বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

১৯ তম পর্বের পর
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

বরাক উপত্যকার ইতিহাস ও জন মানচিত্র

বরাক উপত্যকা যার নামকরণ বরাক নদীর নাম থেকে, দক্ষিণ আসাম নামেও পরিচিত)[১]। আসাম রাজ্যের তিনটি প্রশাসনিক জেলা নিয়ে গঠিত – কাছাড়, করিমগঞ্জ, এবং হাইলাকান্দি। এই উপত্যকার প্রধান শহর হল শিলচর কাছাড় জেলায়। আগে কাছাড় ও হাইলাকান্দি ব্রিটিশ ভারতের কাছাড় জেলায় এবং করিমগঞ্জ শ্রীহট্ট বা সিলেট জেলার অন্তর্গত ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় করিমগঞ্জকে পূর্ববাংলার সিলেট জেলা থেকে কেটে ভারতের আসাম রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়, এবং সিলেটের বাকি অংশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানকার মানুষের মান্য ভাষা বাংলা আর কথ্যভাষা হিসাবে সচরাচর সিলেটি উপভাষার চল, যা অবশ্যই বাংলারই উপভাষা।

“বরাক” নামটি ‘ব্রা’ ও ‘ক্রো’ শব্দদুটির সমণ্বয় থেকে এসেছে। ব্রা-র অর্থ বিভক্ত হওয়া এবং ক্রো-র অর্থ উপরের অংশ বা শাখা। বরাক নদীটি করিমগঞ্জ জেলার হরিতিকরের কাছে সুরমা নদী এবং কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়েছে। এই বিভাজিত নদীর শাখাস্রোতকে স্থানীয় মানুষেরা ‘ব্রাক্রো’ নামে উচ্চারণ করত। বহুবছর ধরে উচ্চারণ বিকৃতির ফলে ব্রাক্রো নামটি বরাকে পরিণত হয়েছে।[২]

বরাকের ইতিবৃত্ত তুলে ধরার জন্য দেবব্রত দত্তর ‘History of Assam’ এবং সঞ্জীব দেবলনস্করের আন্তর্জালকে প্রকাশিত ‘বরাক চর্চা’ পর্যায়ের “ইতিহাস কিংবা প্রাক্-ইতিহাস, বরাক একশো ভাগ বাঙালী” শীর্ষক আলোচনাকে আশ্রয় করেছি। দুটি ইতিবৃত্তে ফারাক নেই বিশেষ। জায়গায় জায়গায় সঞ্জীববাবুকে সরাসরি উদ্ধৃত করেছি।

সঞ্জবীব দেবলনস্কর জানাচ্ছেন দক্ষিণ আসামের তিনটি জেলাই মধ্যযুগে ‘কাছাড়’ নামেই পরিচিত ছিল যেটি ভৌগোলিকভাবে বঙ্গীয় সমভূমিরই ভৌগোলিক ভাবে অঞ্চলটি বঙ্গীয় সমভূমিরই সম্প্রসারিত অঞ্চল। প্রাগৈতিহাসিক পর্ব (প্রাচীন যুগ) থেকেই এ অঞ্চলে আর্য-ব্রাহ্মণ্য জনগোষ্ঠীর আগমন, কৃষিসংস্কৃতির বিকাশ, ত্রিপুরী-কামরূপী এবং হরিকেল-সমতট রাষ্ট্রশক্তির আত্মপ্রকাশ। সব মিলিয়ে দশম শতকে শ্রীহট্ট রাজ্যের অভ্যুত্থান পর্যন্ত একটি ঐতিহাসিক রূপরেখার আদল পাওয়া যায় যদিও ওই পর্বে অঞ্চলটি এক বা একাধিক রাষ্ট্রশক্তির আওতায় আসে। কিন্তু দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে স্বাধীন সার্বভৌম শ্রীহট্ট রাজ্যের বিভাজন, পতন এবং তুর্ক-আফগান শাসন প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তীতে ত্রিপুরী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পর বরাক উপত্যকার সমাজ ও জাতি-গঠনের ইতিহাসে দ্বিতীয় পর্বের সূচনা ধরা যায়।
ত্রিপুরী শাসনের সপক্ষে বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শন, লোকশ্রুতি ছাড়াও বরাকবিদদের হাতে এসেছে ত্রিপুরি রাজা, আদি ধর্মফা প্রদত্ত একটি সংস্কৃত তাম্রপত্র, যেখানে “ত্রিপুরা চন্দ্রবানাব্দে মকরন্দে রবৌ শুক্লপক্ষে পঞ্চদশী দিনে” (৬৪১ খ্রিস্টাব্দে) ক্রোশিয়া (কুশিয়ারা) নদীর তীরে ভূমিদানের কথা রয়েছে। তাছাড়া খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে কামরূপরাজ ভাস্কর বর্মণকে তাঁর বৃদ্ধ প্রপিতামহ ভূতিবর্মণের দেওয়া নবীকৃত তাম্রশাসনে উল্লেখ আছে ‘চন্দ্রপুরি বিষয়া’র সীমারেখায় কাছাড় জেলার একাধিক অঞ্চলের অবস্থিতির, যা এ অঞ্চলে কামরূপ রাজ্যের সাক্ষ্যও বহন করছে। অন্য দিকে, দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের সমতট ভূমির সামন্তরাজ লোকনাথের অপর একটি তাম্রশাসনে সমতল কাছাড়ে ‘জয়তুঙ্গবর্ষ’-এর অন্তর্গত ‘সুরঙ্গ বিষয়া’তে ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের কথা রয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, বিভিন্ন পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্রে বরাক উপত্যকার সংস্কৃত নাম ‘সুবঙ্গবর্ষ’ আবিষ্কৃত হওয়ার পর এই অঞ্চলে বাঙালীর বসবাসের প্রাচীনত্ব নিয়ে কথা উঠতে পারে না। তাছাড়া ঐতিহাসিক হেড়ম্বচন্দ্র বরপূজারী তাঁর ‘History of Assam’ বইয়ে জানি্য়েছেন, খ্রীষ্টীয় পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে কামাখ্যা সংলগ্ন অঞ্চলে নবদ্বীপ থেকে ব্রাহ্মরা এসে বসতি করেন রাজার আমন্ত্রণে। মোটমুটি একই সময়ে বরাক উপত্যকার মণিপুর সংলগ্ন শৈবতীর্থ ভূবন পাহাড়ে এবং বদরপুরে কপিলাশ্রমেও ব্রাহ্মণদের বসতি শুরু হয়। ক্রমশ অব্রাহ্মণ হিন্দু বাঙালীরাও এসে বাসা বাঁধে। সুতরাং ‘ভূমিপুত্র’ শব্দটি অহমদের চেয়ে অনেক বেশি হিন্দু বাঙালীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ ‘কৃতসার’-এ শ্রীহট্টকে ‘হরিকেল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ত্রিপুরা, কুমিল্লা, শ্রীহট্টের বিভিন্ন স্থানে হরিকেল মুদ্রার আবিষ্কার এ অঞ্চলে হরিকেল রাজ্যের বিস্তার স্পষ্ট করেছে। শ্রীহট্টের ‘পশ্চিমভাগ তাম্রফলক’ থেকে দশম শতকে শ্রীহট্ট-কাছাড়ে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের নতুন তথ্য পাওয়া যায়। চতুর্দশ শতকে ত্রিপুরি রাজত্বের বিস্তৃতি ঘটে কাছাড়ের লালা, প্রতাপগড় অঞ্চলে। তার অবসান হয় ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে কাছাড়ে কোচ শক্তির আত্মপ্রকাশে। কোচ সেনাপতি চিলারায় মাইবাঙ রাজকে পরাভূত করে সমতল কাছাড় পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং নিজের ভাই কমল নারায়ণকে উপ-রাজ নিযুক্ত করে ফিরে যান। একাধিক রাজা কাছাড়ের খাসপুরে রাজত্ব করার পর শেষ রাজা ভীমসিংহের কন্যার সঙ্গে ‘ডিমাসা’ রাজবংশের যুবরাজ লক্ষীচন্দ্রের বিবাহ ও দুই রাজ্যের সংযুক্তিতে কোচ রাজত্বের অবসান হয়। ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে সমতল কাছাড়ে ‘ডিমাসা’ রাজত্বের পত্তন ও সম্প্রসারণ ঘটে, চলে ১৭৫৯ পর্যন্ত। এঁদের রাজধানী ছিল খাসপুর।
১৭৫০ থেকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ ক্রমান্বয়ে একাধিক রাজা খাসপুরে রাজত্ব করেন। এর মধ্যে ডিমাসা বংশের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন নিঃসন্তান। গোবিন্দচন্দ্রের সীমানা ছিল বর্তমান নওগাঁ জেলার যমুনামুখ ও ডবকলার নিকট পর্যন্ত। উত্তরাংশের বা পার্বত্য কাছাড়ের নেতা কাচাদিন বা কাহিদান (Kahi Dan) কখনই গোবিন্দচন্দ্রের অধীনতা মানেন নি। কাচাদিনকে গোবিন্দচন্দ্র কৌশলে হত্যা করার পর তাঁর পুত্র তুলারাম প্রতিশোধ নিতে কাছাড়-রাজের ওপর নাগা, কুকি প্রভৃতি পার্বত্য উপজাতিদের সংঘবদ্ধ করে বারবার আক্রমণ চালান। পরপর তিনটি যুদ্ধে জিতেও যান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যস্থতায় চুক্তি অনুযায়ী গোবিন্দচন্দ্র উত্তর কাছাড়ের স্বাধীন সেনাপতি বা করদ রাজা হিসাবে তুলারামকে মেনে নেন।

কৃষ্ণচন্দ্র এবং গোবিন্দচন্দ্রের রাজত্বকাল থেকেই রাজ্যে ইংরেজদের আনাগোনার শুরু। একদিকে সিলেট ইংরেজদের হস্তগত; অন্যদিকে কাচাদিন ছাড়াও ব্রহ্মদেশ ও মণিপুরের সাম্রাজ্য বিস্তারে কাছাড়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হতে থাকে। ফলে রাজ্যে বহিঃশত্রুর মোকাবিলার জন্য ইংরেজদের সাহায্যও প্রার্থনা করা হয়। ১৮২৪ সালে কর্নেল ইনিস ব্রহ্মসৈন্যদের প্রতিহত করেন। এর পর বড়লাট বাহাদুরের প্রতিনিধি ডেভিড স্কটের সঙ্গে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ডিমাসা রাজার একটি চুক্তি হয়। কার্যত এই ‘বদরপুর সন্ধি’র পরই ডেভিড স্কটের হাতে কাছাড়ের স্বাধীনতার অবসান।

সঞ্জীব দেবলনস্করের মতে, “গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন স্বভাবকবি, প্রশাসনে উদাসীন। স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে মণিপুরি যুবরাজদের ক্ষমতা প্রদর্শনের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে ওঠে কাছাড়। তাঁদের ষড়যন্ত্রে রাজা গোবিন্দচন্দ্র রাজধানী ছেড়ে অস্থায়ী রাজধানী, হরিটিকরে সরে আসেন। অবশেষে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে মণিপুরী যুবরাজ গম্ভীর সিংহের চক্রান্তে গোবিন্দচন্দ্র আততায়ীর হাতে নিহত হন। কাছাড়ের রাজসিংহাসন শূন্য হয়ে পড়ে। অপুত্রক রাজাকে ইতিপূর্বে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের জন্য দত্তক গ্রহণ করতেও ইংরেজরা বাধা দিয়েছিল। এ দিকে, ডিমাসা সেমফঙের সদস্যরাও উত্তরাধিকারী নির্বাচনের বিষয়ে একমত হতে পারেন না। রাজমহিষী ইন্দুপ্রভার বৈধতা নিয়ে ইংরেজরা তো বটেই, প্রভাবশালী ডিমাসা প্রতিনিধিরফাও প্রশ্ন তোলেন। পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। ইংরেজরা এটাই চাইছিল। প্রজারা নিরাপত্তাহীনতায় রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। এই অবস্থায় ১৮৩২ সালের ১৪ অগস্ট, একটি অধ্যাদেশ জারি করে ডিমাসা রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ইংরেজরা কাছাড় অধিগ্রহণ করল। কাছাড়ের প্রশাসক নিযুক্ত হলেন ক্যাপ্টেন টমাস ফিশার।”

ওদিকে তুলারামের মৃত্যুর পর (১৮৫১) তাঁর দুই পুত্র নকুলরাম ও ব্রজনাথ উত্তরাধিকার ভোগ করতে থাকে। ইংরেজ সরকারের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি ছিল ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনও সামরিক অভিযান চালাবে না। কিন্তু চুক্তি ভেঙে নকুলরাম নাগাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে মারা যাওয়ার পর ইংরেজ সরকার ১৮৫৪-তে উত্তর কাছাড়ও কব্জা করে নেয়।
“অধিগ্রহণের পর ‘নন-রেগুলেটেড প্রভিন্স’ কাছাড়কে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের ‘মিনিটস্’ অনুযায়ী বাংলা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সুপারিনটেন্ডেন্টই তখন একাধারে প্রশাসক, বিচারক এবং রাজস্ব প্রধান। তাঁর আদালতের বিরুদ্ধে আপিলের জন্য যেতে হত চেরাপুঞ্জিতে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গভর্নর জেনারেলের প্রতিনিধি ডেভিড স্কটের কার্যালয়ে। মুক্তারি প্রথার বিরুদ্ধে প্রবর্তিত হল তহশিলদারি প্রথা। ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলাগুলিকে আনা হল কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ের আওতায়। কাছাড় জেলাটিকে আনা হল সিলেটের দায়রা বিচারকের আওতায়। প্রতিরক্ষার জন্য প্রথমে কাছাড় লেভি, পরে ‘সুরমা ভ্যালি লাইট ইনফ্যান্ট্রি’ গঠন করা হয়। পরে এই লাইট ইনফ্যান্ট্রি রূপান্তরিত হল ‘আসাম রাইফেলসে’। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের রণাঙ্গন হিসেবে কাছাড়ের মাটিতে ঝরল সিপাহিদের রক্ত।”
১৮২৬ সনে যখন ইংরেজ প্রথম অহমরাজ্য অধিকার করে তখন তার অন্তর্ভূক্ত ছিল মাত্র পাঁচটি জেলা – কামরূপ, দরং, নওগাঁ, শিবসাগর ও লখিমপুর। এর ছয় বছর পর ১৮৩২-এ দক্ষিণ কাছাড় এবং তারও পরে ১৮৫৪-তে উত্তর কাছাড়ও কাম্পানির শাসনে চলে আসে। প্রথমে ঢাকা ও পরে কলকাতা থেকে এইসব অঞ্চলের শাসনকার্য চালানো হোত। এরও পরে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জেলাগুলিকে নিয়ে চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশ হিসেবে ১৮৭৪ সালে শিলং-এ রাজধানী স্থাপন করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পূর্বোক্ত পাঁচটি জেলার সঙ্গে আশেপাশের অন-আসামীয় অঞ্চল জুড়ে আধুনিক আসাম রাজ্যের পত্তন করে ইংরেজ। প্রশাসনিক সুবিধার্থে অসমকে সংগঠিত করার জন্য প্রয়োজন জনসংখ্যা এবং রাজস্ব বৃদ্ধির। সেই উদ্দেশে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনটি বঙ্গবাসী জেলা গোয়ালপাড়া, সিলেটের ও কাছাড়কেও অসমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল। “আর এরই সঙ্গে প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বের স্বাধীন ‘কাছাড় রাজ্য’ হয়ে গেল অসম প্রদেশের একটি জেলা। এক কালের স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য ও পরবর্তী কালে বাংলা ডিভিশনের অঙ্গ কাছাড়ের গরিমার পতনের শুরু তখন থেকেই।”
“স্বাধীন ভারতের মাটিতে বঙ্গীয় ঐতিহ্যের ধারা বহন করে আসা আবহমানকালের ভারতীয় ঐতিহ্য-লালিত এই নির্বাসিতা ভূমির সন্তানের অস্তিত্ব, নাগরিকত্ব, ভাষা এবং সাংস্কৃতিক বৈধতা আজ প্রমাণ সাপেক্ষ! ইতিহাসের এ এক নির্মম পরিহাস!”

কিন্তু পরিহাসের চালচিত্র একদিনে গড়ে ওঠেনি। শ্রীহট্ট বা সিলেটে মধ্যযুগের গোড়ায় ইসলামি ধর্মগুরু শাহজালালের বেশ কয়েকজন শিষ্য পূর্ব প্রান্তের মহকুমা করিমগঞ্জ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, যার প্রভাবে ব্যাপক ধর্মান্তরণ হয়ছিল। এদের উত্তর প্রজন্মকেও ‘ভূমিপু্ত্র’ না বলার কারণ নেই। কেন না ধর্ম বদলালেও তারা ভুঁইফোঁড় বহিরাগত নয়। উপরন্তু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় মুখ্যত ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষিজীবী বাঙালী মুসলমানদের আগমণ শুরু হয় ব্রিটিশ প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতাতেই যেহেতু ব্রহ্মপুত্রের ‘ভূমিপু্ত্র’রা ছিল কৃষিশ্রমে বিমুখ। ১৯০৬-এ মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর আসামে মুসলিম সংখ্যাধিক্য বাড়ানোর বিশেষ উদ্যোগ দেখা যায়, যা প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসন পাওয়ার পর মহম্মদ সাইদুল্লাহ্ ও মইনুল হক চৌধুরীর মুখ্যমন্ত্রীত্ব ও কৃষিমন্ত্রীত্বের অধীনে খুবই বেড়ে যায়। দেশভাগের অভিঘাতেও তাদের খুব বেশি ওপার বাংলায় চলে যাওয়ার দরকার পড়েনি। বরং বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গ থেকে মুসলিম বাঙালী আগমণের ঢল নামে, যে স্রোত বহুদিন পর্যন্ত থামেনি। আর হিন্দু বাঙালীরা তো প্রাণ বাঁচাতে দেশভাগ ইস্তক সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত কাতারে কাতারে আসামে আশ্রয় নিয়েইছে। এই কারণেই মূল অধিবাসীর পরিচয় শরণাথী ও অনুপ্রবিষ্টের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। বাংলাভাষী ও বাংলাদেশী অসমীয়াদের কাছে সমার্থক হয়ে গেছে।
কাছাড় কোনও কালেই আসামের অংশ ছিল না। সমতল কাছাড়ের শতকরা আশি ভাগ বাংলাভাষী। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে সরকারি ভাষাও ছিল বাংলা। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাকি অংশে অবশ্য অসমীয়া ভাষার চল বেশি যদিও পার্বত্য ভাষার চেয়ে অধিক বলা যায় না। বেঙ্গল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে থাকার কারণে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক ১৮৩৫ সালে বাংলাকে সমগ্র আসামের শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে লাগু করার পর থেকেই বিবাদের শুরু হয়েছিল। অসমীয়াকে তখন বাংলারই একটা উপভাষা ভাবা হোত। ব্যাপটিস্ট মিশনারীদের গবেষণা অসমীয়াকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পর অসমীয়ারা ভাষার দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৮৭৩ সালের ৯ই এপ্রিল শিক্ষার মাধ্যম হিসাবেও অসমীয়ার দাবি স্বীকৃত হয়। আর শহুরে স্কুলগুলোয় বাঙালী ছাত্রসংখ্যা মাথায় রেখে বাংলা শর্তসাপেক্ষে নিছক একটি বিষয়ে পরিণত হয়। বাংলাভাষীরা পরভাষা, পরধর্ম ও পরসংস্কৃতি-সহিষ্ণু; কোনও অশান্তি করেনি তাই নিয়ে।

অথচ ১৯৩১ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতার ১৬ বছর আগের এক গণনায় প্রকাশ: ১. বরাক-সুরমা উপত্যকায় (সিলেট, কাছাড়, করিমগঞ্জ) বাংলাভাষী ২৮,৪৮,৪৫৪, অসমীয়াভাষী ৩৬৯২। ২. ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় (নেফা ও পার্বত্য অঞ্চল) অসমীয়াভাষী ১৯,৭৮,৮৩২, বাংলাভাষী ১১,০৫,৫৮১, পার্বত্য ১২,৫৩,৫১৫। অর্থাৎ তথাকথিত আসামরাজ্যে বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল অসমীয়াভাষীর দ্বিগুণ। স্বাধীনতার পরেও তাই স্বাভাবিকভাবে বাংলাভাষীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকেই গেছে।
বরাক-সুরমা উপত্যকার উত্তরে খাসিয়া-জয়ন্তীয়া ও বড়াইল পর্বতমালা, পূর্বে মণিপুরের শৈলশ্রেণী, দক্ষিণে মিজোরাম ও ত্রিপুরার পর্বতমালা আর পূর্ব দিকে অধুনা বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ। এই ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সীমানায় স্বাভাবিকভাবেই বরাক-সুরমা উপত্যকা বঙ্গভূমিরই পূর্ব প্রান্তিক আঞ্চল হিসাবে গণ্য হয়েছে। ব্রহ্মদেশের সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের পর ইংরেজরা এই অঞ্চল অধিগ্রহণের পর প্রথমটায় যে একে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সঙ্গে যুক্ত করেছিল, সেটাই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অবধারিত ছিল। বরং পরে ১৯৭৪ সালে আসাম রাজ্যের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে বাংলা থেকে কাছাড়, সিলেট ও গোয়ালপাড়াকে জুড়ে দেওয়াটাই ছিল ভাষা-সংস্কৃতির দিক থেকে অযৌক্তিক। ১৯১১-য় বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহারের সময় এই তিনটি জেলার কথা শাসক ও আন্দোলনকারী কারও অভিনিবেশ পায়নি। এর ফলে অসমীয়া সম্প্রসারণবাদ গোয়ালপাড়াকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে এবং কাছাড়ে স্থায়ী অশান্তির সূচনা হয়। শুধু ১৯৪৭-এ গণভোটের মাধ্যমে সিলেট আসামের কবল থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ববঙ্গে ফিরলে তা ভারতে থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বর্তমানে ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী বরাক উপত্যকার মোট জনসংখ্যার ৪২% হিন্দু, ৫০% মুসলিম, ৪% খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ৪%। কাছাড় জেলায় হিন্দুধর্মাবলম্বীরা হল সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬০%, কিন্তু করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ – যথাক্রমে ৫৩% ও ৫৮%।[৩] পুরো উপত্যকায় মুসলমান বাঙালীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বরাকের বাংলাভাষা আন্দোলনে তাদের বিস্ময়কর অনুপস্থিতি ছিল! তাদের তরফে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তৎপরতা শুরু হয়েছে ২০১০-এ ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার (NPR) প্রস্তুতি শুরু হওয়ার পর।