৩ জুন সমাধিস্থ হবে নাগরিকত্ব বিল

0
476

চিতাকাঠ সরিয়ে তর্জনী তুলবেন দেশভাগের শিকার অসমবাসী

ষোড়শ লোকসভার মেয়াদ ফুরোচ্ছে ৩ জুন, ২০১৯। রাজ্যসভার নিয়ম অনুযায়ী, যে সমস্ত বিল লোকসভায় পাস হয় নি, এবং রাজ্য সভায় মুলতুবি রয়েছে, সেগুলো সমাধিস্থ হবে না। কিন্তু যেসব বিল লোকসভায় পাস হয়েছে, কিন্তু রাজ্যসভায় তোলা যায় নি, সেই বিল গুলোর সমাধি হয়ে যাবে! নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ বা ২০১৯, সেই সমাধিস্থ বিল গুলোর অন্যতম!

২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি লোকসভায় পাস হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। এই বিলের মাধ্যমে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি ও খ্রিস্টানদের যারা ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার বা যারা নির্যাতনের ভয়ে পালিয়ে আসা, তাদের নাগরিকত্ব দিতে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করতে চাওয়া হয়েছিল। বিলটি রাজ্যসভায় তোলার সুযোগ না হওয়ায় বিলবিরোধীরা এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। আগামী ৩ জুন সেই বিলের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। বিলবিরোধীরা নিশ্চিতই আবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবেন!

গণতন্ত্রের স্বঘোষিত পূজারীরা এই বিলকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে বিরোধীতার ধোয়া তুলেছিলেন। অসমে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও বাঙালি বিরোধীরা আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। এবং শাসক বিজেপি-এনডিএ পরাজয় বরণ করেছিল। আর তারই জেরে বিলটির আগামীতে এমন করুণ পরিণতি হতে যাচ্ছে! দেশভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার মানুষগুলোর এই বিলের মাধ্যমে সামান্য হলেও সমস্যার সমাধান হতো, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্ত যারা নিছক বিজেপি বিরোধিতার জন্য সাম্প্রদায়িকতার দোহাই পেড়ে মুসলমানদের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে এই বিল এমন ভাবনার ধুয়ো তুলেছেন বার বার, তাদের মুখে হাসি আজ এঁটোর মতো লেগে আছে!

যাদের প্রয়োজন ছিল তাদের জন্যই এই বিল আনা হয়েছিল। এর মাধ্যমে দেশভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকারদের যে সামান্য সুবিধে প্রদান করা হচ্ছিল, সেটা কি অন্য কোনও সম্প্রদায়ের মানুষের ভাগের অধিকার থেকে ছিনিয়ে এনে দেওয়া হচ্ছিল! দেশভাগের শিকার মানুষগুলো এই বিল পাস হলে যে সুবিধেটুকু পেতেন, সেটার জন্য কি অন্য কোনও সম্প্রদায়ের লোকেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিয়ে দেশছাড়া করা হবে বলে নিদান দেওয়া হয়েছিল! বিলের বিরোধিতা করে যারা দেশভাগের শিকার মানুষগুলোকে তাদের সর্বকালের অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন, তারা গণতন্ত্রের নামে, ধর্ম-নিরপেক্ষতার নামে দেশভাগের শিকারদের আরও দুর্ভাগ্যের কারণ হলেন। পবিত্র গণতান্ত্রিক দেশের অধিকার যদি হয় অন্যের সামান্য উপকার হতে দেখলেই বিরোধিতার তাওয়া গরম করে তোলা, তবে সেটা চূড়ান্ত ধান্দাবাজির নামান্তর!

ভারতের সংবিধানে সবার জন্য, সবার প্রয়োজন মতো সুযোগ- সুবিধে প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানে যেমন সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ সুবিধের কথা বলা হয়েছে, ঠিক তেমনি তফসিলি এবং ওবিসি’র জন্যও বিশেষ সুবিধের কথা বলা আছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে দেশভাগের শিকার গরিব মানুষদের বিশেষ সুবিধে পাওয়াটা কি ভারতীয় সংবিধানের নিরপেক্ষতার অংশ নয়? উদ্বাস্তুদের অধিকার যে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে, সেক্ষেত্রে কেনো তবে এখন নিরপেক্ষতার দোহাই পাড়া হচ্ছে না? বিল বিরোধিতা করা তো সরাসরি দেশভাগের শিকার মানুষের স্বার্থের বিরোধিতার নামান্তর।

এতোদিন বিল বিরোধিতা করে যারা অষ্টপ্রহর ছৌ-নাচ দেখিয়ে গেলেন, গায়ে আগুন দেয়ার হুমকি দিলেন, তারা মূলত রাতজাগা প্যাঁচার দল! একটু ব্যতিক্রমী পথে হেঁটে নতুনত্বের ধ্বজাধারী হওয়াটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য! বিল বিরোধিরা মুসলমান সম্প্রদায়ের সর্বহারা হয়ে যাওয়ার পকেট রাজনীতিতে বিভোর! এই বিল আইন হলে মুসলমানদের নাগরিকত্বের সমস্যা হবে, সেই কাল্পনিক চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাত-দিন বিরোধিতা করে গেছেন! এই বিল পাস হলে ভারতবর্ষের মুসলমানদের নাগরিকত্বের সমস্যা হতে পারে, সেই রাজনৈতিক কষ্ট কল্পনার বলি হলেন দেশভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার অসমের বাঙালিরা।

১৯৫৪ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের এদেশে নাগরিকত্বের পাশাপাশি সব ধরনের সুযোগ সুবিধে পাইয়ে দিতে শিখ সম্প্রদায়ের লোকেদের জন্য The Displaced Persons (Compensation and Rehabilitation) Act, ১৯৫৪ পাস হয়। এই আইনের মাধ্যমে তাদের সব ধরনের সুবিধে প্রদান করা হয়। এবং ২০০৮ সালে এই আইনটি বাতিলও ঘোষণা করা হয় এই কারণ দর্শিয়ে যে, ১৯৭০ সালের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্বসহ নিজেদের সমস্ত অধিকার পেয়ে গেছেন। তাই আজ আর সেই আইনের প্রয়োজন থাকছে না। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৫৪ সালের সেই আইনটি যদি সাম্প্রদায়িক না হয়, তবে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ বা ২০১৯ কীভাবে সাম্প্রদায়িক হতে পারে?

তোষামোদ ও মুসলমান ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে গিয়ে উদ্বাস্তু -সহায়ক বিলটিকে সাম্প্রদায়িকতার তকমায় বানচাল করে দেওয়া হলো! যারা দেশভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার, যারা সমস্যায় রয়েছেন, তাদের জন্যই ছিল সেই বিল! কিন্তু কায়েমি স্বার্থ আর ধান্দাবাজি অক্ষুণ্ণ রাখতেই বলি দেওয়া হলো বিলটির। গড় বাঙালির সবচাইতে বড় গুণ (!),তাদের নিজেদের মগজাস্ত্র ব্যবহার এক্কেবারে নাপসন্দ! আর তাই, অন্যের মুখের ঝাল খেয়ে এক্কেবারে চামচে হয়ে পড়েন সহজেই! অন্যের মুখের ঝাল খেয়ে এতোটাই ফিদা হয়ে গেছেন যে, সে কথা কবুল করতে কোনও কবুলিয়তনামার আর দরকার হয় না! কারন, অন্যের মুখের ঝাল দুরন্ত গতিতে, দুরন্ত আওয়াজে মগজে-মগজে ছুটে চলেছে রয়্যাল এনফিল্ড’ এর মতো, যার কোনও সাইলেন্সার নেই!

সর্বোজন স্বীকৃত যে, চিতা সাজানোর ওপরেই দহনের যাবতীয় সাফল্য নির্ভর করে থাকে। আর সেই কাজ করে থাকেন অভিজ্ঞ পাটুনিরা! তাই বলতে হয়, দেশভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার মানুষগুলোর চিতাও বেশ দক্ষতার সঙ্গেই সাজিয়ে তোলা হয়েছে!