বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

৫ম অধ্যায়

ত্রিপুরায় আদিবাসী বিদ্রোহ

দেশভাগের ইতিহাস পর্যালোচনায় ত্রিপুরার সমস্যাটাই সব চেয়ে কম আলোচিত থেকেছে, যেখানে অধিকাংশ বাঙালীই রাজনৈতিক ভাগ্য ও মানচিত্রের ফেরে বহিরাগত শরণার্থী। মূলত আদিবাসী প্রধান ছিল স্বাধীন ‘ত্রিপুরা’ রাজ্য, স্থানীয় আদিবাসীদের ভাষায় যার মানে ‘জলের ধারে ভূমি’। তবে রাজাসভায় বরাবরই বাঙালীর কদর। মহারাজ বিজয় মাণিক্য বাংলার সাতটি নদীতে পুণ্য-স্নান করেছেন। পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা, অংশত চট্টগ্রাম, নোয়াখালি এমনকি ঢাকা মহকুমার কিছু অংশও ছিল ত্রিপুরারাজের শাসনাধীন; অর্থাৎ দশ হাজারের বেশি বাঙালী ত্রিপুরেশ্বরের প্রজা ছিল। ১২৮০-তে ত্রিপুরার রাজা প্রথম অনেক উচ্চ বর্ণের বাঙালীদের রাজসভায় আমন্ত্রণ করে আনেন। তারা বেশির ভাগই বাংলার ‘বারো ভুঁইয়া’ (H.L. Chatterji, ‘Glimpses of Tripura’s History’,Tripura Review, 15 August 1972)। তাছাড়া শুধু মাণিক্য রাজাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রীতি নয়, বাংলা ছিল বিভিন্ন জনজাতিগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার সাধারণ ভাষা বা lingua franca. ইংরেজ প্রণীত আধুনিক শাসন ব্যবস্থার রূপকারও ছিল বাঙালীরা। তাছাড়া পূর্ববঙ্গীয়দের স্বাভাবিক কৃষি-দক্ষতা কৃষিশুল্ক দ্বারা রাজকোষকে রীতিমতো সমৃদ্ধ করে রাখত। এই আদানপ্রদানে কখনই আদিবাসীদের কোপে পড়তে হয়নি। সুতরাং ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলা ও বাঙালীর যোগ স্বাধীনতা উত্তর ঘটনা নয়, রীতিমতো ঐতিহাসিক ও প্রাচীন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত বা নিরাপত্তাহীন হিন্দু বাঙালীর ঢল ও তাদের বাড় বাড়ন্ত উপজাতিগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় থাবা বসাল।
বস্তুত ত্রিপুরা ও সংলগ্ন পূর্ববাংলায় আদিবাসী ও বাঙালীর বসবাস ছিল মিলিয়ে মিশিয়ে। বাঁটোয়ারার ঠিক প্রাক্কালেও ত্রিপুরার বহু অংশেই ত্রিপুরী উপজাতিদের স্পষ্ট সংখ্যাধিক্য ছিল না; বরং চিটাগং পার্বত্য অঞ্চলে বা Chittagong Hill Tracts (CHT)-এ পার্বত্য উপজাতি জনগোষ্ঠীই প্রধান ছিল, বাঙালীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২%। অন্যদিকে ত্রিপুরার সবচেয়ে আদিবাসীপ্রধান পাহাড়ি এলাকা তিপ্পারাতেও উপজাতি জনসংখ্যা ৪০%-র বেশি ছিল না। কিন্তু ১৯৪৭ যেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত অশ্রয়প্রার্থী বাঙালীর বাঁধ ভেঙে দিল। দুই দশকে উপজাতি জনগোষ্ঠী স্পষ্টত সংখ্যালঘু হয়ে পড়ল। ১৮৭৪-৮৫-এর আদমসুমারি অনুযায়ী আদিবাসীর সংখ্যা যেখানে ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার ৬৩.৭৭% ছিল, ১৯৭১-এ তাদের জনসংখ্যায় প্রতিনিধিত্ব দাঁড়াল ২৮.৯৫%. (Source: Census Report)।

নীচের তালিকার দিকে চাইলে পরিস্থিতির একটা ধারণা পাওয়া যাবে –

আর একটি সূত্র জানাচ্ছে “As per census records tribals constituted 52.89% of Tripura’s population in the first census of the last century held in 1901 while non-tribals formed 47.11%. The balance remained relatively stable in 1931 census when Tripura’s tribal population was 50.26% and non-tribal Bengali population was 49.74%. Even in 1941 tribal and non-tribal population was respectively 50.9% and 49.91%.” মানে ১৯০১ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরায় মোটের ওপর আদিবাসীর অনুপাত মোটামুটি স্থিতিস্থাপতক জায়গায় ৫২%-৫৬%-এর মধ্যে ঘোরা ফেরা করেছে যা দেশভাগের ফলে বিধ্বস্ত হয়ে গেল। ক্ষোভ জমতে জমতে শুরু হল আদিবাসী বিদ্রোহ (Tribal insurgency)। ক্ষোভটা সঙ্গত হলেও অতঃপর মাণ্ডাই গ্রামে উপজাতি জনগোষ্ঠী হিন্দু বাঙালীদের ওপর হিংস্রতা ও নৃশংসতার যা নিদর্শন রেখেছিল, তা এখনও শিড়দাঁড়া দিয়ে হিম স্রোত বইয়ে দেয়।

১৯৮০-তে আগরতলা থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ‘মাণ্ডাই’ (মাণ্ডাভি) গ্রামে বাস ছিল বাঙালী ও ত্রিপুরীদের। ৬ই জুন স্থানীয় TUJS ও TNV নেতারা বাঙালী নিধনের ব্লু প্রিন্ট তৈরি করে ফেলে। সেই রাত থকেই উপজাতির পুরুষেরা হিন্দু বসতিতে ঘাঁটি গাড়ে। ৭ই জুন ভোর থেকেই রক্তস্রোত বইতে থাকে; আর প্রাণ ভয়ে পলায়মান হাজার হাজার হিন্দু বাঙালী ঘর-বাড়ি ফেলে আশ্রয় নিতে থাকে ৪৪ নং জাতীয় সড়কের ধারে। জিরানা গ্রামের বিডিও পশ্চিম ত্রিপুরার জেলা শাসকের নির্দেশে ঘরছাড়াদের জন্য পরে খয়েরপুর স্কুলে ত্রাণ শিবিরও খুলে দেন। গুড় চিঁড়ে বণ্টনের নির্দেশ আসে। কিন্তু তার মধ্যে আদিবাসীদের আক্রমণে সরকারি হিসাবেই এ রাতে ২৫৫ জন হিন্দু বাঙালী ছটফট করতে করতে প্রাণ হারায়। বেসরকারি সূত্র বলে অন্তত ৩৫০ থেকে ৪০০ জন। সংখ্যাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে না, তাই তো? তাহলে একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। “Many of the victims had their heads crushed and their limbs severed. The children were spiked through. Pregnant women had their stomach slit open. According to UNI reports, the attackers inserted sharp weapons in the genitalia of the victim women. en.wikipedia.org/wiki/Mandai_massacre. মাথা গুঁড়িয়ে, হাত পা ছেদ করে, বাচ্চাদের এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে এবং অবশ্যই মহিলাদের আর একটু বাড়তি উৎসাহ নিয়ে, মানে জননাঙ্গে ধারালো অস্ত্র ঢুকিয়ে, গর্ভবতীদের পেট চিরে, – যত রকম বীভৎসতা হতে পারে! গুজরাটের গোধরা ও তার পরবর্তী দাঙ্গা বা দিল্লির ‘দামিনী’-কাণ্ডের লোহার রড পর্বের গর্ব চুরমার করে এই ভারতভূমিতে অনেক আগেই ত্রিপুরা রেকর্ড গড়ে রেখেছে। অমৃত বাজারের প্রতিবেদন জানায় অতীতের কলঙ্ক ‘মাইলাই হত্যাকাণ্ড’-কে ছাপিয়ে গিয়েছিল মান্ডাই গণহত্যা। ৯ জুন পৌঁছনো ভারতীয় সেনাদলের কমান্ডার মেজর আর. রাজামাণির মতে পূর্ববর্তী মাইলাই হত্যাকাণ্ড বীভৎসতায় ‘মাণ্ডাই ম্যাসাকার’-এর অর্ধেকও ছিল না।
৭ই জুন সন্ধ্যে বেলায় জিরানিয়া ব্লকেও শুরু হয় লুঠপাট। প্রশাসনের সবাই নিষ্ক্রিয় ছিল না। কিন্তু জেলা শাসক পি. এম. শর্মা ও অতিরিক্ত জেলা শাসক এম. এল. দাশগুপ্ত দুই কোম্পানি সেনার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু আর্মির ওপর নির্দেশ ছিল শুধু ফ্ল্যাগ মার্চ করার। ততক্ষণে চম্পকনগর, বড়মুড়াতেও আগুন জ্বলছে। ৮ই জুন মাণ্ডাইয়ের LAMPS ম্যানেজার সত্যেন্দ্র চক্রবর্তী ও শচীন সাহা নামে জনৈক সিপিআই(এম) নেতা বিডিও অফিসে খবর দেন ৫০০-র বেশি হিন্দু বাঙালী বন্দি অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুণছে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছে শুনশান পুলিস চৌকিতে। শেষ পর্যন্ত পরের দিন সকাল ৬টা নাগাদ রাজস্থান সশস্ত্র বাহিনী (Constabulary) এবং ত্রিপুরা সশস্ত্র পুলিস বাহিনী জিরানিয়া থেকে মাণ্ডাইয়ের দিকে রওনা হল। রাস্তায় তখন দেখা যাচ্ছে পূর্বা নোয়াবাড়ি জ্বলছে। আর মাণ্ডাই পৌঁছে নেভানো মতো আগুনের শিখাও নয়, পাওয়া গেল রক্তপিচ্ছিল গ্রামময় ভস্ম-স্তূপ। কেবল LAMPS ভবনটি টিঁকে আছে। পুলিস চৌকিতে আশ্রণ নেওয়া দুজন বাঙালী হিন্দু রমনীকে সেখানেই কুপিয়ে খুঁচিয়ে ফেলে রাখে জীবন দেব্বামা নামক এক বীর পুংগব। আহতদের দু ঘণ্টা পরে ট্রাকে করে জিবি নিয়ে যাওয়া হল মৃত ঘোষণা শোনার জন্য। ৮ই জুলাই, ১৯৮০ সরাষ্ট্র মন্তক থেকে ‘দীনেশ সিংহ’ তদন্ত কমিটি গঠন করে দায় চোকানো হয়।

মান্ডাই হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘অমৃত বাজার পত্রিকা’য় ভারতীয় সেনার সংশ্লিষ্ট ভারপ্রাপ্ত মেজর রাজামণি তাকে ‘মাইলাই ম্যাসাকার’ (My Lai massacre)-এর সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন বীভৎসতায় মাইলাই হত্যাকাণ্ড মাণ্ডাইয়ের অর্ধেকও ছিল না। ১৯৬৮-র ১৬ই মার্চ ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামে চালানো মার্কিন সেনার নির্বিচার খুন ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে কেন ত্রিপুরার মাণ্ডাই গ্রামে বাঙালীদের ওপর আদিবাসী বর্বরতার তুলনা করা হয়েছে পরিস্কার নয়। দুটি ভূখণ্ডই কমিউনিস্ট শাসিত ছিল বলে? একদিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নির্লজ্জতম ও নৃশংসতম রূপ বিনা প্ররোচনায় একদিনে ৫০০-র ওপর নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে, আর একদিকে নিজেদের জমিতে প্রান্তিক হয়ে যাওয়া আদিবাসীদের আক্রোশে ৩০০-র বেশি বাঙালীর মৃত্যু – দুটো পরিস্থিতি মোটেই এক নয়। তবে চালচিত্র যাই হোক ত্রিপুরার বাঙালীদের ট্রাজেডির ছবিটা তাতে বদলাবে না।

একটি স্বাধীন রাজতন্ত্রী দেশ থেকে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসাবে তার অন্তর্ভূক্তিতে ততটা প্রতিক্রিয়া হয়নি। কিন্তু দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার তাড়া খাওয়া বাঙালীর আগমণ ঘটে রাজ্যটার জনসংখ্যার চরিত্রই(demography) বদলে দিতে আদিবাসীদের মধ্যে জন্ম নিল অবিশ্বাস ও সামগ্রিকভাবে বাঙালী বিদ্বেষ যা দূর করার উপায় বা উদ্যোগ যথেষ্ট ছিল না। প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ এই রাজ্যটির অর্থনৈতিক বিকাশের যে সম্ভাবনা ছিল তাতে কবর দিয়ে দিল ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে এর ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা। অর্থাৎ ভারতভুক্তির ফলে উদ্বাস্তু আগমণের ভার বইতে হলেও উন্নয়নের সুফল সেভাবে পাওয়া গেল না। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরেও মাত্র ৮০ কিলোমিটার রেল পথ আর একটি মাত্র অমসৃণ জাতীয় সড়ক (NH 44)। আগরতলার বিমান বন্দরের যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা আর কতটুকুই বা সামাল দিতে পারে? মাত্র দু জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পার্লামেন্ট সদস্য মারফৎ রাজ্যবাসীর অভাব অভিযোগ দিল্লির কানে পৌঁছনোর আগেই পথে হারিয়ে যায়। বিচ্ছিন্নতাবাদ ও অশান্তির আদর্শ প্রজনন ক্ষেত্রে শুধু বাঙালী বিরোধী নয়, ভারত বিরোধী জঙ্গিপনাও ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করছে।
রাজতন্ত্রের অবসান এবং ভারতীয় ব্যালট বাক্স গণতন্ত্রের সূচনা ত্রিপুরায় উপজাতিগুলোকে রাজনৈতিকভাবে সত্যিই গুরুত্বহীন অন্তেবাসী করে দিল। রাজতন্ত্র অবসানের ৪০ বছর পর ত্রিপুরা তার প্রথম উপজাতি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে পেল দশরথ দেবকে, যিনি পাহাড়ি প্রদেশের রাজা দশরথ বলেও পরিচিত। ততদিনে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। দশরথ ১৯৯৩-এ কমিউনিস্ট দল ক্ষমতায় ফেরার পর চার বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। এই দশরথ দেবকে মুখ্যমন্ত্রী করার প্রস্তাব ১৯৭৮ CPI(M)প্রথম ক্ষমতায় আসার পরেই উঠেছিল; তুলেছিলেন ত্রিপুরায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের হোতা বীরেন দত্ত, একজন বাঙালী। সেবারে অবশ্য পলিটব্যুরো নেতা প্রমোদ দাশগুপ্তর তৎপরতায় নৃপেন চক্রবর্তীকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। বীরেন দত্ত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই নিয়ে নিজের আক্ষেপ জানিয়ে গেছেন, ‘one big mistake by our party in Tripura’(২৩.০৪.১৯৮৭)। ১৯৭৮-এ দশরথ দেবকে মুখ্যমন্ত্রী করলে আদিবাসী আবেগ এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের ওপর বিশ্বাস দুটোই অটুট থাকত – ‘Tribal extremism would never have taken off had Deb been made the chief minister and we would have been able to spread the communist movement to other tribal-dominated states of Northeast. But we missed that great chance by foisting Nripen Chakrabarty who was always described by tribal extremists as the refugee chief minister’ (Dutta, ibid). তার আগে কংগ্রেস সরকারও উপজাতি জনগোষ্ঠীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি এবং বাঙালী শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল রাজা বীর বীক্রমের দ্বারা ১৯৪৩-এ চিহ্নিত ১৯৫০ বর্গ মাইল Tribal Reserve অঞ্চলেই […,but in 1948, the Regent Maharani’s Dewan A.B. Chatterji vide order no. 325 dated 10th Aswin, 1358 Tripura Era (1948 AD) threw open 300 sq. miles of this reserve for refugee settlement. Later, more of these areas would be opened to the refugees]। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ত্রিপুরায় মোট বাস্তহারা অনুপ্রবিষ্টের সংখ্যা ৬,০৯,৯৯৮। ফলে ক্ষোভ জমছিলই ১৯৪৭-এর পর থেকে। নীচের তালিকা অনুপ্রবিষ্ট পূর্ববঙ্গীয়দের একটা হিসাব দেয় –

মনে রাখতে হবে, ত্রিপুরায় এই স্রোত ছিল সর্বতোভাবে একমুখী। ত্রিপুরা থেকে‌ কোনও আদিবাসী, কোনও অহিন্দু পূর্ব পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে চলে যায়নি। ১৯৪১-এ জনজাতির অনুপাত ৫৩.১৬% থেকে ১৯৮১-তে ২৮.৪৪%-এ নেমে এল। ত্রিপুরার উপজাতি জনগোষ্ঠী নিজেদের ভূমিতে প্রান্তিক হয়ে যেতে থাকল। তাদের জমিও বেহাত হতে লাগল। এই একমুখী জনস্রোতের অভিঘাত যে স্থানীয় ও বহিরাগত উভয় সম্প্রদায়ের কাছে ভয়াবহ হবে তা বুঝেও কিছু করার ছিল না। সীমন্তের এপারে বা ওপারে হিন্দু বাঙালীকে তো মার খেতেই হোত।

আর একটা মারাত্মক আত্মঘাতী ভুল করেছিল কমিউনিস্ট দল। ত্রিপুরায় দল হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্য বিধানসভা গড়ার উপায় ছিল না কেন্দ্রশাসিত রাজ্যটির। ১৯৭৮-এ ক্ষমতায় এসেই উপজাতিদের রাতারাতি “আমরা বাঙালী” তকমায় দাগিয়ে দিতে চেয়েছিল। সবাই তো পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী নয়, যে উড়ে এসে জুড়ে বসাটা মেনে নেবে। Tribal National Volanteers (TNV)-এর নেতৃত্বে কতটা হিংসা ও বিদ্বেষ জমা ছিল ও তার গতি প্রকৃতি কোন দিকে, তা নিয়ে কোনও চিন্তা ভাবনা কাজ করেনি এই আরোপিত অভিন্নতার প্রয়াসে। পুঞ্জিভূত বারুদে অগ্নিসংযোগ হল। ১৯৮৮-তে বাম সরকার পরাভূত হওয়া পর্যন্ত হিন্দু বাঙালীদের ওপর TNV-র তাণ্ডব চলতেই লাগল। সিপিআই(এম) নির্বাচনে হারার পর কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে TNV-র একটি চুক্তি হয় যাতে বিধান সভায় ত্রিপুরী উপজাতির প্রতিনিধির জন্য তিনটি আসন সংরক্ষিত হল। এর ফলে TNVকে প্ররোচিত করে বামপন্থীদের ওপর ওপার থেকে আগত বাঙালীদের আস্থা নষ্ট করার কংগ্রেসি ষড়যন্ত্রেরও সন্ধান পেতে লাগল ত্রিপুরার বাম দল। প্রমাণ স্বরূপ হাতে পাওয়া গেল ত্রিপুরা অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের দুমাসের মধ্যে মিজোরামের সাপ্তাহিক কাগজ জোয়িং (Zoeng)-এ প্রকাশিত কংগ্রেসি মিজো মুখ্যমন্ত্রী লণ্ঠনহাওলা ও TNV নেতা বিজয় কুমার হ্রংখওয়ালের আঁতাত পত্র-বিনিময়। রাজনৈতিক চাপান-উতোর ষড়যন্ত্র-অবিশ্বাস বাঙালী-আদিবাসী সংঘাতকে ক্রমশ জটিলতর করে চলল। এর চরমরূপটা আবার দেখা গেল ২০০২-এ Tripura Tribal Areas Autonomous District Council (TTADC)-র নির্বাচনে বিচ্ছিন্নতাবাদী National Liberation Front of Tripura (NLFT) কয়েকজন বামপন্থী প্রার্থীকে অপহরণ ও খুন করে পুনরায় আতঙ্কের বাতাবহ সৃষ্টি করল Indigenous Peoples Front of Tripura (IPFT)-র প্রচারের স্বার্থে। IPFT প্রত্যাশিতভাবে TTADC নির্বাচন জিতল। TTADC গঠনের পর এই প্রথম বামফ্রন্ট ভোটে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। NLFT ইতিমধ্যেই বামপন্থী আদিবাসীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে ২০০৩ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে চোখ রেখে। বাম নেতাদের অবস্থা হল না ঘরকা, না ঘাটকা। আদিবাসী এলাকায় তারা NLFT-র আক্রমণের নিশানা, আর বাঙালী পাড়ায় তারা চিহ্নিত হল হয় অপদার্থ নয়তো বাঙালী-বিদ্বেষী হিসাবে। ৬.৬.২০০০ সালে দেওয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে UBLF নেতা বিজন বসুর বক্তব্য, ‘It is because we Bengalis vote for them that the communists enjoy some clout in Indian politics. But these are the people who have, instead of protecting the Bengalis, dropped us before the tribal wolves and let them feast on our rotting flesh. We will punish them as much as the tribal extremists, though we will not touch tribals who are fighting the militants,’ তার মানে, আদিবাসী চরমপন্থীদের পাশাপাশি বাঙালী কমিউনিস্ট নেতৃত্বকেও ছেড়ে দেওয়া হবে না। অর্থাৎ বাঙালী উল্টে নিজেদের মধ্যেই অন্তর্দন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল।

মাণ্ডবি রাত্রির পর দাঙ্গায় প্রাণ হরিয়েছে অন্তত ১০০০ জন, যাদের সিংহ ভাগ বাঙালী। US Committee for Refugees, Special Report on Northeast India, compiled by Hiram Ruiz, 2000-র খতিয়ান অনুযায়ী দু লক্ষের বেশি পুনর্বাসিত শরণার্থী আবার বাস্তুহারা হয়েছে। অন্যান্য সূত্র থেকে দেখা যায় গত কুড়ি বছরে ৬০০০ বাঙালী জাতি-দাঙ্গায় খুন হয়েছে, ৫০০-র বেশি অপহৃত হয়েছে যাদের কেউ কেউ মুক্তি পেয়েছে এমন অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে যাতে পরিবারটির আর্থিক ভিত উপড়ে যায়, আর নোখোঁজ যে কত শত তার হিসাব নিতেও আতঙ্ক। অস্তিত্ব সংকটে পড়ে প্রাণরক্ষায় তৈরি United Bengal Liberation Front (UBLF) যান বাহনে বোমা মেরে ২০ জন আদিবাসীকে উড়িয়ে দেয়। বাঙালীদের তরফ থেকে প্রতিশোধ বলতে এইটুকুই এবং সেটা অবশ্যই কোনও সুরাহা এক দিকে দিল্লির ‘উপজাতি গণমুক্তি পরিষদ’কে লাগাতার অবহেলা, অন্য দিকে বাঙালী বাম শক্তির ক্রমাগত উত্থান ত্রিপুরার জনজাতির মধ্যে যে অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের বীজ বুনে জন সিঞ্চন করেছে, তার কোপ থেকে ত্রিপুরার বাঙালীদের মুক্তি নেই। লাগাতার রক্তক্ষরণের এই ইতিহাসে আরও আরও বীভৎসতা ও রাজনৈতিক জটিলতার তথ্য ও বিশ্লেষণ সংযোজন করা যায়, কিন্তু আজও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সফল কোনও সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আদিবাসী উপজাতি বা জনজাতিদের ক্ষোভ হয়তো অহেতুক নয়; কিন্তু একটি সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক স্বার্থে বা ভাবাবেগে ভারত উপমহাদেশকে প্রথমে দুই পরে তিনখণ্ড করার মূল্য হিন্দু বাঙালীদের আর কত প্রজন্ম ধরে দিয়ে যেতে হবে তার উত্তর আমাদের এখনও জানা নেই। প্রসঙ্গত মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে শতখানেক স্বাধীন রাজতন্ত্রী রাজ্যও থেকে গিয়েছিল, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ছাড়া তাদের কী গতি হোত আর তাদের নিয়ে ভারতই বা কী করত কে জানে?

এই ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের দায় তো পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ওপরই বর্তায়। তবে এ নিয়ে আমাদের, মানে পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দু বাঙালীদেরই মাথা ব্যথা নেই, তো পররাষ্ট্রের দায়স্বীকার। এত কিছুর পরেও, এত মার খেয়েও আমরা একতাহীন, পরধর্ম, পরসংস্কৃতি, পররাষ্ট্র লেহনকারী আত্মবিস্মৃত এক জাতি। শুধু সাহিত্যচর্চার খাতিরে আগরতলা গিয়ে কি আমাদের জাতিগত চরিত্রের সামান্যতম উন্নতির প্রয়াস করছি? বাংলার ও হিন্দু বাঙালীদের সমস্যার মূল উৎস যে পাকিস্তানের দাবিতে দেশভাগ যা ক্রমাগত উৎখাৎ ও অনুপ্রবেশের দ্বারা বাংলাদেশ এখনও জিইয়ে রেখেছে, তা চিহ্নিত করার সাহস কি দেখাতে পারি? নাকি বাংলা সংস্কৃতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাদের কাছেই নিজেদের জাতীয়তা নিঃশর্তে সমর্পণ করে আসি?

তার ওপর আসামে ২০১৭-১৮-য় যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে উপজাতি অধ্যুষিত ত্রিপুরায় অনুরূপ জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি নির্মাণের প্রস্তাবে বাঙালীর আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে; বিশেষ করে যখন ক্ষমতাসীন দল উপজাতি জনজাতিদের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করেই ক্ষমতায় এসেছে। অনুরূপ নাগরিক স্বীকৃতি ও বিদেশী চিহ্নিতকরণ পদ্ধতি চালু হলে পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বাঙালীরা যে রাতারাতি বিদেশী ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সাব্যস্ত হবে না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। আর সেটা হলে আর একটা মাণ্ডাই গণ্ত্যাকাণ্ডের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভারতীয় বাঙালীরা দেশের স্বাধীনতার খাতিরে চরম আত্মত্যাগের জন্য এখনও অনুতাপ করছে না, কিন্তু তারা চিরকাল সংকটেই থাকবে এটা যেন নিয়তি নির্ধারিত বলেই ভারতবর্ষ ধরে নিয়েছে।

চলবে