের দেশে যারা আমাদের কুকুরবেড়ালের মত মেরে মেরে শেষ করেছে, সাত পুরুষের জমি বাড়ি থেকে এক কাপড়ে তাড়িয়ে দিয়েছে ভিখারির মত, তাদের গায়ে আমরা এই রাজ্যে কোনোদিন একটা আঁচড়ও দিই নি। আমরা স্বভাবত দেশকে ভালোবাসি, যারা এমনকি বিরোধী রাজনীতি করেন তারাও দেশের বিরুদ্ধে কাজ করেন না। এবং সর্বোপরি বাঙালি হিন্দুর দেশপ্রেম সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত। তুমি একটি গোঁড়া অসহিষ্ণু কমিউনিস্ট পরিবারের মেয়ে, আমি বুঝছি এটা তোমার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। তাই তোমার খারাপ লেগে থাকলে আমারো সেটা খারাপ লেগেছে।” আমরা হিন্দু জাতীয়তাবাদী, কমিউনিস্ট পুরুষদের মত লম্পট লুচ্চা নই। তাই মেয়ে দেখেই এতবড় মিথ্যা কথাটা বলে দিতে পারলাম না: “তুমি কিছু মনে রেখো না, আমি চেষ্টা করব এমন কোন পোস্ট না করতে, যাতে তোমায় এরকম কষ্ট পেতে হয়।” কারণ আমি আদর্শের সাথে আপোষ করি না, আমি জানি, কালই হয়ত আবার কোনো অপ্রিয় সত্য কথা বলতে হবে।

এতটা শুনে মেয়েটি শান্ত হল। তারপর এও জানালো যে আমায় ও ভেবেছিলো একজন মনস্টার। আমায় দুটো কথা শোনানোর লোভ ও সামলাতে পারছিল না, শুনিয়েই ও আমায় ব্লক করে দিত। কিন্তু কথা বলার পর ওর মনে হচ্ছে আমি কোন ভালো ঘরোয়া মনস্টার (এই ধরুন, কালু রাক্ষস) যে খারাপ পথে চলে গেছি। আচ্ছা মা চল তাই সই। আমি ভালো মনস্টার। তো ভালো মনস্টার হলেও আমার উদ্দেশ্য তো কমিউনিস্ট প্রোপাগাণ্ডার ঠুলিটা চোখ থেকে খুলে দেওয়া। তাই কথা এগোলাম রাজনীতির কথা খুব শ্লথ গতিতে ঢুকতে থাকল। ও আমার কাছে জানতে চাইল মার্কসবাদের মত এক বৈজ্ঞানিক সত্যে কেন আমি বিশ্বাস করি না? আমি আমার মত করে ওকে বোঝালাম। সে শুনে আমাকে উড়িয়ে দিলো। কিভাবে কমিউনিস্টরা দেশের সমস্ত মানুষকে স্বর্গের মত সুখে রাখতে পারে সে সম্বন্ধে আমাকে অনেকক্ষণ বোঝালো। আমিও কাউন্টার করলাম কমিউনিস্ট শাসনে উত্তর কোরিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার হতদরিদ্র থেকে যাওয়া মানুষদের কথা বলে। আমলাশোলের পিঁপড়ে খাওয়া মানুষ আর ক্যালকাটা ক্লাবে স্কচ প্যাঁদানো কমিকুত্তার শিল্পপতি ছেলের কথা শুনে চুপ করে রইল। এসব নিয়ে প্রথম রাতটা বেশ হৃদ্যতার সাথেই শেষ হল।

দ্বিতীয় দিন ঘুম ভেঙেই আমি বেশ চমকে গেলাম। একটা ছোট্ট মেসেজ এসছে “আমি পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী হিন্দু গণহত্যার প্রকৃত ইতিহাস পড়তে চাই। এই আমার ই মেইল আইডি, এখানে পাঠিও”। চুপিচুপি মনে মনে একটু হেসে নিলাম। সত্য যেদিন সামনে এসে দাঁড়ায়, সেদিন মানুষের চোখ ফুটতে দেরি হয় না। পর পর কয়েকটা বই পাঠালাম। নোয়াখালি দাঙ্গা নিয়ে সুচেতা কৃপালনীর রিপোর্টটা, দীনেশচন্দ্র সিংহের রক্তরঞ্জিত ঢাকা বরিশাল, কালিদাস বৈদ্যের অন্তরালের শেখ মুজিব। একাত্তরের পরেও যে এসব থামেনি, সেটাও দেখাবার জন্য তসলিমার লজ্জা আর হুমায়ুন আজাদের পাক সার জমিন সাদ বাদও দিয়ে দিলাম। এরই সাথে আমার কাছে স্বাধীন ভারতবর্ষে আরব সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সবথেকে অন্ধকার অধ্যায় কাশ্মীর হিন্দু গণহত্যার দলিল রাহুল পণ্ডিতার আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস ছিলো, ওটাও পাঠিয়ে দিলাম।

তারপর আবার রাতে আমায় ধরল। জিজ্ঞেস করল আমি কোনদিন বাঙালী হিন্দু আত্মপরিচয়ের পক্ষে লেখালিখি করেছি কিনা। সেই সব পোস্টে কি লেখা থাকে? ভারতের অসহায় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কিছু লেখা থাকে কিনা ? আমি বললাম “যে লেখায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের পৃথিবীতে সবথেকে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর মানুষের কথা লেখা থাকে সেটা আর কোনো অসহায় ব্যক্তির বিরুদ্ধে কি কখনো হতে পারে কেটি?”
একটা ছোট্ট উত্তর এলো “না”
“আমিও তাই বলছি।”

তারপর আবার দুদিন চুপ। আমিও ঘাঁটাই নি পড়ছে পড়ুক। দুদিন পর সকালে আবার চমক । যার জন্য এই স্টেটাসটা লিখতে বসতেই হল।
“মনস্টার আমার কিছু ব্যাক্তিগত কথা ছিলো শেয়ার করতে পারি ?”
“বল”
“তুমি তো জানই আমি কমিউনিস্ট পরিবারের মেয়ে। আমাদের পরিবারে সবাই বামপন্থী বা অতিবামপন্থী রাজনীতি করে, কাশ্মীরের আজাদি চায়। আবার কেউ চায় পশ্চিমবঙ্গকে ভারত থেকে আলাদা করে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করতে, ওরা বলে আমরা কাঁটাতার মানি না। আমিও এতদিন তাই চাইতাম, আমার মনে হত সব বাংলাভাষী যদি একসাথে থাকে তাহলে তো ভালোই, দুই বাংলা জুড়ে সাম্যবাদী পিপলস রিপাবলিক গড়ে উঠবে। কিন্তু…”
“কিন্তু কী কেটি?”
“এই ইতিহাস পড়ে এখন মনে হচ্ছে এতে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমরা সংখ্যালঘু হয়ে গেলে আবার পূর্ব পাকিস্তানের মত হয়ত পশ্চিমবঙ্গেও আমাদের উপর অত্যাচার শুরু হবে। আমার দেশের বাড়ি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার খুব ইন্টিরিয়রে, ওখানে এখনই এলাকার পরিস্থিতি খুব ভালো নয়। আমি আগে ভাবতাম অশিক্ষা দারিদ্র্য এর জন্য দায়ী, বইগুলো পড়ে এখন বুঝতে পারছি আসল কারণটা কী। আমার এক দাদা এলাকার মানুষের মধ্যে এনআরসি সিএএর পক্ষে সচেতনতা গড়ে তুলতে চাইছে, আমি এই প্রথবার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে দাদার পক্ষে দাঁড়াতে চাই।”
সত্যি বলছি আমার গায়ে কাঁটা দিলো পড়ে। জিজ্ঞেস করলাম

“সে দাঁড়াতেই পারো । কিন্তু তুমি এগুলো আমায় কেন বলছ কেটি? আমার কাছে কি কোন সাহায্য চাও ? আমি তো এত দূর থেকে কিছুই করতে পারব না।”
বলল “না, আসলে কাকে বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়ল তোমার কথা। তুমি তো হিন্দু ন্যাশনালিস্ট। আমি শুনেছি গোটা দেশের মধ্যে একমাত্র তোমরাই এই নিয়ে সোচ্চার, তাই মনে হল তোমাকে বললে যদি তুমি আমায় সাহস দিতে পারো। আমার পরিবারে এটা অপরাধ। আর এর বিরুদ্ধে যাওয়া মানে আমি একা হয়ে যাব”
আমার চোখে জল এসে গিয়েছিলো। লিখলাম,
“তুমি ঠিক শুনেছো কেটি। আমরা হিন্দু জাতীয়তাবাদী, আমাদের কাছে ভোটব্যাঙ্কের আগে দেশ। যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে পূর্ব বাংলায়, কাশ্মীরে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় হিন্দু বৌদ্ধ আদিবাসীর সর্বনাশ হয়েছে আমরা তাকে আটকাবার কথা বলি। আমার খুব গর্ব হচ্ছে তোমায় নিয়ে। তুমি আমার বন্ধু। আমি জানি এই লড়াইটা কঠিন, লড়াইটা জিতবে কি হারবে তা আমি জানি না। কিন্তু অনেক দূর থেকে তোমার এই বন্ধু তোমার জন্য গর্বিত হবে । তোমায় নিয়ে লিখবে যে তুমি একটা লড়াই করেছিলে।”
তারপর গত ডিসেম্বর মাসের এক বিকেলে প্রথমবার ওর দাদার নেতৃত্বে ওদের গ্রামের বাড়ির এলাকায় সিএএ-এনআরসির পক্ষে, অবৈধ অনুপ্রবেশ মারফত পশ্চিমবঙ্গ অসমের সর্বনাশের বিরুদ্ধে জনসমাবেশ হয়েছে। কেটি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে শুধু অর্গানাইজ করে নি, ঘরে ঘরে গিয়ে ভারতীয়দের সভায় আসতে বলেছে, এমনকি ওর পরিবারের সকলকে রাজিও করিয়েছিল সেই সমাবেশে আসতে।
না, এটা তো রূপকথা নয়। তাই সবাই আসে নি, আরবদের পয়সা নিয়ে বা কলকাত্তাইয়া লিবারবালদের হাততালি পেতে দেশের শত্রুতা করে যারা, তেমন অনেক কমিউনিস্ট আত্মীয় ওকে শাপশাপান্ত করেছে, ওকে একঘরে করার কথাও হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় খাপ বসিয়ে। তবু ও হেরে যায় নি। হাজার হাজার বিরোধীকে ভয় দেখিয়ে, মারধোর করে, হাত কেটে নিয়ে, খুন করে কমিউনিস্টরা যখন ভোটে জিতত তখন ওর বাবা সেই সাধারণ মানুষের রক্তমাখা বিজয় মঞ্চে দাঁড়িয়ে নির্লজ্জ নীরোর মত গণসঙ্গীত গাইতেন একদিন। কিন্তু সেদিন ওর মা নিজে ওই জাতীয়তাবাদী সমাবেশে উপস্থিত না থাকলেও মেয়েকে আশীর্বাদ করেছেন। আমাকে সেসব ছবি পাঠিয়েছিল ও।
ছবি গুলো দেখে আমি ওকে লিখেছিলাম “প্রাউড অফ ইউ”।
উত্তর এলো “আমি এখনো একজন সিপিএম কর্মী, তুমি ভেবো না তুমি আমার ব্রেন ওয়াশ করতে পেরেছো”

আমি কে তোমার ব্রেন ওয়াশ করার? তোমার লড়াইটা অনেক কঠিন ছিলো কেটি। আমার পাশে অনেক লোক আছে তোমার পাশে শুধু তোমার ছায়া। তবু তুমি পেরেছো। আমার প্রাপ্তি শুধু একটাই যতই গালি দাও দেশকে বাঁচানোর কথা উঠলে, আরব সাম্রাজ্যবাদ আর তাদের দালালদের বিরুদ্ধে যে কোন বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উঠলেই যাদের কথা মাথায় আসে তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদী। ভালো থেকো কেটি। নেকড়েরা দিনে দিনে দলে ভারি হচ্ছে। সামনে আরো কঠিন লড়াই তোমার দাদার, তোমাদের দেশের বাড়ির লোকের আর তোমার। আমার সমর্থন রইলো এক লড়াকু সিপিএমের প্রতি, যে পার্টির শিখিয়ে দেওয়া তোতাপাখির বুলি শুনে দেশের সাথে বেইমানি করেনি, জেনারেল জিয়ার হুকুমে জল্লাদজ্যোতির মত মরিচঝাঁপির বাদায় জলে বাঙালী হিন্দু উদ্বাস্তুদের পশুর মত ধর্ষণ করেনি, জবাই করেনি, প্রকৃত ইতিহাস জেনে সচেতন মানুষের মত দেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছে । পালটে দাও এদেশের খোলনলচে। তারপর বোলো, তোমাদের পার্টিতে তোমার জায়গা হল নাকি দাঙ্গাবাজ গোরুর বাচ্চার ট্যাগ কপালে নিয়ে পার্টি ছাড়তে হল আরো অনেকের মত। বোলো, তুমি দেশপ্রেমিক ছিলে নাকি তোমার পার্টি?

আজ লকডাউনের মধ্যে একটা মেসেজ পেলাম। আর কেটি নয়, বন্ধুদের সে বলে দিয়েছে তাকে কেতকী বলে ডাকতে।