খালিস্তান আন্দোলন (১৪): শেষের সেদিন ভয়ংকর, অপারেশান ব্লু স্টার ২

– চিন্ময়ানন্দ অবধূত

(১৩ম পর্বের পর)

ওয়েস্টার্ন কমান্ডের প্রাক্তন কমান্ডার ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস কে সিনহা অপারেশন ব্লু স্টারের আগে প্রস্তাব দিয়েছিলেন পুরো অপারেশন টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট করে দেখানো হোক। এতে ভারতের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে কোন পরিস্থিতিতে সরকার এইরকম পদক্ষেপ নিতে বাধ‍্য হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে সেনা অভিযান শুরু করার আগে তিনি স্বর্ণমন্দিরের ইলেকট্রিক এবং জলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে ছিলেন। সেনাবাহিনীর শিখ অফিসার এবং অনান্য সদস্যদের ধর্মানুভূতি যাতে আহত না হয়, তা নিশ্চিত করতে তিনি স্বর্ণমন্দিরের বাইরে একটি অস্থায়ী গুরদোয়ারা নির্মাণ করে, সেখান থেকে সেনাদের আশীর্বাদ নিয়ে অপারেশন শুরু করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সুন্দরজি, এস কে সিনহার প্রস্তাবে রাজি হননি, হয়তো তিনি এই সেনা অভিযানের সাফল্য কার‌ও সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাননি। তবে অপারেশন ব্লু স্টারের পরে সেনাবাহিনীতে সত‍্যিই শিখ অফিসার ও সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল।

অপারেশন ব্লু স্টারের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল শিখ তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। খালিস্তানি জঙ্গিদের অস্ত্র এবং রসদের সম্ভার, প্রতিরক্ষা ব‍্যবস্থা এবং ইন্টেলিজেন্স, সবকিছু সম্পর্কে তথ‍্য সংগ্রহ করা ছিল তার উদ্দেশ্য। অপারেশন ব্লু স্টারের ঠিক আগে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

ডোভালের দেওয়া তথ‍্যের ওপর ভিত্তি করে এস‌এফ‌এফ কমান্ডোদের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল ব্রারকে বলেছিলেন আকাল তখতের সামনের দিক এতটাই সুরক্ষিত যে সামনের দিক থেকে আক্রমণ চালালে অনেক প্রাণহানির সম্ভাবনা। তাই তারা আকাল তখত ভবনের পিছনের দেওয়ালে বিস্ফোরক দিয়ে ছিদ্র করে কমান্ডো পাঠানোর পক্ষে ছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর মাথারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। তাঁদের যুক্তি ছিল আকাল তখতের তাঁরা কোনও ক্ষতি হতে দেবেন না। বাস্তবে যদিও আকাল তখত ভবনের ভালোই ক্ষতি হয়েছিল।

এমনকি অপারেশন শুরু হ‌ওয়ার ঠিক আগে অমৃতসর বিএস‌এফের ডিআইজি জি এস পান্ধের, মেজর জেনারেল ব্রারকে বলেছিলেন আকাল তখতে যারা আশ্রয় নিয়েছে তারা সশস্ত্র জাঠ শিখ। তারা আকাল তখত রক্ষা করার জন্য প্রাণ দেবে কিন্তু আত্মসমর্পণ করবে না। বরং স্বর্ণমন্দিরের বিদ্যুৎ ও জলের সংযোগ কেটে দিয়ে আট দশ দিন ধরে অবরোধ করা হোক। ইতিমধ্যে ভিতরে আটকে থাকা সাধারণ মানুষকে বের করে নিয়ে আসা হোক। পান্ধের এবং ব্রার, দুজনেই ছিলেন জাঠ শিখ, জাঠ শিখদের মনস্তত্ব বেশী ভালো বোঝেন তাই নিয়ে একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

পান্ধের মেজর জেনারেল ব্রারের পাগড়িবিহীন মস্তক এবং ক্লিন শেভড গালের প্রতি কটাক্ষ করায় ব্রার রীতিমতো ক্রুদ্ধ হন। ব্রারের ক্রোধ আরও চরমে ওঠে যখন তিনি জানতে পারেন এই মিটিংয়ের পর পান্ধের দিল্লিতে একটি রিপোর্ট পাঠিয়ে বসে আছেন। ফলে পান্ধেরকে ডিআইজি পোস্ট থেকে অপসারিত করে ত্রিশ দিনের ছুটি দিয়ে পুলিশ প্রহরায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। (পান্ধেরের বিরুদ্ধে সিআইডি আর সিবিআই যৌথভাবে তদন্ত শুরু করে এবং তাঁর নয়াদিল্লির বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু কিছুই না পাওয়ায় তাঁকে ১৯৮৫ -এর শুরুতে মণিপুরে পুলিশের ডিআইজি করে পাঠানো হয়।)

তিন জুন সারাদিন কার্ফিউ জারি করা হয়। ইতিমধ্যে গুরচরণ সিং তোহরা একবার ভিন্দ্রান‌ওয়ালের সঙ্গে দেখা করে আত্মসমর্পণ করার উপদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু ভিন্দ্রান‌ওয়াল সরাসরি তাঁকে ইন্দিরা গান্ধীর দালাল বলে অপমান করে। ভিন্দ্রান‌ওয়ালে অবশ্য বুঝতে পেরেছিল তার সময় শেষ হয়ে এসেছে। সে নিজেও আত্মসমর্পণের থেকে নিজের প্রাণ দেওয়া শ্রেয় মনে করেছিল। আত্মসমর্পণ করলে শিখ জনগণ কখনও তাকে ক্ষমা করত না। অবশ‍্য ভিন্দ্রান‌ওয়ালে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া শেষ সাক্ষাৎকারে হুঙ্কার দেয়, “ভেড়া সবসময়েই দল বেঁধে থাকে, কিন্তু একদল ভেড়াকে খতম করার জন্য একটি সিংহ‌ই যথেষ্ট।”

স্বর্ণমন্দিরের অতিথিশালায় লোঙ্গোয়াল আর তোহরা অবশ্য আত্মসমর্পণের জন্য এসজিপিসির সেক্রেটারি ভান সিংকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ভান সিং প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের সামনে পড়ে পালিয়ে আসে। ইতিমধ্যে ভিন্দ্রান‌ওয়ালে এবং তার প্রতিদ্বন্দী বব্বর খালসার দলবল অতিথিশালার দখল নিয়ে নিয়েছে। ভিন্দ্রান‌ওয়ালে এমনকি লোঙ্গোয়ালের কাছে তার “দোভাষী” হরমিন্দর সিং সান্ধুকে পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে রেখেছে, আত্মসমর্পণ করলে ফল ভালো হবে না।

চার তারিখ পঞ্জাব থেকে সমস্ত সাংবাদিকদের হরিয়ানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

পাঁচ তারিখ সকাল সাতটার সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিক্সটিন্থ ক‍্যাভালারি রেজিমেন্টের কতগুলো ট‍্যাঙ্ককে জালিওয়ান‌ওয়ালাবাগের সামনের গলি দিয়ে স্বর্ণমন্দিরের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়।

মেজর জেনারেল ব্রারের কাছে প্রাথমিক চ‍্যালেঞ্জ ছিল স্বর্ণমন্দিরের বাইরের প্রতিরক্ষা ব‍্যবস্থা ধ্বংস করা। স্বর্ণমন্দিরের বাইরের সতেরখানা বিল্ডিং নিয়ে শাহবাগ সিং এই প্রতিরক্ষা ব‍লয় তৈরী করেছিল যার মধ্যে একটি ছিল টেম্পল ভিউ হোটেল। সেখান থেকে স্বর্ণমন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বারে অনায়াসে সৈন্যদের প্রবেশ প্রতিরোধ করা যেত। এর পাশেই ছিল ব্রহ্মবুটা আখড়া, এখান থেকেও স্বর্ণমন্দিরের প্রবেশদ্বারে অনায়াসে গুলিবর্ষণ করা যেত। এর পর ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরী দুটি মিনার এবং জলের ট‍্যাঙ্ক। এখানে শাহবাগ সিং স্নাইপার মোতায়েন করেছিল। স্বর্ণমন্দিরের চত্বরের যে কোনও জায়গায় এখান থেকে গুলি চালানো যেত।
দুপুরের দিকে সেনাবাহিনীর ৩.৭ ইঞ্চি ব‍্যাসার্ধের মাউন্টেন গানের শেল দিয়ে একটি জলের ট‍্যাঙ্ক ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু সেনা সংখ্যা কম থাকায় স্বর্ণমন্দিরের সংলগ্ন সতেরোটি বিল্ডিংয়ের প্রতিটিতে অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। তাই স্বর্ণমন্দির দখল করার কয়েকদিন পর পর্যন্ত ঐসব বিল্ডিং থেকে গুলিবর্ষণ চলতে থাকে।

সন্ধ্যা সাতটার সময় মাউন্টেন গানের শেল আর একটি জলের ট্যাঙ্ক আর মিনারদুটো উড়িয়ে দেয়, যেখান থেকে খালিস্তানি জঙ্গিরা ক্রমাগত সেনাবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে বিএসএফ আর সিআরপিএফ স্বর্ণমন্দির চত্বরের দক্ষিণ প্রান্তের হোটেল টেম্পল ভিউ আর ব্রহম বুটা আখরার দখল নিয়ে নেয়।

যাইহোক স্বর্ণমন্দির সংলগ্ন ঘন্টা ঘর বা ক্লক টাওয়ারের প্রবেশদ্বার সুরক্ষিত মনে হলে ব্রার সেখানে ট‍্যাঙ্ক ঢোকানোর অনুমতি দেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণমন্দিরের দেওয়ালের ওপর পজিশন নেওয়া জঙ্গিরা ট‍্যাঙ্কের ওপর মর্টার চার্জ করে।

ইতিমধ্যে আকাল তখতের পিছনের সরু গলি দিয়ে প‍্যারামিলিটারি কমান্ডোরা আকাল তখতে ঢোকার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু কয়েকজন কমান্ডো আকাল তখতের ছাদে উঠতে পারলেও প্রবল গুলিবর্ষণের সম্মুখীন হয়ে ফিরে আসতে বাধ‍্য হয়।

অমৃতসরে উপস্থিত একমাত্র সাংবাদিক সুভাষ কারপেকার (এনার নাম পুলিশের লিস্টে ছিল না) সন্ধে সাতটা নাগাদ প্রথম শববহনকারী গাড়িকে তিনি ছটিবিন্দ শ্মশানের দিকে যেতে দেখেন। মনে রাখতে হবে তখনও কিন্তু সেনাবাহিনী স্বর্ণমন্দির চত্বরে ঢুকতে পারেনি। পোড়া মাংসের কটু গন্ধ ভেসে আসতে থাকে স্বর্ণমন্দিরের দিক থেকে।

হরমিন্দর সাহেবের নকশা

রাত দশটার সময় মেজর জেনারেল ব্রার মনস্থির করেন এবার স্বর্ণমন্দিরে চত্বরে কমান্ডো অভিযান চালানো হব । সেই হিসেবে প্রথমে পাঠানো হয় প‍্যারাশ‍্যুট রেজিমেন্টের ফার্স্ট ব‍্যাটেলিয়ন কমান্ডোদের। কিন্তু ভিতরে ঢোকার সিঁড়ির দুই পাশেই শাহবাগ সিং লাইট মেশিনগান ফিট করে রেখেছিলেন। এল‌এমজির গুলিতে অনেক কমান্ডোর মৃত্যু হয়। যারা ঢুকতে পেরেছিল তাদের অবস্থা হয় একদম “সিটিং ডাক” এর মত, কেননা তারা সরোবরের দক্ষিণ দিকের বিল্ডিংয়ে জঙ্গিদের বন্দুকের পাল্লায় চলে এসেছিল।

এদিকে যারা বেঁচে যায়, তাদের আবার পাঠানো হয় স্বর্ণমন্দিরে। এবারে তাদের সঙ্গে যায় টেন্থ ব‍্যাটেলিয়ন অফ গার্ড, যার নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ইসরার খান।

প্রবেশদ্বারের ভিতরে ঢোকার সিঁড়ির দুই পাশের জঙ্গিদের খতম করা হলেও আকাল তখত, হরমন্দির সাহিব ভবন এবং দক্ষিণ প্রান্তের অন্যান্য বিল্ডিং থেকে জঙ্গিরা সহজেই সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করতে পারছিল। ইসরার খান এইসব বিল্ডিংয়ে গুলি চালানোর অনুমতি প্রার্থনা করলেও ব্রার তা নাকচ করে দেন, কেননা এক্ষেত্রে স্বর্ণমন্দিরের ক্ষতি হ‌ওয়ার সম্ভাবনা ছিল।এরপর ছিল ম্যানহোল থেকে আচমকা মেশিনগানের ফায়ারিং আর লুকোনো স্নাইপার (দূরপাল্লার বন্দুক) অ্যাটাক। শাহবাগ সিং, আকাল তখত ভবনের চারিদিকে মাটির দশ ইঞ্চি উপরে মেশিনগান বসানোয় ক্রলিং বা মেঝেতে বুকে হেঁটে এগোনোও ছিল অসম্ভব। প্রায় এক পঞ্চমাংশ সেনার মৃত্যু হয়।

ব্রার তখন পরিকল্পনার পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। সরোবরের চারপাশের পথ পরিক্রমার বদলে তিনি পাশের ভবনের একতলা এবং ছাদের দখল নিতে বলেন। এর ফলে দক্ষিণ দিকের ভবনগুলোতে পজিশন নেওয়া কিছু জঙ্গিদের খতম করা সম্ভব হলেও আকাল তখত আর স্বর্ণমন্দিরের থেকে গুলিবর্ষণ অব‍্যহত ছিল।

এরপরও কিছু কমান্ডো আকাল তখতের সামনের উঠোনে পৌঁছাতে পেরেছিল, কিন্তু শাহবাগ সিং আকাল তখত এবং তার বিপরীতে তোষাখানাকে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করেছিলেন। যেসব সেনা এবং কমান্ডোরা আকাল তখতের সামনে পৌঁছতে পেরেছিল, জঙ্গিদের গুলিতে তাদের এক তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়।

ইতিমধ্যে মাদ্রাজি রেজিমেন্ট পূর্ব দিক দিয়ে স্বর্ণমন্দির চত্বরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, আর ফিফটিন্থ ডিভিশন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল উত্তর দিক দিয়ে ঢোকার। কুমায়ুন রেজিমেন্ট হোস্টেল কমপ্লেক্সে জঙ্গিদের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছিল, আর বিহার রেজিমেন্ট স্বর্ণমন্দিরের চারপাশে একটি সুরক্ষাবলয় সৃষ্টি করেছিল।

আক্রমণের তীব্রতা বাড়ানোর জন্য সুন্দরজি এবং দয়াল সেভেন্থ গাড়োয়াল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সেনাকে ব্রারের কমান্ডে পাঠালেন। স্বর্ণমন্দিরের ভিতরে এদের নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এ কে দেওয়ান। ব্রিগেডিয়ার দেওয়ান বুঝতে পেরেছিলেন দক্ষিণ দিক দিয়ে জোরদার আক্রমণ চালানো গেলে আকাল তখতে প্রবেশ করা সম্ভব হতে পারে। তাই তিনি আরও দুই কোম্পানি সেনা পাঠাতে অনুরোধ করলেন। এবার দুই কোম্পানি কুমায়ুন রেজিমেন্টের সেনা পাঠানো হল। কিন্তু যদিও পরিক্রমার উত্তর এবং দক্ষিণ দিক সেনাবাহিনীর দখলে চলে গিয়েছিল এবং ১৩৭ জন সেনার মৃত্যু হয়েছিল, আকাল তখত তখনও সেনাবাহিনীর অধরা। ইতিমধ্যে ছয় তারিখ ভোর তিনটার সময় মাদ্রাজ রেজিমেন্ট পূর্ব দিক দিয়ে স্বর্ণমন্দির চত্বরে ঢুকতে সমর্থ হয়েছে এবং আকাল তখতের ওপর আক্রমণ জোরদার হয়েছে, কিন্তু আকাল তখতের প্রতিরক্ষা যে এতটা মজবুত তার সম্পর্কে সেনাবাহিনীর কোনও ধারণা ছিল না।

হতাহতের গ্রাফ ক্রমশ উর্ধ্বগামী হ‌ওয়ায় ব্রিগেডিয়ার দিওয়ান, ব্রারকে স্বর্ণমন্দিরের ভিতরে ট‍্যাঙ্ক পাঠানোর অনুরোধ করলেন। ব্রার ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছিলেন এই শুধুমাত্র সেনাবাহিনী পাঠিয়ে আকাল তখত দখল কার্যতঃ অসম্ভব। কিন্তু ট‍্যাঙ্ক পাঠানোর আগে সুন্দরজি দিল্লির স্পেশাল অপারেশন রুমের যোগাযোগ করলেন, যেখানে স্বর্ণমন্দিরের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখছিলেন উপপ্রতিরক্ষা মন্ত্রী কে পি সিং দেও এবং তাঁর সহকারী রাজীব ঘনিষ্ঠ অর্জুন সিং। কেন্দ্রীয় সরকার নিজেও ট‍্যাঙ্ক পাঠানো নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। দুইঘন্টা পর সরকার ট‍্যাঙ্ক পাঠানোর অনুমতি দেয়।

মেজর জেনারেল ব্রার অবশ্য এর মধ্যে একটি স্কট ওটি সিক্সটি ফোর আর্মার্ড পারসোনাল কার (APC) পাঠিয়েছিলেন আকাল তখত ভবনে। কিন্তু আকাল তখতের থেকে উৎক্ষিপ্ত একটি চাইনিজ রকেট এপিসিকে অচল করে দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ধারণা ছিল না জঙ্গিদের এই পর্যায়ের প্রস্তুতি রয়েছে।

পরেরদিন ভোরে সাতটি বিজয়ন্ত ট্যাঙ্ক স্বর্ণমন্দির চত্বরে প্রবেশ করে আকাল তখতের দিকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা পরে আকাল তখতের ধ্বংসাবশেষ দেখে অনুমান করেছিলেন, অন্ততঃ আশিটি উচ্চ ক্ষমতাবিশিষ্ট গোলা আঘাত করেছিল আকাল তখত ভবনকে। আকাল তখতের স্বর্ণমন্ডিত গম্বুজটি সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের সময়কার সূক্ষ্ম মার্বেল পাথরের এবং কাঁচের কারুকার্য ধ্বংস হয়ে যায়। একটার পর একটা শক‌ওয়েভ আকাল তখত ভবনের ভিত পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিতে থাকে। জঙ্গিরা বাধ‍্য হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং ভারতীয় সেনা এবং কমান্ডোদের বুলেটের শিকার হয়।

 

জঙ্গিদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আকাল তখতের থেকে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়। তাভলীন সিং পরে মন্দিরের পুরোহিত এবং ভিন্দ্রানওয়ালের বাহিনীর যারা তখনও জীবিত ছিল, তাদের থেকে জানতে পারেন, ভিন্দ্রানওয়ালে, শাহবাগ সিং আর অমৃক সিং সমেত ত্রিশ জন নিজেদের “আত্মোৎসর্গ” করার উদ্দেশ্যে ছয় তারিখ সকালে সেনাবাহিনীর বুলেটের সামনে চলে আসে। ইতিমধ্যে তারা বুঝতে পেরেছিল যদি তারা বেঁচে থাকে, তাদের জন্য আকাল তখতের যে ক্ষতি হয়েছে, শিখ সম্প্রদায় এজন্য তাদের ক্ষমা করবে না।

ভিন্দ্রান‌ওয়ালের মৃতদেহ

যদিও সরকারি ভাষ‍্য অনুযায়ী ছয় তারিখ রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী আকাল তখতের ভিতরে ঢুকে ভিন্দ্রান‌ওয়ালে এবং শাহবাগ সিংয়ের মৃতদেহ আবিষ্কার করে।

ছয় তারিখ সকালে, যখন ব্রিগেডিয়ার দেওয়ান আরো কয়েকজন স্বর্ণমন্দিরের লাইব্রেরীর সামনে প্রাতরাশ করছেন, লাইব্রেরী থেকে আসা একটি স্নাইপারের বুলেটের থেকে অল্পের জন্য ব্রিগেডিয়ার দেওয়ান বেঁচে যান। মাদ্রাজ রেজিমেন্টের কয়েকজন সেনা মেশিনগান দিয়ে প্রত‍্যুত্তর দেয়। বিকেল চারটা পর্যন্ত খন্ডযুদ্ধের পর তিন জন জঙ্গিকে খতম করা হয়। এই লড়াইয়ের সময় আগুন ধরে যায় লাইব্রেরীতে। পুড়ে যায় স্বয়ং শিখ গুরুদের নিজের হাতে লেখা পবিত্র গ্রন্থসাহিবের পান্ডুলিপি।

ছয় তারিখ সন্ধ্যার মধ্যেই ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বর্ণমন্দির চত্বরের দখল নেয়। মেজর জেনারেল ব্রার নিজে স্বর্ণমন্দির চত্বরে প্রবেশ করেন, কিন্তু পরিক্রমার চারপাশের বিল্ডিংগুলোয় তখনও কিছু জঙ্গির সঙ্গে সেনাবাহিনীর গুলির লড়াই চলছে।

(ক্রমশ)

তথ্যসূত্রঃ

1. Amritsar. Mrs Gandhi’s Last Battle, Mark Tully and Satish Jacob

2. The Khalistan Conspiracy, GBS Sidhu

3. Operation Blue Star, K.S.Brar

4. The Punjab Story, Edited by KPS Gill

5.India, The Siege Within. M. J. Akbar

6. Durbar, Tavleen Singh