বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

তৃতীয় পর্বের পর

প্রতিরোধ: গোপাল পাঁঠা ও অন্যান্যরা

অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি আঁচ করে হিন্দু মহাসভাও হিন্দুদের প্রস্তুত থাকতে বলে। ‘হিন্দু সেবক সঙ্ঘ’ মুসলিম লীগের উর্দু প্রচারপত্রের পাল্টা প্রচারপত্র ও পোস্টার লাগায়: “সাবধান! ১৬ই আগস্ট”। নির্দেশ ছিল লীগের স্বেচ্ছাচারিতা ভেঙে সমুচিত জবাব দেওয়ার: “Hindus will have to give clear reply to the highhandedness of the Muslim Leage.” [58][59] পাড়ায় পাড়ায় ব্যায়াম সমিতিগুলোর ওপর হিন্দু মহাসভার একটা প্রভাব ছিল, সহযোগতাও ছিল। মণিকুন্তলা সেনও একই কথা জানিয়েছেন, “লীগের ডাকা মিছিল থেকে কিছু একটা অঘটন ঘটবে এটা সবাই অনুমান করছিল। সুতরাং হিন্দুরাও পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হলো।[58][60]

ইদানিং কলকাতা দাঙ্গায় হিন্দুদের রক্ষাকর্তা হিসাবে যাঁর নাম উঠে আসে তিনি হলেন, গোপাল মুখোপাধ্যায়, কলেজ স্ট্রীটে পারিবারিক মাংসের দোকান দেখাশোনা করার সুবাদে যাঁর ব্যাঙ্গাত্মক ডাক নাম জুটেছিল ‘গোপাল পাঁঠা’ [2][5]।[61][62] তবে ঐতিহাসিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে সেই দুর্দিনে অনেক ভদ্রসন্তানও ময়দানে নামতে বাধ্য হন। গোপাল মুখার্জী ছিলেন তেমনই একজন।[64] গোপালবাবুকে নিয়ে ইতিহাসে আলোচনা বিস্ময়কর রকম নগণ্য। পাঠ্যসূচীতে তো নেইই, এমনকি আন্তর্জালকে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর আলোচনাতেও তাঁর নাম চোখে পড়েনি, পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে প্রচলিত কাহিনীর সত্যতা যাচাই করার জন্য তাঁর নাম করে খোঁজাখুঁজি করতে। তবে অনেকে যেমন দাবি করে ১৬-১৭ আগস্ট দুই দিন হিন্দুরা একতরফা মার খাওয়ার পর ১৮ থেকে গোপাল মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দান উল্টে গিয়েছিল, ঘটনা ঠিক তেমন নয়। গোলমালের আঁচ পেয়ে কিছুটা সতর্কতা হিন্দুদের তরফ থেকেও ছিল। নতুবা সেই বিপর্যয় আটকানো যেত না।

গোপাল মুখোপাধ্যায়ের পরিবার ১৮৯০-এর দশকে পূর্ববঙ্গের চৌডাঙা জেলার জীবননগর থেকে কলকাতায় এসে বৌ বাজারের মালঙ্গ লেনে বসবাস শুরু করে[1][63]। গোপালের কাকা অনুকূল চন্দ্র ছিলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ও একজন বিপ্লবী, যাঁকে স্বাধীন ভারতে ১৯৬৪ সালে মরণোত্তর পদ্মভূষণ পুরস্কার দেওয়া হয়।[64][56]
মাংস ব্যবসার দৌলতে মুসলিম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠা-বসা, বন্ধুত্ব। ঐতিহাসিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ একাধিক গবেষকের মতে মুসলিমদের প্রতি কোনও বিরূপতা বা ভীতি কোনওটাই ছিল না গোপালের মধ্যে[6]।[65][56] তাছাড়া পরোপকারী হিসাবেও পাড়ায় পরিচিতি ছিল। তবে গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহের পরিবর্তে তাঁর আদর্শ ছিল নেতাজির সশস্ত্র বিপ্লব। সেই উদ্দেশ্যে অল্পবয়সী ছেলেদের নিয়ে ‘ভারত জাতীয় বাহিনী’ নামে একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, যার কাজ ছিল দুর্গতদের সেবা করা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণ দেওয়া। বাহিনীর অনেক সদস্যই ছিল কুস্তিগীর। কলকাতা দাঙ্গার সময় গোপালের বয়স ছিল ৩৩ বছর।[56]

১৬ই আগস্ট সকাল থেকেই মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের মিছিল ও হিন্দুহত্যার খবর শোনা যায়। ১৭ই আগস্ট ব্যাপক হারে হিন্দু হত্যা ও নারী ধর্ষণের ভয়াবহ খবর পেয়ে নিজের ছেলেদের প্রত্যাঘাতের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। তাদের মধ্যে বীডন স্ট্রীটের বাসিন্দা ও ঐ এলাকার দায়িত্বে থাকা বসন্ত নামে এক কুস্তিগীরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৭-র রাতে আক্রমণ প্রতিহত করার পরিকল্পনা করা হয়। আত্মরক্ষার পরিকল্পনা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বেশ কিছু অবাঙালী হিন্দুও যোগ দেয় সেই বাহিনীতে। বড়োবাজার এলাকার মাড়োয়াড়িরা যাদের দোকান-পাট পুড়েছিল মুসলিম হানায়, তারা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আর্থিক সাহায্য করতে চায়।[56]
আর কিছু অস্ত্র যোগাড় করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকান সৈন্যদের কাছ থেকে ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়[6]।[65] দুদিন একতরফা হিন্দু নিধনের পর ১৮ই আগস্ট ছিল পাঁঠার নেতৃত্বে সিংহ বীক্রমে ঘুরে দাঁড়ানোর দিন। গোপাল বাহিনীর এই প্রস্তুতির কথা সুরাবর্দি ও লীগের দুষ্কৃতিরা জানত না। তারা মহা উৎসাহে ১৮-র সকালেও হিন্দু এলাকায় মৃগয়ায় বেরিয়েছে। সুরাবর্দির নির্দেশে তাদের হাতে আর দু’ দিন সময় ছিল হিন্দু সাফাইয়ের জন্য, কারণ দিল্লিতে খবর যাওয়ায় ওপর মহল থেকে হিংসা থামানোর জন্য চাপ আসছিল। সুতরাং ভাইসরয় হস্তক্ষেপ করার আগেই কাজ সেরে ফেলে অপরাধীদের পার্শ্ববর্তী জেলায় চালান করার তাড়া ছিল মন্ত্রীমশাইয়ের।[56] সেদিন সকালেই ‘হিন্দু সাফাই অভিযাত্রী’র দল অতর্কিতে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে চম্পট দিতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ মারাও যায়।

হানাবাজদের পর্যুদস্ত করে গোপালের বাহিনী অতঃপর মুসলিম এলাকায় গিয়ে কট্টর ইসলামপন্থীদের কচুকাটা করতে থাকে। উল্লেখ্য খুনের বদলা খুন হলেও ধর্ষণের বদলা ধর্ষণ হয়নি সেই প্রত্যাঘাতে। ছাড় দেওয়া হয়েছিল শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদেরও।[56] “গোপাল মুখোপাধ্যায়ের বিবৃতি: আগে থাকতে কিছু হাতবোমা মজুত রাখা ছিল। কিন্তু এত বড় দাঙ্গা হবে ভাবা যায়নি। ১৬ তারিখে পাড়ার কিছু মুসলমান পরিবারকে থানায় পৌঁছে দিয়ে আসা হয়। এক মুসলমান যাদুকর বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি। তার নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয় হিন্দু যুবকরা। কিন্তু ঐ দিনই সন্ধ্যের পর থেকে বীভৎস দাঙ্গার খবর আসে। জানা যায়, স্থানিয় ফিয়ার্স লেনে. সাগর দত্ত লেনে প্রচুর হিন্দু মারা পড়েছে। তখন ঠিক করা হয়, একটঅ হিন্দুর লাশ দেখলে দশটা মুসলমানের লাশ ফেলতে হবে।ততারপর একদিনে চলে হিন্দুদের রেসকিউ করা, আর অন্যদিকে হিন্দু হত্যার বদলা নেওয়া। গরীব মুসলমানরাই মারা যায় এর ফলে, কারণ তারাই পেটের টানে রাস্তায় বেরিয়েছিল।” (সাক্ষাৎকার: ৩২.০৭.৯২)[64]
ঐতিহাসিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, “They faced resistance everywhere. Hindu youths counter-attacked with such ferocity that the Muslim League men had to flee. Many were killed. Emboldened by their success in taking on and defeating their Islamist attackers, Hindu youths took the fight to Muslim-majority areas and started killing Islamist men. They did not, however, touch Muslim women and children or the aged and the infirm,” তিনি আরও লিখেছেন গোপাল কখনই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, শুধু আত্মরক্ষার্থে হিন্দু যুবকদের সংগঠিত করেছিলেন। তিনি উভয় সম্প্রদায়ের গৃহহীন ও বিধবাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং তাদের খুন বা ধর্মান্তরিত হওয়া থেকেও রক্ষা করেছিলেন। “Gopal was never communal. He simply organised self-defence of Hindus by organising Hindu youths to fight back Islamist aggression. He gave shelter to the homeless and widows and stopped them from getting killed or converted,”[56]
তবে হিন্দু সংগঠনগুলো যাবতীয় কৃতিত্ব গোপাল মুখোপাধ্যায়কে দেয় অনেকটা নায়ক নির্মাণের জন্য। হিন্দু মহাসভার শরীরচর্চায় অস্ত্রশিক্ষায় অনুপ্রেরণা ছাড়া পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া অত দ্রতু পাড়ায় পাড়ায় সার্বিক প্রতিরোধ কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তখন কিন্তু ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনির উন্মাদনা আমদানি হয়নি, শক্তি যুগিয়েছিল ‘বন্দে মাতরম’-এর দেশাত্মবোধই। এই ভূমিকায় এখন আর কোনও হিন্দু সংগঠনকে দেখা যায় না। ঐতিহাসিক টুকার ফ্রান্সিসের (Tuker, Francis ) বর্ণায় পাওয়া যায়, ১৭ তারিখ বিকেলের পর সেনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু ১৮ তারিখ থেকে বাস ও ট্যাক্সি চেপে বের হয় হিন্দু ও শিখ হাতে লাঠি, তরোয়াল ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে।[66] শোনা যায়, রাতারাতি কামারশালায় তরোয়াল, বর্শা, কাটারি ইত্যাদি তৈরি হয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শোনা, দেশপ্রিয় পার্ক এলাকায় রাস্তার ধারে একটাও রেলিং অবশিষ্ট ছিল না, চলে গিয়েছিল কামারশালে। যদিও অনেকে ভাবতে ভালোবাসে যেসব নেতারা হিন্দু হত্যায় প্ররোচনা বা আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের সনাক্ত করে হত্যা করা হয়। তবে গোপালবাবুর নিজের বয়ান অনুযায়ী বহু গরীব সাধারণ মুসলমানরাই বেশি মারা পড়েছিল। অন্তত সোহ্‌রাবর্দি বা নাজিউদ্দীনের মতো নেতাদেরর যে কেশাগ্র স্পৃষ্ট হয়নি, তার সাক্ষী তো ইতিহাস। মণিকুন্তলা সেনের অভিধায় “ডাইরেক্ট অ্যাকশনের জেনারেল ছিলেন সোহরাবর্দি।”[67][68] অথচ দুই সম্প্রাদায়ই দাঙ্গায় কাজে লাগায় নিম্নবর্গের মানুষদের। “হিন্দুদের পক্ষে তারা ছিল: গোয়ালা, কুলি, জমাদার, রিকশাওয়ালা; মুসলমানদের তরফে ছিল: সহিস, কোচোয়অন, কসাই, রাজমিস্ত্রী। প্রাণে মরে প্রধানত গরিবরাই: ‘মুচি, মেথর, মুদ্দোফরাস, মোসাদ, কোচোয়ান, কুলি, গাড়োয়ান, রাজমিস্ত্রী, রিকশাওয়ালা, বিড়িওয়ালি, ব্যাপারী, চাষী, জেলে ও মাঝিরা’।”[69][70]
১৮-২০ আগস্ট মুসলিম লীগের ঘাতকদল সমুচিৎ জবাব পেয়ে যায়। সুরাবর্দি ও তার সাকরেদরা এবং হিন্দু বিদ্বেষী কলকাতা পুলিসের আধিকারিক ও সিপাইরা – কেউ সেই প্রতিরোধ ও প্রত্যাক্রমণ আটকাতে পারল না। হিন্দুদের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছিল শুধু গোপাল মুখার্জী ও তাঁর অনুগামী বসন্ত নামক কুস্তিগীরের সক্রিয় নেতৃত্বে তাঁদের সতীর্থদের জন্য নয়, একই সঙ্গে পেশিবল দিয়ে সেই লড়াইয়ে ঝাঁপিয়েছিল বিহার ও ইউনাইটেড প্রভিন্সের দলিত ও অবাঙালী হিন্দুরা, অর্থ সাহায্য করেছিল মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা।[56] জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ এসেছিল ভবানীপুর গুরুদ্বার থেকেও। তাছাড়া প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী গোপালবাবুরা মূলত উত্তর কোলকাতায় সক্রিয় ছিলেন, যেখানে দক্ষিণ কলকাতাতেও যে প্রতিরোধ বা প্রত্যাক্রমণ হয়েছিল তা অনেকটাই ভবানীপুর অঞ্চলের শিখদের প্রভাবে। তখন বাঙালী লক্ষ্মী ছেলেরাও যে ইঁদুরের গর্তে ঢুকে বসে থাকেনি, তার প্রমাণ রাশবিহারী বসু রোডের ধারে বসা কামারশালায় রাস্তার রেলিংগুলির সদ্‌ব্যবহার। দাঙ্গাটা কার্যত গুণ্ডাদের হাতেও চলে যায়।
অনেকেই অপর সম্প্রদায়ের নিরপরাধ মানুষকে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও রক্ষা করেন। অভিনেত্রী সন্ধ্যারানী ছিলেন তেমন একজন। এই মহানুভবতায় বলা বাহুল্য হিন্দুরা অনেক বেশি সংখ্যাক হলেও বিচ্ছিন্নভাবে মুসলিমরাও কেউ কেউ কিছু হিন্দুকে রক্ষা করেছিল। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও সবাই তখন দূর থেকে মজা দেখেননি। কংগ্রেসের বিজয় সিং নাহার, পবিত্রকুমার দে থেকে কমিউনিস্ট পার্টির দু-একজন নেতাও লুঠপাট থামাতে দাঙ্গা থামাতে উদ্যোগ নেন, হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে উদ্ধারও করেন।[71][72][73] এর মধ্যে বিজয় সিং নাহার নিজের লাঠি হাতে উন্মত্ত জনতার হাত থেকে একাধিক হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করেন, সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলেন।[74][75]। প্রশাসনিক মদতে ভয়াবহ দাঙ্গা প্রতিরোধে ও তার অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে পারার নেপথ্যে ছিল অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, আত্মোন্নতি সমিতি, বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এমনকি বামপন্থী আরএসপি – এই দলগুলির সক্রিয় ভূমিকা। সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, বিষ্ণচরণ ঘোষ ও তাঁর ছাত্ররাও। এঁদের নিয়ে বাঙালী ঐতিহাসিকদের বিশদ গবেষণার খুব অনীহা। সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইতিহাসের দিকে ফিরে ছেচল্লিশের দাঙ্গা বইয়ে দাঙ্গা থামাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে শহীদ হওয়া পাঁচজনের নাম পাওয়া যায় – ভূদেব (ননী) সেন, স্মৃতিশ বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীন্দ্র মিত্র, সুশীল দাশগুপ্ত, লালমোহন সেন। সবাই হিন্দু।
সুরাবর্দির কাছে বাঙালী হিন্দুর এই পাল্টা মার দেওয়ার ব্যাপারটা ছিল অভাবনীয়। ১৯ আগস্ট সন্ধ্যায় দৃশ্যত তাঁকে হতাশ হয়ে পড়তে দেখা গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে শান্তি প্রস্তাব দেন। সেটা তাঁকে দিতেই হোত, না হলে দাঙ্গার মোড় ঘুরে যাওয়ায় মুসলিম জনসংখ্যা আরও হ্রাস পেত। দাঙ্গা থামানোর দায়িত্ব দেন মুসলিম লীগের ছাত্র নেতা জি. জি. আজমেরি ও Muslim National Guard-এর দায়িত্ব থাকা মুজিবর রহমানকে, যাঁরা প্রথম দিকে হত্যাকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্বেই ছিলেন।[56]
হিন্দুঘাতী মার চলা কালে জাতির জনকের টনক নড়েনি, কিন্তু পাল্টা মারে মুসলিমরা আক্রান্ত খবর পেতেই গান্ধীজী যথারীতি কলকাতার হিন্দুদের কাছে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ত্যাগ করার ও তাঁর কাছে অস্ত্র সমর্পণের আবেদন করেন। গোপাল মুখোপাধ্যায়ের কাছেও অস্ত্রত্যাগের ব্যক্তিগত আবেদন রাখেন। জনৈক কংগ্রেসি নেতা আবার গোপালকে বাপুজীর পায়ে অস্ত্র সমর্পণ করার নির্দেশ দেন। গোপাল মুখার্জী জবাব দেন, “হিন্দুদের মর্যাদা রক্ষিত না হলে একটি পেরেকও জমা দেব না।” [I will not lay down even a nail if it has not been used for defending Hindu honour.][56][76] ভাগ্যিশ বলামাত্র গান্ধীজীর পরামর্শ মানার দুর্বুদ্ধি গোপাল বা তাঁর অনুগামীদের হয়নি। তিনি সুরাবর্দিকে শর্ত দেন, মুসলিম লীগের ঘাতকরা আগে অস্ত্রত্যাগ করে হিন্দু হত্যা বন্ধ করুক। সেই শর্ত সুরাবর্দি মেনে নিতে বাধ্য হন বলেই পশ্চিম বাংলা হিন্দু শূন্য হয়ে যায়নি।
সুরাবর্দির এই পশ্চাদপসরণের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল ধৈর্যৈর শেষ সীমায় চলে গেছেন, যার ফলে সুরাবর্দির নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকারকে বরখাস্ত করতে পারেন। তাই নিজের গদি ও মান বাঁচাতে শান্তির আবেদন করেন। কিন্তু ২১ আগস্ট সুরাবর্দির সরকারকে বরখাস্ত করে বাংলায় ভাইসরয়ের শাসন জারি হয়। ব্রিটিশ ও গোর্খা পুলিস টহল দিয়ে সারা কলকাতা ছেয়ে ফেলে আবিষ্কার করে হিন্দুদের তুলনায় মুসলিমদের মৃত্যু হয়েছে বেশি।[56]
তবে খুনি সুরাবর্দির সেই ক্ষমতাচ্যুতি নিতান্তই সাময়িক। পার্লামেন্টে বাংলার মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তোলা হলে, নমশূদ্র নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কংগ্রেসের সদস্য ভাঙিয়ে ভোটাভুটিতে সুরাবর্দিকে জিতিয়ে দেন। রক্তের নদীতে নিজের রাজনৈতিক জীবনের ভেলা ভাসিয়ে তিনি পরে পূর্ব পাকিস্তানে ক্যাবিনেট মিনিস্টার হন, যদিও টিঁকতে পারেননি।
সেই সময় গোপাল ও তাঁর ‘ভারত জাতীয় বাহিনী’-র ছেলেরা কলকাতার পরিত্রাতা হিসাবে নায়কোচিত সম্মান পেয়েছিলেন। গোপাল পরবর্তী জীবনে সমাজসেবা নিয়ে থাকতেন। তাঁর সেবা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল “National Relief Centre for Destitutes”।[76] নিজের এলাকায় বারোয়ারি কালী পুজোও শুরু করেন। আজ গোপাল মুখোপাধ্যায় ঐতিহাসিক আলোচনায় যতই উপেক্ষিত হন, আর প্রসঙ্গ উঠলে তাঁর স্বাজাতি ও স্বধর্মের মানুষ যতই গালাগালি দিক, তিনি হাত-পা গুটিয়ে থাকলে শুধু যে কলকাতা হিন্দুশূন্য হয়ে যেত তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গেরও পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি আটকানো যেত না, তাঁকে গুণ্ডা দাঙ্গাবাজ বলার মতো বাঙালীরা হয়তো জন্মানোর সুযোগই পেত না।
ঐতিহাসিকদের কলমে:
ঐতিহাসিক Yasmin Khan-এর ভাষায়, “if he did not explicitly incite violence (which) certainly gave the crowd the impression that they could act with impunity, that neither the police nor the military would be called out and that the ministry would turn a blind eye to any action they unleashed in the city…”।[77] অর্থাৎ হিংসা উস্কে উন্মত্ত জনতাকে যা খুশি করার ছাড় দেওয়া ছিল যেখানে পুলিস বা মিলিটারি কেউ বাধা দেওয়ার ছিল না, আর প্রশাসনের তরফে ছিল দেখেও না দেখার আশ্বাস। আবুল কালাম আজাদের “India wins Freedom” বা লিওনার্ড মোসলের (leonard Mosley) লেখা “The last Days of the British raj” বইগুলোতে ’৪৬-এর কলকাতা গণহত্যার হাড় হিম করা বর্ণনা পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিক দেবেন্দ্র পাণিগ্রাহী তাঁর “India’s Partition: The Story of Imperialism in Retreat”[33] বইয়ে মুসলিম লীগের মুখপত্র The Star of India-র ১৯৪৬-এর ১৩ আগস্ট সংখ্যা থেকে সুরাবর্দির বক্তৃতা উদ্ধৃত করেছেন – “Muslims must remember that it was in Ramzan that permission for jehad was granted by Allah. It was in Ramzan that the Battle of Badr, the first open conflict between Islam and heathens, was fought and won by 313 Muslims and again it was in Ramzan that 10,000 Muslims under the Holy Prophet conquered Mecca and established the Kingdom of Heaven and the commonwealth of Islam in Arabia. The Muslim League is fortunate that it is starting its action on this Holy month and day”. [78] রমজানের সময় আল্লা প্রদত্ত জেহাদের নির্দেশ, রমজান মাসেই মাত্র ৩১৩ জন মুসলিমের বদর যুদ্ধে জয় ও রমজানের সময় পয়গম্বরের ১০,০০০ মুসলমান নিয়ে মক্কা বিজয় করে স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাহিনী স্মরণ করিয়ে শত্রুদমনের এই টোটকা দারুণ ফলপ্রসূ হয়েছিল। ঐতিহাসিক যুথিকা রায় বলেছেন, সুরাবর্দিকে হিন্দুদের আতঙ্কিত করার জন্য যে কোনও উপায় অবলম্বনের ছাড়পত্র মহম্মদ আলি জিন্নাই দিয়ে রেখেছিলেন। পত্যাক্রমণের মুখে ও কেন্দ্রীয় সরকারের চাপে পড়ে লোক দেখানো শান্তির কথা বললেও হাজার কুড়ি মানুষ তখন মৃতের স্তূপ হয়ে নর্দমা খাল বিল পথে গঙ্গায় ভেসে গেছে।
হিন্দু প্রেস, ইন্ডিয়ান প্রেস কাগজ থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত প্রত্যক্ষদর্শী, লেখক ও ঐতিহাসিক সেই ভয়াবহতার জন্য সুরাবর্দির উত্তেজক ভাষণ ও আপৎকালে নিজের পুলিসকে নিষ্ক্রিয় করে রাখাকেই দায়ী করেছেন[36][37][38][39]।[47][48][58] পুলিস সূত্রে খবর সুরাবর্দি ও নিজামুদ্দিনের বক্তৃতা শুনে উত্তেজিত মুসলিম লীগ কর্মী ও তাদের সহযোগী স্বেচ্ছাসেবীর দল স্বাধীন পাকিস্তানের দাবিতে মুসলিমদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করার ডাক দিয়ে হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি আক্রমণ শুরু করে[40][41][42][43][44][45]।[46][79][80][81][82]
মুসলিম লীগ এই হিংসার দায় কংগ্রেসের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। অবশ্যই অন্যায় আবদারের কাছে নতজানু না হয়ে ‘আল্লা হো আকবর’-এর সঙ্গে প্রকৃতই পাল্লা দিয়ে চলেছিল কংগ্রেসসহ হিন্দু বিপ্লবী দলগুলোর নেতৃত্বে ‘বন্দে মাতরম’।[74][84] কিন্তু লীগ নেতা আবুল হাশিমের আত্মজীবনী সূত্রেই জানা যায়, নিজামুদ্দীন পরিষ্কার ঘোষণা করেন, “আমাদের লড়াই কংগ্রেস আর হিন্দুদের বিরুদ্ধে।” হাশিম তাঁকে সতর্ক করলেও ততক্ষণে দাঙ্গার খবর আসতে থাকে।[85][86] আর এক লীগ নেতা মনসুর আহমেদ সাফাই দেন: সভায় রটে যায়, বেহালা, কালীঘাট, মেটিয়াবুরুজ, মানিকতলা অঞ্চলে হিন্দুরা অনেক মুসলমানকে খুনজখম করেছে। এরপর কয়েকজন আহত মুসলমানকে কাঁধে করে এনে দেখানো হয়। তাতেই নাকি জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।[85][87] আসলে কিছু তো অজুহাত লাগে।
ঐতিহাসিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘ইতিহাসের দিকে ফিরে ছেচল্লিশের দাঙ্গা’ বইটিতে লিখেছেন “৩১শে জুলাই থেকে ১৬ই আগস্ট ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার পাতা ওল্টালে একটা চক্রান্ত কিভাবে দানা বাঁধছে, দাঙ্গার একটা ছক কিভাবে তৈরি হচ্ছে, তার পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়: ১ আগস্ট: নাজিমুদ্দীন মুসলমান যুবকদের আর দেরি না করে মসলিম ন্যাশনাল গার্ডে যোগ দেবার আহবান জানাচ্ছেন।”[88][পৃ ৩২]…. ১৫ আগস্ট: রেলওয়ে কর্মীদের নিয়ে মুসলিম ন্যাশনাল কোর গঠন করা হচ্ছে। লীগ নেতা নুরুল হুদা ঘোষণা করছেন, আর শ্লোগান নয়, এবার চাই অ্যাকশন: No more slogan, the clarion call has come for action, nothing but action.”[পৃ.৩৩][89]
তিনি আরও জানিয়েছে “ইতিপূর্বে (১৯৪৩) মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি স্বীকার করে কমিউনিস্টরা লীগের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। লীগও সম্ভবত কমিউনিস্টদের হাতে রাখতে চেয়েছিল। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ঠিক আগের দিনই বাংলার লীগ সরকার বন্দী বিপ্লবীদের মুক্তিদান ঘোষণা করে। বন্দীদের মধ্যে তখন গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, নলিনী দাসের মতো কমিউনিস্টরাই সংখ্যায় বেশি ছিল।” বিনিময়ে ১৫ই আগস্ট এক সভায় বামপন্থী ট্রাম শ্রমিক ইউনিয়ন মুসলিম লীগের ডাকা ধর্মঘট সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়, না হলে নাকি শ্রমিকদের মধ্যেই দাঙ্গা বেধে যেত। দলের মধ্যে মতান্তর সত্ত্বেও এমনকি ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক একতার স্বার্থে’ লীগের মিছিলে যোগদানের পক্ষেও মত দেয় অনেকে[পৃ.৩৫-৩৬] [90][91] যদিও লীগের দাঙ্গা পরিকল্পনার ছবিটা ততদিনে পরিষ্কার ছিল। কারণ একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান থেকে জানা যায়: ভবানীপুরের নর্দার্ন পার্কের সমস্ত রেলিং ১৬ই আগস্টের কয়েকদিন আগেই উধাও। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, হ্যারিসন রোডে মুসলমানদের দোকানে চলছিল অস্ত্রে শান দেওয়া। সঙ্গে লীগের লরিতে চেপে পাড়ায় পাড়ায় স্লোগান – “আল্লাহ আকবর। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।” সুতরাং গোলমালের আঁচ পেয়ে গোপনে অস্ত্রে সংগ্রহ শুরু করে কিছু হিন্দু যুবকও।[পৃ-৩৮][92]
ব্যতিক্রমীভাবে অ্যান্ড্রিউ সাহেবের (Andrew Whitehead) মতে “Gopal Chandra ‘Patha’ Mukherjee or Mukhopadhyay (1913-2005) was a goonda or gang leader in Calcutta and involved in the Great Calcutta Killings which so disfigured the city at Partition.”[93] মোটামুটি সুরঞ্জন দাস প্রমুখের বক্তব্যও তাই – লম্বা চুলওয়ালা গুণ্ডা।[93] কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসের অধ্যাপিকা (Professor of South Asian History at the University of Cambridge) ঐতিহাসিক জয়া চ্যাটার্জী সুরাবর্দির দায় স্বীকার করলেও হিন্দু নেতাদেরও সমান দোষ দিয়েছেন[47]। “Both sides in the confrontation came well-prepared for it … Suhrawardy himself bears much of the responsibility for this blood-letting since he issued an open challenge to the Hindus and was grossly negligent … in his failure to quell the rioting … But Hindu leaders were also deeply implicated.”[94] আক্রান্ত হয়ে হিন্দুরা বিনা প্রতিরোধে মার খেয়ে নির্মূল হয়ে গেলে হয়তো খুশি হতেন। ক্রিয়াতে তো আপত্তি নেই, অসুবিধা প্রতিক্রিয়া নিয়ে। তাঁর অভিযোগ সংবাদপত্র ঘটনার জন্য শুধু সুরাবর্দিকে দায়ী করেছিল বলে। “Hindu culpability was never acknowledged. The Hindu press laid the blame for the violence upon the Suhrawardy Government and the Muslim League.”[95] জয়া চ্যাটার্জীদের মতো প্রগতিশীল বাঙালী মণিষার জন্যই সাদা ও কালো গুলিয়ে ধূসর হয়ে যায়, যাঁরা বাংলাভাগের পেছনে শুধুই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা দেখেতে পান। শুধু তাই নয়, যথারীতি নিজের উদ্ভট অসাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে ডঃ চ্যাটার্জী গোপাল পাঁঠাকে গুণ্ডা হিসাবে দেখেছেন, দাঙ্গায় যাঁর দায় সুরাবর্দির চেয়ে কিছু কম নয়। “…was a major goonda at the time, who could command a force of around 500 men”।[76] তাছাড়া দেশভাগ গবেষক অ্যান্ড্রিউ হোয়াইটহেড (Andrew Whitehead)-এর সাক্ষাৎকার নিয়ে শ্রীমতী চ্যাটার্জী জানিয়েছেন, স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ও বড়ো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গোপালের ঘণিষ্ঠতা ছিল। তাদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলেই নাকি গোপাল গুণ্ডা উত্তর কলকাতায় সুরাবর্দির শান্তিদূতদের সঙ্গে টক্কর দিতে পেরেছিলেন।[76] তাই তো, কী অন্যায়! ডাঃ রায় বা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা থেকে সুরাবর্দির সশস্ত্র গুণ্ডাদের প্রতিহত করা – সবটাই তো অমার্জনীয় অপরাধ।
সত্যিটা জানা যায় ঘটনার পর ফোর্ট উইলিয়াম স্থিত এক ব্রিটিশ অফিসারকে লেখা জনৈক গোয়েন্দা পুলিসের চিঠিতে: “There is hardly a person in Calcutta who has a good word for Suhrawardy, respectable Muslims included. For years he has been known as “The king of the goondas” and my own private opinion is that he fully anticipated what was going to happen, and allowed it to work itself up, and probably organised the disturbance with his goonda gangs as this type of individual has to receive compensation every now and again.”[48][96] কলকাতায় এমন কেউ ছিল না যে সুরাবর্দির নিন্দা করেনি, এমনকি সম্মানীয় মুসলিমরাও। বহুদিন পর্যন্ত তাঁর পরিচয় ছিল ‘গুণ্ডাদের রাজা’। পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি টের পেয়েও তিনি সে সব ঘটতে দিয়েছিলেন ইচ্ছাকৃতভাবে। এই ‘গুণ্ডা-রাজ’ সম্পর্কে ত্রিপুরার বর্তমান রাজ্যপাল তথাগত রায়ের মতে দাঙ্গাটা সুরাবর্দির পূর্ব-পরিকল্পিত ছিল। কী হতে চলেছে খুব ভালো করে আঁচ পেয়েই বাংলার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী সেটা ঘটতে দিয়েছিলেন। নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যেই পুলিস বাহিনী ও মন্ত্রীত্ব থেকে হিন্দু কর্মী, আধিকারিক ও নির্বাচিত নেতাদের সরিয়ে রেখেছিলেন[49]।[97]
জয়া চ্যাটার্জী, সুরঞ্জন দাস বা তাঁদের গোত্রের আরও জনা কয়েক ছাড়া বাকি ঐতিহাসিকরা প্রকৃত অপরাধীকে সনাক্ত করতে কোনও জটিল তত্ত্বের অবতারণা করেননি। এমনকি বাংলাদেশী ঐতিহাসিক হারুন-অর-রশিদ তাঁর “The Foreshadowing of Bangladesh: Bengal Muslim League & Muslim Politics: 1906-1947”,[50] [98] বইটিতে সুরাবর্দির হিন্দু বিনাশের নারকীয় পরিকল্পনার বর্ণনায় বলেছেন, পুলিসকে মুসলিম আততায়ীদের আটকানোর সুযোগই দেওয়া হয়নি।
দাঙ্গার দায় সম্পূর্ণ মুসলিম লীগের ওপর আরোপ করেছিলেন আবুল কালাম আজ়াদ।[99][102] পুলিসের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফজলুল হকও – গোলমালের আঁচ না পেলে পুলিসকে মাইনে দিয়ে রাখা কেন?[100][102] আর সবচেয়ে শ্লেষাত্মক মন্তব্য করেন ছাত্রনেতা আননিসুজ্জামান: “আমরা দেখিয়াছি ময়দানের সভায় যাইবার জন্য মিছিলকারী ও লীগওয়ালারা ছোরা ও লাঠিসহ সশস্ত্র হইয়া অবলীলাক্রমে রাস্তার উভয় পার্শ্বস্থ হিন্দুর দোকান লুণ্ঠন করিতে করিতে যাইতেছে। আমরা আরও দেখিয়াছি, সশস্ত্র পুলিস ইহা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিয়াছে আর মনের আনন্দে হাসিয়াছে।….একথা সকল নিরপেক্ষ সজ্জন ব্যক্তি অকপটে স্বীকার করিবেন যে, দাঙ্গার জন্য মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দই একমাত্র দায়ী।[101] মুসলিম লীগ দায় অস্বীকার করলেও নির্মলকুমার বসু লিখেছেন, “The offensive began from the side of the Muslim mobs; but within a few hours …Hindus also struck back.”[102] একই বক্তব্য সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের।[103]
ইতিপূর্বে ভারতে দাঙ্গা লেগে থাকলেও এই দাঙ্গায় “ethnic cleansing,” ব্যাপারটা সম্ভবত প্রথম পরিলক্ষিত হয়।[104] হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করতে মহিলা ও শিশুদের শেষ করার কর্মসূচী নিয়েছিল মুসলিম লীগ। যুদ্ধ ও দাঙ্গা দুটোই সমাজের পুরুষালি অভিশাপ, কিন্তু তার বলি হতে হয় নারী ও শিশুদের। লর্ড ওয়াভেল বলেছিলেন, পলাশির যুদ্ধে যতজনের মৃত্যু হয়েছিল তার চেয়েও বেশি মানুষ মারা যায় এই কলকাতার দাঙ্গায়। এর থেকেই অনুমান করা যায়, মৃতের সংখ্যা ৪-৫ হাজারে সীমাবদ্ধ ছিল না।
লর্ড ওয়াভেল (Lord Wavell) জানিয়েছেন ২৭ আগস্ট ১৯৪৬ তাঁর সঙ্গে বৈঠকে গান্দীজী তাঁকে বলেছিলেন, “If India wants bloodbath she shall have it … if a bloodbath was necessary, it would come about in spite of non-violence”.[33][105] অর্থাৎ ভারত যদি রক্তস্নান করতে চায় তো হবে। যদি রক্তস্নান জরুরি হয়ে থাকে তাহলে তা অহিংসা নীতি সত্ত্বেও হবে। কী চমৎকার সত্যাগ্রহ! তাই না?
দাঙ্গার সময় ব্রিটিশ পুলিস ও সেনার ভূমিকা ছিল আগুনে রুটি সেঁকার মতো। ব্যারাকপুর মিলিটারি ব্যারাকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, “When the riot begins we will not interfare. If the people want ‘swaraj’ let them fight for it.”- [Modern Review, July 1947]। [106] সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেডিয়ার পরে জানান, পূর্বাঞ্চলের সেনাধ্যক্ষ বুচার (General Butcher) গোয়েন্দা পুলিসকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, হাঙ্গামা হতে পারে।[107] সো্হ্‌রাবর্দি সম্ভবত প্রত্যাঘাতের খবর পেয়ে প্রথম দিনই মিলিটারি নামাতে চাইলেও গভর্নর বারোজ (Burog) গা করেননি। বরং ইংরেজরা এমনকি এক হিন্দু পুলিস অফিসারও জনগণে দুর্দশায় আমোদিত হয়েছিল। হিন্দু বাঙালীরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করবে, আবার ব্রিটিশ পুলিস মিলিটারি তাদের বাঁচাতে তৎপর হবে – তা কী করে হয়? স্বরাজ চাই? নে স্বরাজ। একই বর্ণনা মেজর জয়পাল সিংও দিয়েছেন, “দাঙ্গা দেখে ব্রিটিশ পুলিসরা বেশ মজা পাচ্ছিল আর বলছিল: ‘বেজন্মাদের এমনই হোক। এভাবেই তারা স্বরাজ ভোগ করুক।”[108] তাই ভাইসরয় Owavel বিরক্ত হলেও হানাহানি বন্ধ করার তাগিদ দেখা যায়নি। তারা সোৎসাহে লক্ষ্য করেছিল, দাঙ্গার চরিত্র সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক (markedly communal), ব্রিটিশ বিরোধিতার কোনও চিহ্নই ছিল না। একজন ইওরোপীয়দের গায়েও আঁচড় লাগেনি।[109]
ঐতিহাসিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে গুণ্ডা-দুর্বৃত্তদের এই দাঙ্গায় পরিকল্পনামাফিক কাজে লাগানো হয়েছিল।[110] সোহরাবর্দির সুশাসনে ১৯৪৩-এ বাংলার ভয়াবহ সরকার সৃষ্ট মন্বন্তরের পর বেকারকত্ব ও অনটনের জ্বালা থেকে সেই সময় গুণ্ডা মাস্তানদের দৌরাত্ম্য বেড়েছিল। স্বীকার করেও বলতে হয়, মুসলিম সরকারের উৎসাহে মুসলিমদের সহজাত দুর্বত্তপনার বিরুদ্ধে কিছু হিন্দু মাস্তানও দাঁড়িয়েছিল বলেই ইতিহাসের পাতা থেকে এখনও বাঙালী হিন্দু মুছে যায়নি।

পরিস্থিতি সামলাতে ভাইসরয়ের শাসন জারি হওয়ার পর কংগ্রেসের নেতা জওহরলাল নেহেরুর প্রধানমন্ত্রীত্বে ভারতে আপৎকালীন মধ্যবর্তী সরকার (Interim Government) গঠিত হয়। কিন্তু জিন্নার ও সুরাবর্দি পরিকল্পিত ও আহূত আগস্ট ১৯৪৬-এ কলকাতায় গণহত্যার ভয়াবহতা খুব স্পষ্ট ভাবে পাকিস্তান দাবি আর দাঙ্গা যে সমার্থক তা প্রমাণ করে দিল।
মুসলিম লীগ সরকার খুব নিখুঁত হিসাব কষেই এগোচ্ছিল। সেই সময় কলকাতার মোট জনসংখ্যা ছিল ২০ লক্ষ যার মধ্যে ১২.৮ লক্ষ হিন্দু এবং ৬.৬ লক্ষ মুসলমান। তাদের মধ্যে ৩.৩৮ লাখ (৩০%) অবাঙালী, বাংলার ভারতে থাকা বা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যাদের মতামত খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, যেহেতু তারা বহির্বঙ্গ থেকে আগত ভাবা হোত। অথচ কলকাতার হিন্দু বাঙালীদের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় তাদের অংশগ্রহণের অনুপাত ছিল বাঙালী ভদ্রলোকদের তুলনায় অনেক বেশি। যাই হোক, ১৭ই আগস্ট রাত্রির মধ্যে কম-বেশি ৭০০০ হিন্দু খুন হয়েছিল, যার ফলে বাকিরা পালাতে শুরু করে। দেখা গেছে, প্রতি ১০০ খুনে ৪০০০ হিন্দু প্রাণ ভয়ে পালাচ্ছিল।[56] সুতরাং ১৮-১৯ তারিখের মধ্যে আরও ৫০০০ মানে মোট ১২০০০ হিন্দুকে খুন করা গেলেই ৪,৮০,০০০ হিন্দুকে কলকাতা থেকে নিশ্চিহ্ন করা যেত। মানে ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপের আগেই কলকাতায় হিন্দুর সংখ্যা ৭.৮ লক্ষে নামিয়ে আনা যেত, যেটা মুসলিম জনসংখ্যার চেয়ে সামান্য বেশি। পরে তাদের মুছে ফেলা বা দমিয়ে রাখাটা কোনও ব্যাপারই ছিল না। সুরাবর্দির পরিকল্পনা ছিল কলকাতার আশপাশ থেকেও মুসলিম নিয়ে এসে হামলা চালানো, যাতে মৃত বা পলাতক হিন্দুদের জমি-বাড়ি সব কিছু মুসলিমদের দখলে চলে আসে।[56]

কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত প্রত্যাঘাতের ফলে মুসলিমদের মন থেকে হিন্দুদের দুর্বলতা নিয়ে আত্মতুষ্টি ঘুচে বরং ভীতির সঞ্চার হয়েছিল, যার ফলে সমগ্র বাংলাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার উৎসাহেও সাময়িক ভাঁটা পড়ে। তবে ঐতিহাসিক মার্গারেট বার্কহোয়াইটের মতে, কলকাতা গণহত্যা ছিল সারা ভারত জুড়ে দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়ার সূত্রপাত। কারণ পলাতক উদ্বাস্তুদের সঙ্গেই হত্যালীলার খবর ছড়িয়ে পড়ছিল। “Tousands began fleeting Calcutta. For days the bridge over the Hooghly River … was a one-way current of men, women, children, and domestic animals, headed towards the Howrah railroad station … But fast as the refugees fled, they could not keep ahead of the swiftly spreading tide of disaster. Calcutta was only the beginning of a chain reaction of riot, counter-riot, and reprisal which stormed through India.”[55]
বস্তুত কলকাতার আগুন নিভতে না নিভতেই শুরু হয়ে যায় নোয়াখালি গণহত্যার বিভীষিকা। কলকাতায় মুসলিম লীগের নিজেরদের দাঙ্গার অভিসন্ধি স্বীকার করেনি। তাদের যুক্তি ছিল কলকাতায় তারা সংখ্যালগু জেনেও কেন দাঙ্গার সূত্রপাৎ করবে। সেই বোধ তাদের কলকাতা দাঙ্গার আগে ছিল, নাকি পরে হল সেটা হিন্দু সংখ্যালঘু নোয়াখালিতে একতরফা গণহত্যার দিকে তাকালে বোঝা যায়।

অবশ্য বাঙালী বামমনস্ক বুদ্ধিজীবীরা যতদিন আছে, ততদিন মুসলিমদের কোনও অপকীর্তির ওপরই পর্দা কিংবা তার যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য অনুপম যুক্তির অভাব হবে না। ঐতিহাসিক জয়া চ্যাটার্জী যেমন নিজের ‘অসাম্প্রদায়িক’ অবস্থান থেকে গোপাল পাঁঠাকে গুণ্ডা হিসাবে ব্যাখ্যা করে সুরাবর্দির অপরাধ লঘু করতে চেয়েছেন, তেমনি ঐতিহাসিক মধুশ্রী মুখোপাধ্যায় ১৯৪৩-এ বাংলার ভয়াবহ সরকার সৃষ্ট মন্বন্তরের জন্য দায় সুরাবর্দির বদলে উইনস্টন চার্চিলের ওপর বর্তাতে চেয়েছেন, যে প্রসঙ্গে পরে আসছি। যেখানে মুসলিম আগ্রাসনে সর্বপ্রথম হিন্দু মেয়েদেরই প্রাণ ও মান নষ্ট হয়, সেখানে বর্ণহিন্দু বিদুষী নারীদের প্রতিবাদের বদলে ঘাতকদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের রুচি ও অনুপ্রেরণা আসে কোথা থেকে কে জানে? ঐতিহাসিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় মুসলিম লীগের প্রধান দায় স্বীকার করে অনেকটা নিরপেক্ষ ও অনুপুঙ্খ ছবি উঠে এলেও তিনিও আফসোস করেছেন, বাঙালী সেদিন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের ভুলে ভ্রাতৃ সংহারে মেতে উঠেছিল। পশ্চিম এশীয় বিজাতীয় ভাবধারায় জারিত ধর্ষক লুঠেরা ভগ্নীসঙ্গমী মাতৃসঙ্গমীদের ভাই ভাবার ভুলটাই বাঙালী জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি।

চলবে