বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

২০ তম পর্বের পর

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

বঙ্গাল খেদা ও বাংলা ভাষা আন্দোলন

দক্ষিণ তথা সমগ্র আসামে বাঙালী সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াও সরকারী চাকরি ও অন্যান্য উচ্চপদে সেই ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই বাঙালীরা অগ্রসর। সংখ্যালঘু অসমীয়াদের ঈর্ষার কারণ এগুলোও। দেশভাগের পর বরাক উপত্যকার বাংলাভাষী কাছাড়, করিমগঞ্জ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্যুত হয়ে আসামের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় অসমীয়ারা প্রতিশোধ নেওয়ার অবকাশ পেয়ে গেল। তাই ১৯৫৫-তেই প্রথম বঙ্গাল খেদানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল যদিও তা বেশি দুর ছড়াতে পারেনি। পরম সহিষ্ণু বাঙালীরা সংখ্যাগুরু হয়েও একতরফা মার খেয়ে শান্তিরক্ষা করে।
কিন্তু অশান্তি করার মতো বিষয়, যেমন অসমীয়াকে বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষা করার যে দাবিটা অহমদের ছিলই, প্রতিরোধহীন বাঙালীর শান্তিপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে তা ১৯৬০ সালে “বঙ্গাল খেদা” আন্দোলনের রূপ নেয়। এবারে সমগ্র আসাম জুড়ে এক-তরফা বাঙালী নিধনের আগুন জ্বলে ওঠে। ৪ঠা জুলাই থেকে টানা দশদিন। বহু বাঙালী নরনারী শহীদ শিরোপা না পেয়েই মারা গেল। আর নরমেদ যজ্ঞ সফল হল ’৬০-এর ২৪শে অক্টোবর আসাম বিধানসভায় “একক অসমীয়া ভাষা বিল” পাস হওয়ার মাধ্যমে। বঙ্গভাষীরা না হয় ভেদ্য লক্ষ্য, বিবেচিত হল না বিপুল সংখ্যক পার্বত্য জনজাতির কথাও। রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশও সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য হল (State Recognisation Commission, Report, Pg-211, sec 733, Para 719)।

চমৎকার! যে বাঙালীরা বহিরাগত শরণার্থী, তাদেরও যাহোক একটা পুনর্বাসন হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, দন্ডকারণ্যে বা আন্দামানে। কিন্তু বরাক-কাছাড়-করিমগঞ্জের যেসব বাঙালীরা সেখানকারই ভূমিসন্তান, তাদের রাতারাতি উচ্ছেদ প্রাদেশিক আন্দোলনের রূপ পেয়ে গেল। রাজ্যভাষাবিরোধী কাছাড়কে রাজ্যের মানচিত্র থেকে অপসারণের প্রস্তাবও ওঠে। অথচ কাছাড়ের বাঙালাভাষীরা অসমীয়া সাহিত্য-সংস্কৃতি বর্জন করার বদলে তার দ্বারা সমৃদ্ধই হতে চেয়েছে। তাই এত অত্যাচারের পরও পৃথক রাজ্যের সঙ্গত দাবি ওঠেনি সেভাবে। হয়ত দেশভাগের ফলে দাঙ্গার নারকীয় স্মৃতিই তাদের রাজ্য ভাঙাভাঙির প্রতি অনীহা তৈরি করেছিল। কিন্তু আরও একটু আগে ‘ভালোমানুষ’ বাঙালী জেগে উঠলে একতরফা প্রাণনাশ কিছুটা ঠেকানো যেত।

অন্যদিকে সংঘাতের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ শোনা যায় একটি বেনিয়া জনগোষ্ঠীর প্ররোচনা। শিক্ষিত সম্প্রদায় – তা অভিবাসীই হোক বা ভূমিসন্তান, অর্থনৈতিক শোষণের পথে অন্তরায়। তাই তাদের বিরুদ্ধে উস্কানি বা হিংস্রতায় অর্থ যোগান –কোনওটা দিতেই কার্পণ্য করেনি মাড়োয়ারিররা।
আসাম বিধানসভায় একপেশে ‘একক অসমীয়া ভাষা বিল’ পাস হওয়ার পর সেখানকার বাঙালীদের কিছুটা টনক নড়ে। একতরফা সমঝোতায় শান্তিরক্ষার বদলে তারা ক্রমশ অস্তিত্ব হারাতে বসেছিল। ১৯৬১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে আহূত কাছাড় জেলা সম্মেলনে যে কঠিন সংকল্প গৃহীত হয়, তা মাতৃভাষার সম্মানার্থে আত্মোৎসর্গের অঙ্গীকার। মারের বদলা মার নয়, শুরু হয় শান্তিপূর্ণ পিকেটিং-কে অস্ত্র করে মাসের পর মাস ‘সত্যাগ্রহ’। ১৯শে মে শিলচর স্টেশনে (Silchar railway station) প্রথম রেল অবরোধ হয়। অবরোধের সময় হঠাৎ খবর করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিস লাঠিচার্জ করেছে। হরতাল তবু মনে হচ্ছে সফল। শিলচর স্টেশন দিয়ে একটাও গাড়ি চলাচল করতে পারেনি। অকস্মাৎ চিৎকার – কাটিগড়ায় ধরা সত্যাগ্রহীদের গাড়িতে আগুন। আন্দোলনকারীরা ছুটে গিয়ে কাদা, পাঁক, জল দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলল। তারপর লাঠিচার্জ না করে উপায় থাকে? “হরতাল সফল হতে চলেছে, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ”! তিন হাজার কণ্ঠ্যে একই কথা! তাই নাকি? ২টো ৩৫মিনিটে গুলি চলে। এগারোজন ঘটনাস্থলেই শহীদ। আহত শতাধিক। কিশোরী কমলা, বালিকা মঙ্গলা কেউ রেহাই পেল না।

আন্দোলন চলে একমাস। আসাম সরকার বাধ্য হয় কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলার সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলাকে মেনে নিতে। Barak Valley.[6][7] Section 5 of Assam Act XVIII, 1961-তে আছে, “Without prejudice to the provisions contained in Section 3, the Bengali language shall be used for administrative and other official purposes up to and including district level.”[8]

বাঙালীরা অবশ্য বাংলা ভাষাভিত্তিক অঞ্চল নয়, চেয়েছিল সমগ্র আসামে দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি। মিলল না। তবু পৃথক বঙ্গভাষী রাজ্যের দাবি তোলেনি, যেখানে রক্তস্নাত না হয়েও বোড়োল্যান্ড, কার্বি আলং রাজ্যের দাবি তুলছে বিভিন্ন জনজাতির মানুষ। পৃথক রাজ্যের দাবি তোলার বিপদটা কী, তা টাকার উল্টো পিঠে লেখা, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

ইতিহাসের পরিহাসও তেমনি! একদিন যারা “বঙ্গাল খেদা”র জিগির তুলেছিল, তাদেরই উগ্রতম অংশ (হয়ত বা প্রচ্ছন্নভাবে অনেকেই) এক সময় ভারত থেকেই বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি তুলেছে। প্রথমদিকে এদেরও বাঙালী হত্যায় মদত দিয়েছিল ‘অহিংস’ ঐ বেনে গোষ্ঠী। পরে আসু (AASU), অগপা বা আসাম গণ পরিষদ (AGP), আলফার (ULFA) আক্রোশ তাদের দিকেও বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। যতদিন আসামে শুধু বাঙালীরা মার খেয়েছে, ততদিন দিল্লীর চোখ না খুললেও হিন্দীভাষীরাও আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে আসামে ধ্বণিত হয়েছে সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ। কিন্তু তার পরেও ২০১৪-র পর থেকে ‘আসু’ বাঙালী উচ্ছেদের উদ্যোগ যেন নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করেছে, আর সেই উদ্দেশ্যে তৈরি করেছে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ। এর মাধ্যমে কেন্দ্রের শাসক দলের ব্যানারে সরাসরি বা সহযোগীর ভূমিকায় কৌশলে ঢুকে আগে দখল করেছে রাজ্যের শাসনভার আর তা করার পর থেকে নিজেদের পুরোনো অ্যাজেন্ডাকে বাস্তবায়িত করতে চাইছে ফ্যাসিবাদী কায়দায়। চিলাপাথারে গোলমাল বাধিয়ে উদ্বাস্তু নেতা সুবোধ ঘোষকে মিথ্যে অভিযোগে কারারুদ্ধ করা, কিংবা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিট্রার (NPR)-এ কারচুপি করে সমস্ত বাঙালীদের বহিরাগত চিহ্নিত করা সেই অ্যাজেন্ডারই বাস্তবায়নের প্রয়াস।

এপার ওপার দুই বাংলার মানুষের কাছে ক্রমশ ২১শে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ১৯শে মের ভাষা আন্দোলনও স্মরণীয় হয়ে উঠছে। আব্দুল বরকতদের পাশাপাশি ক্রমশ উল্লিখিত হচ্ছে ১৯৬১-র ১৯শে মের ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য (Kamala Bhattacharya), সুনীল সরকার, সুকোমল পুরোকায়স্থ, তরণী দেবনাথ, হিতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল (Sachindra Chandra Pal) , চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, কানাইলাল নিয়োগী (Kanailal Niyogi) , কুমুদরঞ্জন দাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর (Birendra Sutradhar); অথবা কদাচিত ১৬ই আগস্ট ১৯৭২-এ করিমগঞ্জে নিহত বিজন চক্রবর্ত্তী কিংবা ২১শে জুলাই করিমগঞ্জে শহিদ জগন্ময় দেব, দিব্যেন্দু দাস, কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস এঁদের নামও। কিন্তু এই আলোচনায় সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সুকৌশলে ১৯-শে মে দরদীদের প্রচারে এড়িয়ে যাওয়া হয়। টাকার ওপিঠের গল্পটাই এখন শোনাতে চেষ্টা করি।

টাকার ওপিঠ: অনুপ্রবেশ ও সংঘাত
প্রাক-স্বাধীনতা:

পূর্বতন পাকিস্তান ও আজকের বাংলাদেশ থেকে ৬০ বছর ধরে ক্রমাগত অনুপ্রবেশের ফলে আসামে বাঙালীর যে সংখ্যাধিক্য তাতে মার খাওয়া হিন্দু বাঙালীর পাশাপাশি মুসলিম বাঙালীর সংখ্যা কিছু কম নয়, বরং এতটাই বেশি যে বিধানসভা গঠনে এদের সমর্থন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

১৯০৫-এ প্রথম বঙ্গভঙ্গের পর থেকেই মুসলমান কৃষকরা আসামের উর্বরা ব্রহ্মপুত্র ও সুরমা উপত্যকায় ক্রমাণ্বয়ে বসবাস শুরু করে। শুধু তাই নয় ১৯০৬-এ মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর নবাব সেলিমুল্লাহ খুব স্পষ্ট করেই মুসলমানদের আসামে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে বলেছিলেন। বস্তুত চাষাবাদের কঠিন কায়িক শ্রমে ব্রহ্মপুত্রের আদি অববাহিকাবাসীর অনীহার কারণেই সরকারি আমন্ত্রণে পূর্ববঙ্গের মুসলিম চাষীরা সেখানে বসত পেয়েছিল। আসামের দুর্গম বনভূমি ও চরাঞ্চল শষ্যশ্যামল হয়ে ওঠার পেছনে মুসলিম কৃষকদের অবদান অস্বীকারের জায়গা নেই। কিন্তু তার পেছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিসন্ধিটা স্পষ্ট হতে স্থানীয়দের মনে জাতিবিদ্বেষের বিষবৃক্ষের চারা মহীরূহ হয়ে উঠল।

১৯৩৫-এ Government of India Act অনুসারে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন চালু হলে কংগ্রেস ১৯৩৬ সালে আসামের প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৩৮টি আসন জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু আইনের মধ্যে প্রাদেশিক প্রশাসকদের ক্ষমতা ছাঁটা বুঝে কংগ্রেস প্রদেশ সরকার গঠন না করে বিরোধীর ভূমিকায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। গোপীনাথ বরদোলোই বিরোধী নেতা নির্বাচিত হন। আর কংগ্রেস ছাড়া অন্যান্য দলের সমর্থনে ক্যাবিনেট গঠন করার সুযোগ পান মহম্মদ সাইদুল্লা যাঁর অ্যাজেন্ডা ছিল আসামে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ানো।

একদিকে কংগ্রেসের উত্তোরোত্তর জনপ্রিয়তা এবং গোপীনাথ বরদোলোইয়ের স্বচ্ছ ভাবমূর্তী, অন্যদিকে তৎকালীন আসাম সরকারের অপদার্থতার জেরে সইদুল্লার ক্যাবিনেট ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বরে পদত্যাগ করে। অতঃপর ২১ সেপ্টেম্বর গোপীনাথ বরদোলোইকে সরকার গড়তে আবাহন করেন রাজ্যপাল। মুখ্যমন্ত্রী বরদোলোইয়ের অন্যতম কীর্তির মধ্যে পড়ে ভূমি রাজস্ব (Land Tax) বন্ধ করা ও আসামের মাটিতে মুসলিমদের অবাধ অনুপ্রবেশ রুখে স্থানীয় মানুষদের অধিকার সুরক্ষিত করা। কিন্তু অনুপ্রবেশে সেই রাশ টানাই অসমীয়াদের মধ্যে জাতি বিদ্বেষ উস্কে দিয়েছিল বলে অনেকের অভিমত।
তবে সেই সরকারের স্থায়ীত্ব বেশিদিন ছিল না। ১৯৩৯-এ ভারতীয় নেতাদের অমতে ইংরেজ সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনা নিয়োগ করার প্রতিবাদে কংগ্রেস দেশ জুড়ে সরকার প্রদেশ সরকার থেকে পদত্যাগ করে। ফলে কংগ্রেস হাই কম্যান্ডের নির্দেশে ও গান্ধীজীর অনুরোধে ১৯৪০ সালে বরদোলোইকেও পদত্যাগ করতে হয়। তিনি গ্রেপ্তরাও হন যদিও অসুস্থতার জন্য বছর ঘোরার আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে বরদোলোই সহ কংগ্রেসের সব নেতারাই গ্রেপ্তার হন।

কিন্তু এই সুযোগে ব্রিটিশ সরকারকে যুদ্ধে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাইদুল্লাহ্ পুনরায় মুখ্যমন্ত্রিত্ব পান। জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হয়েই সাইদুল্লা ১৯৩৯ থেকে ৪১-এর মধ্যে পূর্ববঙ্গীয়দের জন্য এক লক্ষ বিঘা জমি বরাদ্দ করেন বিষ্ণুরাম মেধি ও অন্যান্য নেতাদের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। যুক্তি হিসাবে দেখানো হল কৃষিজীবি মুসলমান বাঙালীরা ‘Grow more Food’ প্রকল্পের জন্য জরুরি। ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় Lord Wavel, Viceroy’s Journal, London Publication, December 22, 1943-এ বলেন “…The chief political problem is the desire of Muslim Ministers of Assam to increase the immigrations into uncultivated Government lands in Assam under the slogan of ‘Grow more food’ but what really is to ‘Grow more Muslims’” (Politics of Migration by Dr. Manju Singh, Anita Publications, Jaipur, 1990, Page 70)। মাঝে কয়েক মাস বিরতির পর সাইদুল্লাহ্ আগস্ট ১৯৪২-এ পুনরায় ক্ষমতা লাভ করে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ পর্যন্ত গদিতে আসীন থাকেন এবং আসামের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ক্রমশ সঙ্গীন করে তোলেন। আসামের কংগ্রেস নেতারা তো বটেই, সুভাষ চন্দ্র বোস এমনকি মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত এই অবারিত স্থানান্তরণে অসন্তোষ ব্যক্ত করেন।

গোপীনাথ বরদোলোই ১৯৪৪ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রাজ্য সরকারের তীব্র বিরোধীতা শুরু করেন। অন্যান্য নেতাদেরও সমর্থন পান। সাইদুল্লাহ্ রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি, মিটিং মিছিলে নিষেধাজ্ঞা, পরিযায়ী মুসলিম পুনর্বাসন ইত্যাদি ব্যাপারে আলোচনায় বসতে বাধ্য হন। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের জন্য নতুন সংবিধান ঘোষণা করলে পুনরায় কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচন হয়। কংগ্রেস ১০৮টির মধ্যে ৬১টি আসন জিতে পুনরায় সরকার গড়ে। গোপীনাথ বরদোলোই সর্বসম্মতিক্রমে পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬-এ ক্যাবিনেট কমিশন (Cabinet Commission) গঠন করে ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সঙ্গে শিমলা ও দিল্লিতে আলোচনায় বসে। তাদের পরিকল্পনা ছিল রাজ্যগুলোকে ৩টি দলে (group) ভাগ করা হবে যেখানে বাংলা ও আসাম থাকবে তৃতীয় দলে। গোপীনাথ আশঙ্কা করলেন নতুন বিন্যাসে আসাম বাংলার দলভুক্ত হলে বাঙালীদের তুলনায় অসমীয়া প্রতিনিধিরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। আসামের প্রতিবেশে যেহেতু মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ, তাই আশঙ্কা অমূলক ছিল না।সাইদুল্লার আংশিক পূর্ণ অ্যাজেন্ডা পূর্ণতা লাভ করবে। আসাম প্রদেশ কংগ্রেস প্রত্যাশিতভাবেই এই দল-বিন্যাসের প্রতিবাদ করে। বরদোলোই জাতীয় কংগ্রেসএর ওয়ার্কিং কমিটি, ক্যাবিনেট কমিটি ও ভারতের ভাইসরয়কে জানিয়ে দেন, আসাম নিজের সংবিধান নিজেই রচনা করবে এবং কোনও দলে যোগ দেবে কিনা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে।
কিন্তু ক্যাবিনেট কমিশন দল-বিন্যাস বাধ্যতামূলক করে ঘোষণা করেন কোনও রাজ্য চাইলে পরে সংশ্লিষ্ট দল ছাড়তে পারে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় সাড়া না পেয়ে বরদোলোই এরপর আসাম জুড়ে গণবিক্ষোভ গড়ে তোলেন। শেষে জাতীয় কংগ্রেস বিষয়টা আসাম অ্যাসেম্বলিতে উত্থাপনের পরামর্শ দিতে অ্যাসেম্বলি স্থির করে কোনও দলের অধীনে না গিয়ে আসামের ১০ প্রতিনিধি রাজ্যের নিজস্ব সংবিধান নির্ধারণ করবে যা পরে ভারতের সংবিধান গঠনকারী জাতীয় কমিটির সঙ্গে মিলিত হবে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে থাকতে আসামের কখনই আপত্তি ছিল না, কিন্তু বরাবর আপত্তি ছিল বাংলার অঙ্গ হিসাবে বা বাংলা বাংলার দলভুক্ত হয়ে থাকায়। জাতিসত্তার সংঘাত শুরু তখন থেকেই। সুতরাং যারা অসমীয়াদের বাঙালী বিদ্বেষের জন্য বরদোলোইকে দায়ী করে, তারা হয়তো খুব ভুল বলে না। কিন্তু নিজস্ব জাতিসত্তা রক্ষার চেষ্টা তো অপরাধ হতে পারে না, অপরাধ হল জাতি বিদ্বেষ। এই বরদোলোইই কিন্তু দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালীর পুনর্বাসনে সাহায্য করেছিলেন।

জওহরলাল নেহেরু আসামের পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞতাবশত এবং জিন্নাহ্ জেনেও বিশেষ অভিসন্ধি নিয়ে গ্রুপিং পরিকল্পনা কার্যকর করতে হাত মেলান। গোপীনাথ বরদোলোই গান্ধীজীকে অনুরোধ করেন হস্তকএপের জন্য এবং পরে প্রবল বিরোধিতায় অনড় থাকেন। দেশ জুড়ে তখন অবিরাম চলেছে পাকিস্তানের দাবিতে হত্যালীলা। ১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটন নতুন ভাইসরয় হবে জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও গান্ধীজীর সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনার পর সমস্যার পাকাপাকি সমাধানের জন্য গ্রুপিং বা দল-বিন্যাস বাতিল করে দেশভাগের সিদ্ধান্ত নেন।

আসাম বাংলার বাইরে আলাদা অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারায় শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভে যাওয়া থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু জিন্না ও তাঁর পাকিস্তানের আসামকে গ্রাস করার বাসনা বহাল থাকে যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ পায় উত্তরাধিকারসূত্রে। তাই ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে ভারতের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ ও ইন্দিরা গান্ধীর বদান্যতায় প্রাণে বেঁচে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ মুজিবর রহমান প্রথমেই ভারতের কাছ থেকেই আসামকে দাবি করেন। ইতিহাসের চাকা কী আশ্চর্যভাবে ঘুরে যায়! এক সময় আসামের রাজস্ব ঘাটতির জন্য বাংলার অংশ কেটে আসামে জোড়া হয়েছিল, আর ১৯৭১-এর পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্পূর্ণতা আনার জন্য সে দেশটি আসামকে গ্রাস করতে চায়। এই অসমীয়া ও বাঙালীর অন্তর্ঘাৎ তো সহজে আরোগ্য লাভের বিষয় নয়। আর একদিকে অসমীয়া জাতিসত্তা ও অন্যদিকে বাংলাদেশের ইসলামি সাম্রাজ্যবাদ – দুইয়ের টানাপোড়েনে সবচেয়ে বেশি ঘর পুড়েছে কিন্তু হিন্দু বাঙালীর যারা সবার সঙ্গেই সহিষ্ণুতার সঙ্গে সহাবস্থান করতে চেয়েছে।

বাঙালীদের প্রতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বামপন্থী সংগঠক ও আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্তন উপাচার্য অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য ‘আসাম শুধু অসমীয়াদের’ নীতি ও স্লোগানের জন্য বরদোলোইকে দায়ী করেছেন। অবশ্য তাঁর লেখা “কিছু জরুরি তথ্যের পেক্ষিতে আসামে বেপরোয়া বাঙালী বিতাড়ন” নামের একটি পুস্তিকায় এটাও উল্লিখিত আছে, যে ‘সমগ্র আসামের ওপর শুধু অসমীয়াদের একচেটিয়া অধিকার এবং বাঙালীরা একমাত্র অসমীয়াদের প্রভুত্ব স্বীকার করে সেখানে থাকতে পারে বলে’ আসামের প্রথম রাজ্যপাল আকবর হায়দরিও দাবি করেছিলেন। যাইহোক, ১৯৯৯ সালে এই গোপীনাথ বরদোলোইকে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী মরোণোত্তর ভারতরত্ন সম্মান দিয়ে ও রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে আব্দুল কালাম সংসদে তাঁর মূর্তি উন্মোচন করে বামপন্থী শিবিরের গাত্রদাহ আরও বাড়িয়ে দেন।

স্বাধীনতার পর

স্বাধীনতার পর নয়া আসামের রূপকার গোপীনাথ বরদোলোই সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক দিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে চিনা আগ্রাসন থেকে আসামকে রক্ষা করে ভারতের অঙ্গীভূত রাখেন। শুধু তাই নয়, বাংলা থেকে আসামের স্বাতন্ত্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হলেও দেশভাগের পর লক্ষ লক্ষ হিন্দু শরণার্থী আসামে ছুটে এলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করেন বরদোলোই। কিন্তু হিন্দু শরণার্থীর পাশপাশি মুসলিম অনুপ্রবিষ্টের ভিড়ে আসামের জনমানচিত্রে ওলট-পালট হচ্ছে সন্দেহে অসমীয়াদের বাঙালী বিদ্বেষ ক্রমশ উগ্রতর হতে থাকে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত ‘বঙ্গাল খেদা’ কর্মসূচী সক্রিয় হলেও ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর মুসলিম শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীরও ঢল নামলে অসমীয়া ও আসামের উপজাতিগুলিও হিংস্র হয়ে ওঠে, যদিও তাদের হিংস্রতার শিকার হয়েছে অধিকাংশত হিন্দু বাঙালীরাই।
মহম্মদ সাইদুল্লার আমল থেকে আসামে প্রবিষ্ট এই ‘বাঙালী’রা কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তান গঠনের অন্যতম দাবিদার হয়ে ওঠে, অথচ দেশ ভাগ হওয়ার পরেও পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যায় না, আসামের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে। ওদিকে ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাঙালীর স্রোত পশ্চিমবঙ্গের মতো আসামকেও সামলাতে হলেও সিলেট পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় আসামে মুসলিম জনসংখ্যা অনেকটা কমেই যায়। এইখানে মইনুল হক চৌধুরীর ভূমিকা সামান্য আলোচনার দাবি রাখে।

কাছাড় জেলার সোনাবারিঘাটে জন্মানো মইনুল শিলচর গৌহাটি ও সিলেটে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে স্নাতক হন। কলেজের ছাত্র ইউনিয়ানের নির্বাচনে শেখ মুজিবর রহমানকে হারিয়েও দেন। পরে ১৯৪৬ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (Aligarh Muslim University) থেকে ইতিহাসে এমএ করেন। সেই সময় মইনুল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন, যার ঘোষিত অনুপ্রেরণা সুভাষচন্দ্র বসু ও মৌলানা আবুল কালাম আজ়াদ হলেও তিনি সদস্যপদ নেন মুসলিম লীগের। বলা বাহুল্য লীগের কাছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল আসলে বকলমে পাকিস্তান দাবির আন্দোলন।

সাংগাঠনিক গুণে মইনুল মুসলিম লীগের যুব সংগঠনের সেক্রটারিও হন। ১৯৪৭-এ আইনের ডিগ্রীও লাভ করেন। ঘণিষ্ঠতা বাড়ে জিন্নার সাথে, হয়ে ওঠেন তাঁর ব্যক্তিগত সচিব। জিন্নার কাছে মইনুল বরাক উপত্যকা নিয়ে আলোচনা করেন। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, বরাকের বাঙালী সংখ্যাধিক্য নয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাই ছিল মূল প্রতিপাদ্য। কিন্তু ১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় মইনুল দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন ভারতে থাকবেন না পাকিস্তানে চলে যাবেন। জিন্না আশ্বাস দেন, “wait for ten years, I shall present Assam on a silver plate to you” (Politics of Alienation in Assam by Bhawani Singh, 1984, Page 72)। ভিন্নতর সূত্র জানাচ্ছে মইনুলের জবাবি পত্রে আছে, “Qued-e-azam, wait for next thirty years. I shall present Assam to Pakistan on a silver plate”(স্বরাষ্ট্রমন্ত্র সূত্র, সাপ্তাহিক বর্তমান থেকে প্রাপ্ত)। ১৯৪৮-এ জিন্না মারা গেলেও কংগ্রেস পরে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করে দেয় সেই মইনুলকে ক্যাবিনেট মন্ত্রী বানিয়ে, যিনি স্বাধীনতার পর ভারতে মুসলিম লীগ নির্বল হয়ে গেলে ফকরুদ্দিন আহমেদের সৌজন্যে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। মুসলিম লীগে থাকতে যেটুকু অপূর্ণ ছিল, কংগ্রসে যোগ দিয়ে তা পরিপূর্ণ করা গেল।

১৯৪৮-এ শিলচর বার অ্যাসোসিয়েশন (Bar Association of Silchar)-এর সদস্য হয়ে মইনুল পেশা জীবন শুরু করেন। ১৯৫০ থেকে সক্রিয় রাজনীতির সৌজন্যে শিলচর পৌরসভা বোর্ডে প্রভাব বাড়তে থাকে তাঁর। ১৯৫২ সালে আসাম আইনসভার (Assam Legislative Assembly) সদস্যপদ এবং ক্রমে ১৯৫৭ নাগাদ আসাম বিধানসভার ক্যাবিনেট মন্ত্রীত্বও লাভ করেন। দায়িত্ব পান কৃষি মন্ত্রকের অর্থাৎ যে দায়িত্ব পেলে কৃষক আমদানির ছলে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধির কাজটা গুছিয়ে করা যায়। বারবার নির্বাচনে জিতে ১৯৬৭ সালে চতুর্থবার বিধায়ক হওয়ার পর বিমলা প্রসাদ চালিয়ার সঙ্গে মতানৈক্যের জেরে মন্ত্রীত্ব থেকে বঞ্চিত হন। অবশ্য ক্ষতি কিছু হয়নি; ১৯৭২-এ জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সম্মানজনক অভিষেক হয়ে যায় এবং জাতীয় হজ কমিটির (Haj Committee) চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু মুসলমান সব সম্প্রদায়ের বাঙালীরই অনুপ্রবেশ ক্রমশ বাড়ছিল। ১৯৬৪-তে কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিয়া (Bimala Prasad Chaliha) বেআইনি অনুপ্রবেশ রুখতে নেহেরুর একপ্রকার বিরুদ্ধে গিয়ে Prevention of Infiltration from Pakistan (PIP) Act 1964 আনেন, কারণ আসামের জনসংখ্যার অনুপাত, চরিত্র ও নিজস্ব সংস্কৃতি সবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিল।”Prime Minister Jawaharlal Nehru wanted the Assam Chief Minister, Bimala Prasad Chaliha to go easy on deportations and even stop them. Chaliha refused, saying that the problem was so critical that Assam’s demography and culture would be permanently changed” (Rites of Passage by Sanjoy Hazarika, Penguin Books, 2000, Page 60)। কিন্তু মুসলিম নেতারা বাঙালী মুসলমানদের অসমীয়া ভাষা শিখে মূল জনস্রোতে আত্মগোপনের পরামর্শ দেয়। শেষ পর্যন্ত ২০ জন মুসলিম এমএলএ সরকার ফেলে দেওয়ার হুমকি দিলে চালিয়া PIP আইনকে ঠাণ্ডাঘরে পাঠাতে বাধ্য হন। চৌধুরীর সঙ্গে চালিয়ার মতবিরোধের কারণটা বোঝাই যাচ্ছে। যারা বাংলাদেশে প্রস্থান করেছিল তারা আবার আসামে ফিরে জাঁকিয়ে বসে। মাঝখান থেকে আক্রোশে শুরু হয়ে যায় ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন যার লক্ষ্য ও শিকার ছিল কিন্তু অধিকাংশত হিন্দু বাঙালীরা।
এদিকে বরাক ও সমগ্র আসামে মুসলমান বাঙালীর দাপট দেখে ১৯৭১-এ সার্বভৌম বাংলাদেশের ‘কৃতজ্ঞ’ প্রধানমন্ত্রী মুজিবর রহমান বায়না ধরলেন আসামকেও তাঁর চাই। “Without the inclusion of Assam the East Bengal economy could not be balanced”। মরূভূমির উট আর সদাগরের সেই গল্পের মতো। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের মতোই অনুপ্রবেশ নীতিও বজায় রাখল বাংলাদেশ। রাজ্যসভার ৭২তম Report of the Committee of Petitions, ২২ মার্চ, ১৯৮২ অনুসারে: “…. a total of 2,20,690 Pakistani infiltrators were detected in the state during the period 1950-1961 and another 1,92, 339 were spotted in the following decade. During the Bangladesh War of Liberation (1971) a total of 1,00,000 immigrants stayed behind even after Independence of their country…. The prime factor responsible for this abnormal growth (of Muslims) was the geo-political ambition of Pakistan over Assam ” (Page 2 of the Report).

সুতরাং আসামীদের যে সম্মিলিত বাঙালী বিতৃষ্ণা, তার মধ্যে ভাষার সাথে সাথে সাম্প্রদায়িক উপাদানও রয়েছে যা এখানকার বাঙালী বুদ্ধিজীবিরা জানেন না অথবা এড়িয়ে যান। অথচ বাঙালীর অবস্থা এমন দোলাচলে আর এতই করুণ যে ২০১৭-য় দাঁড়িয়ে অনুপ্রবেশ রুখতে বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং যখন আসামে ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্ত রুদ্ধ করার জিগির তুলেছেন তখন তাকে সাধুবাদ জানাতে গিয়েও থমকে ভাবতে হয়, বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হিন্দু বাঙালীদের কী হবে?
যেখানে মুসলমান বাঙালীর অনুপ্রবেশই রাজ্যটির মূল সমস্যা, সেখানে আসুর মতো চরমপন্থী সংগঠনগুলো হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বাঙালীদের প্রতিই একই রকম অসহিষ্ণু। বরং ভাষা আন্দোলনের জেরে হিন্দু বাঙালীরাই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। আসামে শরণার্থী তো বটেই দীর্ঘদিনের বাসীন্দা হিন্দু বাঙালীরা এখনও ‘সন্দেহভাজন’-এর তালিকায় থেকে নাগরিকত্ব বা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত, যেখানে মুসলিম সম্প্রদায় এতটাই শক্তি সঞ্চয় করেছে যে অনুপ্রবেশ বিরোধী আইন থেকে প্রতিকার কোনওটিই কার্যকরী করা যায়নি এতদিন। সংখ্যালঘু বলে যারা পরিচিত, সমগ্র রাজ্য এমন কি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে তাদের এত দাপট পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না।

একটা লক্ষ্যনীয় বিষয়, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তি যুদ্ধে যেখানে মুসলমান বাঙালীরা প্রাণ দিয়েছেন, আসামে বাংলাভাষার ও বাঙালীর সংকটে কিন্তু মুসলিম বাঙালীদের তেমন অংশগ্রহণ নেই। সেটা কি শুধুই হিন্দু বাঙালীদের প্রতি নিস্পৃহতা, নাকি আত্মগোপনের কৌশলও? এ নিয়ে কোনও পর্যবেক্ষককেই আমি প্রশ্ন তুলতে দেখিনি। হিন্দু বাঙালী আপাদমস্তক ঐক্যসংহতিপ্রেমী, পরসংস্কৃতি পরধর্ম সহিষ্ণু শ্রদ্ধাশীল জাতি।

২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী বরাক উপত্যকার মোট জনসংখ্যার ৪২% হিন্দু, ৫০% মুসলিম, ৪% খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ৪%। কাছাড় জেলায় হিন্দুধর্মাবলম্বীরা হল সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬০%, কিন্তু করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ – যথাক্রমে ৫৩% ও ৫৮%[৩]। এই পরিসংখ্যান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তীব্র বাঙালী বিদ্বেষ সহ্য করেও বরাকের বাঙালীরা যে ভিন্ন রাজ্যের দাবি জানাতে পারছে না, তার অন্যতম কারণ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে হিন্দু বাঙালীর দুর্গতি অবশ্যম্ভাবী। শুধু তাই নয়, মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যটির মধ্যে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরির সম্ভাবনা মোটেই কষ্টকল্পিত নয়। সুতরাং মৃত্যুর সঙ্গে একতরফা চুক্তি শুধু হিন্দু বাঙালীদেরই করতে হয়েছে।
মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটা রূপরেখা দিলাম। ‘আসাম বাণী’ নামের সাপ্তাহিক তার ১৮ আগস্ট ১৯৯৪ সংখ্যায় জানিয়েছে ১৯৭১ থেকে ১৯৯১-এর মধ্যে ১৬ লক্ষ বাংলাদেশী আসামে অনুপ্রবেশ করেছে যাদের সিংহভাগ মুসলমান। তবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালী মুসলিমরা নিজেদের অসমীয়া বলেই পরিচয় দেয়। এই সময়ে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সেখানে ৪১.৮৯% সেখানে মুসলমান জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৭.৪২%। তপশিলি জাতি ও উপজাতি জনসংখ্যা বৃদ্ধি যথাক্রমে ৮১.৮৪% ও ৭৮.৯১% হলেও বর্ণহিন্দুর বৃদ্ধিতে হ্রাস হিন্দু বাঙালী হত্যা ও বিতাড়নেরই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।

চলবে