বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

ভারত ভাগের সঙ্গে বাংলা ভাগ

সুরাবর্দি বাংলা ভাগের পক্ষপাতী ছিলেন না; কারণ তাহলে পাটকল সহ অধিকাংশ শিল্পাঞ্চল, কয়লা খনি, কলকাতার মতো বাণিজ্য কেন্দ্র ও ব্যস্ত জাহাজ বন্দর এগুলো সবই হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলায় থেকে যাবে, মুসলমান প্রধান পূর্ব বঙ্গ যেখানে কৃষি ছাড়া শিল্পোৎপাদন নগণ্য তার অর্থনীতি মার খাবে।[176][177] ২৪ এপ্রিল ১৯৪৭-এ দিল্লিতে একটা প্রেস কনফারেন্সও করেছিলেন two-nation-র বদলে দেশকে তিন টুকরো করে স্বাধীন বাংলা দেশে একাধিপতিত্ব করার বাসনায়।[176][177][178] কারণ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে বিহার ও উড়িষ্যা আলাদা হয়ে গেলে সমগ্র বাংলায় মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৫%)। রাজ্যের মুসলিম লীগ নেতারা দ্বিধান্বিত হলেও জিন্না যুক্তি মেনে নিমরাজি হয়ে কৌশলগত সমর্থন দিলেন, যদিও দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পুরো বাংলা ও পাঞ্জাবকে তো তিনি পাকিস্তানেই চেয়েছিলেন; বাংলা আলাদা হলে পাকিস্তানের ভাগ কমে যাবে। যাইহোক পাকিস্তানে না গেলেও ইসলামিক বসংবদ রাষ্ট্র তৈরি হবে বলে জিন্নার মত আদায় করে সুরাবর্দি দ্বিধান্বিত মুসলিম নেতাদের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হন।[179][180] যে মুসলিম লীগ ১৯০৬ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত বাংলার অখণ্ডতার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন, সেই লীগই মুসলমান আধিপত্যের গন্ধ পেয়ে ‘অখণ্ড বাংলা’র দাবিদার হয়ে উঠল।
সুরাবর্দির ইচ্ছা বা পরিকল্পনা নেহেরু প্যাটেল সহ অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা মানেননি। কিন্তু অখণ্ড বাংলার স্বপ্নে অথবা মন্ত্রিত্ব লাভের বাসনায় নেতাজীর দাদা শরৎ বসু সুরাবর্দির সঙ্গে চুক্তি পর্যন্ত করে ফেলেন।[181][182][183][184] একদিকে কংগ্রেস নেতারদের বাংলার অখণ্ডতার প্রতি উদাসীনতা, অন্যদিকে সুরাবর্দির মুসলিম ও অমুসলিমদের পৃথক ইলেকটোরেট বজায় রাখার অভিসন্ধিমূলক দাবি। ওদিকে চলছে মুসলিম লীগের লাগাতার দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচার। বাঙালী হিন্দুদের অবস্থা হল শাঁখের করাতের মতো। প্রমাদ গুণলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা। এইখানে শ্যামাপ্রসাদ যিনি অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন চূর্ণ করেছেন বলে আভিযোগ, তাঁর ভূমিকা ও অবস্থান সম্পর্কে কয়েকটা বিষয় পরিস্কার করা আবশ্যক।
মা যোগমায়া দেবী ও পিতা ‘বাংলার বাঘ’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পু্ত্র ‘ভারত কেশরী’ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।[185][186] ১৯১৪-য় ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে প্রেসিডেন্সি কলেজে (Presidency College.[8][9]) ভর্তি হন।[186][187] ১৯১৬-য় ইন্টার আর্টস্‌ পরীক্ষায় (Inter Arts Examination) সপ্তদশ স্থান অধিকার করে পাস[10][188] করার পর ১৯২১ সালে ইংরিজি নিয়ে স্নাতক হন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হন[5]।[185] ১৯২৩ সালে বাংলায় এমএ পরীক্ষা দিয়েও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন[12][189] ও একই বছর সেনেটের ফেলোশিপ পান[190] ১৯২৪ সালে আইন নিয়ে বি.এল (B.L.) পাস করে[5][185] কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। সেই বছরই আশুতোষ মুখার্জী মারা যান।[191] এরপর ১৯২৬ সালে বিলেত পাড়ি দিয়ে লিংকন ইন ( Lincoln’s Inn)-এ পড়া শুরু এবং একই বছর ইংলিশ বার (English Bar )-এ যোগ দেওয়ার আহ্বান লাভ।[192] দেশে ফিরে ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (Vice-Chancellor) পদ লাভ করেন এবং সর্বকনিষ্ঠ উপাচার্য হিসাবে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব সামলান।[193] তাঁর আমলেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রথম বাংলায় বক্তৃতা দেন এবং দেশীয় ভাষায় সর্বোচ্চ পড়াশুনোর সূচনা হয়[17][18]।[194][195] এরপর ১৯৩৮ সালে তিনি ডিলিট (D.Litt) উপাধি লাভ করেন[19]।[196][197] এত কথা বলতে হল, যেহেতু শুধু বাংলার টুকরো করা নয়, নিজে উপাচার্য হওয়ার সুযোগে ডিলিট বাগানোর মতো অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়া খুব ফাঁকতালে সেটা অর্জন করেছিলেন বলে মনে হয় না।

১৯২৯ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসাবে বাংলার আইনসভায় (Bengal Legislative Council) প্রবেশ দিয়ে রাজনৈতিক জীবনের শুরু[20]।[198] প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন চালু হলে ১৯৩৭ সালে নির্দল প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন জিতে কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ জোটকে সমর্থন জানালে উক্ত জোট ক্ষমতায় আসে[22][23][24]।[199][200][201] এরপর ১৯৩৯-এ যোগ দেন হিন্দু মহাসভায় এবং ক্রমে কার্যনির্বাহী সভাপতি (acting president) থেকে কার্যকরী সভাপতি (working president) হন।[202][203] ১৯৪১-এর ১২ ডিসেম্বর মুসলিম লীগের নেতারা মন্ত্রীত্ব থেকে ইস্তফা দিলে ‘কৃষক প্রজা পার্টি’-র এ. কে. ফজ়লুল হকের নেতৃত্বে জোট সরকারে শ্যামাপ্রসাদ ১৯৪১-৪২ সময়টুকুর জন্য বাংলার অর্থমন্ত্রী হন (Finance Minister)। এই সময়ই মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বিতর্কিত মন্তব্য, “মুসলিমরা পাকিস্তানে থাকতে চাইলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে যেখানে খুশি চলে যাক” [“pack their bag and baggage and leave India … (to) wherever they like”][30][204] তাঁর সরকার বিরোধী মন্তব্যের জন্য গতিবিধির ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপে। ১৯৪২-এ বন্যায় প্রভূত প্রাণহানি ও সম্পত্তি নষ্টের জন্য সরকারের কাছে কৈফিয়ত চাওয়ায় শ্যামাপ্রসাদকে মেদিনীপুরে যেতে বাধাও দেওয়া হয়।

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী গান্ধীজীর নেতৃত্বে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ (“Quit India”) সমর্থন না করে ব্রিটিশ সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে বাম-কংগ্রেস উভয় শিবির থেকে কটাক্ষ করা হয়। সেই সময় ‘হিন্দু মহাসভা’ ভারত ছাড়ো আন্দোলন বয়কট করেছিল।[205] শ্যামাপ্রসাদ রাজ্যপাল (Governor of Bengal) স্যর জন হার্বাট (Sir John Herbert)-কে চিঠি লেখেন: “Let me now refer to the situation that may be created in the province as a result of any widespread movement launched by the Congress. Anybody, who during the war, plans to stir up mass feeling, resulting internal disturbances or insecurity, must be resisted by any Government that may function for the time being.”[44][206]। অর্থাৎ যুদ্ধকালীন অস্থিরতায় দেশ বা রাজ্যের অভ্যন্তরে কোনওরকম গোলোযোগের অবকাশ যাতে না ঘটে, ইংরেজ সরকারকে সে ব্যাপারে সতর্ক ও সহযোগিতা দুটোই করেছিলেন। ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদারও বলেছেন, যুদ্ধকালে দেশের অভ্যন্তরে গোলমালের আশঙ্কা এড়াতেই শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভার নেতারা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’ও আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।[207][208][209][210] কিন্তু গোলমালের আশঙ্কা কেন করেছিলেন তাঁরা? কারণ আমাদের মহানুভব বাপু চেয়েছিলেন ইংরেজরা দেশটাকে কষাইদের হাতে তুলে দিক – অর্থাৎ সম্পূর্ণ ক্ষমতা মুসলিম লীগকে হাস্তান্তরিত করুক।[211] সত্যিই কি সমর্থন করার মতো ছিল সেই শর্তে ব্রিটিশদের চলে যাওয়া? কিন্তু ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ওপর ব্রিটিশ সরকারের দমনমূলক আচরণের প্রতিবাদে ২০ নভেম্ভর ১৯৪২-এ মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগও করেন। উপরন্তু মেদিনীপুরের বন্যা নিয়ে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হক সরকারের ইচ্ছাকৃত অবহেলা ও ত্রাণে বাধা দেওয়ার কারণেও ক্ষুব্ধ ছিলেন। মহাবোধি সোসাইটি, রামকৃষ্ণ মিশন ও মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটির সহযোগিতায় ত্রাণের ব্যবস্থা করেন[26][27][28]।[212][213][214]। মেদিনীপুরের বন্যাত্রাণে কিন্তু তাঁর সভায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদেরও উপস্থিতি ছিল। অতঃপর ১৯৪৩-এ ‘অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা’র সভাপতি মনোনীত হয়ে[215] ১৯৪৬ পর্যন্ত সেই পদে আসীন থাকেন:[216] ১৯৪৬-এ পুনরায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্দল প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন জেতেন[22] [217] এবং বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারে পুনরায় অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব পান। একই বছর সংবিধান সমিতির (Constituent Assembly of India ) সদস্যও হন[29]।[215]
প্রসঙ্গত কমিউনিস্ট পার্টিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কমিউনিস্ট রাশিয়া মিত্রশক্তির পাশে ছিল বলে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিপক্ষে ইংরেজ সরকারকে সমর্থন জানায়। অথচ ব্রিটিশের দালাল শুধু হিন্দুত্ববাদী শিবির ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীরা। একটা সত্য সব সময়ই প্রযোজ্য – দেশের সংকটের সময়ও বিভিন্ন দল পাস্পরিক প্রতিযোগিতায় মেতে প্রচার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, বা প্রার্থিত গুরুত্ব না পেলে নিজেদের প্রত্যাহার করে, পরাধীন ভারতেও করেছিল। সেই চেষ্টা যদি গেরুয়া শিবির করে থাকে, লাল শিবিরও কম করেনি। কিন্তু দেশের স্বাধীনতাকে মিথ্যে ‘আজ়াদী ঝুটা হেয়’ বলার ঔদ্ধত্য অবশ্য সবাই দেখাতে পারে না। বাম শিবিরের রাগ আসলে অখণ্ড ইসলামিক বাংলা তৈরির অধরা স্বপ্নে, যদিও তার যৌক্তিকতা দুর্বোধ্য।

১৯৪৬-এর পর দাঙ্গা আর পারস্পরিক অবিশ্বাসের মধ্যে কাটল দম বন্ধ করা দেড় বছর। পাঞ্জাব ও উত্তরপূর্ব সীমান্তে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে লাগাতার দাঙ্গা চলেছে। কলকাতা গণহত্যা ও নোয়াখালি হিন্দু নির্মূলীকরণের প্রতিক্রিয়ায় বিহারের মুঙ্গেরে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ, রাওয়ালপিণ্ডিতে হিন্দু হত্যা, গড়মুক্তেশ্বরে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের অসহিষ্ণুতা – এইসব বড় দাঙ্গাগুলো ছাড়াও দেশজুড়ে প্রতিদিনই হানাহানির নরককুণ্ড! ওদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করে ব্রিটেনের Labour Party-র সরকারও বিধ্বস্ত। উপনিবেশগুলো বিশেষত ভারতের দায় তারা ঝেড়ে ফেলতে চায়। নাও বাপু স্বাধীনতা। তৎকালীন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটন ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য ছ মাসের সময় সীমা দিলেন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে কংগ্রেসের তরফে জওহরলাল নেহেরু ও আবুল কালাম আজ়াদ, মুসলিম লীগের তরফে মহম্মদ আলি জিন্না, অস্পৃশ্যতা বিরোধী নেতা বি. আর. আম্বেদকর এবং আকালি দলের শিখ নেতা মাস্টার তারা সিং “Mountbatten Plan” মেনে দেশভাগে মত দিলেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রথম দেশভাগের প্রস্তাব মেনে নেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল।[218][219][220][221] পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের জন্য ৫ সদস্যের দুটি পৃথক কমিশন গঠিত হয়। দু ক্ষেত্রেই র‍্যাডক্লিফ (Sir Cyril Radcliffe) সাহেব এবং দুজন কংগ্রেস ও দুজন মুসলিম লীগ সদস্যকে নিয়ে সীমা কমিশন গঠিত হয়েছিল।[222][223] জিন্না ছাড়া বাকিদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল দাঙ্গা থামানো, যদিও গদির লোভও যে ছিল না, তা নয়।

জিন্নার পাকিস্থান দাবিতে সকলেই যখন নতি স্বীকার করে নিয়েছিল, যেই সময় ১৯৪১ সালে গান্ধীজী পরামর্শ দিয়েছিলেন বাংলার জনগণ যাতে জনগনণায় অংশ গ্রহণ না করেন। অথচ মুসলিম লীগের নির্দেশ ছিল যাতে বাংলার প্রতিটি মুসলিম নাগরিক জনগনণায় অংশ নেয়। তারই মধ্যে কলকাতা গণহত্যার নায়ক সুরাবর্দি এবং শরৎ চন্দ্র বসু জোট বেঁধেছেন ভারতকে তিন টুকরো করে অখণ্ড বাংলা গড়ার লক্ষে। বিপদের আঁচ পেয়ে শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলার নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। বাংলার শিল্পসমৃদ্ধ পশ্চিমাংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ পেয়ে সারা বাংলায় মুসলিম শাসন কায়েম করা ছাড়া বাংলার অখণ্ডতা চাওয়ার আর কোনও কারণ যে লীগের থাকতে পারে না, তা পরিষ্কার। “They also opined that even though the plan asked for a sovereign Bengal state, in practice it will be a virtual Pakistan and the Hindu minority will be at the mercy of the Muslim majority forever”। লীগের শাসনে বাংলা মানে তা আদতে আর একটি পাকিস্তান, যেখানে সংখ্যালঘু হিন্দু বাঙালীদের মুসলমান ভ্রাতাদের দয়ার মুখাপেক্ষী করে রাখা, যে দয়ার নিদর্শন কিছুদিন আগে কলকাতা ও নোয়াখালি বা অন্যত্রও পাওয়া গেছে।
কিন্তু সব বুঝেও গদির লোভে সকলের মুখে তালা। জনগণনায় শ্যামাপ্রসাদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হল – বাংলায় মুসলিমরাই সংখ্যাগুরু, ৫৮% । ফলে বাংলার বিভাজন নিয়ে আগুন আরও তীব্র হয়ে উঠলো। কিন্তু ডাঃ মুখার্জী অনড়। বাংলার সমস্ত জেলা ভিত্তিক পরিসংখ্যান দেখিয়ে প্রশ্ন তুলললেন, ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পাকিস্তানে গেলে বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও পাকিস্তানে যাবে কেন? লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে (Lord Mountbatten) তিনি চিঠি লিখে বোঝান, বাংলার বিভাজন কতটা জরুরি এবং হিন্দু বাঙালীদের নিজস্ব বাসভূমি পশ্চিম বাংলাকে ভারতে রাখা কেন দরকার। তাঁর যুক্তিকে ইংরেজ সরকারও অস্বীকার করিতে পারেনি। বস্তুত লর্ড মাউন্টব্যাটন নিজেই মোহনদাস গান্ধীকে জিন্না সুরাবর্দিদের সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন।

১৯৪৭-এর ১৫ এপ্রিল তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত “Bengal Partition Convension”-এ হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে শ্যামাপ্রসাদ ভারত ভাগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাগেরও দাবি করলেন। হিন্দুত্ব ও সাম্প্রদায়িকতাকে এক করে যারা দেখতে চায়, তারা মুসলিম লীগের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর জোট বাঁধা নিয়ে কটাক্ষ করে, কিন্তু লীগের করাল রূপে বীতশ্রদ্ধ হয়েই যে ক্ষমতার লোভ ত্যাগ করে ডাঃ মুখার্জী তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলা ভাগ দাবি করেছিলেন, সেই সহজ কথাটা সেইসব সমালোচকদের বোধগম্য হয় না। অবশ্য ভাগাভাগির পরেও যে হিন্দু বাঙালীর সংকট কাটেনি – সেটা অন্য বিষয়। কিন্তু ইতিহাসের পরিহাসে যে হিন্দু বাঙালীরা ১৯০৫-১১ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, ১৯৪৭-এ তাদের প্রাণ বাঁচাতেই বাংলার অঙ্গচ্ছেদ করতে হল।

শ্যামাপ্রসাদকে সমর্থন করেন দামোদর সাভারকার সহ আরও অনেকে। গান্ধী ও নেহেরুকে শ্যামাপ্রসাদ বোঝালেন এই ভাগ কেন জরুরি। গান্ধীজী হিন্দু বাঙালীর জন্য ভাবতে কতটা রাজি হতেন বলা যায় না, তবে স্বয়ং মাউন্টব্যাটনও ’৪৬-এর কলকাতা হত্যাকাণ্ডে সচকিত হয়ে গান্ধীজীকে সতর্ক করেছিলেন। কলিন্স অ্যান্ড লাপিয়ের তাঁর “Mountbatten and the Partition of India” গ্রন্থে লিখেছেন লর্ড মাউন্টব্যাটন গান্ধীজীকে স্মরণ করিয়ে বলেছিলেন, “আপনি ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্টের কথা ভুলে যাবেন না। ঐদিন শুধুমাত্র মহড়া হিসাবে জিন্নাহ্‌ কলকাতায় পাঁচ হাজার মানুষ খুন করিয়েছিলেন।”

অতঃপর ১৯৪৭-এর ২০ জুন বাংলার আইনসভা (Bengal Legislative Assembly) বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ভাগ্য নির্ধারণের বৈঠকে বসল – অবিভক্ত বাংলা ভারতে থাকবে না পাকিস্তানে যাবে, নাকি পূর্ব পশ্চিমে বিভক্ত হয়ে গিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাঁটোয়ারা হবে। সমগ্র বাংলায় তখন যা মুসলিম আধিক্য ও সরকারে তাদের প্তিনিধিত্ব, তাতে প্রাথমিক ভোটাভুটিতে ১২০টি ভোট পড়ল অবিভক্ত বাংলাকে পাকিস্তানে (Constituent Assembly of Pakistan) নিয়ে যাওয়ার পক্ষে। পরে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি পৃথক একটি বৈঠকের নির্বাচনে ৫৮টি ভোট পড়ে বাংলা ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গকে ভারতে (Constituent Assembly of India) রাখার পক্ষে ও ২১টি পড়ে বিপক্ষে। ওদিকে পূর্ববঙ্গে অন্য একটি বৈঠকে ১০৬ বনাম ৩৫ ভোটের রায় বাংলা ভাগের বিপক্ষে রায় দেয় যার মধ্যে। সেই বৈঠকেই আরেকটি মতগ্রহণে ভাগাভাগি হলে পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে ১০৭টি ও বিপক্ষে পড়ে মাত্র ৩৫টি ভোট। [224][1] পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্ধারিত সেই ৫৮ বনাম ২১ ভোটের জয়ই পশ্চিমবঙ্গকে হিন্দু বাঙালীর নিজস্ব বাসভূমি হিসাবে ভারতে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। সেই ভোটে পক্ষে মতদানকারীর মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম দাবিদার জ্যোতি বসুও ছিলেন, কারণ তিনি জানতেন ইসলামিক পাকিস্তানে তাঁর রাজনৈতিক তরী বাসাস পাবে না। অথচ এখনও পর্যন্ত কমরেডদের বাংলাভাগ নিয়ে কান্নাকটি ও শ্যামাপ্রসাদকে দোষারোপ বন্ধ হল না। তবে এই ভাগ বাঁটোয়ারায় ভূমি বণ্টন সবটুকু যুক্তিপূর্ণভাবে হয়নি। ৬ জুলাই শিলেটকে আসাম থেকে কেটে বাংলাদেশে জোড়া হল। আবার যশোর খুলনা হিন্দুপ্রধান ও‌ওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রে চলে গেল পাকিস্তানের থাবায়।

আমাদের ইতিহাস বইতে এসব থাকে না। কোন সর্বনাশ এড়াতে বাংলা ভাগ তার উল্লেখমাত্র না করে শুধু হিন্দু-মুসলিম কাল্পনিক মৈত্রীর গল্প শুনিয়ে কাঁটাতার নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু অপনোদন দ্বারা অখণ্ড বাংলার জন্য হাহুতাশ করতে শেখানো হয়। অশোক মিত্রের মতো কিছু বাঙালী কমিউনিস্ট নেতার এবং আরও অনেকেরই তো আফসোসের সীমা নেই। শ্যামাপ্রসাদের সিদ্ধান্তে কংগ্রেসের রাজি হওয়া নিয়ে বিস্তর বক্রোক্তি করেছেন অশোকবাবু, “পশ্চিমবাংলাবাসীর জন্য কত দরদ, পূর্বদিকের জেলাগুলোর মানুষের যা খুশি হোক”। অবশ্য অশোকবাবুদের বাংলা দরদের মান রেখে সুরাবর্দির উত্তরসূরীরা বাংলাভাগের প্রতিশোধটাও নিলেন জমিয়ে। হিন্দু বাঙলিরা মুসলমানদের অধীনে ও দয়ায় বেঁচে থাকতে যখন রাজি নয়, তখন মরেই যাক। তাই বাংলা ভাগ করেও হিন্দু মৃগয়া আটকানো যায়নি। খুন, ধর্ষণ, জোর করে ধর্মান্তকরণ ও উচ্ছেদের ধারাবাহিকতায় পূর্ববঙ্গে ১৯০১ সালে যেখানে হিন্দু ছিল ৩৩%, বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহারের পর ১৯১১-য় হল ৩১.৫%, ১৯২১ সালে ৩০.৬%, ১৯৩১-এ ২৯.৪%, ১৯৪১-এ ২৮%, স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর ১৯৫১-তে ২২.৫%, ১৯৬১-তে ১৮.৫%, মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে (’৭১-এ জনগণনা হয়নি) ১৩.৫%, ১৯৮১ সালে ১২.১৩%, ১৯৯১ সালে ১০.৫১%, ২০০১ সালে ৯.২%, আর ২০১১-তে দাঁড়িয়েছে ৮.৯৬%। দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের স্বাধিনতার অব্যবহিত পরে হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাসের হার সবচেয়ে বেশি ২৮% থেকে ২২.৫% এববং ১৮.৫% থেকে ১৩.৫%। মুসলিমদের জন্মহার বেশি আর হিন্দুদের মৃত্যুহার – হিসাবটা খুব সোজা। এমনকি রাজাকার বিরোধী ‘শাহবাগ’ অভ্যুত্থানেও উদারপন্থীদের সঙ্গে মৌলবাদীদের বিবাদের জেরে হিন্দু মেয়েদের অবাধে ধর্ষণ অপহরণ হয়েছে ও হয়ে চলেছে। গড়পড়তা এই হার বজায় থাকলেও ২০১৩-এর মধ্যে বাংলাদেশে হিন্দু বাঙালীর সংখ্যা ৫%-এ নেমে যাবে। তবে ১৯১১-র পর হিন্দু নির্মূলীকরণ অভিযান যে হারে গতি পেয়েছে এবং পশ্চিমবাংলার হিন্দুদের আত্মহননের আগ্রহ যে হারে বেড়েছে, তাতে হিন্দু হ্রাসের হার দ্রুততর হওয়ারই সম্ভাবনা। ’৪৭-এর অখণ্ড বাংলার ৪৫% হিন্দু জনসংখ্যা একই হারে ২০১৪-য় ১২-১৩%-এ নেমে গেলে হয়ত অসুবিধা ছিল না।

আমাদের ইতিহাসের পাঠ্য-পুস্তকে এই অন্ধকার দিকগুলো আড়াল করে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও প্রথম (১৯০৫-১১) বঙ্গভঙ্গ রদে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত অবদানের কল্পকাহিনী শেখানো হয়। কংগ্রেস, বামপন্থী বা স্বঘোষিত সেকুলার রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো কেন বাংলা ভাগ হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ কী ভাবে, কার প্রচেষ্টায় ভারতে থেকে গেল সেই ইতিহাস সামনে আসতেই দেয়নি। সুমিত সরকার, রোমিলা থাপার, জয়া চ্যাটার্জি প্রমুখের মতো ঐতিহাসিকরা এসব ঘুণাক্ষরে উল্লেখ করেননি, বা করলেও বিকৃত ব্যাখ্যা করেছেন। হিন্দু মহাসভার নেতারা কিন্তু তখন বিপর্যয়ে রাজনৈতিক শিবির দেখেন নি, বাঙালীর সার্বিক স্বার্থরক্ষার জন্য কখনও কংগ্রেস কখনও বা বামপন্থী নেতৃত্বকেও সমর্থন দিয়েছে যার এধাধিক নিদর্শন প্রশঙ্গক্রমে আসবে। দেখলে শ্যামাপ্রসাদবাবু নিজেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য প্রার্থী হতেন, আর রক্তাক্ত সময়ে জনসমর্থন পেতে খুব অসুবিধা হোত না। কিন্তু তিনি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী যখন যুগপৎ শরফণাথী পুনর্বাসনে ও কেন্দ্রীয় উদাসীনতায় নাজেহাল, তখন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের তোলা বাংলার ন্যায্য দাবি-দাওয়া সংসদে জোরালোভাবে পেশ করে যথাসম্ভব আদায় করে আনতেন।
অথচ আমাদের বুদ্ধিজীবী মহলে অন্তর্ভুক্তির অন্যতম শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশভাগের দায় গান্ধী-নেহেরুর ওপর এবং বাংলাভাগের তথা প্রকারান্তরে দেশভাগের দায় শ্যামাপ্রসাদের ওপর চাপিয়ে জিন্নাকে দেবদূত বানানো। আমরা ভুক্তভুগীরা যা উপলব্ধি করতে পারিনি (আসলে চাইনি), সে কথা মাউন্টব্যাটেনের মুখ্য সচিব লর্ড ইজ়মে (Lord Ismay) লিখে গেছেন, “The dominating feature in Mr. Jinnah’s mental structure was his loathing contempt of Hindus. He apparently thought that all the Hindus were sub human creatures with whom it was impossible for Muslims to live.”। ভদ্রলোকের একটু ভুল হয়ে গেছে; হিন্দুদের সঙ্গে সহবাস অসম্ভব মনে হলেও হিন্দু মেয়েদের যৌনসঙ্গ পেতে মুসলিমদের ভালোই লাগে – সে বাঙালীই হোক বা অবাঙালী।

চলবে