সামাজিক জরুরি অবস্থা: ভারতে কেন্দ্রায়িত বিকেন্দ্রীকরণের পথ দিশা

0
833

প্রাণঘাতী করোনা থাবায় ভারতবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। ২০২০ সালে আমরা বিষে বিষে জর্জরিত। লকডাউন ২.০ চলছে। এরমধ্যে ২০ এপ্রিল থেকে অর্থনীতির চাকা আবার চালু করার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ভারতের মতো এক বিশাল উন্নয়নশীল দেশে ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোর মতো কয়েক মাসব্যাপী লকডাউন চালু রাখা প্রায় অসম্ভব। জীবন ও জীবিকার মধ্যে এক গতিশীল সামঞ্জস্য আমাদের রাখতেই হবে। ভারত সরকার নিশ্চিতরূপে ধাপে ধাপে লকডাউন তোলার কথাই ভাবছে। তাই, শোনা যাচ্ছে, ৩ মে এই লকডাউন উঠে গেলেও গণপরিবহণ ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হবে না। অন্ততপক্ষে, যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল এখনি শুরু হবে না।

এইখানেই, বিশেষ করে, পরিযায়ী শ্রমিক ও অন্যান্য কারণে বিভিন্ন রাজ্যে আটকে পড়া মানুষদের কথা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। এই সঙ্গেই গণবন্টন ও রেশন ব্যবস্থার কথাও এই জরুরিকালীন সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সঙ্গে সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও আইন শৃঙ্খলার বিষয়গুলি তো আছেই। এই প্রেক্ষাপটেই ‘সামাজিক জরুরিঅবস্থা’র বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করা খুবই প্রাসঙ্গিক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোদিজী লকডাউনের এই পরিস্থিতিকে সামাজিক জরুরি অবস্থা বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আমরা জানি, ভারতব্যাপী এই লকডাউন চালু হয়েছে কেন্দ্রীয় জাতীয় বিপর্যয় আইন- ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এ্যাক্ট, ২০০৫ অনুযায়ী। সারা ভারতে জরুরি ভিত্তিতে এই প্রথম এই আইন লাগু হয়েছে। আবার, সেই সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্য মহামারী রোগ আইন- এপিডেমিক ডিজিজেস এ্যাক্ট, ১৮৯৭ লাগু করেছে। সেই জন্যই প্রধানমন্ত্রী এই লকডাউনকে জরুরিঅবস্থা হিসাবে বলেছেন। কিন্তু, ‘সামাজিক’ কেন? কারণ, এই জরুরিঅবস্থা সাংবিধানিক ভাবে ৩৬০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অর্থনৈতিক কারণে নয়, বা ৩৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ, সশস্ত্র বিদ্রোহ হেতু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির জন্যও নয়। আবার, ৩৫৫ ও ৩৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে ধরনের জরুরি অবস্থার কথা রাজ্যগত ভাবে সংবিধানে বলা হয়েছে, এই ব্যবস্থা তাও নয়। এইজন্যই এই লকডাউন সাংবিধানিকভাবে জরুরিঅবস্থার সঙ্গে তুলনীয় নয়। কিন্তু, এই লকডাউনের ব্যাপ্তি ও অভিঘাত হয়তো বা তার থেকেও বেশি। সেই কারণেই এই লকডাউনের পর্যালোচনা খুবই জরুরি।

সাংবিধানিক ভাবে ভারত একটি কেন্দ্রায়িত যুক্তরাষ্ট্র, যা স্বাভাবিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রীয়; কিন্তু জরুরি অবস্থার মতো বিশেষ সময়ে এককেন্দ্রিক। এখানেই প্রশ্ন, এই লকডাউনের সময় ভারত কতোটা এককেন্দ্রিক হয়ে এই জরুরি অবস্থার মোকাবিলা করতে পারছে? কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোর মধ্যে এবং বিভিন্ন রাজ্যগুলোর নিজেদের মধ্যে কতোটা এককেন্দ্রিক সমন্বয় গড়ে তোলা যাচ্ছে? যে সমবায়িক যুক্তরাষ্ট্রীকতা বা কোঅপারেটিভ ফেডারালিজমের কথা বলা হয়, তা এই লকডাইনে কতোটা কাজ দিচ্ছে?

ভারতের সংবিধানের ২৪৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সপ্তম তপসিল যদি পর্যালোচনা করা যায়, তবে বোঝা যায় যে, মানুষের মৌলিক চাহিদা, যেমন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা – এগুলো পূরণের দায়িত্বজনিত আইনি ব্যবস্থা রাজ্যের অধিকারে। তার সঙ্গে, আইন শৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য, হাসপাতাল, ভূমি, কৃষি, সেচ, সমবায়, বাজার, গণবন্টন, পঞ্চায়েত, পৌরসভা ইত্যাদিও রাজ্য তালিকাভুক্ত। আবার, বন, শিক্ষা, দাম নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ, সামাজিক সুরক্ষা, আর্থিক ও সামাজিক পরিকল্পনা, জনসংখ্যা ও পরিবার ইত্যাদি যৌথ তালিকাভুক্ত। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করার প্রাথমিক দায়িত্ব রাজ্য ও তার অধীনে স্থানীয় স্তরের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, যেমন, পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলির।

এখানে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, লকডাউনের মতো অস্বাভাবিক জরুরিঅবস্থা কালে এইসমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ভাবে রাজ্যভিত্তিক হয়ে ভারতব্যাপী অতিমারীকে (প্যানডেমিক) কতোদূর মোকাবিলা করতে সক্ষম? এবারে কিছু জলন্ত ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা যাক।

লকডাউনের প্রথম থেকেই আমরা পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা দেখছি। ভারতের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও এটা প্রায় নিশ্চিত যে, বিভিন্ন রাজ্যে ছড়ানো এই ধরনের শ্রমিকদের সংখ্যা এই মুহূর্তে কয়েক কোটির কাছাকাছি। এটা ঠিক, লকডাউনের আগে তাদের সবাইকে যদি নিজ নিজ রাজ্যে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতে হতো, তাহলে লকডাউন কতোদিন যে পিছিয়ে করতে হতো, তা অনুমান করাও কঠিন। তা সম্ভব ছিল না। সেই জন্য সমস্ত রাজ্যের সরকারের উপরেই এই সব শ্রমিকদের দেখ-ভালের দায়িত্ব আছে। ঠিক এখানেই প্রশ্ন, এইসব শ্রমিকদের জন্য খাদ্য, বাসস্থান ও নগদ কিছু টাকার ব্যবস্থা কতোটা সুষ্ঠ ভাবে করা হচ্ছে? কেন সাময়িকভাবে তাদের রেশন কার্ড দেওয়া যাচ্ছে না? পরে তাদের জন্য ‘এক দেশ, এক রেশনকার্ড’ চালু করা যাবে না কেন? ইন্টার-স্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স এ্যাক্ট, ১৯৭৯ অনুযায়ী তাদের কেন উপযুক্ত আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে না? এমনকি ভোটের সময়ও এরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করা থেকে আইনি কারণে বঞ্চিত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রীকতার নামে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কেন? আসলে এই লকডাউন পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের বিভিন্ন সরকারের উদাসীনতা ও নিস্ক্রিয়তাকে প্রকট করে দিয়েছে।

এবারে, গণবন্টন ও রেশনিং ব্যবস্থা। ভারত সরকার যেমন বিনামূল্যে চাল-ডালের ব্যবস্থার কথা বলেছে, তেমনি  রাজ্য সরকারগুলিও রেশনের মাধ্যমে আরো খাদ্য-সামগ্রী দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কোথাও একটা সমন্বয়ের অভাব আছে। এফসিআই ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে সমন্বয় হচ্ছে না; আবার বন্টন ব্যবস্থার ত্রুটি ও দুর্নীতির জন্য সাধারণ মানুষ সব জায়গায় ঠিক ভাবে রেশন সামগ্রী পাচ্ছে না। করোনা ক্রাইসিস অনেক কিছুর মতো ভারতে গণবন্টন ব্যবস্থার অনিয়ম, অব্যবস্থা ও সীমাবদ্ধতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এর থেকে উত্তরণের পথ কি?

করোনা ক্রাইসিস সবথেকে বেশি আঘাত করেছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। এটা ঠিকই যে, এইধরনের অতি সংক্রামক অতিমারী পৃথিবীতেই বোধহয় এই প্রথম দেখা গেল। আমরা এখন সবাই ‘বিশ্বগ্রামবাসী’ – ‘গ্লোবাল ভিলেজ সিটিজেন’! তাই, কোভিড-১৯ সহজেই বিশ্বযাত্রী হয়ে বিশ্বের কোণায় কোণায় পৌঁছে গেছে। কোনো দেশেই এ ধরনের অতিমারীর জন্য স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। তাই সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য প্রাথমিকভাবে লকডাউন করা ছাড়া উপায়ও ছিল না। কিন্তু, আমাদের দেশে সমস্যা আরো অনেক গভীর। আগেই জেনেছি, জনস্বাস্থ্য, হাসপাতাল ইত্যাদি রাজ্য তালিকাভুক্ত। একেক রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো একেক রকম। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কেন্দ্রীয় স্তরের সঙ্গে রাজ্য স্তরের সমন্বয়ের অভাব। এই অবস্থাতেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, করোনা পরীক্ষার কিট, পিপিই, পরিসংখ্যান নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য চাপান-উতর। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?

আইন শৃঙ্খলা যেহেতু রাজ্য সরকারের অধীনে, তাই এই লকডাউনকে সার্বিক ভাবে সফল করার দায় ও দায়িত্বও রাজ্য সরকারগুলোর উপরেই বর্তায়। কিন্তু অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, আপ্রাণ চেষ্টা করেও পুলিশ তা করতে পারছে না। জনসাধারণের একাংশ লকডাউনের নিয়মবিধি মানছে না, স্বাস্থ্য-কর্মীদের সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার করছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের সময় যেমন কেন্দ্রীয় আধা-সেনা নামানো হয়, দরকার থাকলেও রাজ্য সরকারগুলো তা ব্যবহার করছে না।

এসবের প্রেক্ষাপটেই এই সামাজিক জরুরিঅবস্থার সময় কেন্দ্রায়িত বিকেন্দ্রীকিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এটা ঠিকই যে, কেন্দ্রীয় বিপর্যয় আইন অনুযায়ী কেন্দ্র সরকার কিছু কিছু ব্যবস্থা নিতে পারে; কিন্তু, তা নিশ্চয় সাংবিধানিক ব্যবস্থায় যে ধরনের জরুরিঅবস্থার কথা বলা হয়েছে তার বাইরে গিয়ে নয়। এরই মধ্যে ভারত সরকার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা ও মর্যাদা দেওয়ার জন্য মহামারী আইন, ১৮৯৭ সংশোধন করে মহামারী রোগ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২০ – অর্ডিন্যান্স জারি করেছে, যাতে তাদের উপর হামলাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যায়।

কিন্তু, বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় এই ধরনের জরুরিঅবস্থায় কেন্দ্রায়িত বিকেন্দ্রীকিত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা লাগু করার অন্য কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না। সেখানেই ভবিষ্যতে আমরা কোন ধরনের পথ বেছে নেব, তার উপরেই নির্ভর করছে ভবিষ্যতে এই ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলা করার তথা জনগণের মৌলিক অধিকার ও প্রয়োজনগুলো মেটানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতীয় নাগরিকত্ব একক; আমরা সবাই ভারত রাষ্ট্রের নাগরিক, কোনো একটি রাজ্যের নয়। আর, ভারত এক যুক্তরাষ্ট্র- ‘ইউনাইটেড স্টেটস’ নয়, বরং একটি ‘ইউনিয়ন’- একীভূত রাষ্ট্র-সত্তা, যা নাগরিকরা গড়ে তুলেছে; যেখানে ‘ইউনিয়ন অব স্টেটস’ বলতে আক্ষরিক অর্থে রাজ্যগুলোর একীভূত সত্তা বলা হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তা সব নাগরিকদের একীভূত রাষ্ট্র-সত্তা, যেখানে রাজ্যের চিরন্তন অস্তিত্বকে সাংবিধানিক ভাবে স্বীকার করা হয় নি।

ভবিষ্যতের পথ অবশ্যই কেন্দ্রিকভাবে বিকেন্দ্রীকিত একীভূত যুক্তরাষ্ট্রীয়তা – সেন্ট্রালি ডিসেন্ট্রালাইজড ইউনিফায়েড ফেভারালিজম – যেখানে জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণের জন্য ও জরুরিঅবস্থার উপযুক্ত মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন ধরনের ইউনিফায়েড সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে যা রাজ্য-সাপেক্ষ নয়, বরং নাগরিক তথা রাষ্ট্র-সাপেক্ষ।