শ্রীজাত প্রসঙ্গ: দুঃখজনক তবে বাংলার কি প্রতিবাদের মুখ আছে?

0
952

গতকাল কবি শ্রীজাত অসমের শিলচরে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। শিলচর পুরোপুরি বাংলাভাষীদের এলাকা। তাই বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক জগতের কোন প্রখ্যাত ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করার প্রচলনও বহুল। কিন্তু কালকের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয় কিছু মানুষের তান্ডবে। তারা অনুষ্ঠানের মঞ্চে উঠে সভা ভণ্ডুল করে দেয়।  হোটেলটির সামনের রাস্তায় দীর্ঘসময় প্রতিবাদ করতে থাকে এবং হোটেলটি ভাংচুরও করে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয় ও তদানুসারে কবিকে উদ্ধার করে সরকারী সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য ছিল শ্রীজাতের পরিবেশিত কবিতার কিছু অংশ চরম আপত্তিকর। 

ঘটনাটি দুঃখজনক। অনামী কোন সংগঠনের সদস্যরা একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একজন শিল্পীর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তা নিন্দনীয়। শিল্পীর নিজের ভাবপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত। কোন মত বা তত্বের প্রতিবাদ, তর্ক বৌদ্ধিক স্তরেই হওয়া উচিত। এরকম আচরণ আদতে বিরোধী মতকেই সাহায্য করে। এই আচরণের প্রতিবাদ তো হওয়া উচিত কিন্তু প্রতিবাদের অধিকার কি আছে এরাজ্যের মানুষের? পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বোধহয় এই যোগ্যতাটা একটু একটু করে হারিয়ে ফেলছে।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেই যোগ্যতাটা হারিয়েছিল যেদিন তসলিমা নাসরিনকে এরাজ্য থেকে জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হল। ২০০৭ সালে অল ইন্ডিয়া মাইনোরিটি ফোরাম নামে একটি সংগঠন তসলিমাকে কলকাতা থেকে তাড়ানোর জন্য দাঙ্গা শুরু করল। ১৭ই আগস্ট কলকাতায় প্রকাশ্যে মৃত্যুর ফতোয়া দেওয়া হল। ২১শে নভেম্বর সকাল থেকেই মধ্য কলকাতার কিছু অঞ্চল বিশেষত পার্ক সার্কাস, তপসিয়া, তিলজলা, ট্যাংরা, পার্ক স্ট্রীট, মল্লিকবাজার, এলিয়ট রোড জোর করে বন্ধ করে দিয়ে, গাড়ী পুড়িয়ে দাঙ্গা শুরু হল। বিকেলের দিকে দাঙ্গাবাজরা তৎকালীন ক্ষমতাসীন সিপিআইএম র দুটি পার্টি অফিস পুড়িয়ে দিল সর্বসমক্ষে। তাদের প্রতিহত করার জন্য প্রশাসন কোথায় অন্তর্হিত হয়েছিল তা নিয়ে রহস্য এখনো রয়ে গেছে। বামফ্রন্ট প্রমাদ গোনে। এতো ধর্মনিরপেক্ষতা, শ্রেণী সংগ্রাম প্রভৃতি সব তত্ব মাথায় রেখে পার্টি তথা সরকার একটি ভিজে বেড়ালে পরিণত হল। শিল্প সংস্কৃতি মনস্ক, নন্দন চত্বর আলো করা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন বঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু অরাজকতাকে প্রশমিত করার অঙ্গীকার তাঁর মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায়নি। অতঃপর, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “দুজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর অনুরোধে মুখ্যমন্ত্রী তসলিমাকে থাকতে দিয়েছিলেন। এখন কিছু লোক চাইছেন না যে তিনি এখানে থাকুন।  লেখিকার এরাজ্য এখুনি ছেড়ে যাওয়া উচিত।” ভোট বড় দায়। এই দায়ে সেদিন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, মার্ক্সীয় নন্দন তত্ব সব চুলোর দোরে দিয়ে, বামফ্রন্ট শেষ পর্যন্ত কুলোর বাতাস দিয়ে তসলিমাকে তাড়িয়েছিল।    

কিন্তু যাঁরা রাজনীতির সাথে যুক্ত নন অর্থাৎ কলকাতার যত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, এগিয়ে থাকা সব খবরের কাগজের দুঁদে সাংবাদিকরা!! তাঁরা কি করেছিলেন? তাঁরা তো এগিয়ে এসে বলেননি, “না,  বিমান বাবু! তসলিমা অবাঞ্চিত কখনোই নন। তসলিমা মুসলমান মৌলবাদের বিরুদ্ধে বলেন, হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধেও কলম ধরেন।  তাঁর নিজের মত বলার অধিকার আছে, উনি থাকবেন।” কেউ বলেন নি। সেদিনই সাধারণ মানুষ বুঝেছিল এই যে অমুক পুরস্কার পাওয়া, তমুক শিরোনামা খ্যাত বুদ্ধিজীবী, এই যে তাদের প্রগতিশীলতা, এই সবই আসলে ভণ্ডামি। এসব তাদের স্টাইল স্টেটমেন্ট। নিজেদের জীবনে এসব বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করলেও জল্লাদের সামনে বলার মেরুদন্ড এঁদের নেই।

এই যে এগিয়ে থাকা কাগজের সব বড়ো বড়ো কথা বলা বোদ্ধা লেখক, এরা বাস্তবিকই কাগুজে বাঘ। বাংলায় ওপারে তবু তসলিমা নাসরিন, শাহরিয়ার কবীর, সালাম আজাদ আছেন কিন্তু এপারে ৯ কোটি রাজ্যবাসীর মধ্যে একজনও শিক্ষিত বাংলাভাষী মেরুদন্ডওয়ালা মানুষ নেই। এরপরে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ২০০৭ সালের কলকাতার দাঙ্গার প্রধান আয়োজকরা ক্ষমতার অলিন্দে এসে গেলেন। সেই মুখগুলো দেখে কোন কবি, কোন সাহিত্যিক, কোন বিদ্দ্বজন বললেন না শিল্পীর স্বাধীনতার বাংলা, ব্যক্তি স্বাধীনতার কলকাতা, বলার অধিকারের রাজ্যে এই সাম্প্রদায়িক চেহারাগুলি কেন? কারণ কথা বলার সাহস ওইসব বিদ্দ্বজ্জনের ছিল না। রাজ্যের মানুষ বুঝলো প্রগতিশীলতা এঁদের কাছে এক সস্তার উত্তরীয় আর কিছুই না। প্রতিপক্ষ যখন ইসলামী মৌলবাদ তখন এঁরা বড় অসহায়। সেদিনই এই রাজ্য প্রতিবাদ করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে।

বিবেক অগ্নিহোত্রীর ছবি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা আকাশের নীচে প্রদর্শনের সময়েও একই মানসকিতা চোখে পড়েছিল। ২০১৬ সালের ৭ই মে, যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির স্নাতক স্তরের ছাত্ররা ঠিক করেছিল ত্রিগুণা সেন হলে অনুপম খের অভিনীত “বুদ্ধ ইন এ ট্রাফিক জ্যাম” র স্ক্রীনিং হবে। সেই মত ত্রিগুণা সেন  প্রেক্ষাগৃহের কর্তৃপক্ষ মানে প্রাক্তন ছাত্র সংসদের কাছে অনুমতিও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ও অতি বাম চক্র জোর করে অ্যালুমনি এসোসিয়েশনকে দিয়ে অনুমতি বাতিল করায়। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ছাত্রদের জেদের কাছে হার মানতে হল সাবেক বামেদের। প্রেক্ষাগৃহ না পেয়ে যাদবপুরের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ব্লু আর্থ ওয়ার্কশপের সামনের খোলা মাঠে কাপড় টাঙিয়ে দেখানো হয়েছিল ছায়াছবিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে।

সেদিন বামপন্থী শিল্পমনস্কতার এক ভয়াবহ রূপ দেখা গিয়েছিল। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর গাড়ীতে লাঠি দিয়ে মেরে, লাথি দিয়ে মেরে, বিবেককে ধরে টানাটানি করে বাধা দিয়েছিলেন তথাকথিত বামপন্থী ছাত্র ও তাদের পরিচালক, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা। পঞ্চাশোর্ধ এক বাম সমর্থক শিক্ষিকা হ্যান্ড মাইক নিয়ে চিত্র প্রদর্শনে র মাঠে ঢুকে পরে বাধা দিতে থাকেন। শিক্ষক শিক্ষিকাদের এহেন আচরণ বামপন্থী ছাত্রদের আরও উশৃঙ্খল করে তোলে। এই প্ররোচনাতেই কোনোমতে ছবিটি শেষ হওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরেই তারা আয়োজকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সন্দীপ দাস নামক এক দলিত ছাত্র্রকে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয়। বঙ্গবাসী কলেজের সম্মানীয় অধ্যাপক দেবাশিস চৌধুরীকে বেধড়ক মারধর করা হয়। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কেউই বহিরাগত ছিলনা।  ত্রিগুণা সেন হলের অনুমতি থেকে যাদবপুর থানায় অভিযোগ সবই লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন পড়ুয়া ছাত্ররাই করেছিল। ঘটনাসমূহ কি ইঙ্গিত বহন করে? বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল ছাত্র একটি ছবি দেখতে চাইলেও বামপন্থী গুন্ডারা তা দেখতে দেবেন না। কেন? বিবেকের শিল্পী স্বাধীনতা নেই? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের  একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল।  বুঝেছিলাম কলকাতা মুক্তচিন্তার অধিকার হারাচ্ছে। এতো অসহিষ্ণুতা কেন?     

সম্প্রতি বিজয় রত্নাকরের ফিল্ম ‘দ্য একসিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ দেখানোর সময়েও কলকাতার আবার সেই চেহারাই সামনে এল। যেখানে যেখানে এই ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে সেকানে গিয়ে কংগ্রেস সমর্থকরা হুজ্জতি করছেন। ভাঙচুর হচ্ছে, দর্শকেরা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যে, অন্য শহরেও কংগ্রেস দল অনেক বেশী শক্তিতে আছে। কিন্তু শিল্পের উপর আঘাত কেবল কলকাতায়! নিজের পছন্দের মতো ছাড়া অন্য কিছু দেখব না, দেখতেও দেব না; এতো অসহিষ্ণুতা ভারতের অন্য রাজ্যে নেই। তবে কোন কবি, কোন লেখক এর প্রতিবাদ করেননি।

তাই শ্রীজাতর ঘটনা আজ রাজ্যের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষকে নতুন করে ভাবনার জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। শিল্পের স্বাধীনতার জন্য লড়াইটা রং বেছে করলে ভুল হবে। আর প্রতিপক্ষ নৃশংস, হিংস্র হলেও প্রতিবাদের সাহস থাকতে হবে। প্রতিবাদ তসলিমার জন্যও করতে হবে; বিবেক অগ্নিহোত্রীর জন্যও করা উচিত। তেমনই আজকে বিজয় রত্নাকর বা শ্রীজাতর জন্য করা উচিত। তা না করলে ওই শিল্পী, সাহিত্যিক, রঙ্গকর্মীর প্রতিবাদ মানুষের মনে দাগ কাটবে না। বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠস্বরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হবে।   

তবে বাহবা দিতে হয় অসমের সর্বানন্দ সোনওয়ালের সরকারকে। এতকিছুর পরেও তাঁরা রাজধর্ম পালন করেছেন। বামফ্রন্ট সরকারের মতো ভয় পেয়ে কুলোর বাতাস দিয়ে রাজ্য থেকে দূর করে দেয়নি। অবান্তর বিবৃতিও তুলে ধরেননি কেউ। কবিকে সযত্নে সার্কিট হাউজে তুলে এনে তার সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।