রাম কে নাম ৩

৩য় পর্ব

অভীক মুখোপাধ্যায়

দ্বিতীয় পর্বের পর

অযোধ্যা। আজকের নয়। আজ থেকে ৪৯৪ বছর পিছিয়ে যান, বন্ধু। তখনো সেখানে শ্রীরামজন্মভূমির আরাধনাস্থলে উড়ছে গৈরিক পতাকা। পীঠস্থানের অধীশ্বর সিদ্ধ মহাত্মা বাবা শ্যামানন্দ। বাবার কাছে হিন্দু – মুসলিমের ভেদ ছিল না। দলে – দলে ভক্তরা আসত দেশ – বিদেশ থেকে। একদিন এক হযরত কজল আব্বাস মুসা আশিকান নামের ফকির এসে বাবার পায়ে পড়ল, বলল — সিদ্ধি চাই। বাবা শ্যামানন্দের নরম মন। তিনি ফকিরকে শিষ্যত্ব দিলেন। সিদ্ধ ফকির হয়ে ওঠার অল্পদিনের মধ্যেই এলাকাতে মুসা আশিকানের সিদ্ধির চর্চা হতে লাগল।

কিছুদিন পরে এল আরেক ফকির — নাম তাঁর জালাল শাহ। যোগক্রিয়া শেখার ইচ্ছে। কিন্তু ভারী কট্টর নিজের ধর্মের প্রতি। জালাল শাহ কিন্তু রামজন্মভূমির স্থানমাহাত্ম্যটা আসার পরে টের পেল। এবং তখন থেকেই তার মনে হতে লাগল, এই জায়গাটাকে যদি বদলে নিজের সাধের করে ফেলা যায় তো কেমন হয়।

শুরু হল এক সুনিয়োজিত ষড়যন্ত্র। সাম্প্রদায়িকতার সূত্রপাত এখান থেকেই। রাতদুপুরে অযোধ্যার বুকে নানা জায়গায় পুরোনো প্রথায় বড় বড় কবর খুঁড়ে মরদেহ পোঁতা আরম্ভ হয়ে গেল। প্রাচীন মন্দির, মহর্ষিদের সমাধি ধ্বংস করে পবিত্র নগরীকে বড়সড় কবরখানার রূপ দেওয়া শুরু হল।

এরই মধ্যে আরেক যুবা ফকির এল অযোধ্যায়। তার হাবভাব কিন্তু ফকিরি নয়। চলাফেরায় ঔদ্ধত্য। উগ্র চাহনি। দুচোখে জয়ের নেশা। সে ভারতবর্ষ জয় করতে এসেছে। অতীব বুদ্ধিমান সেই যুবক যুদ্ধের আগে খোঁজখবর নিয়ে দেখবে বলেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেখছে — ঠিক কীভাবে আক্রমণ করলে সহজে জয় আসবে। যুবকের নাম বাবর। স্বাভাবিক ভাবেই ফকিরবেশী বাবরকে আশ্রয় দিল মুসা আশিকান ও জালাল শাহ। বাবর তাদের কাছে দোয়া চাইল, তারা বলল — জিতলে পরে এই রামজন্মভূমিতেই মসজিদ চাই। বাবর না করেনি।

বাবরের মতো যুদ্ধনীতিক সম্ভবত মোগল বংশ আর পায়নি। তার আক্রমণের সামনে হার মানল ইব্রাহিম লোদি। হার মানলেন রানা সঙ্গ। বাবর দিল্লি সহ উত্তর পশ্চিম ভারতের দখল নিল। তারপর আবার গেল অযোধ্যায়। দুই ফকিরকে দেওয়া কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল বাবরকে।

নিজের সেনাপতি মির বাঁকি তাশখন্দিকে মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দিয়ে বাবর দিল্লির দিকে কুচ করলেন। হাওয়া তখন বারুদের গন্ধ। খবর পেলেন বাবা শ্যামানন্দ। তিনি প্রতিমা সরযূর জলে বিসর্জিত করে দিব্য বিগ্রহ নিয়ে চললেন আজকের উত্তরাখণ্ডের পানে। মন্দিরের পূজারীরা মন্দিরের দ্বার আগলে দাঁড়ালেন — আমাদের মৃতদেহের উপর দিয়ে মন্দিরে ঢুকতে হবে। সেই কাজই করল বর্বর বাহিনী। কিংবদন্তী বলে, পূজারীদের কেটে খণ্ড খণ্ড করে কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল। বাবরের বাহিনী কামান থেকে গোলা দেগে মন্দিরকে ধূলিস্মাত করে দিল। সেখানেই দাঁড় করানো হবে মসজিদ।

শ্রীরাম মন্দিরের ধ্বংস হওয়ার কাহিনী দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। ফৈজাবাদের কাছেই ভিটি রাজ্যের মহারাজা মহতাব সিংহ সেইসময়ে সেনা নিয়ে তীর্থে চলেছিলেন। তিনি এই সংবাদ শুনে বললেন — ‘আমার রাজ্যের কাছেই এক মহান তীর্থ নষ্ট হয়ে গেল, আর আমি অন্যত্র তীর্থে গিয়ে কী করব?’ সেনা নিয়ে লড়তে চললেন মহতাব। অঞ্জনা কে বাগ নামক বাগানে ছাউনি ফেলা হল। রাতারাতি রামভক্ত ক্ষত্রিয়ের দল একত্রিত হয়ে গেল। ধর্মযুদ্ধ হতে চলেছিল।

সূর্যের প্রথম আলো মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভীষণ যুদ্ধ শুরু হল। মির বাঁকির সেনাদল সংখ্যায় ভারী, কিন্তু মহতাবের নেতৃত্বে রামভক্তরা ক্ষুধার্ত বাঘের মতোই আক্রমণ চালিয়েছিল। আগামী পনেরো দিন চলেছিল এই যুদ্ধ। পানিপতের প্রথম যুদ্ধের মতোই কামানের ব্যবহার এবারেও ফারাক গড়ে দিল। প্রতিপক্ষকে তছনছ করে দিল মির বাঁকি। বলা হয়, মহতাবের বাহিনীতে একজনও বাঁচেনি। মহতাব সিংহ, হসবরের রাজা রণবিজয় সিংহ, মকরহির রাজা সংগ্রাম সিংহ প্রত্যেকেই নিহত হয়েছিলেন। আর মোগলদের সেনা সংখ্যাও তলানিতে এসে ঠেকেছিল। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ কানিংহামের লখনউ গেজেটিয়ারে তিনি এই ইতিহাস লিখে গেছেন। এই সংঘর্ষে মূলত ক্ষত্রিয়রা থাকলেও এক ব্রাহ্মণ পরশুরামের মতোই সংহারকর্তা হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দেবীদিন পাণ্ডে। অযোধ্যার পাশেই সূর্য কূণ্ডের কাছে সনেথু গ্রামের নিবাসী দেবীদিন নাকি মির বাঁকিকে প্রায় নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিলেন। ইতিহাস দেবীদিনকে মনে রাখেনি। বা ইচ্ছে করেই তাঁকে ভুলিয়ে দিয়েছে ইতিহাসের লেখকরা। কোনোভাবেই দেবীদিনকে কাবু করা যাচ্ছিল না। শেষে একটা ইটের আঘাতে (খুলি ফেটে গিয়েছিল বলে জানা যায়) দেবীদিনকে ভয়ানক আহত করে দেয় মির বাঁকির এক সৈনিক। রক্তাক্ত দেবীদিন মাথার পাগড়ি খুলে সেই দিয়ে ফেট্টি বেঁধে লড়তে থাকেন। এক সময়ে তিনি হাতির পিঠে বসে- থাকা মির বাঁকিকে আক্রমণ করেন, বাঁকি হাওদায় লুকিয়ে পড়লেও দেবীদিনের হাতে প্রাণ হারায় বাঁকির হাতির মাহুত। সেই সময়েই বাঁকি দেবীদিনকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ওটাই শেষ আঘাত, আর প্রয়োজন পড়েনি। দেবীদিনের নিথর দেহের সাক্ষী হয়ে থাকে অযোধ্যার মাটি। দেবীদিন সাতশো মোগল সৈন্যের সংহার করেছিলেন।

এবার ছিল মসজিদ নির্মাণের পালা। বলা হয় নিহতদের রক্ত দিয়ে ইট বানিয়ে ভিতে দিয়েছিল বাহিনী। কিন্তু যতবার দেওয়াল তৈরি করা হচ্ছিল, ততবার তা ভেঙে পড়ছিল। একদিন, দুদিন, তিনদিন রোজই এক ঘটনা। সারাদিন কাজ করে দাঁড় করানো পাঁচিল সন্ধেবেলায় পরে যেত। মির বাঁকি ভাবল, কোনো রামভক্ত এই কাজ লুকিয়ে লুকিয়ে করছে। দেওয়ালের বহু আগেই পাহারা বসিয়ে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছিল না। কিন্তু দেওয়াল সেই ভেঙেই পড়তে লাগল। দুই ফকির এসব দেখে হতাশ হয়ে পড়ল। মির বাঁকি অবশেষে বাবরকে খবর দিল। বাবর শুনে বলে পাঠালেন, হচ্ছে না যখন বন্ধ করে দিলেই হয়। আমাদের কাজ ছিল দখল করা, সেটা তো হয়েই গেছে। দুই ফকির বলল, তামাম হিন্দোস্তানে যদি নিজের বুনিয়াদ কায়েম করতে হয়, তাহলে এখানে মসজিদ বানিয়ে সেই কাজটা শুরু করতে হবে। আপনি নিজে আসুন, এসে কাজ দেখুন — জালাল শাহ চিঠি লিখল। বাবর নিজে অযোধ্যা গেলেন। কাজ আবার চালু হল, কিন্তু যে কে সেই ব্যাপার। দেওয়াল আর দাঁড়ায় না। এসময় কেউ বলল, রামচন্দ্রের ভক্ত হনুমানজি চিরঞ্জীবী, তিনি এখানেই বিরাজ করেন। যতক্ষণ তিনি আছেন, ততক্ষণ এখানে অন্য কোনো ধর্মের স্থাপত্য দাঁড়াবে না। মসজিদ রক্ষা করতে চাইলে তাঁর স্থাপত্যে কিছু রদবদল করতেই হবে। স্থাপত্যের মিনার সরিয়ে ফেলা হল। সদর দরজায় একটা চন্দন কাঠের খুঁটি লাগানো হল। স্থাপত্যের মাঝবরাবর দুটি গোলাকার চিহ্নের মধ্যে ফার্সি ভাষায় শ্রী সীতাপাক স্থান লেখা হল। উত্তরের দিকে কৌশল্যা দেবীর ছটপূজার জায়গাটাতে যে গর্ত করা হয়েছিল, সেটাকে আবার বুজিয়ে দেওয়া হল। মন্দিরের চারদিকে পরিক্রমার যে পথ, তা আবার পূর্ববৎ করে দেওয়া হল। প্রতিদিন রামভক্তদের ভজন পূজনের জন্য আংশিক ছাড় দিয়ে দিলেন বাবর। মুসলিমরা প্রতি শুক্রবার নমাজ পড়ার ফরমান পেলেন।

 

রামমন্দিরের জন্য এটাই ছিল প্রথম যুদ্ধ। সেই শুরু। তবে বাবর বুঝতে পেরেছিলেন ভূমিকম্পের শেষ এখানেই নয়, তাই ফরমান জারি করে বাইরে থেকে রামভক্তদের অযোধ্যা যাওয়াটাই বন্ধ করে দিলেন দক্ষ পাদশাহ।

এরপরেও যুদ্ধ হয়েছে। হসবরের মহারাজা রণবিজয় সিংহের বিধবা পত্নী মহারানি জয়রাজ কুমারী নিজের তিন হাজার প্রমীলা বাহিনী নিয়ে লড়াই করবেন বলে ঠিক করেন। গেরিলা যুদ্ধ চালাতে শুরু করে রানির সেনা। রানির গুরু ছিলেন স্বামী মহেশ্বরানন্দ নামে এক সন্ন্যাসী। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে রামভক্তদের একত্রিত করছিলেন।

বাবরের সময়ে এবং তার পরে হুমায়ুনের কালেও জয়রাজ কুমারীর নারীদল গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে মোগলদের বাহিনীতে প্রবল ক্ষতি করে দিয়েছিল। এভাবে লড়তে লড়তে একবার অযোধ্যা দখল করে ফেলেন জয়রাজ কুমারী। কিন্তু আবার হামলা করে মোগলরা। অযোধ্যা দখলের মাত্র তিনদিনের মাথায় আবার তা চলে যায় মোগলদের হাতে।

আকবরের সময়ে রানির বাহিনী অন্তত কুড়িবার আক্রমণ করেছে অযোধ্যা দখলের জন্য। অন্তিমবারে দখল হয় অযোধ্যা। এইবারে মসজিদের বাইরের প্রাচীরের চার দেওয়াল ভেঙে সেখানে একটি চবুতরা স্থাপিত হয়। ভগবান রামের প্রতিমা স্থাপন করে ফেলে রানির বাহিনী। কিন্তু যুদ্ধে রানি নিহত হন। আকবর, জাহাঙ্গীর তথা শাহজাহানের সময়ে আর এই চবুতরা বা প্রতিমায় হাত পড়েনি।

শাহজাহানের পর আওরেংজেব। বাবর ছিলেন দক্ষতম যুদ্ধনীতিক, আর ইনি মোগলদের মধ্যে দক্ষতম রাজনীতিক। মসনদে বসেই ঠিক বুঝে নিলেন যে তাঁর বিরুদ্ধে যত মাথা তোলার ব্যাপার হচ্ছে, সেগুলো হচ্ছে বিভিন্ন মঠ – মন্দির থেকেই। রামজন্মভূমিও তারই মধ্যে পড়ছে। নিজের সিপাহসালার জাঁবাজ খানকে পাঠালেন। সঙ্গে সুবিশাল বাহিনী। ঠিক সেইসময়ে অযোধ্যায় জানকী ঘাটে অবস্থান করছিলেন চত্রপতি শিবাজী রাজের পূজনীয় গুরুজি রামদাসের শিষ্য বৈষ্ণব দাস। তাঁর সঙ্গে দশ হাজার চিমটাধারী সাধু ছিল। আওরেংজেব বাহিনী পাথিয়েছে এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই সাধুর দল তৈরি হয়ে গেল। আবার ধর্মযুদ্ধ হল। আমাদের পাঠ্যবইতে বিদেশের মাটির ক্রুসেডের কথা থাকলেও এসব নিয়ে কোনো শব্দ ব্যয় করা হয় না। কিন্তু এই ভীষণ যুদ্ধের আঁচ ছিল প্রবল। উর্বশী কুণ্ডে সাত দিন যুদ্ধ চলল। অবিশ্বাস্য হলেও সেদিন আওরেংজেবের সেনাদল হার মানে।

গরম তেলে জল পড়ার মতোই চিড়বিড়িয়ে উঠেছিলেন আওরেংজেব। সামান্য ক’টা সাধুকে মারতে পারল না? আগের সেনাপতিকে সরিয়ে নতুন মুখ আনা হল। সৈয়দ হাসান আলি। অনেক বেশি সংখ্যক সৈন্য পাঠালেন পাদশাহ। তাঁর গর্জন ছিল —  রামজন্মভূমি আমার চাই!

ভারতে তখন আগুনের মতো খবর ছড়াচ্ছে। এই কথা শিখ গুরু গোবিন্দ সিংহের কানে পৌঁছাল। তিনি ফৈজাবাদের সহাদতগঞ্জে এসে গেলেন। সঙ্গে বিশাল বাহিনী। সে এক ভীষণ যুদ্ধ বাঁধল। সৈয়দ হাসান নিহত হল। একটি মোগল সৈন্যো জীবন নিয়ে ফিরতে পারেনি।

আওরেংজেব এই পরাজয় সহজে মানতে পারছিলেন না, কিন্তু তিনি আর সাহস করে আগামী চারবছর অযোধ্যার দিকে হাত বাড়াননি। তবে ভেতরে ভেতরে আগুনটা জ্বলছিল ঠিকই। চার বছর পরে আবার আক্রমণ হল। এবং এবারে মসজিদের দখল নিল মোগলদের বাহিনী। মন্দিরের প্রতিমা এবারেও কোনো গুপ্ত স্থানে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে চবুতরা নষ্ট করে দিল সৈন্যরা।

মোগলদের শেষ দিকটাতে এক নবাব শহাদত আলি খানের সময়ে রাম জন্মভূমি পুনরুদ্ধারের জন্যে আমেঠির রাজা গুরু সিংহ যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু জয় আসেনি।

তবে রামভক্তেরা হার মানলেন না। আক্রমণের পরে আক্রমণ চলল। নাসিরুদ্দিন হায়দারের সময়ে মোট তিনবার আঘাত হানা হয়। রাজা দেবী বক্স সিংহের নেতৃত্বে আরও কয়েকজন রাজা যুদ্ধে নামেন। এই জুদ্ধটাই রামজন্মভূমির ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম যুদ্ধ ছিল। সাতদিনের লড়াই শেষে মোগলরা পিছু হটে। রামজন্মভূমির দখল নিয়ে রামভক্তরা শর দিয়ে অস্থায়ী ছাউনির মতো মন্দির বানায়। আজকের রামলাল্লা যেমন তাঁবুতে থাকতেন, অনেকটা তেমনই। নবাব এই অস্থায়ী ছাউনিতে হাত লাগানোর সাহস করেননি। কিন্তু রামচন্দ্রের বনবাস তো সবে শুরু হল। ঘরে ফেরা যে তখনো বাকি।

(ক্রমশঃ)