অনঘ্ন

অনঘ্না সামনের টেরাসে বেরিয়ে এল। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুরো ছাদ। রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। আজই বিকেলে এখানে এসেছে সে। পুরুলিয়া শহর থেকে ৪৫ কিমি মত দূরে অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে এই স্থান। কলকাতার ব্যস্ত নাগরিকের কাছে প্রায় অনাবিষ্কৃত। পুরুলিয়া শহর থেকে ঘন্টা খানেকের জার্নিতে মালভূমির নেশা ধরানো শোভা দেখতে দেখতে নাগরিক যন্ত্রণার কথা অনায়াসে ভুলে যাওয়া যায়। এরকমই নির্জন প্রান্তে এই বাংলোটা।  মনে মনে সৈকতের তারিফ করে এটার সন্ধান দেওয়ার জন্য। এই ছাদটা বাংলোর প্রবেশ পথের ডান দিকে, অর্থাৎ পশ্চিমে। সেদিকেই মুখ করে আছে অনঘ্না। পুরো বাংলোটাই বাগান দিয়ে ঘেরা। তারপরে পাঁচিল, তারপরে রাস্তার ওপারে কিছুদূর ফাঁকা মাঠ, তার পর জঙ্গল। বেশ গা ছমছমে পরিবেশ। আবার চাঁদের আলোয় অদ্ভূত মায়াবী লাগছে। দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। একটা রাতজাগা পাখি কর্কশ সুরে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। অপলক তাকিয়ে থাকে সে। পরিবেশটাই কেমন যেন নেশা লাগানো।

“আপনি কি আজই এসেছেন?” কিছুটা চমকেই উঠেছিল অনঘ্না! ঘুরে তাকিয়ে দেখে একজন সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। গায়ে চাদর, হাতে ছড়ি। বাহ্যদৃশ্য বলে বয়স কম করে পঞ্চাশ, কিন্তু চাঁদের আলোয় যা দেখা যাচ্ছে তাতে বেশ দৃঢ় স্বাস্থ্যের অধিকারী বলেই মনে হচ্ছে। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। “হ্যাঁ, কেন বলুন তো?” ভদ্রলোককে একবার আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে উত্তর দেয় সে।

-“এই এমনি। আগে তো আপনাকে কখনো দেখিনি।”

-“হ্যাঁ এই প্রথম এলাম এখানে। খুব সুন্দর জায়গা।”

-“একদিনে আর কিই বা দেখলেন? থাকুন কটা দিন। সব কিছু দেখলে আর ফিরতে ইচ্ছে করবে না।”

কে এই লোকটা? এও কি এখানে বেড়াতে এসেছে? মনে মনে ভাবে অনঘ্না।

-“হ্যাঁ সেরকমই তো মনে হচ্ছে। আপনিও কি বেড়াতে এসেছেন এখানে?”

-“হ্যাঁ সেরকমই বলতে পারেন। আবার নাও বলতে পারেন।”

-“মানে?”

-“মানে হল যে এটাই আমার দেশ। যদিও এখানে বেশী থাকিনি আমি। কখনো কলকাতা, কখনো মুম্বই, কখনো বা নিউ ইয়র্ক বা ইওরোপ করেই কেটেছে।”

-“ও আচ্ছা। কি করেন আপনি?”

-“করতাম। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আইআইটি খড়গপুরের ফার্স্ট ব্যাচ আমরা।”

এতক্ষণ ভদ্রলোককে কিছুটা উটকো মনে হলেও এবার একটু কৌতুহল বোধ করে অনঘ্না। তাছাড়া ভদ্রলোকের কথার মধ্যে একটা আকর্ষণী ব্যাপার আছে। ধীরে ধীরে নিচু অথচ স্পষ্ট ব্যারিটোনে উচ্চারণ। শুনতে বেশ ভালোই লাগে।

-“বাহ। দারুণ তো।”

-“দারুণ কিনা জানিনা, তবে ওই ডিগ্রিটা নিঃসন্দেহে আমার কর্মজীবনকে বহুল পরিমাণে সমৃদ্ধ করেছিল। যাই হোক, আপনার পরিচয়?”

-“আমি অনঘ্না… অনঘ্না স্যান্যাল।”

-“অনঘ্না… অর্থাৎ যাকে হনন করা যায় না।”

-“হ্যাঁ, দাদু শখ করে রেখেছিলেন নামটা।”

-“আচ্ছা। কি করেন আপনি?”

-“আমি আর্কিওলজি নিয়ে পিএইচডি করছি।”

বলেই অনঘ্নার খেয়াল পড়ল ভদ্রলোকের নামটাই জানা হয়নি। কিন্তু জিজ্ঞেস করার ঠিক সাহস হল না। ভদ্রলোক কেমন যেন একটা প্রভাব বিস্তার করে ফেলছেন ক্রমশ।

-“আর্কিওলজি! আর্কিওলজির ছাত্রীরা নাকি খুব অদ্ভুত হয়ে থাকে। ভীষণ রহস্যময়।”

ভদ্রলোকের গলার স্বরে যেন একটা হালকা পরিবর্তন দেখা দিল। চাঁদের আলোয় অনঘ্না লক্ষ্য করল যেন হালকা হাসির আভা দেখা গেল ওনার ঠোঁটে।

-“তাই? প্রচুর আর্কিওলজির ছাত্রীর সংস্পর্শে এসেছেন মনে হচ্ছে?”

-“প্রচুর নয়, তবে একজনের কথা বলতে পারি।”

-“কে তিনি? আপনার স্ত্রী?”

-“না স্ত্রী না।”

-“তার মানে প্রেমিকা?”

-“প্রেমিকা বলা যায় কিনা জানিনা, তবে বলতেও পারো।”

-“বেশ ইন্টারেস্টিং তো! আপনাদের লাভ স্টোরি শুনতে ইচ্ছে করছে খুব।”

-“শুনবে? এক্সকিউজ মি! আপনাকে তুমি করে বলে ফেল্লাম!”

-“আরে ঠিক আছে। আমি আপনার থেকে অনেক ছোট। আপনি আপনি করলেই বরং কেমন লাগে।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে। তো তুমি শুনতে চাইলেই শোনাতে পারি।”

-“আপনার আপত্তি না থাকলে আমার আর কিসের আপত্তি?”

-“তবে চলো টেবিলটায় বসা যাক।” বলেই ভদ্রলোক ছাদের মাঝখানে বসানো টেবিলটায় বসে পড়লেন। অনঘ্না একটু সংকোচ বোধ করল! টেবিলে যে একটা জনি ওয়াকারের বোতল এনে রেখেছিল খেয়ালই ছিলনা! আর ভদ্রলোকের প্রথমেই সেটা চোখে পড়ল! হাতে তুলে নিয়ে বললেন-

-“জনি ওয়াকার! তুমি কি হুইস্কির ভক্ত নাকি?”

-“না মানে ওই একটা এনেছিলাম আর কি।”

-“তবে বলি শোনো, আমার সাথে তার প্রথম মোলাকাত হয়েছিল কিন্তু হুইস্কির মাধ্যমে। তবে ভারতীয় কোন মহিলার হুইস্কি প্রীতি দেখিনি আগে।”

-“আরে সেরকম না, আমি ওই কালে ভদ্রে খাই। বাই দ্য ওয়ে, এই কথাটার অর্থ হল তিনি ভারতীয় ছিলেন না, তাই তো?”

-“ইয়েস। তার বাবা ছিল চেক, আর মা পোলিশ। যদিও জার্মানীর নাগরিক ছিল সে।”

-“আপনি তারমানে জার্মানীতে ছিলেন তখন?”

-“হ্যাঁ। আচ্ছা যদি কিছু মনে না করো তো একটা নিপ নিতে পারি? মানে বহুদিন হুইস্কি ধরিনি, ডাক্তারের বারণ দেখিয়ে কেউ এনে দিতে চায় না।”

-“ডাক্তারের বারণ যখন…”

-“আরে ছাড়ো তো! উনি নিজেই বলেন কালেভদ্রে এক আধ পেগে কিছু হয়না। এরা একটু বেশীই সাবধানী!”

মনে মনে দ্বন্দ্ব থাকলেও অনঘ্না আর আপত্তিও করলনা। ভদ্রলোক নিজেই যখন বলছেন, তখন আপত্তি করতে গিয়ে যদি ওনার মেজাজ বিগড়ে গল্পের মুডটাই চলে যায়? আর তাছাড়া বেশ ঠান্ডা লাগছে। হালকা চুমুক দিতে দিতে গল্প শুনতেও মজা।

-“আচ্ছা আমি আরেকটা গ্লাস আনছি।”

-“দরকার নেই। তুমি তো দেখছি আগে থেকেই দুটো গ্লাস এনেছো।”

যাহ! ভুল করে দুটো গ্লাসই এনেছিল তবে!

-“বুঝলে হে, আজ মনে হচ্ছে ভাগ্যদেবী এই বুড়োর ওপর একটু বেশীই প্রসন্ন।”

-“কী রকম?” সিল খুলতে খুলতে জানতে চায় অনঘ্না।

-“এই যে এতদিন পর জমিয়ে গল্প করার কাউকে পেলাম, আবার সঙ্গে হুইস্কি। তাও আবার তোমার মত কারো সাথে বসে।”

-“আপনার বান্ধবীর সাথে কাটানো স্মৃতি মনে আসছে নাকি?”

কথাটা বলার সাথে সাথেই অনঘ্না বুঝতে পারল ভদ্রলোকের সাথে অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে সে। গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বলে সে।

-“হ্যাঁ তা বলতে পারো। তবে আমার পেগটা বেশী মোটা বানিও না। এই বয়সে পোষাবে না। নাহলে আমি নিট ব্লু লেবেল নিতাম।”

-“ওরে বাবা!”

-“আরে তখন মার্শাল প্ল্যান চলছে, বুঝলে কিনা? আমেরিকান কোম্পানি গুলোর কাছে তখন ইওরোপ একেবারে সোনার খনি। আমাদের জন্য আলাদা করে ব্লু লেবেল থেকে শুরু করে কনিয়াক, শ্যাম্পেন সবই আসত। গিনেসও।”

-“বাহ। আপনি তো খুব লাকি ছিলেন। কাস আমাকেও কেউ দিত এরকম।”

-“তুমি যে দেখি মারিয়ার মত বললে।”

-“মানে তিনি?”

-“হুম। সেও এরকম বলত। তুমি খুব লাকি।”

-“আমাকে তাহলে মারিয়ার মত মনে হচ্ছে?”

-“হ্যাঁ মিল তো অনেক আছে দেখছি।”

-“বাহ। ভাল লাগল শুনে। আচ্ছা আপনি গল্প শুরু করবেন কখন? ভীষণ এক্সাইটেড ফিল করছি যে!”

-“হ্যাঁ ভাল কথা বলেছো। বকবক হয়ে যাচ্ছে বেশী। দাঁড়াও একটু।”

বলে ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা পাইপ বের করে তামাক ঠাসলেন। এরপর একটা চকচকে লাইটার দিয়ে সেটা ধরালেন। এরপর একবার টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলতে শুরু করলেন-

***********

 

“আমার দেশ এখানে হলেও জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবই কলকাতায়। বাবা পেশায় আইনজীবী ছিলেন। এখানকার জমিদারীটা আমার ঠাকুরদা কিনেছিলেন। ছুটিতে বেড়াতে আসতাম এখানে। চার ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম সবার ছোট। আর সবাই তখনকার বনেদী বাড়ির প্রথা মেনে ডাক্তারী বা আইন পড়লেও আমি ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নিই। তবে কাঠখোট্টা ইঞ্জিনিয়ার হলেও কিছু প্রথা কিন্তু আমিই টিকিয়ে রেখেছি, যেমন এই পাইপ খাওয়া। বাকি সবাই তো যুগের তালে সিগারেটবিলাসী! আরে সিগারেট দিয়ে কি আর আভিজাত্য দেখানো যায়? তো যাই হোক পাশ করার পর অল্প কিছুদিন মুম্বইতে বাবার এক পরিচিতের কাছে কাজ করি। এরপর জেনারেল ইলেক্ট্রিকের চাকরি পেয়ে আমেরিকা চলে যাই। সেখানে বিভিন্ন প্রজেক্টে বছর খানেক কাটানোর পরে ইওরোপে পাঠানো হয়। ওই সময়ই নিউ ইয়র্কে প্রথম মেরিলিন মনরো কে সামনে থেকে দেখেছিলাম। ওহ, সে যে কি সৌন্দর্য না দেখলে বোঝা যাবে না। তার সামনে আজকের এই জোলি ফোলি সব তুচ্ছ।”

-“আর তিনি?” বলেই হিহিহিহি করে হেসে ওঠে অনঘ্না।

-“হাহাহাহাহা! উফ তুৃমি যে দেখি পুরো মারিয়া বনেই ছাড়বে! আরে উনি হলেন গিয়ে সেলিব্রিটি, সুদূর আাকাশের রামধনু, আর মারিয়া ঘাসের ওপর প্রজাপতি। দুটোর নো কমপ্যারিজন।”

-“হুম হুম। পলিটিক্যালি কারেক্ট অ্যানসার।”

-“তা তুমি কি ভাবলে আমাকে চেপে দিলে? ওটি হচ্ছে না।”

-“আচ্ছা আচ্ছা দেখা যাবে। তা তারপর কি হল বলুন।”  দ্বিতীয় পেগটা বানাতে বানাতে বলে অনঘ্না।

-“ইওরোপে আমাকে জার্মানিতে যেতে হয়। পোস্টিং হয় হামবুর্গে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধাক্কা কাটিয়ে তখন ইওরোপের পুনর্গঠন চলছে। মার্শাল প্ল্যানের দৌলতে প্রচুর ইনফ্রাস্টাকচারের কাজ চলছে। ফলে ইঞ্জিনিয়ারদের ব্যাপক চাহিদা। আমাদের কোম্পানি তখন পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরী করছে, রেলওয়ের কাজও করছে। তারই ইন্সটলেশন ও লোকাল রিসোর্স ট্রেনিংএর কাজ পড়ল আমার ওপর। বিভিন্ন ধরনের কাজ, ফলে শেখার সুযোগ প্রচুর। অল্পদিনেই আমার খুব ভাল লেগে গেল। কাজের পাশাপাশী এদিক ওদিক ঘোরাঘুরিও শুরু করলাম। বইএর দোকান, আর্ট গ্যালারী, এগুলো ছিল আমার প্রধান গন্তব্য, আর অবশ্যই পাব বা রেস্তোরাঁ। তো এমনি একদিন এক পাবে ড্রিঙ্ক নিয়ে বসে আছি এমন সময় ম্যানেজার এসে বললেন অসুবিধে না হলে একটা অনুরোধ রাখতে। বললাম ‘কি অনুরোধ?’

-‘এই ইনি অনেক্ষণ ধরে টেবল পাচ্ছেন না, যদি একটু আপনার টেবলটা শেয়ার করেন।’

আমি তাকিয়ে দেখি ছিপছিপে চেহারার এক সুন্দরী যুবতি দাঁড়িয়ে আছে। তো না বলার কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে আমি ঠিক আছে বলে দিলাম। মেয়েটি আমার উল্টোদিকের চেয়ারটাতে বসল। আমি কিছু বলার আগেই জিজ্ঞাসা করল- “বিদেশী মনে হচ্ছে?”

-‘হ্যাঁ।’

-‘কোন দেশ? ইন্ডিয়া?’

-‘হ্যাঁ, কিন্তু কিভাবে জানলেন?’

-‘জানিনা। বুঝে নিয়েছি।’

-‘কী রকম?’

-‘দূর! দেখে বোঝা যায় না?’

-‘হ্যাঁ, তা যায়।’

-‘ভারতের কোথা থেকে আসছেন?’

-‘ক্যালকাটা, বেঙ্গল…”

-‘আমি জানি কলকাতার সম্পর্কে। আগে ক্যাপিটাল ছিল।’

-‘বাহ। তা আপনার পরিচয়?’

-‘আমার নাম মারিয়া নোভাদেভ। আমি আর্কিওলজিতে পিএইচডি করছি। বাবার দিক থেকে চেক, মা’র দিক থেকে পোলিশ। আর আমার হোমটাউন মিউনিখ।’

-‘বাহ। আমি রাজোত্তম রায়চৌধুরী। পেশায় ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। জেনারেল ইলেক্ট্রিকে চাকরি করি।’

এরপর কিছুক্ষণের নীরবতা। অতঃপর ওয়েটার অর্ডার নিতে এলে তার হুইস্কি প্রীতির ব্যাপারে অবহিত হই। এমনিতে জার্মানরা বেজায় বিয়ার ভক্ত, আর চলে ওয়াইন। এর বাইরে আরো কিছু ড্রিঙ্ক চলে বটে, কিন্তু ব্রিটিশদের মত হুইস্কিপ্রীতি তাদের নেই। তবে জার্মান বিয়ারের প্রচুর ভ্যারাইটি আছে, আর বিশাল বড় বড় পাত্রে পরিবেশন করে। বিয়ারের প্রকারভেদ অনুযায়ী গ্লাস বা মাগের আকার নির্ধারিত হয়। তো যাই হোক, তাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে এই পাবটাতে খুব ভালো হুইস্কির প্রিপারেশন বানায়। এহেন পছন্দের মিল দেখে কথা এগোতে থাকে তরতর করে। এবং অল্প সময়েই দুজনে একে অপরের বেশ পরিচিত হয়ে যাই।”

এই পর্যন্ত বলে ভদ্রলোক একটু থামেন। অমঘ্না ওনার খালি গ্লাসটা ভর্তি করে দেয়। তারপর নিজেরটাও করে।

-“বাহ। আর্ট গ্যালারী, বুক স্টোর, সিনেমা, থিয়েটার হল, ওয়াইন টেস্টিং থেকে প্রেম শুরু হয় শুনেছি, আপনাদেরটা তো সেদিক থেকে বেশ অন্যরকম।”

-“হ্যাঁ, ওই তোমাদের ভাষায় যাকে বলে একটু হটকে।”

-“হিহিহি! আপনার মুখেও হটকে?”

-“কেন হে? শরীরটা বুড়িয়ে গেছে বলে কি মনটা তাজা থাকতে নেই?”

-“নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।” মাথা ওপর নীচ করে অনঘ্না।

-“হ্যাঁ তা না হলে আর এই মাঝরাতে তোমার মত বিউটিফুল ইয়াং লেডির সাথে বসে ড্রিঙ্ক করার সৌভাগ্য হয় না।”

-“হিহিহিহি। নাহলে আমারও এরকম একটা লাভ স্টোরি শোনার সৌভাগ্য হয় না।”

-“হাহাহাহা। গো যাই হোক, আমাদের গল্পে ফেরত আসা যাক। কোথায় ছিলাম যেন?”

-“ওই তো দুজনে একে অপরের বেশ পরিচিত হয়ে উঠলেন।”

-“হ্যাঁ। তো তারপর থেকে টুকটাক একসাথে এদিক ওদিক যেতেও শুরু করলাম। তখন অবশ্য এখনকার মত হুটহাট ডেটে টেটে যাওয়ার চল তেমন ছিলনা। জাস্ট আউটিংয়ে যাওয়া বলতাম আমরা। সে অর্থে ডেট মানে ভাল রকমের গিফ্ট দিতে হত। আসলে তখন ইওরোপ ভিক্টোরিয়ান পিউরিটির ধারনাগুলো থেকে সবে বেরোচ্ছে। যুদ্ধের প্রতিকূল পরিবেশে মহিলারাও কাজ করতে বেরিয়েছেন। যুদ্ধের সময় পুরুষ কর্মীর অভাব থেকে বহু কারখানাতে মহিলা কর্মী নিয়োগ করা হয়েছিল। আর পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে তখন অর্থনীতি ধীরে ধীরে পোক্ত হতে শুরু করেছে, এবং ভাল সংখ্যক কর্মরত মহিলার সৃষ্টি হয়েছে। এককথায় বলা যায় ফরাসী বিপ্লবের পরে আরেক দফা সামাজিক পরিবর্তন আসছে। তো এইরকম পরিবেশে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি আর কি। মারিয়া আর্কিওলজির ছাত্রী হলেও দর্শন ও সমাজতত্ত্ব বিষয়েও খুব আগ্রহ ছিল, আর আমার বাড়িতে এই সংক্রান্ত বইয়ের বিশাল কালেকশন ছিল। ফলে কাঠখোট্টা ইঞ্জিনিয়ার হলেও ছোটবেলায় এইগুলো পড়ার কারণে একটা ধারনা তৈরী হয়েছিল। যার কারণে অনায়াসে আমাদের মধ্যে এই ধরনের আলোচনা চলত। কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই দুজনে বেরিয়ে পড়তাম। শহরের বাইরে লং ড্রাইভেও যেতাম মাঝে সাঝে। তো এইভাবে চলছিল আর কি।”

-“লং ড্রাইভ! ওয়াও! আর হুইস্কি?” নিজের জন্য আরও একটা পেগ বানাতে বানাতে বলে অনঘ্না। হঠাৎ করেই ভীষণ খুশী বোধ করতে থাকে নিজের ভিতরে।

-“ওটা তো থাকতই। অফিসের পরে প্রতিদিন সন্ধ্যাতেই আমাদের আড্ডা হত। হয় কোন পাবে, নয়ত আমার কোয়ার্টারে। গল্প, হুইস্কি, ঘোরাঘুরি, তিনের মেলবন্ধন।”

-“আরে ওয়াহ! কাস আমারও এরকম কেউ থাকত!”

-“তুমি তো চাইলেই পাবে।”

-“চাচ্ছি তো! পাচ্ছি কই?”

-“আরে তোমার মত মেয়ের আবার বয়ফ্রেন্ডের অভাব।”

-“বয়ফ্রেন্ড হলেই কি চলে? আপনার মত কই?”

-“হাহাহাহা! আমার মত হলে তো অন্য ঝামেলা আছে।”

-“ঝামেলা আবার কিসের?”

-“সবটা তো শোনো আগে।”

-“আচ্ছা বলুন।”

-“তো এইভাবে চলতে চলতে একদিন তাকে মনের কথা জানিয়েও দিলাম। সি বিচে বসে, সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে। উত্তরে সেও জানাল যে সেও আমাকে ভালোবাসে। ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়ল। আমার বাড়িতে তখনও জানাইনি। বলতে পারো একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম। উনিশ ও বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে বাঙালী ছোকরার বিলেত গিয়ে মেম প্রেমের কাহিনী তখনও একেবারে জৌলুস হারায়নি। আমাদের পরিবারে উদারনৈতিক চর্চা থাকলেও এক কথায় করে মেম বউকে মেনে নেবে এরকমটা ভাবা একটু বেশীই আশা করা। যাই হোক পরবর্তী ছুটিতে দেশে গিয়ে তবেই এ ব্যাপারে মুখ খুলব বলে স্থির করেছিলাম। তবে বাড়িতে না হলেও আমার সহকর্মীদের জানিয়েছিলাম এবং তাকে প্রপোজের পরে একদফা পার্টিও দিতে হয়েছিল।”

-“তারপর?”

-“তারপরেই একবার মাস খানেকের জন্য মারিয়াকে বার্লিন যেতে হয়। ওখানে একটা ওয়ার্কশপ ছিল। যুদ্ধের সময় জার্মানি তথা গোটা ইওরোপ জুড়েই বহু প্রাচীন সৌধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। সেসবের পুনর্নির্মাণ চলছিল তখন। ফলে আর্কিওলজিস্টদের সেরা গন্তব্য তখন ইওরোপ। অন্যদিকে আমিও হঠাৎ করেই বেশ ব্যস্ত হয়ে যাই নতুন কিছু প্রজেক্টের দায়িত্ব এসে যাওয়ায়। দুজনেই এতটাই ব্যস্ত হয়ে যাই যে চিঠিপত্র লেখাও হয়ে ওঠেনি। অবশেষে এক রবিবার বিকেলে আমার দরজায় কেউ বেল বাজাল। খুলে দেখি মারিয়া দাঁড়িয়ে।

-‘কি মিস্টার একটা চিঠিও তো লিখতে হয়!’

-‘এই মানে কাজের চাপ…’

-‘হ্যাঁ কাজের চাপ তে বটেই। আমি তো ভাবলাম আমাকেই ভুলে গেছেন।’

আমি এই ব্যাপারে বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলাম না। ফলে মেয়েদের এই ধরনের অনুযোগের জবাব কিভাবে দিতে হয় সেটাও জানা ছিলনা।

-‘তুমিও তো পারতে একটা চিঠি লিখতে। তুমিও তো লেখোনি। ‘ মুখ ফসকে বলে ফেল্লাম কথাটা।

-‘এখন আমার দোহাই দেওয়া হচ্ছে? বলো না নিজেরই মনে হয়নি। আমার কথা ভাবতে কে বলেছে?’

নিজের অপক্ক কৃতকর্মের কথা উপলব্ধি করলাম। বুঝতে পারলাম কেন বিবাহিত বা প্রণয়াচ্ছন্ন পুরুষরা এমন ঝাঁঝহীন হয়ে পড়ে। অতঃপর একটি নাতিদীর্ঘ মানভঞ্জনের পালা শেষে একসাথে ডিনারের প্ল্যান করলাম। আসলে মেয়েদের এই আপাত যুক্তিহীন অভিমানগুলো মনোযোগ আকর্ষণের একটা উপায় মাত্র। কারো প্রতি অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। ঠিক যেমন পুরুষদের রাগ বা পজেসিভনেস। তো যাই হোক সেই রাতে মারিয়া নিজে হাতে পোলিশ ডিস বানাল। ওর দিদিমার কাছ থেকে শেখা। কালচারাল মিক্সের এই এক ভাল দিক।”

বলেই ভদ্রলোক আবার পাইপ ধরালেন। অনঘ্না এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল। এবার বলল-

-“আমি কিন্তু বাঙালী ছাড়াও কন্টিনেন্টাল আর চাইনিজও বানাতে পারি। হিহিহি।”

-“বাহ। এই বুড়োকে খাওয়ানোর প্ল্যান আছে নাকি?”

-“আপনাকে খাওয়ানোর প্ল্যান কার থাকবে না বলুন?”

-“ওই খাওয়াটাই আছে শুধু। অন্য কিছুর সাধ থাকলেও সাধ্য নেই।”

-“হিহিহিহি।”

-“তো যাই হোক সেদিন সন্ধেটা দারুনভাবে কাটল। আমার জীবনের সবচেয়ে রোমান্টিক, উত্তেজক সন্ধে বলা যায় ওটাকে। সবকিছু সারতে সারতে বেশ রাত হয়ে গেল। ঠিক হল মারিয়া রাতে থেকে যাবে। সেসময়ে অনাত্মীয় কোন মহিলা একা একজন সিঙ্গল ছেলের কোয়ার্টারে রাতে থাকবে, এটা খুব একটা সহজলভ্য ছিল না। তবে আমাদের আমেরিকান কোম্পানি তখন মুক্ত হাওয়ার প্রতীক। ফলে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু সে কারণে নয়, স্রেফ অনভ্যস্ততা এবং নতুন কিছুর উত্তেজনাটা ব্যাপক হারে মনে দাগ কেটেছিল।”

-“এক্সকিউজ মি। আপনারা মানে সেদিন প্রথম একসাথে রাত কাটান?” প্রশ্নটা করেই অনঘ্নার মনে হল যে একটু বেশীই অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছে। তিনখানা পেগের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

-“হ্যাঁ, ওই আরকি। তখন তো এরকম সিঙ্গেল ফ্ল্যাট পাওয়াও দুষ্কর ছিল। তোমাদের প্রজন্মের কাছে তো এসব জলভাত।”

-“বাহ। ওই সময়টা বেশ সুন্দর ছিল তবে। উত্তেজনায় ভরপূর।”

-“আরে একটা বড় পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ তখন। খুব দ্রুত তখন চারপাশটা পাল্টে যাচ্ছে। যাই হোক পরের দিন সকালে বেশ এমব্যারাসড লাগছিল। মারিয়ার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। যদিও ও যেন আরো বেশী উচ্ছল হয়ে গিয়েছিল। ব্রেকফাস্ট বানিয়েছিল। তারপরে চলে গিয়েছিল।”

-“আরে ওয়াহ! দারুণ মিষ্টি রোমান্স তো!”

-“মিষ্টি? হাহাহা! তা বটে।”

-“হুম। তারপরে কি হল?”

-“তারপরে ঘনিষ্ঠতা আরো বৃদ্ধি পেল। প্রায়ই মারিয়া আমার কোয়ার্টারে আসতে লাগল। কখনো কখনো আমার কলিগরাও আসত। একসাথে পার্টি হত। মারিয়া সাধারণত রাতে থেকে যেত। আমার বন্ধুরা দু একজন পাকাপাকি একসাথে থাকার পরামর্শ দিতে লাগল। এরমধ্যে একবার উইকেন্ডের আগে দিন তিনেকের ছুটি ম্যানেজ করে দুজনে একসাথে সুইজারল্যান্ডও ঘুরে এসেছি। অবশেষে একদিন…”

ভদ্রলোক একটু থামেন।

-“অবশেষে কী?”

-“বলছি।” এক চুমুকে বাকি পানীয়টুকু শেষ করেন তিনি। অনঘ্না কালবিলম্ব না করে ভর্তি করতে গেলে হাত তুলে ওকে থামিয়ে দেন তিনি।

-“আপাতত থাক। এবার যা বলব ভাল করে শুনবে। হয়ত অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।”

-“তবে তো শুনতেই হবে।”

-“হুম। একদিন রাতে, তারিখটা ছিল ২৪ নভেম্বর, অর্থাৎ আজকের তারিখ, এরকমই একটা রাত, তবে শহরে, পার্টি ছিল আমার কোয়ার্টারে।”

-“আচ্ছা, এই কারণে এত মনে পড়ছে? সুন্দর রাত, সেম তারিখ, আর আমি আার্কিওলজির ছাত্রী। হিহিহিহি!”

-“হুম বলতে পারো। আসলে কথাগুলো মনে পড়ছিল খুব। আর তোমাকে আর্কিওলজির ছাত্রী দেখে একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল। যাই হোক, গল্পে ফেরত আসা যাক। যথারীতি পার্টি শেষে মারিয়া থেকে গেছে। রাতে দুজন একসাথে শুয়েছিলাম। তখন রাত হয়তো দুটো হবে। ঘুমের মধ্যে কেউ আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে। চোখ খুলে দেখি মারিয়া ডাকছে আমাকে।

-“দেখো তো কারা ডাকছে।” মারিয়া বলার সাথে সাথেই দরজায় আবারো ধাক্কা পড়ল। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। তৎক্ষণাৎ সিকিউরিটি অফিসার ব্যারি রিচার্ডসন আরো দুজন অপরিচিত ব্যক্তিকে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। প্রত্যেকের হাতে পিস্তল। ঢুকেই তারা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।

-“আপনারা…”

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘাড়ের কাছে ধাতব স্পর্শ অনুভব করলাম।

-“হ্যান্ডস আপ! এক পা এগোলেই এনার মৃত্যুর কারণ হবে তোমরা।” মারিয়ার কন্ঠস্বর। এটাও বুঝলাম ঘাড়ে আর কিছু নয় পিস্তলের নলের স্পর্শ। ঠান্ডা আতঙ্কের একটা স্রোত নেমে গেল আমার শিরদাঁড়া দিয়ে। কার্যত ডবল শকের সম্মুখীন।

-“আ… আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”

-“বুঝতে তোমাকে হবেও না। এই তোমাদের বন্দুক নীচে কর!” শেষ শব্দগুলি বেশ জোর দিয়ে বলল মারিয়া।

-“কি হচ্ছে মারিয়া? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!”

-“আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি।” সিকিউরিটি অফিসার ব্যারীর গলা। “আমাদের প্রোজেক্টের ভিতরকার খবর ওনার চাই। সেটা উনি হস্তগত করেছিলেন আমাদের টিমের মধ্যেকারই এক বন্ধুর মাধ্যমে। সেই বন্ধু আর কেউ নয় মিঃ ফ্রেড জেফারসন। তার মাধ্যমেই প্রজেক্টের মূল নক্সা ইনি হাতে পান। পরিকল্পনা ছিল আপনার বান্ধবী হওয়ার সুবাদে এখানে অবাধ যাতায়াতের সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে নিয়ে এই মহিলা ফ্রেডের থেকে নক্সাটা নেবে। তারপরে বার্লিনে কেজিবির লোকেদের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু ঘটনা হল ফ্রেড এই ব্যাপারে একেবারেই অপরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে। যেখানে ওর এখান থেকে বেরোনোরই কথা নয়, সেখানে আজ রাতেই পালানোর চেষ্টা করে। ফলে সহজেই ধরা পড়ে যায় এবং সব কিছু ফাঁস হয়ে যায়। সে এতটাই কাঁচা যে পুরো পরিকল্পনাটাই আমাদের বলে দিয়েছে। ফলে একে খুঁজে পেতে দেরী হয়নি। তাই এখন আপনাকে জিম্মি করে কাজ হাসিল করতে চাইছে।”

আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।

-“ফালতু বকা শেষ? এবার অস্ত্রগুলো ফেলো।”

প্রাথমিক শক টা কাটিয়ে উঠে তখন ব্যাপারটা অনুধাবন করার চেষ্টা করছি। প্রতিটা মুহুর্ত এখন গুরুত্বপূর্ণ। ব্যারি ও তার সঙ্গীরা কেউই অস্ত্র ফেলেনি। ওরাও পিস্তল উঁচিয়ে ধরে আছে।

-“ফালতু সময় নষ্ট করে লাভ নেই ম্যাডাম। আপনি চেকমেট। এখনি সারেন্ডার করুন নইলে আপনার লাশটা পড়ে থাকবে শুধু।”

-“তার আগে এঁর লাশ পড়ে থাকবে।”

-“মনে রেখো আমরা তিনজন তুমি একজন। রয়চৌধুরীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করাটা একেবারেই বোকা বোকা কনসেপ্ট।”

যা বুঝলাম মারিয়া আমাকে ভীতু ভাবছে। টিপিক্যাল ভীতু চাকুরীজীবীর মত ঘাবড়ে যাব, বা আত্মরক্ষা করতে গিয়ে সব কিছু আরো জটিল করে তুলব ভাবছে। কিন্তু ঘটনা হল এইরকম পরিস্থিতে কিভাবে নিজেকে বাঁচাতে হয় আমার ভালোই জানা আছে। আমাদের বাড়িতে এইগুলো প্রথম থেকেই শেখানো হয়। আমার এক কাকা সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠনের সাথে যুক্তও ছিলেন। মারিয়া ডান হাতে পিস্তল ঠেকিয়ে বাঁহাতে আমার কলারের পিছন দিক ধরে রেখেছে। ফলে নীচু হওয়া মুশকিল। ব্যারি মারিয়াকে বকিয়ে সময় কিনছে।

-“রয়চৌধুরী ঢাল নয়, তলওয়ার হবে।” বলেই মারিয়া হঠাৎ করে আমাকে ওর দিকে একবার টেনে নিয়েই জোরে ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলে দিল। ব্যারির গায়ের ওপর পড়তে পড়তে দুটো চাপা দুম দুম করে শব্দ শুনলাম। বুঝলাম সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল থেকে গুলি ছুটল। সাথে সাথেই দুটো পুরুষ কণ্ঠের আর্তনাদ আততায়ী ও আক্রান্তের পরিচয় সম্পর্কে কোন সন্দেহ রাখল না। আমি দ্রুত নীচু হয়ে গড়িয়ে গেলাম। পিছিয়ে এসে মারিয়ার পিছন দিকে চলে এলাম। দেখলাম ব্যারি ও মারিয়া পরস্পরের দিকে পিস্তল উঁচিয়ে আছে। আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম নক্সাটা কোথায় থাকতে পারে। আমি দ্রুত স্লিপ করে মারিয়ার দিকে গেলাম এবং দ্রুত ওর পা দুটো ধরে টান মেরে ওকে পেড়ে ফেল্লাম। এই ঘটনাগুলো ঘটে গেল দেড় থেকে দুসেকেন্ডের ব্যবধানে।

-“ব্যারি! জাস্ট শ্যুট হার!” চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। ব্যারি দাঁড়িয়ে রইল।

-“কী হল ব্যারি? ক্যুইক!” ব্যারি তখনও দাঁড়িয়ে। আমি তাকিয়ে দেখলাম ব্যারি হাসছে।

-“ইউ ফুল রয়চৌধুরী! লড়াই শেষ। তোমার নিরাপত্তা নিয়ে তো ছেলেখেলা করা যায় না! তাই আমি মারিয়াকে কিছু করতে পারছি না।”

-“মানে?”

-“ওহ রাজ!” এবার বলল মারিয়া। “তুমি সত্যি খুব কিউট। দুজন সিআইএ অফিসার খতম। অর্থাৎ লড়াই হয়েছে। এবার আমি আর ব্যারি নক্সা সমেত সোওজা ইস্ট জার্মানি চলে যাবো।”

-“মানে? তাহলে এতক্ষণ…”

-“সাজানো নাটক হল রয়চৌধুরী।” বলতে থাকে ব্যারি।

-“সবটাই আমাদের প্রি প্ল্যানড। দুটো অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। এক, নক্সাটা হাতানো, দুই, এই দুজনকে খতম করা। দুটোই ভালভাবে উত্তীর্ণ। এবার তোমাকে খতম করা হবে, কারন তুমি সব কিছু জেনে ফেলেছো।”

-“আর…” বলতে থাকে মারিয়া… “পুরো ব্যাপারটা ব্যারি পুরোপুরি গোপন রেখেছিল, ফলে সিকিউরিটির আর কেউ জানে না। সুতরাং আমাদের কেউ সন্দেহও করবে না।”

-“বাই বাই রয়চৌধুরী!”

ব্যারী পিস্তল তুলে ধরে। আমি দেখতে পাচ্ছি ও ট্রিগার টানছে। একটা চাপা শব্দ… তীব্র জ্বালাময় একটা অনুভূতি… তারপরে সব শেষ… একদম হালকা… মুক্ত…”

-“মানে?” অনঘ্না প্রচন্ড বিশ্মিত হয়! “কি বলছেন আপনি?”

-“হ্যাঁ, ওটাই ছিল আমার জীবনের শেষ দিন। বললাম না অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। এ ঘটনা আর কেউ জানে না। আজ তোমাকে বলে ভীষণ তৃপ্তি পেলাম…”

অনঘ্নার চোখের সামনে ভদ্রলোকের শরীরটা ক্রমশ স্বচ্ছ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তারপর মিলিয়ে যেতে থাকে। ভদ্রলোকের একটাই কথা কানে আসতে থাকে- “মুক্তি মুক্তি মুক্তি…”।

**********

-“ও ম্যাডাম! ম্যাডাম!” অনঘ্নাকে ধরে কেউ ঝাঁকাচ্ছে। ধীরে ধীরে চোখ খোলে অনঘ্না। দিনের আলো টের পায়। দেখে ম্যানেজার এসে ওকে ডাকছেন।

-“আপনি ঠিক আছেন তো ম্যাডাম? নিতাই ঝাঁট দিতে এসে দেখে আপনি টেবিলে মাথা রেখে পড়ে আছেন। তাই আমাকে ডাকল। শরীর ঠিক আছে তো?”

ধীরে ধীরে সব কথা মনে পড়ে তার।

-“হ্যাঁ ঠিক আছি।” কাল রাতে কি দুঃস্বপ্ন দেখছিল ও?

-“ইয়ে মানে রাতে বোধহয় নেশাটা একটু বেশীই হয়ে গিয়েছিল আপনার। একটু সাবধান থাকবেন। যদি পড়ে টড়ে যেতেন?”

-“আরে না ঠিক আছি।” উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে সে। টেবিলে তাকিয়ে দেখে বোতলটা পুরো খালি। জলের বোতলের ছিপি খোলা। কিন্তু গ্লাস একটাই! তাহলে কি নেশার ঘোরে ভুলভাল ভাবছিল সব? ওদিকে ম্যানেজারের কথা শোনা যাচ্ছে-

-“ব্রেকফাস্ট কি ম্যাডাম ঘরে দিয়ে যাব?”

-“না তার দরকার নেই। আমি নীচে যাচ্ছি।” টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলতে তুলতে বলে সে।

মোবাইলটা নিয়ে সময় দেখতে গিয়ে খটকা লাগে তার। স্ক্রীনের এককোণে সামান্য গুঁড়ো ছাই। যতদূর মনে পড়ছে ও তো সিগারেট খাচ্ছিল না। তাহলে ছাই এল কোথা থেকে?

দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিয়ে নীচের ডাইনিঙের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল অনঘ্না। আজ জঙ্গলের দিকটায় যাবে সে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে হলে ঢুকেই থমকে গেল সে। সামনে কয়েকটা পোর্ট্রেট।

-“উনি কে?”  ম্যানেজারের স্বাগত সম্ভাষণ শুনে একটার দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞাসা করে সে।

-“উনি এই বাড়িটা যিনি বানিয়েছিলেন তাঁর ছোট নাতি। ওঁর পাশে ওঁর ঠাকুরদা। আর…”

-“নাম কি ছিল ওঁর?”

-“রাজোত্তম রায়চৌধুরী। আইআইটি খড়গপুরের প্রথম ব্যাচ। বিদেশে চাকরি করতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের হতে অপমৃত্যু হয় ওঁর। তাই ওঁর ছবিটা ঠাকুরদা বীরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর পাশেই রাখা আছে। শুনেছি এই বাড়িতে খুব আসতেন উনি।”

অনঘ্নার মাথার ভিতর আবার সব গুলিয়ে যেতে লাগল। অবিকল রাতের সেই ভদ্রলোক। কেবল বয়সটা অনেকটা কম। কাল রাতে তাহলে কি রাজোত্তমবাবুর আত্মা এসেছিল? নাকি সবটাই পুরো একটা লিটারের প্রভাব? তাহলে ছাইটা?

 

অঙ্কন শিল্পী: পৌলমী গঙ্গোপাধ্যায়

Previous articleঘরের দিকে ফেরা
Next articleধর্মনিরপেক্ষ পাসপোর্ট ও পুনর্বাসন নীতির ঘোষণা
ধ্রুবজ্যোতি পাঠক
পেশায় শিক্ষক ধ্রুবজ্যোতি পাঠক সাহিত্যকে 'Food of Soul' বলে থাকেন। খাদ্যরসিকরা যেমন রান্নাবান্নার নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকেন, তেমন ইনিও সাহিত্য নিয়ে পরীক্ষা করতে ভালবাসেন। বিভিন্ন ধরনের গল্প, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ইত্যাদী লিখে থাকেন তিনি। কাজের ফাঁকে লেখালিখি ছাড়াও তিনি অল্পবিস্তর ফটোগ্রাফিও করে থাকেন। এই সবকিছুর অভিজ্ঞতাকেই তিনি সাহিত্যে প্রয়েগের চেষ্টা করে থাকেন।