বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

ভাইয়ের রক্তে রাঙা একুশে ফব্রুয়ারি, কিন্তু বোনেদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধ:

এটা ব্যতিক্রম নয়, এটাই নিয়ম। যুদ্ধের ফলাফল কোন দিকে যাবে সে ব্যাপারে কোনও পক্ষ আত্মবিশ্বাসী হতেই পারে, নিজেদের জয় সম্পর্কে নিশ্চিতও হতে পারে। কিন্তু যে ব্যাপারে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা, তা হল যোদ্ধাদের জীবন। শান্ত অবস্থাতে যে পুরুষালি জবরদস্তি অপরাধ বলে গণ্য, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সেটা দস্তুর হয়ে যায়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সেটা হয়ে উঠতে পারে ধর্মাচারণও। আর অপরাধই হোক বা ধর্মাচারণ তা পুরুষের কর্তব্য, যার শিকার বা লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় নারী ও শিশু। এগুলো রাষ্ট্রের কাছে কিছুদিন পরে ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ মাত্র যা মাতৃভাষা দিবসে আলোচিত হয় না। কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা যে ব্যাপক হারে বাঙালী মেয়েদেরই হয়েছিল এবং বিশ্বের সর্বকালের সেরা নারীমেদ উৎসবের একটি যে এই পূর্ব বাংলারই মাটিতেই সদম্ভে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তা এতদিন পরে অন্তত সগর্বে স্মরণ করা যেতেই পারে।

১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় পাকসিস্তানি সেনার সঙ্গে তাদের সমর্থক জামাত-ই-ইসলামি ২ থেকে ৪ লক্ষ বাঙালী মেয়েকে ধর্ষণ করে বলে উইকিপেডিয়ায় উল্লিখিত থাকলেও স্বাধীন বাংলাদেশের বেশ কিছু গবেষকের দাবি সংখ্যাটা কম করে দশ লক্ষ। শুধু ধর্ষণ নয়, লক্ষ ছিল পরিকল্পিতভাবে বাঙালী নির্মূলিকরণ যার ফলে একে “systematic genocidal rape”[1][2][3][4] বলে চিহ্নিত করা হয়। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একটি ফতোয়ায় ঘোষিত হয়, বাঙালী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা হল হিন্দু আর তাই তাদের নারীদের ‘গণিমতের মাল’ (“booty of war”) হিসাবে ভোগ ও ধর্ষণযোগ্য[5]। ইমাম ও অন্যান্য ধর্মীয় ব্যক্তিরা সেনাকে ধর্মের নামে যথেচ্ছ ধর্ষণের শুধু অবাধ অনুমোদন নয়, রীতিমতো উৎসাহ দিত[6]।

বিভিন্ন ইসলামি সমাজকর্মী ও নেতারাও ধর্ষণ ও অপহরণ মহাযজ্ঞে সোৎসাহে অংশগ্রহণ করেছিল সম্ভোগের পাশাপাশি বাংলাভাষী সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশাপাশি সংখ্যাগুরু মুসলিম সর্বস্তরে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিতে। ধর্ষণ ব্যাপারটা তো সেখানেই শেষ হয়ে যায় না। তাই তার ফলশ্রুতিতে জন্ম নিয়েছিল হাজার হাজার ‘যুদ্ধশিশু’, হয়েছিল অসংখ্য গর্ভপাত, শিশুহত্যা, আত্মহত্যা, নিরুদেশ। যে কোনও যুদ্ধ বা অরাজকতায় এটাই স্বাভাবিক সে সাক্ষ্য তো ইতিহাসই দেয়[7]। আর এখানে তো ধর্ষণ বা হত্যা সবকিছুর পেছনে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ছিল – দুবলা বেঁটে কালো বঙ্গালি আবার মুসলমান নাকি? মুসলিম পরিচয়ধারী নিম্নবর্গের এই মানুষগুলিকে হত্যা ছিল বিধর্মী দেশদ্রোহী নিধন এবং সেটা অবশ্যই ইসলাম অনুমোদিত পবিত্র কাজ।

এই ধর্ষণ ও হত্যালীলার সিংহভাগ কৃতিত্ব পাকিস্তানি সেনা ও বাংলার ‘রাজাকার’-দের হলেও ঐতিহাসিক ইয়াসমিন সইকিয়া[15][16] জানিয়েছেন বাঙালী জাতীয়তাবাদী যোদ্ধারাও প্রতিশোধ নিতে বিহারী মুসলিমদের বাড়িতে ঢুকে নারী নিগ্রহ চালায়[13][14] যেহেতু বিহারী মুসলিমরা ছিল উর্দুভাষী পাকিস্তানিদের সমর্থক। দেশের নারী প্রধানমন্ত্রীর কাছে নারী অবমাননা থেকে বিরত থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভারতীয় সেনারা ’৭১-এর যুদ্ধে সংযম ও চরিত্রের জন্য বিশেষ খ্যাতি লাভ করলেও ইয়াসমিন সইকিয়ার দাবি বিচ্ছিন্ন হলেও দু-একটি অপকর্মে তাদেরও অংশগ্রহণ ছিল।

মুক্তিযুদ্ধ অবসানের ৪০ বছর পর ২০০৯ সালে ‘War Crimes Fact Finding Committee’ একটি প্রতিবেদনে ধর্ষণসহ যুদ্ধাপরাধের জন্য ১,৫৯৭ জনকে দোষী ঠাউরেছে। সংখ্যাটা যে বাস্তবের তুলনায় নগণ্য তা অনুমান করতে ইতিহাসবেত্তা লাগে না, কারণ গণঅপরাধের কোনও সাক্ষ্য থাকে না। ২০১০ সাল পর্যন্ত ‘ International Crimes Tribunal’ (ICT) বেশ কিছু যুদ্ধাপরাধীকে যাবজ্জীবন বা প্রাণদণ্ডের শাস্তিও দিয়েছে। বহির্বিশ্বে দু-চারটে সিনেমাও হয়েছে এই নিয়ে। তবে তাতে ভয়াবহতার সার্বিক চেহারাটা যে ফুটে ওঠেনি, তা কিছু গবেষকের লেখা থেকে স্পষ্ট হয়। তাই যে একুশে ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষা এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভাইয়ের রক্তপাত স্মরণ করা হয়, তার নেপথ্যে কত শত-সহস্র-লক্ষ বোনের রক্তবন্যা বয়েছিল এবং কী নিদারুণভাবে তার কিঞ্চিৎ পরিচয় দিতে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানি প্রায় অসম্পাদিতরূপে উদ্ধৃত করছি:
“উলঙ্গ মেয়েদেরকে গরুর মত লাথি মারতে মারতে, পশুর মত পিটাতে পিটাতে উপরে হেডকোয়ার্টারে দোতলা, তেতলা ও চারতলায় উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। পাঞ্জাবী সেনারা চলে যাওয়ার সময় লাথি মেরে আবার কামরার ভিতর ঢুকিয়ে তালা বদ্ধ করে রাখতো। বহু যুবতীকে হেডকোয়ার্টারের ওপরের তলার বারান্দায় মোটা লোহার তারের ওপর চুল বেধেঁ ঝুলিয়ে রাখা হতো। পাঞ্জাবীরা সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করত। কেউ এসে ঝুলন্ত উলঙ্গ যুবতীদের কোমরের মাংস বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতো; কেউ তাদের বক্ষের স্তন কেটে নিয়ে যেত; কেউ হাসতে হাসতে তাদের যোনিপথে লাঠি ঢুকিয়ে দিয়ে বিকৃত আনন্দ উপভোগ করতো; কেউ ধারালো চাকু দিয়ে কোন যুবতীর পাছার মাংস আস্তে আস্তে কাটতো; কেউ চেয়ারে দাঁড়িয়ে উন্নত বক্ষ নারীদের স্তনে মুখ লাগিয়ে ধারালো দাঁত দিয়ে স্তনের মাংস কামড়ে তুলে নিয়ে আনন্দে অট্টহাসি করতো!! কোনো মেয়ে এসব অত্যাচারে চিৎকার করলে তার যোনিপথে লোহার রড ঢুকিয়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ হত্যা করা হতো। প্রতিটি মেয়ের হাত পিছনের দিকে বাধা থাকতো। মাঝে মাঝে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেখানে এসে উলঙ্গ ঝুলন্ত মেয়েদেরকে এলোপাতাড়ি বেদম প্রহার করতো। প্রতিদিনের এমন বিরামহীন অত্যাচারে মেয়েদের মাংস ফেটে রক্ত ঝরছিল; কারও মুখেই সামনের দিকে দাঁত ছিল না; ঠোঁটের দুদিকের মাংস কামড়ে এবং টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল; লাঠি ও লোহার রডের বেদম পিটুনিতে মেয়েদের আঙুল, হাতের তালু ভেঙে থেঁতলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল! এসব অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত মেয়েদেরকে প্রসাব পায়খানা করার জন্যেও হাত ও চুলের বাঁধন খুলে দেয়া হতো না। এমন ঝুলন্ত আর উলঙ্গ অবস্থাতেই তারা প্রস্রাব পায়খানা করতো। আমি প্রতিদিন গিয়ে এসব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতাম।…./” – সুইপার রাবেয়া, ‘৭১ এর অভিজ্ঞতা বর্ননায়!
“…….মেয়েদের কারও লাশের স্তন পাইনি, যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত এবং পিছনের মাংস কাটা দেখেছি। মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে – তাদের হত্যা করার পূর্বে স্তন জোরপূর্বক টেনে ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে, যোনিপথে বন্দুকের নল বা লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে…….”
– ঢাকা পৌরসভার ছন্নুডোম, ২৯ মার্চের অভিজ্ঞতা বর্ণনার অংশবিশেষ!
/“….. পাঞ্জাবী,বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্থানী পুলিশ জিভ চাটতে চাটতে ট্রাকের সামনে এসে মেয়েদের টেঁনে হিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ কাপড় চোপড় খুলে নিয়ে উলঙ্গ করে আমাদের চোখের সামনেই মাটিতে ফেলে কুকুরের মত ধর্ষণ করতো।… সারাদিন নির্বিচারে ধর্ষণ করার পর বিকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং এর ওপর উলঙ্গ করে লম্বা লোহার রডের সাথে চুল বেঁধে রাখা হতো। রাতে এসব নিরীহ বাঙালী নারীর ওপর অবিরাম ধর্ষণ চালানো হতো। গভীর রাতে মেয়েদের ভয়াল চিৎকারে ঘুম ভেঙে যেত। ভয়ংকর, আতঙ্কিত আর্তনাদ ভেসে আসতো – ‘বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও, পানি দাও, একফোঁটা পানি দাও, পানি…পানি….’!!!” — রাজারবাগ পুলিশ লাইনের আর্মস্ এসআই, বিআরপি সুবেদার খলিলুর রহমান!
[উৎস: বই:: ১) মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ২) বীরাঙ্গনা ১৯৭১ – মুনতাসীর মামুন]
আর একটি চিত্রায়ন বাংলাদেশের নাগরিক মোহম্মদ নাজমুল হক-এর ফেসবুক পোস্ট থেকে: [বানান প্রায় অপরিবর্তিত]
“যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প থেকে কয়েকটি কাঁচের জার উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে ফরমালিনে সংরক্ষিত ছিল মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অংশ। অংশগুলো কাটা হয়ে ছিল খুব নিখুঁতভাবে।” – ডাঃ বিকাশ চক্রবর্তী, খুলনা
“মার্চে মিরপুরের একটি বাড়ি থেকে পরিবারের সবাইকে ধরে আনা হয় এবং কাপড় খুলতে বলা হয়। তারা এতে রাজি না হলে বাবা ও ছেলেকে আদেশ করা হয় যথাক্রমে মেয়ে এবং মাকে ধর্ষণ করতে। এতেও রাজি না হলে প্রথমে বাবা এবং ছেলে কে টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হয় এবং মা মেয়ে দুজনকে দুজনের চুলের সাথে বেঁধে উলঙ্গ অবস্থায় টানতে টানতে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।”– মোঃ নুরুল ইসলাম, বাটিয়ামারা কুমারখালি।

“আমাদের সংস্থায় আসা ধর্ষিত নারীদের প্রায় সবারই ছিল ক্ষত-বিক্ষত যৌনাঙ্গ। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিঁড়ে ফেলা রক্তাক্ত যোনিপথ, দাঁত দিয়ে ছিড়ে ফেলা স্তন, বেয়োনেট দিয়ে কেটে ফেলা স্তন-উরু এবং পশ্চাৎদেশে ছুরির আঘাত নিয়ে নারীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসতো।”– মালেকা খান, যুদ্ধের পর পুনর্বাসন সংস্থায় ধর্ষিতাদের নিবন্ধীকরণে যুক্ত সমাজকর্মী।”
“১৮ ডিসেম্বর মিরপুরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া একজনকে খুঁজতে গিয়ে দেখি মাটির নিচে বাঙ্কার থেকে ২৩ জন সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মাথা কামানো নারীকে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে পাক আর্মিরা।”– বিচারপতি এম এ সোবহান
“যুদ্ধের পর পর ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে বেশ কিছু নারীকে। তাদের পোশাক এবং চলাফেরা থেকে আমরা অনেকেই নিশ্চিত জানতাম ওরা যুদ্ধের শিকার এবং ওদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।” – ড. রতন লাল চক্রবর্তী, অধ্যাপক ইতিহাস বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

“কোনো কোনো মেয়েকে পাকসেনারা এক রাতে ৮০ বারও ধর্ষণ করেছে।” – সুসান ব্রাউনি মিলার (Against our Will: Man, Women and Rape, pg 83)
“এক একটি গণধর্ষণে ৮/১০ থেকে শুরু করে ১০০ জন পাকসেনাও অংশ নিয়েছে।” – “যুদ্ধ ও নারী” (“War and Women”), published by War Crimes facts finding Committee
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে দেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী। এই নরপশুর নেতৃত্বেই রাওফরমান, রহিম খান, টিক্কা খানের মত পাকিস্তানী জেনারেল এদেশের উপর চালায় শতাব্দীর ঘৃণ্যতম গণহত্যা। সেই সাথে এসব বিকৃত রুচির জেনারেলদের পরিকল্পনায় সংঘটিত হয় ধর্ষণের মহোৎসব। আমার এখনকার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু মুক্তিযুদ্ধে নারী নির্যাতন, যত ঘাঁটছি আমার বিস্ময় তত বেড়েই চলছে। এই সেক্টরে এসে আমরা বরাবরই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পুরনো কিছু গল্প বলে পাশ কাটিয়ে যেতে চাই, আর এর ফাঁকে আড়াল হয়ে যায় নির্মমতার অনেক গল্প, যে গল্প হার মানাবে হিটলারের নির্মমতাকে, আনা ফ্র্যাঙ্কের ডাইরিকে। আমার হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত ধর্ষণের সংখ্যা হয়ত দশ লক্ষও হতে পারে।জী ভাই আমি দশ লক্ষই বলছি। হাতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে দেখেই বলছি। সম্ভবত সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশী ধর্ষণের রেকর্ডটাও আমাদের পকেটেই যাচ্ছে। আর এই ধর্ষণ উৎসবের হালালাইজেশানটা করা হয়েছিলো ধর্মের নামে।
ব্রিগেডিয়ার আবদুল রহমান সিদ্দিকী তার “East Pakistan The End Game” বইতে লেখেন, “নিয়াজী জওয়ানদের অসৈনিকসুলভ, অনৈতিক এবং কামাসক্তিমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতেন। ‘গতকাল রাতে তোমাদের অর্জন কি আমার বাঘেরা?’ চোখে শয়তানের দীপ্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন তিনি। অর্জন বলতে তিনি ধর্ষণকেই বোঝাতেন।”

সেপ্টেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের সকল ডিভিশান কমান্ডারের কনফারেন্সে এক অফিসার তুলেছিলেন পাকিস্তানী সেনা কর্তৃক বাঙ্গালী নারীদের ধর্ষনের প্রসঙ্গ।নিয়াজী তখন সেই অফিসারকে বলেন, “আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি। যুদ্ধক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিও।”তারপর হেসে বলেন, “ভালই তো হচ্ছে, এসব হিন্দুয়ানী বাঙ্গালী রক্তে সাচ্চা মুসলিম পাঞ্জাবী রক্ত মিশিয়ে তাদের জাত উন্নত করে দাও।” আর এই ধর্ষণের পক্ষে তিনি যুক্তি দিয়ে বলতেন, “আপনারা কি ভাবে আশা করেন একজন সৈন্য থাকবে, যুদ্ধ করবে, মারা যাবে পূর্ব পাকিস্তানে এবং যৌন ক্ষুধা মেটাতে যাবে ঝিলমে?” ধর্ষণে লিপ্ত এক পাকিস্তানী মেজর তার বন্ধুকে চিঠি লিখেছেন, “আমাদের এসব উশৃঙ্খল মেয়েদের পরিবর্তন করতে হবে যাতে এদের পরবর্তী প্রজন্মে পরিবর্তন আসে, তারা যেন হয়ে ওঠে ভালো মুসলিম এবং ভালো পাকিস্তানী।”

স্বাধীনতার পর ধর্ষিতা বাঙালী মহিলাদের চিকিৎসায় নিয়োজিত অষ্ট্রেলিয় ডাক্তার জেফ্রি ডেভিস গনধর্ষনের ভয়াবহ মাত্রা দেখে হতবাক হয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আটক পাক অফিসারকে জেরা করেছিলেন যে তারা কিভাবে এমন ঘৃণ্য কাজ-কারবার করেছিলো। অষ্ট্রেলিয় চিকিৎসক বিচলিত হলেও পাক অফিসারদের সাচ্চা ধার্মিক হৃদয়ে কোন রকম রেখাপাত ঘটেনি। তাদের সরল জবাব ছিল, “আমাদের কাছে টিক্কা খানের নির্দেশনা ছিল যে একজন ভালো মুসলমান কখনই তার বাবার সাথে যুদ্ধ করবে না। তাই আমাদের যত বেশী সম্ভব বাঙালী মেয়েদের গর্ভবতী করে যেতে হবে।” নিয়াজী ধর্ষণে তার সেনাদের এতই চাপ দিতেন যে তা সামলে উঠতে না পেরে এক বাঙালী সেনা অফিসার আত্মহত্যা করতে বসেন।

ঘৃণা আর ভালোবাসা একটা মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ, আপনি কাউকে প্রচণ্ড ভালোবাসতে পারেন শুধুমাত্র তখনই যখন আপনি ঘৃণা করতে পারবেন তার বিপরীত সত্ত্বাকে। আপনি নিজেকে মনেপ্রাণে একজন বাঙ্গালী, একজন দেশপ্রেমিক তখনই বলতে বলতে পারবেন যখন পাকিস্তানকে, তাদের সমর্থকদের মনে প্রাণে ঘৃণা করতে পারবেন।
[কৃতজ্ঞতায়ঃ শহীদ রুমী স্কোয়াড]
ওপরে যা লেখা হল সেগুলো একটাও আমার কথা নয়, এমনকি ভাষা ও বানানও অসম্পাদিত। এরপর আর সংযোজনের প্রবৃত্তি হচ্ছে না। তবু কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি এক জায়গায় ৮০ বস্তা খালি মানুষের খোবলানো চোখ পাওয়া গিয়েছিল – কতজন ভাই কতজন বোন জানা নেই।

বাংলাদেশী ভাইটির সৎসাহসকে কুর্নিশ জানিয়েও একটু সংযোজন না করে পারছি না: wikipedia-র ঐতিহাসিক সূত্র জানাচ্ছে ১৯৫০-এ পূর্ব পাকিস্তান গণহত্যা (1950 East Pakistan genocide) ও ১৯৬৪-র দাঙ্গার (1964 East-Pakistan riots.[15]) জেরে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঝাঁকে ঝাঁকে হিন্দু বাঙালী পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসে। আর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসাবে হিন্দু বাঙালীর নাম না পাওয়া গেলেও বা ওপরোক্ত ফেসবুক পোস্টে মুসলিম বাঙালী মেয়েদের যন্ত্রণার ছবি ফুটে উঠলেও উইকিপেডিয়ার ‘বেঙ্গলি হিন্দু’ এই সূত্রটি জানাচ্ছে ২৪ লক্ষ হিন্দু বাঙালীকে পাকিস্তানি সেনা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল যেখানে মোট হত্যার সংখ্যা ছিল ৩০ লক্ষ।[18] । শেষ পরিসংখ্যানটি পাওয়া গেছে আরব দুনিয়ার আল-জাজ়িরা (Al-Jazeera) সংবাদ মাধ্যম সূত্রে, সঙ্ঘ পরিবারের পুস্তিকাসূত্রে নয়। আর পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ১৯৪৭-এ ৩১% বা মতান্তরে ২৭% থেকে ২০১৬-য় ৭% হয়ে যাওয়া ও ক্রমাগত কমতে থাকা তো ঘটমান বর্তমান। [16]
কিন্তু এই ইতিহাস এবং বর্তমান ধামাচাপা দিয়ে বা খোলাখুলি অস্বীকার করে আজকের হিন্দু বাঙালীরা নিজেদের বাসভূমিকে কেন আবার পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ নামক বধ্যভূমি বানাতে চাইছে, তাও আবার সম্প্রীতির নামে, তা বোঝা দুষ্কর।

বাংলার মুক্তিযুদ্ধে ভারতের আত্মঘাত

বিচ্ছিন্নতাবাদ কেবলই আরও আরও ছিন্ন-বিচ্ছিন্নতার দিকে এগোয়। স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে আহূত অনেক অতিথিদেরই গর্ব করে বলতে শুনি, “আমি মুক্তি যুদ্ধ করেছি। আপনাদের সোদপুরেও আমাদের ঘাঁটি ছিল”। লুকোনোর উপায় নেই, অস্বীকারেরও পথ নেই। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রসংঘের কাছে বারবার আবেদন করে জানান, ভারত যুদ্ধ চায় না। প্রতিদিন লক্ষ-লক্ষ শরণার্থী, ভেঙে পড়া অর্থনীতি, উপচে পড়া শরনার্থী শিবিরে হাহাকার – পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে। নিজের দেশবাসীর কাছে আকাশবাণীতে আত্মসপর্মণ, “I am placing my country in the warfront.” রাষ্ট্রসংঘ কোনও সদর্থক হস্তক্ষেপ করেনি যার তত্ত্বাবধানে সারা বিশ্বে বহু উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। সম্ভবত সাদা চামড়ার প্রভূরা আমাদের খেওখেয়ির দিকে তাকিয়ে মজা দেখছিল – বুঝুক কালা আদমিরা স্বাধীনতায় কত সুখ! উত্তাল সত্তর – লোকক্ষয়, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ, হরণ। ভারতীয় জওয়ানরা তাদের মহিলা প্রধানমন্ত্রীর মান রাখতে নারী নির্যাতন থেকে বিরত থেকে সারা বিশ্বের যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল নজির রাখলেও পাকিস্তানি জওয়ানদের তো তেমন কোনও প্রতিশ্রুতি রাখার দায় ছিল না। বরং মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে রাওফরমান, রহিম খান, টিক্কা খানের মত পাকিস্তানী সেনা নায়করা বাংলাদেশের উপর গণহত্যা এবং ধর্ষণ মহোৎসবের যে অবিস্মরণীয় নজির গড়েছেন তার সামান্য পরিচয় ইতিমধ্যেই পেয়েছি এক বাংলাদেশী ভাইয়ের সৌজন্যে। তাছাড়া যুদ্ধের কিছু অবশ্যম্ভাবী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকেই।

কিন্তু বাংলাদেশীদের যন্ত্রণা উপশমে শরণার্থীদের দায়িত্ব নেওয়া ছাড়াও ভারত কীভাবে বাংলাদেশ ও তার ‘বঙ্গবন্ধু’-র জন্য জীবনপণ করেছিল সেই ইতিহাস উল্টে দেখা যেক।
“মেরা ভারত মহান”: একটি অকথিত কাহিনী
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ ১৩ দিন ব্যাপী ইন্দো-পাক যুদ্ধের অবসান ঘটে ভারতীয় সেনা ও বাংলাদেশের ‘মুক্তিবাহিনী’-র সামনে যে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার উদ্বাহু আত্মসমর্পণের মাধ্যমে, আট মাস পরে ২ আগস্ট ১৯৭২-এ সাক্ষরিত ‘শিমলা চুক্তি’ অনুযায়ী তাদের মুক্তি দেয় ভারত। এইসব নরপিশাচরাই যে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে পূর্ববাংলা জুড়ে রেকর্ড হারে অপহরণ, গণধর্ষণ ও গণহত্যার (Bangladesh Genocide) রূপকার, তা জেনেও। আশ্চর্যের ব্যাপার কাশ্মীর সমস্যাকে নিজেদের অনুকূলে আনার শর্ত না দিয়ে কেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এই বিতর্কমূলক ভালোমানুষী, সেই নিয়ে কিন্তু তখনকার বিরোধীপক্ষ বামেরাও তেমন প্রশ্ন তোলেনি, যতটা তাঁর জরুরি অবস্থা নিয়ে নিন্দায় সোচ্চার হয়েছে। বরং ঘোলাজলে ভোটার শিকারেই তারা বেশি মনোযোগী হয়েছিল। আর এখন তো তারা পাক পরিচালিত সন্ত্রাসের অস্তিত্বই অস্বীকার করছে নয়তো তাকে ‘আজাদির লড়াই’ আখ্যা দিয়ে খোলাখুলি নৈতিক সমর্থন জানাচ্ছে।

ঘটনার ৪০ বছর পর জনমানসের বিভ্রান্তি কাটাতে নেপথ্যের গল্প বলেছেন প্রাক্তন ভারতীয় ডিপ্লোম্যাট শঙ্কর এস ব্যানার্জী, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে অক্টোবর ২০১৩-য় ‘Friend of Bangladesh Liberation War’ সম্মান পেয়েছেন যিনি। “Indira Gandhi’s biggest worry after the surrender of Pakistan in 1971 was the safety of Mujibur Rahman. The release of Pakistani POWs was the price Zulfiqar Ali Bhutto (and the ISI) extracted for the safe return of the Bangladeshi leader.”। পাকিস্তানের মিলিটারি কোর্টে চলা মামলার রায় এগোচ্ছিল মুজিবরের মৃত্যুদণ্ডাদেশের দিকে। পাশাপাশি মুজিবকে রাখা জেলের কুঠুরিতে খোঁড়া সাড়ে ছয় ফিটের গর্ত হুমকি দিচ্ছিল যে কোনও মুহূর্তে নিষ্ঠুর হত্যালীলার। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে নিরাপদে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনাটা শ্রীমতী গান্ধীর কাছে ছিল অগ্রাধিকার। সেই সঙ্গে জেনেভা কনভেনশনের (Geneva Convention) পরামর্শ (যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর পালনের দায় নেই) মেনে প্রায় লাখ খানেক পাকিস্তানি সেনাকে সম্মানজনক ও স্বাস্থ্যকর ভাবে জেলে পোষার খরচটাও ছিল যুদ্ধ ও শরণার্থী বিধ্বস্ত ভারতের পক্ষে মহা দায়।
মুক্তিযুদ্ধ জয়ের পর যদি দেশটা নেতাশূন্য অনাথ হয়ে যায়, তাহলে তো সব আয়োজন বৃথা। বাংলাদেশ ও মুজিব পরিবারের স্বার্থে এবং সাহায্যকারী হিসাবে ভারতের মুখরক্ষার খাতিরে তাই যে কোনও মূল্যের জন্য প্রস্তুত ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। র-এর রামনাথ কাও ব্যাপারটা জানতেন। আপৎকালীন সভায় উপস্থিত ছিলেন বিদেশমন্ত্রকের প্রধান নীতি নির্ধারক (head of policy planning in the Ministry of External Affairs) দুর্গা প্রসাদ ধর, RAW প্রধান রামনাথ কাও (যাঁকে ইন্দিরার ‘kitchen Cabinet’-এর এক সদস্য বলা হোত), প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব (principal secretary) পি এন হাস্কর এবং বিদেশ সচিব (foreign secretary) টি এন কউল।
যুদ্ধে শোচনীয় ও লজ্জাজনক পরাজয়ের দায় স্বীকার করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ করেন জুলফিকার আলি ভুট্টোকে Chief Martial Law Administrator of Pakistan হিসাবে পাকিস্তানের শাসনভার দিয়ে। ভুট্টো তখন ওয়াশিংটনে, রাষ্ট্র সংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলের সভায় (UN Security Council meetings) যোগদান করতে। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে রাওয়ালপিণ্ডি ফেরার পথে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে ভুট্টোর বিমানটির জ্বালানি ভরার কথা। ভারতে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত) Chief Secretary (সর্বোচ্চ সিভিল পদাধিকারী) মুজাফ্ফর হুসেনের স্ত্রী লায়লা হুসেন ছিলেন ভুট্টোর একদা ঘণিষ্ঠ বান্ধবী। মুজাফ্ফর হুসেন জেলের বদলে দুর্গা প্রসাদ ধরের বাংলোয় কেন ভিআইপি আতিথ্যে অবস্থান করছিলেন, সে প্রশ্ন অন্য; তবে যুদ্ধবন্দী আধিকারিকের স্ত্রী লায়লার বিশেষ অনুরোধে সাড়া দিয়ে জুলফিকার আলি ভুট্টো একটি রফা করেন এবং দেশে ফিরে পাকিস্তানের শাসনভার পেয়ে মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেন। দুই বন্ধুর এই সাক্ষাত করানোয় শঙ্কর এস ব্যানার্জীর বিশেষ ভূমিকা ছিল।
যাইহোক, বিনিময়ে সময়মতো নিজার যা চাই শ্রীমতী গান্ধীর কাছে চেয়ে নেবেন বলে জানিয়েছিলেন ভুট্টো (“… What I want in return, I will let Mrs. Indira Gandhi know through another channel.”)। এরই পরিণতিতে ২ আগস্ট শিমলা চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানি সেনাদের নিঃশর্তে মুক্তি দেয় ইন্দিরার ভারত। ওদিকে পাকিস্তানে মৃত্যদণ্ডাদেশ রদ হয়ে ৮ই জানুয়ারি মুজিবর মুক্তি পাওয়ার পর ১০ই জানু্য়ারি থেকে মুজিবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভ করলেও তার তিন বছর পরে ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের কতিপয় মিলিটারি অফিসার রহমান পরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়। বলা বাহুল্য সেটা ছিল আইএসআই (ISI)-এর ১৯৭১-এ অপূর্ণ অ্যাজেন্ডারই পূর্ণতা প্রাপ্তি। আর একটা সত্য যা শঙ্কর ব্যানার্জীর লেখায় উল্লিখিত নেই তা হল, মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও গণমাধ্যমগুলির কণ্ঠরোধ করে নিজের একাধিপত্য কায়েমের প্রবণতা সামরিক শাসকদের মতো মুজিবরের মধ্যেও দানা বেঁধেছিল। যিনি ভারতকে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের জন্য গণভোটের মাধ্যমে ভারতভুক্তি সম্পর্কে কাশ্মীরের জনতার মতামত নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনি নিজে কিন্তু গণতান্ত্রের কণ্ঠরোধ করার জন্যই নিজের দেশবাসীর কাছে জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন। তাই মুজিব পরিবারের হত্যায় বাংলাদেশে তেমন কিছু জনরোষ দেখা দেয়নি।

বস্তুত ভুট্টোর কাছে মুজিবরকে আগে মুক্তি দিয়ে বন্দী প্রত্যার্পণের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না, কিন্তু তারও সাত মাস পরে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়া ছিল শ্রীমতী গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের নিতান্ত দয়া, সৌজন্য ও উদারতা যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে বিরলতমের মধ্যে বিরলতম ঘটনা, যেমন বিরল ইতিহাস ছিল বাংলাদেশে একটি (ভারতীয়) সেনাবাহিনীর নারী নির্যাতনে লিপ্ত না হওয়া।

কাশ্মীরের ব্যাপারে পিতা জওহরলাল যে ভুল করেছিলেন, তা সংশোধনের পূর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে মানবিক আবেদনে পুনরায় ভুল করে সৌজন্য দেখাতে গেলেন পুত্রী। অথচ বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সৈয়দ কিন্তু তাঁর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা চিঠিতে সতর্ক করেছিলেন ভারত যেন পশ্চিম সীমান্তে একতরফা যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত না নেয়। চিঠির শেষ লাইনটা ছিল, “When you chop off the tail of a cobra, its head becomes ten times more venomous.” চিঠিটা যথাসময়ে পৌঁছলেও ভারতের অবস্থান তৎক্ষণাৎ বদলে যেত কিনা এখন বলা যায় না; তবে সেই সৌজন্যের প্রতিদান পাকিস্তান এমনকি বাংলাদেশের কাছ থেকেও ভারত কীভাবে পেয়েছে ও পাচ্ছে তার সাক্ষী ও ভুক্তভোগী আমরা সবাই। অথচ সুজনের সঙ্গেই সৌজন্য চলে দুর্জনের সঙ্গে নয়, ঐতিহাসিক ভুল থেকে এই শিক্ষা পেতে ভারতীয় রাজনীতি, কূটনীতি এবং বিদ্দজ্জন সমাজ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবিরা কতদিন সময় নেবে বা আদৌ শিক্ষা নেবে কিনা জানা নেই। আপাতত নাশকতা, খুন, ধর্ষণের ধারাবাহিকতাকেই নিজেদের নিয়তি হিসাবে মেনে নিতে হবে, যার জন্য দায়ী কারা তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হলেও বাঙালী বিদ্দজ্জন সমাজ মিথ্যাচার দ্বারা রাজনৈতিক খেয়োখেয়িকেই নিজেদের বুদ্ধিজীবিকার মানদণ্ড স্থির করে রেখেছে।

আর কাঁটাতার? সে তো লঙ্ঘনের জন্যই – মানবতার খাতিরেও, একমুখী অনুপ্রবেশ ঘটাতেও। কলকাতা রেডিও থেকেই প্রথম ঘোষিত হল, “জয় বাংলা”!! ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানটিকে রাষ্ট্রীয় নারা মেনে নেওয়ার মধ্যে ভারতীয় বাঙালী মণীষা যদি একটু আহত হয়ে থাকে, ‘জয় বাংলা’ যেন সেই আঘাতে একটা ওষধি-প্রলেপ।
কিন্তু আমরা কী পেলাম? আমরা – ভারবাসী, পশ্চিমবঙ্গবাসী? ১৯৭১-এর যুদ্ধে প্রকৃত জয় হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের, কিন্তু চূড়ান্ত সমরকুশলতা দেখিয়েও ভারতের জয় নেহাতই আপাত ও আনুষ্ঠানিক। মুজিবকন্যা দ্বারা চল্লিশ বছর পরে ইন্দিরা গান্ধী মরণোত্তর ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্মানে ভূষিত হলেও পাকিস্তানের কাছে সেই সময় – ১৯৯১-৭২-এ যুদ্ধে জিতেও ভারতকে কার্যত কূটনৈতিক হার ও চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতিই স্বীকার করতে হল। যুদ্ধের সরাসরি আর্থিক ক্ষতির ওপর কিছু দক্ষ সেনা হারিয়ে কোটিখানেক অকৃতজ্ঞ কৃতঘ্ন শরণার্থীর চাপ, ‘বঙ্গবন্ধু’ হতে গিয়ে একটি শত্রু রাষ্ট্রের কাছে চিরশত্রুতার অঙ্গীকার। আরও স্পষ্ট করে বললে একটির বদলে দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্পষ্ট ও গোপন শত্রুতা।

সাংস্কৃতিক দৌত্য করতে ওপার বাংলায় ঘুরে আসা ইন্টালেকচ্যুয়াল ভারতীয় বাঙালী শাখ দিয়ে মাছ ঢাকতে ব্যস্ত। হিন্দীর আধিপত্যই নাকি বাঙালী সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় ও একমাত্র শত্রু, বাংলাদেশ সীমান্ত ভেদ করে আসা সন্ত্রাসবাদী বা অনুপ্রবেশকারীরা নয়। ভারতের বুকে পররাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলন বা জয়ধ্বণিও নয়, এমনকি একের পর এক হামলায় প্রাণহানি ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ইসলামি দুষ্কৃতিদের নিরাপদে আশ্রয়গ্রহণও নয়, সম্ভবত আজকে মেয়েদের ওপর সংঘটিত অপরাধে ভারতে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় স্থানাধিকারও নয়, ঘটনাগুলোর নজির-বিহীন নৃশংসতা তো নয়ই। আমাদের সাহিত্যসভা মন্দ্রিত করে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ যখন সদর্পে ও আবেগকম্পিত স্বরে ঘোষণা করে, “যতদূর বাংলা ভাষা ততদূর আমার বাংলাদেশ”, আমরা শুনে আপ্লুত হই। আমাদের ভাষাগত পরিচয় জাতীয় পরিচয়ের সাথে সচেতনভাবেই সংঘাত করে; আর আমরা নিজেদের উদারতা প্রদর্শনের নেশায় নিজেদের আত্মবিস্মৃতিতে নিজেরাই অভিভূত হই।

প্রসঙ্গত যে মুজিবরকে বাঁচাতে ইন্দিরার এত শিরোঃপীড়া আর ভারতীয় সেনাফর চূড়ান্ত তৎপরতা, সেই মুজিবর সম্পর্কে একটি তথ্য একটু স্মরণ করিয়ে দিই – মুজিবরের আওয়ামি লীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হুসেন শাহিদ সুহ্‌রাবর্দি। একদা পাকিস্তানের দাবিতে অন্যতম সোচ্চার এই ব্যক্তিই দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গে বা পূর্বপাকিস্তানে নিজের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে হয়ে ওঠেন পাকিস্তান বিরোধী (অবশ্যই ভারত বিরোধিতা বজায় রেখে) বাঙালীয়ানার প্রধান কাণ্ডারি, বাঙালী জাতীয়তাবোধের জনক। ‘বঙ্গবন্ধু’ ‘সেকুলার’ মুজিবরও কিন্তু ছিলেন এই সুহ্‌রাবর্দিরই শিষ্য এবং কলকাতা গণহত্যায় তাঁর অন্যতম সহায়। কালসর্প ঠিক নিজের জাত চিনিয়ে দেয়। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েই ‘কৃতজ্ঞ’ বঙ্গবন্ধু ভারতের কাছে আসামকে আবদার করে বসেন এবং অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আসামকে মুসলিম প্রধান রাজ্যে পরিণত করে ভবিষ্যতে গ্রাস করার পথ প্রশস্ত করতে থাকেন।

দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের যৌথ অবদান

প্রসঙ্গত অনুপ্রবেশের একটা খতিয়ান দিলে পশ্চিমবঙ্গের তুলনামূলক সংকটাপন্ন অবস্থাটা পরিষ্কার হয়। অবশ্য তথ্য দ্বারা সত্য উদ্ঘাটিত হয়, মিথ্যাবাদ রোখা যায় না। ১৯৫১-র জনগণনায় ধরা পড়ে ২.৫২৩ মিলিয়ান বা ২৫.২৩ লক্ষ শরণার্থী পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে প্রবেশ করে, যার মধ্যে ২.০৬১ মিলিয়ান পশ্চিমবঙ্গে ও বাকিরা আসাম, ত্রিপুরা ও অন্যান্য রাজ্যে পাকাপাকিভাবে বাসা বাঁধে। ১৯৭৩ সাল নাগাদ শরণার্থীর সংখ্যাটা ৬ মিলিয়ান বা ৬০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। পাশের তালিকায় ভারতে উল্লেখযোগ্য উদ্বাস্তু-স্রোত ও তাদের কারণ দেওয়া হল (major waves of refugee influx and their cause):
Year
Reason
Number in lakhs
1947
Partition
3.44
948
Hyderabad annexation by India
7.86
1950
Barisal riots
15.75
1956
Pakistan becomes Islamic Republic
3.20
1964
Riots over Hazratbal incident
6.93
1971
Bangladesh liberation war
15

অবশ্য পাকিস্তানেরও পাল্টা দাবি ১৯৫১-র সেনসাসে নাকি মূলত বাংলা ও বিহার থেকে ৬,৭১,০০০ উদ্বাস্তু পূর্ববঙ্গে হাজির হয়েছিল যে সংখ্যাটা নাকি ১৯৬১-তে পৌঁছে যায় ৮,৫০,০০০-এ। দেশভাগের পর দুই দশকে মোটামুটি ১.৫ মিলিয়ান বা ১৫ লক্ষ মুসলমান পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার থেকে পূর্ববঙ্গে চলে যাওয়ার যে হিসাব দেওয়া হয়, তা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যায় প্রতিফলিত নয়, কারণ পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতে এখনও পর্যন্ত খেপে খেপে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটেই চলেছে।
প্রসঙ্গত একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে (Bangladesh liberation war) হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ১ কোটি ১০ লক্ষ (11 million) মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও যাদের মধ্যে অন্তত ১৫ লক্ষ (1.5 million) ভারতেই থেকে যায়। পশ্চিমবঙ্গের সংকট অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কত বেশি গুরুতর ছিল বা আছে, এর থেকে পরিস্কার হয়।

বাংলার দ্বিতীয়বার বিভাজন হিংসা ও সন্ত্রাসের যে উত্তরাধিকার সঞ্চার করেছে এই উপমহাদেশে, তার থেকে আজও মুক্তি নেই; বরং বিশ্বসন্ত্রাসবাদের পটভূমিকায় জটিলতর রূপ ধারণ করেছে। বাসবী ফ্রেজারের ভাষায়, “There is the reality of the continuous flow of ‘economic migrants’ / ‘refugees’ / ‘infiltrators’ / ‘illegal immigrants’ who cross over the border and pan out across the sub-continent, looking for work and a new home, setting in metropolitan centers as far off as Delhi and Mumbai, keeping the question of the Partition alive today”.
বিভাজন না মানলে হিংসা, মানার পরেও হিংসা, পুনরায় বিভাজনের পরিস্থিতিতে হানাহানি এবং তা বন্ধ করে আর্তকে রক্ষা ও আত্মরক্ষার চেষ্টা করায় চিরতরে ধারাবাহিক হিংসার লক্ষ্য হওয়া! নৃতত্ত্বের যাদুঘরের কী নিদারুণ নিয়তি!

চলবে