‘পলান্ন, মাংসদন’ অপভ্রংশ ‘বিরিয়ানি’

0
576

চতুর্থ পর্বের পরে

কুমারসম্ভবম্

অধ্যায় ৫ — শতপথ ব্রাহ্মণ, অষ্টাধ্যায়ী ও মাংসদন

বিবিধ বৈদিক সাহিত্যেও “মাংসদন” (मांसौदन, Māṃsaudana) শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়, যথা:—
১। শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪.৯.৪.১৭ (शतपथ ब्राह्मण १४.९.४.१७; Śatapatha Brāhmaṇa 14.9.4.17) এবং ….

২। বৃহদারণ্যক উপনিষদেও ষষ্ঠ অধ্যায়ের অন্তর্গত চতুর্থ ব্রাহ্মণের অষ্টাদশ শ্লোকে ‘মাংসদন’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে, যথা –

बृहदारण्यकोपनिषद् / बृहदारण्यक उपनिषद (६.४.१८) (Brihadâranyakopanishad or Brihadâranyaka Upanishad 6.4.18)

पुत्रमन्थकर्म ब्राह्मणम्ः—

अथ य इच्छेत् पुत्रो मे पण्डितो विगीतः (विजिगीथः) समितिङ्गमः शुश्रूषितां,
वाचां भाषिता जायेत सर्वान्वेदाननुब्रुवीत (सर्वान् वेदाननुब्रुवीत) सर्वमायुरियादिति।
माꣳसौदनं पाचयित्वा सर्पिष्मन्तमश्नीयातामीश्वरौ (सर्पिष्मन्तमश्नीयाताम्। ईश्वरौ) जनयितवे।—
औक्षेण वाऽऽर्षभेण वा (औक्ष्णेन वा। आर्षभेण वा) ॥१८॥

-> जो चाहता हो कि उसका पुत्र प्रख्यात पण्डित (पंडित), विद्दानों की सभामें निर्भय प्रवेश करनेवाला तथा श्रवणसुखद वाणी बोलनेवाला हो, सम्पूर्ण वेदों का स्वाध्याय करे और पूरे सौ वर्षों तक जीवित रहे, वह पुरुष और उसकी पत्नी औषधियों का गूदा (फल आदि के अन्दर का कोमल सार भाग) और चावल पकाकर उसमें घी मिलाकर खायें। इससे वे उक्त योग्यतावाले पुत्रको जन्म देने में समर्थ होते हैं। उक्षा अथवा ऋषभ नामक ओषधि के गूदे के साथ खानेका नियम है ॥१८॥
(इस मन्त्र में आये औक्षण, आर्षभ और माꣳसौदनं (मांसौदन) शब्द का अर्थ मांस है जबकि ये दोनों ही औषधियां हैं।)

পুত্রমন্থকর্ম ব্রাহ্মণামঃ—

অথ য় ইচ্ছত পুত্রী মে পন্ডিতো বিগিতঃ সতীতিজ্ঞমাঃ শুশ্রুসিতাম,
বাচাম ভাষিতা জায়েত সর্বান্বেদানানুব্রুবিত (সর্বান্ বেদানানুব্রুবিত) সর্বমায়ুরিয়াদিতি।
মাংসদন পাচয়িত্বা সর্পিষ্মন্তমশ্রীয়াতামীশ্বরো (সর্পিষ্মন্তমশ্রীয়াতাম্ ঈশ্বরো)
জনয়িতবে।
ঔক্ষেণ ওয়াসসর্ষভেণ ওয়া (ঔক্ষ্ণেণ ওয়া। আর্ষভেণ ওয়া) ॥১৮॥

-> যে ব্যক্তি চায় যে তাঁর পুত্র প্রখ্যাত, বিশিষ্ট পণ্ডিত (পন্ডিত) তথা যে নির্ভয়ে পণ্ডিতদের সমাবেশে প্রবেশ করে মনোরম বক্তব্য পেশকারী বাচস্পতি তথা বাগ্মী হোক, সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করুক এবং শতায়ু হোক, সেই ব্যক্তি এবং তার স্ত্রী যেন বিভিন্ন ঔষধি যুক্ত মশলা এবং ঘৃত সহিত তণ্ডুল রন্ধন করে একত্রে ভক্ষণ করেন যাতে তাঁরা উপরোক্ত যোগ্যতা নিয়ে পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হন। “উক্ষা” বা “ঋষভ” নামক ঔষধ নির্যাস সহযোগে গ্রহণ করার নিয়ম ॥১৮॥
(এই মন্ত্রের ‘অক্ষন’, ‘অর্ষভ’ এবং ‘মাংসদন’ শব্দের অর্থ যদিও মাংস, তবে প্রকৃত পক্ষে উভয়ই ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত।)

পানিনি রচিত “অষ্টাধ্যায়ী” গ্রন্থে (Aṣṭādhyāyī by Pāṇini 4. 4.67) .. ৪.৪.৬৭ শ্লোকে ‘মাংসদন’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে, যথা –

४.४.६७ श्राणामांसौदनाट्टिठन्
श्राणा-मांस-ओदनात् टिठन्
श्राणामांसौदनशब्दभ्यां टिठन् प्रत्ययो भवति तदस्मै दीयते नियुक्तमित्येतस्मिन्नर्थे।
ठकोऽपवादः ॥६७॥
-> पक्व हुये मांसौदन (मांस और ओदन, भात) जिस को सही तरीके से दिया जाना है।

শ্রাণা-মাংস-ঔদনাত্ টিঠন্
-> পরিপাক কৃত মাংসদন যাকে সঠিকভাবে দেওয়া প্রয়োজন।

“तत् अस्मै नियुक्तम् दीयते” (इति) श्राणा-मांसौदनात् टिठन्
-> अवश्यमेव, हमारा मांस और ओदन (भात) दिया जाता है।

“তৎ আস্মৌ নিয়ুক্তম্ দিয়তে” (ইতি) শ্রাণা-মাংসদনাত্ টিঠন্
-> আমাদের অবশ্যই বা মাংসদন (পলল সহযোগে পরিপাক কৃত অন্ন) দেওয়া হয়।

অধ্যায় ৬ — বিরাটপর্বে পলান্ন

বিরাটপর্ব অনুসারে, অজ্ঞাতবাস কালে পঞ্চপাণ্ডব এবং যাজ্ঞসেনীরা মৎস্যরাজ বিরাট রাজার প্রাসাদে শেষ এক বৎসর কাল অতিবাহিত করেছিলেন।
সেখানে জ্যেষ্ঠ পান্ডব যুধিষ্ঠির অক্ষবিশারদ ‘কঙ্ক’ নাম গ্রহণ কল্পে মৎসরাজকে দ্যূতক্রীড়ায় সঙ্গ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় তথা মধ্যম পান্ডব বৃকদর জরাসন্ধজিৎ পাচকের ছদ্মবেশে ধারণ কল্পে ‘বল্লব’ নাম গ্রহণ করেছিলেন। পাঞ্চালি সেথায় ‘সৈরিন্ধ্রী’ পরিচয়ে বিরাটভার্য্যা রাজমহিষী সুদেষ্ণার কেশসংস্কারকারিনী ছিলেন। তৃতীয় পান্ডব ‘বৃহনল্লা’ রুপি অর্জুন রাজকুমারী উত্তরার নৃত্যগীত শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। চতুর্থ পান্ডব নকুল ‘গ্রন্থিক’ নামের আড়ালে মৎস্যরাজের আস্তাবলের অশ্ব পরিচর্যা এবং পঞ্চম পান্ডব সহদেব ‘তন্ত্রীপাল’ পরিচয়ে বিরাটরাজের গোশালার দায়িত্ব সামলেছিলেন।

সেই অজ্ঞাতবাস কালে বিরাট রাজার সুবিশাল পাকশালায় বৃকদর ভীম পলান্ন তথা মাংসদন (বিরিয়ানি) পরিপাক কালে বাতাস তার সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল। পলান্ন রন্ধনের সেই তীব্র সুঘ্রাণে ব্যাকুল এবং বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন জ্যেষ্ঠ পান্ডব যুধিষ্ঠির, যদিও তিনি মাত্রাতিরিক্ত খাদ্যরসিকও ছিলেন না তাই খাদ্যের সুঘ্রাণে প্রতি তাঁর কোন লোভও ছিল না; কিন্তু তাঁর দুশ্চিন্তা ছিল পলান্ন পরিপাক কালে সেই খাদ্য থেকে নির্গত অতিরিক্ত সুঘ্রাণ সম্পর্কে, কারণ সেই সুঘ্রাণ বা তার সম্বন্ধিত কোন সংবাদ যদি কৌরবদের কাছে পৌঁছে যায় তাহলে তাঁদের গোপনীয়তা ভঙ্গ হয়ে অজ্ঞাতবাস বিঘ্নিত তথা হতে পারে এবং শর্ত অনুযায়ী অজ্ঞাতবাস কালে তাঁদের পরিচয় জ্ঞাত হলে আবারও বারো বছর তাঁদের বনবাসে অতিবাহিত করতে হবে। তাই তিনি মধ্যম পাণ্ডবকে পলান্ন পরিপাক কালে মশলাপাতি এবং সুগন্ধি কিঞ্চিৎ স্বল্প পরিমানে ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।


মহাভারতের বিরাটপর্বে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস সম্পন্ন হলে, অভিমন্যুর সঙ্গে উত্তরার শুভ পরিণয় উপলক্ষে বিবাহ বাসরে নানা রকমের সূরা ও পললের (মাংসের) সঙ্গে মাংসদন তথা পলান্নেরও পর্যাপ্ত আয়োজন ছিল।
মহাভারতে বর্ণিত পাকশাস্ত্র বা খাদ্যতালিকা বিশ্লেষণ করলে সহজেই এই সুখাদ্যের ঐতিহাসিক অস্তিত্বের প্রমাণ মিলবে।

উত্তরা অভিমন্যুর বিবাহ বাসরের খাদ্যতালিকাতেও – ‘ঘৃত সহযোগে পরিপাক করা পলল মিশ্রিত অন্নের’ – উল্লেখ পাওয়া যায় যা প্রকৃত পক্ষে ‘পলান্ন’ বা ‘মাংসদন’ এবং যা বর্তমানের বিরিয়ানি নামে প্রচলিত।

চলবে

Previous articleবাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট
Next articleনেতাজী রহস্য উন্মোচনে বড়পর্দায় “সন্ন্যাসী দেশনায়ক”
কুমারসম্ভবম্
লেখক প্রায় ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন পেশার সিঁড়ি, যথা অন্তর্জাল তথা বাণিজ্যিক প্রযুক্তি, মানব তথা পরিচালন সম্পদ উন্নয়ন তথা পররাষ্ট্র বিভাগীয় কর্মসঞ্চালনার পথ অতিক্রমণ করে অবশেষে প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রদের পরিচালন ব্যবস্থার পাঠ শিখতে সহযোগিতা করেন। লেখকের ভাবনা চিন্তা তথা লেখনীর প্রধান বিষয়বস্তু - প্রধানতঃ সনাতন ধর্ম, মাতৃভূমি রাষ্ট্র ভারতবর্ষ, ভারতীয় সুপ্রাচীন ঐতিহ্য, প্রাগৈতিহাসিক প্রাচীন ইতিহাস, ভারতীয় ভাষা, শত সহস্র আঞ্চলিক খাদ্য-আহারাদি, বিবিধ পোশাক-পরিচ্ছদ, অতি প্রাচীন লোক সংস্কৃতি, সর্বৎকৃষ্ট মার্গীয় সঙ্গীত, বিভিন্ন অননুকরণীয় শিল্পকলা ইত্যাদি বিভিন্ন মৌলিক বিষয়-বস্তু সংক্রান্ত ভাবনাতেই কেন্দ্রীভূত।