বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

অষ্টম পর্বের পর

দেশভাগের অর্থনীতি ও পরিষেবাগত প্রভাব

র‍্যাডক্লিফ লাইন বাংলায় একটা অবিমিশ্র অর্থনৈতিক অঞ্চলকে দু’ টুকরো করে দিল, যে দুটো টুকরো একে অপরের পরিপূরক ছিল। উর্বর আবাদি জমির সিংহ ভাগ চলে গেল পূর্ববঙ্গে যা ধান ছাড়াও পাট ও অন্যান্য কাঁচামাল উৎপাদন করত। সেই মাল পশ্চিমাংশ ব্যবহার করে শিল্পদ্রব্য সরবরাহ করত পূর্বাঞ্চলে। ভূমি বাঁটোয়ারার পর পশ্চিমবঙ্গে দেখা দিল খাদ্যশষ্য ঘাটতি। এই ঘাটতি চলেছিল ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত এক দশক ধরে। ১৯৫৯-এ বার্ষিক খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯,৫০,০০০ টন। ‘মা ফ্যান দাও!’…. কলকাতার রাস্তা বেয়ে চলত বু্ভুক্ষুর মিছিল, যা ছড়িয়ে গিয়েছিল মফস্বলেও। রেশন চালু করেও কান্না থামানো যায়নি।
আবার পশ্চিম দিকে পাটকল, পূর্ব দিকে ৪/৫ অংশ পাট চাষের জমি। পাকিস্তান পূর্ব দিকে পাটকল স্থাপন করে ভারতে পাট রপ্তানি করা বন্ধ করে দিল। পশ্চিমবঙ্গে পাট রপ্তানি করা মানে দেশদ্রোহিতা। পশ্চিমবঙ্গের পাটকল ও শ্রমিকরা তো সংকটে পড়লই, পূর্ববঙ্গেও উৎপন্ন পাটের বাজার বন্ধ হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চাশের দশক থেকে পাট ঊৎপাদন বাড়িয়ে কলগুলো ফের সচল করে তুলল। ১৯৬১-তে ৯,১৭,০০০ হেক্টর জমিতে ১১,৪৪,৪০০ মেট্রিকটন পাট উৎপাদন করা গিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে অবশ্য এর চেয়ে কম জমিতে (৮,৩৪,০০০ হেঃ) উন্নততর মানের আরও বেশি পাট উৎপন্ন হয়েছিল (১৩,১৪,৫৪০ মেঃ টন)। পশ্চিমবঙ্গে পাট শিল্প যদিও বা সাময়িক সংকট কাটিয়ে উঠল, পূর্ববঙ্গ থেকে আমদানি করা চামড়া ও বাঁশের অভাবে চর্মশিল্প ও কাগজের কলগুলো পড়ল বিপদে।
তীব্র খাদ্য সংকট ও উদ্বাস্তু সমস্যায় এই বাংলা যখন বিধ্বস্ত, তখন ডঃ বিধান চন্দ্র রায় জওহরলাল নেহেরুর সহযোগিতায় একাধিক বহুমুখী প্রকল্পের সুবিধা পশ্চিমবঙ্গে আনলেন। DVC, ময়ূরাক্ষী প্রকল্প, দুর্গাপুর শিল্পনগরী স্থাপন, সল্টলেক নগরী, কল্যাণী। কিন্তু বৃটিশ ভারতে শিল্পে দেশের প্রথম স্থানাধিকারী রাজ্য পরবর্তী তিন দশকে রাজনৈতিক অস্থিরতায়, অনুপ্রবেশে, সংঘর্ষে, বন্‌ধ্ সংস্কৃতির জেরে ক্রমশ অন্যান্য রাজ্যগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়তে লাগল, যে নিম্নগতি আজও অব্যাহত। অবনতির কারণ হিসাবে কয়লার মাসুল সমীকরণ নিয়েও রাজনৈতিক চাপান-উতোর আছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের ধার্য করা কিছু কর কেন্দ্র সরকারের হস্তক্ষেপে কমে যাওয়ায়, শরণার্থী ও অনুপ্রবেশ বিধ্বস্ত রাজ্যটির অর্থনীতি আরও বিপন্ন হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে জেলা সদর হওয়া ছাড়া ঢাকায় কোনও গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি দ্প্তরেও আসীন ছিল অধিকাংশ ইংরিজি শিক্ষিত হিন্দু বাঙালী। তারা এপারে চলে আসাতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা প্রশাসনিক দপ্তরগুলো কব্জা করে বসল। সেই জোরে বাঙালীদের ওপর চাপিয়ে দিল উর্দু শিক্ষার বাধ্যবাধকতা। ওপারের বাঙালী দেখল, তারা আদৌ স্বাধীন হয়নি। ফলে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠল যার ফলশ্রুতি প্রথমে মাতৃভাষার দাবিতে লড়া ও পরে আর এক প্রস্থ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। পূর্ববঙ্গকে সাহায্যের জন্য তাকাতে হল সেই ভারতের দিকে, যাকে রক্তাক্ত করে কয়েক দশক আগে সে বেরিয়ে এসেছিল এবং ক্রমাগত হিন্দু খেদিয়ে, অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, বাণিজ্য সম্পর্ক ত্যাগ করে তখনও যত ভাবে পারা যায়, তার ওপর অশান্তি বর্ষণ করে চলেছে। প্রসঙ্গত পাকিস্তানের মতো উন্নয়নকে গৌণ করে ধর্মীয় ভাবাবেগকে একমাত্র রাজনৈতিক পুঁজি করার মানসিকতা অন্তত তখনকার কিছু ভারতীয় দেশনেতার ছিল না। তাই সংকটকে সংকট হিসাবেই দেখা হয়েছে এবং তাই নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে বারবার বিতণ্ডায় জড়িয়েছে।

শুধু তো অর্থনীতি নয়, পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান হয়ে যাওয়ায়, রেল ও সড়ক পথ বিপর্যস্ত হয়ে সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত কেন্দ্রীয় ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে সংযোগচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কলকাতা-শিলিগুড়ি, আসাম-চট্টগ্রাম রেল পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। আসাম তো ভারতীয় রেলসংযোগ ব্যবস্থার বাইরেই চলে গেল। চা, কাঠ সহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহন বন্ধ। আসামের চা শিল্পে ব্যবহৃত হোত চট্টগ্রামের কয়লা। পাকিস্তান পণ্য পরিবহনের জন্য ভারতের কাছে চড়া মাসুল ধার্য করল। ১৯৫০-এর মধ্যে যদিও বা শিলিগুড়ির মাধ্যমে আসামকে রেলপথে জুড়ে দেওয়া গেল, কিন্তু রপ্তানির জন্য কলকাতা বন্দরে চা পৌঁছানো যথেষ্ট ব্যয়-সাপেক্ষ হয়ে উঠল। চট্টগ্রাম বন্দর বিকল্প হিসাবে কিছুদিন ব্যবহৃত হলেও ১৯৬৫-র যুদ্ধের পর সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ-এ রূপান্তরিত হয়, কিন্তু ‘কৃতজ্ঞ’ বাংলাদেশ ২০০৩-এর আগে পর্যন্ত তার ভূখণ্ডে ভারতের কোনও রেলপথ মঞ্জুর করেনি, বরং স্বাধীনতা পেয়েই আসামকেও ভারতের কাছে দাবি করেছিল।

আজকের তারিখেও ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর, আসামের যোগাযোগ যথেষ্ট অসুবিধা ও ব্যয়সাপেক্ষ রয়ে গেছে। যে দেশটাকে আমরা স্বাধীন করলাম, রেলপথ নির্মাণের অনুমতির জন্য আজও আমরা তার অনুমতি ও অনুকম্পার মুখাপেক্ষী। ’৪৭-এর পর উত্তর-পূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর বাড়-বাড়ন্তের পেছনে এই আহত পঙ্গুকৃত যোগাযোগ ব্যবস্থাও কম দায়ী নয়।

তার মধ্যে ভারতের ভাগে পড়া পশ্চিম বাংলার প্রতি কেন্দ্র সরকারের অবজ্ঞাও কম ছিল না। যে রাজ্যটির ভাগাভাগিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তার ওপরেই যেন সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষ। জানি না, পুরো বাংলার দায়িত্বটাই ভারতের ঘাড় থেকে নেমে গেলে ভালো হোত, নয়া দিল্লির এমন মনোভাব ছিল কিনা। কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে শুধু একদা বামপন্থী বা অধুনা তৃণমূল কংগ্রেস নয়, সোচ্চার হয়েছিলেন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ও, যার ফলে নেহেরুর সাথে তাঁর প্রবল বাদানুবাদও হয়। পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু উদ্বাস্তুর পুনর্বাসনে যখন পশ্চিমবঙ্গ নাজেহাল, তখন তিনি নেহেরুকে একটি চিঠি লেখেন: “হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রায় ১৫ লক্ষ (প্রথম ধাক্কায়) মানুষ সব হারিয়ে পূর্বপাকিস্তান থেকে এ রাজ্যে চলে এসেছেন। তারা এ রাজ্যে জীবিকার্জনের আশা হারিয়েছেন। মাসের পর মাস কেন্দ্রীয় সরকার এ রাজ্যে উদ্বাস্তু সমস্যার কোন অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায়নি এবং তাদের দায়িত্ব বহন করেনি।” আরও লেখেন “আপনি কি জানেন না যে, আপনার সরকারের কাছ থেকে ১৯৪৮-৪৯-৫০ ঐ দুই বছরে পশ্চিমবঙ্গ মোট অনুদান হিসাবে পেয়েছে ৩ লক্ষ টাকার সামান্য বেশি এবং পারস্য ৫ কোটি টাকার সবটাই ঋণ হিসাবে? আপনি কি জানেন যে, এই অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য যে অর্থ ব্যায় হচ্ছে তার তুলনায় নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর? ঐ পর্যন্ত যে অনুদান দেওয়া হয়েছে তা ২৬ লক্ষ উদ্বাস্তুর পক্ষে যৎসামান্য, কেননা ঐ অনুদান ২ বছরে দাঁড়ায় মাথা পিছু ২০ টাকা।…” তাঁর প্রশ্ন ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের হিন্দুদের প্রতি কেন্দ্র সরকার যেখানে অত উদার, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের ব্যাপারে কেন এত কৃপণ।

দীর্ঘ চিঠিতে ডাঃ রায় এও অভিযোগ করেন: “কেন্দ্র সরকারের আয়কর বিভাগ পাটের উপর কর বাবদ পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য অর্থ কমিয়ে সে টাকা অন্য রাজ্যের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনা করে পাট ও করের উদ্বৃত্ত সব টাকাটাই কেন্দ্র সরকার নিজে আত্মসাৎ করছে। পশ্চিমবঙ্গকে আগে না জানিয়ে হটাৎ ১৯৪৮-এর মার্চ মাসে জানানো হলো যে এ রাজ্যে আয়করের অংশ ২০% থেকে কমিয়ে ১২% করা হয়েছে, যার অর্থ পশ্চিমবঙ্গ বছরে ৬ কোটির জায়গায় ৩.৫ কোটি টাকা পাবে। বাকি ২.৫ কোটি ভাগ করা হবে অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে। ২ কোটি ২০ লক্ষ জনসংখ্যা নিয়ে বোম্বাইয়ের আয়করের ভাগ ২০% থেকে বেড়ে ২১% হয়েছে। আর তার চেয়ে কিছু বেশি জনসংখ্যা নিয়ে বাংলার ভাগ ২০% থেকে ১২%-এ নেমেছে। অথচ দুটি রাজ্য আয়কর তহবিলে প্রায় একই হারে টাকা জমা দেয়। কোন যুক্তিতে ও ন্যায়বিচারের নীতি অনুসারে ঐ নতুন বন্টন ব্যবস্থা চালু হয়েছে তা জানিনা। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক অবস্থা পঙ্গু হয়ে পড়েছে। আমি এই সংকীর্নতাবাদ পছন্দ করিনা, কিন্তু ঘটনাচক্রে আমি এই সব কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি।” পরিশেষে ছিল একটি সতর্কবাণী: “সময়ে ব্যবস্থা নিলে যাও বা অশান্তি, এখনও ঠেকানো যেতে পারে।”

সেই সময় রাজ্যের এই দাবিদাওয়া নিয়ে কংগ্রেসের ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ও হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একযোগে কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করতেন। রাজ্যের স্বার্থে ডাঃ রায়ের দাবি-দাওয়াকে সাংসদ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সংসদে জোরালোভাবে তুলে ধরতেন। এই দুজনের যৌথ নাছোড় প্রচেষ্টাতেই হিন্দু বাঙালীর জন্য গঠিত পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি পূর্ব পাকিস্তানের শত্রুতার পাশাপাশি ভারতমাতার বৈমাত্রেয় মনোভাবের সঙ্গেও দিয়ে যুঝে গিয়েছিল।
যাদের আত্মবলিদানে স্বাধীনতা, স্বাধীনতার বিনিময়ে তাদেরই পুনরায় রক্তাক্ত করা, আবার স্বাধীন দেশেও তারাই সর্বাধিক বঞ্চনার শিকার। ভারতীয় বাঙালীর মনে কিছু অভিমান জমে থাকা তো অস্বাভাবিক নয়।
নয়া বাঙালী জাতিসত্তা: সুহ্‌রাবর্দি বনাম নাজ়িমুদ্দিন
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী জাতিসত্তার কাঠামোটা মূলত কলকাতা দাঙ্গার পরিকল্পক ও পরিচালক হুসেন শাহিদ সুহ্‌রাবর্দির তৈরি। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ইতিবৃত্ত খতিয়ে দেখলে বাঙালী দরদের আসল চেহারাটা ফুটে উঠবে। সুরাবর্দির সঙ্গে আর এক মৌলবাদী নেতা খাজা নাজ়িমুদ্দিনের রাজনৈতিক অবস্থানের পার্থক্য এবং ক্ষমতা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বীতা বাংলার অন্যতম নিয়তি নির্ধারক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মেদিনীপুর জেলার সম্পন্ন ও সুশিক্ষিত মুসলিম পরিবারে জন্মান হুসেন শাহিদ সুহ্‌রাবর্দি। বাবা প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী স্যর জ়াহিদ সুহ্‌রাবর্দি ছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের একজন জুরি সদস্য। মা ছিলেন ভারতের প্রথম সিনিয়ার কেম্ব্রিজ পাস করা মহিলা। দাদা মশাই আদেইদুল্লাহ্ সুহ্‌রাবর্দি বিখ্যাত উর্দু লেখক। ভাই হাসান সুহ্‌রাবর্দি পরে পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকে অন্যতম আমলা হয়েছিলেন।
কলকাতা হাই মাদ্রাসা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ১৯০৬ সালে সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজে (St. Xavier’s College) ভর্তি হন। ১৯১১ সালে অংক নিয়ে বিএসসি পাস করেন[2][3]0[18]। ১৯১৩ সালে আরবি ভাষা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। তারপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে অক্সফোর্ড (Oxford)-এ পড়তে যান। স্বচ্ছল ঘরের ছেলে হওয়ার সুবাদে ইংল্যান্ডে থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট ক্যাথরিন কলেজে (St. Catherine’s College) পড়ার সুযোগ পান এবং একই সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ও আইনে বিসিএল (BCL) ডিগ্রী লাভ করেন[19][20]। অক্সফোর্ড থেকে পাস করে কিছুদিন গ্রেট ব্রিটেইনের গ্রে’স ইন (Gray’s Inn) সংস্থার বারে যোগ দিয়ে ব্যারিস্টার-ইন-ল (barrister-at-Law)-র শিক্ষানবিশী লাভ করেন[2]।
ভারতে ফিরে ১৯২১ সালে মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে তাদের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে জিতে বাংলার মন্ত্রীসভায় (Bengal Legislative Assembly) প্রবেশের সুযোগ পান। শিক্ষাগত উচ্চতা যাই থাকুক, ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের টানে সুহ্‌রাবর্দি ভারতের বৃহত্তর মুসলিম সমাজের প্রতিবেশে মৌলবাদী খিলাফৎ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন[13]। অবশ্য ১৯২৪-২৫ নাগাদ মেয়র চিত্তরঞ্জন দাশের অধীনে কলকাতার ডেপুটি মেয়র পদের লোভে ‘স্বরাজ পার্টি’তে যোগ দেন[13]। কিন্তু ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর ১৯২৬ সাল থেকে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে স্বরাজ পার্টির সঙ্গে সুরাবর্দির বিচ্ছেদ ঘটে। কলকাতা হাই কোর্টে তিনি মুসলিম অভিযুক্তদের হয়ে সওয়াল করেন এবং কংগ্রেসকে চাপে রাখতে শিল্প ধর্মঘট করান। অর্থাৎ কলকাতা গণহত্যার আগে থাকতেই দাঙ্গা বাধানোয় হাত পাকিয়ে রেখেছিলেন। তারপর ১৯৩০-এ মুসলিম লীগে ফিরে ‘মুসলিম একতা’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন এবং যত্নসহকারে ‘দ্বি-জাতিতত্ত্ব’ ও পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার শুরু করেন।

১৯৩৪ সালের সাধারণ নির্বাচন জেতার পর মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব নেন নিজেকে পাকিস্তানের যৌথ পত্তনকারী হিসাবে তুলে ধরার অভিলাষে। পুরস্কার স্বরূপ ১৯৩৬-এ মুসলিম লীগের বাংলা বিভাগের (Bengal chapter) সেক্রেটারি জেনারেল (Secretary-General) মনোনীত হন। ১৯৩৭-এর সাধারণ নির্বাচনে বাংলার লীগ শাসিত সরকারে যোগ দেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার প্রধান (Premier) শের-এ-বাংলা আব্দুল কাশিম ফজ়লুল হকের প্রাদেশিক শাসনে বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রকের (Ministry of Commerce and Labour) দায়িত্ব সামলান16[12]।

১৯৪৫ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী বা আজকের নিরীখে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন খাজা নাজ়িমুদ্দিন। ১৮৯৪-এর ১৯ জুলাই মাসে ঢাকার এক সম্ভ্রান্ত নবাব পরিবারে জন্ম তাঁর। মা বিলকিস বানো ও মাতামহ খাজা আহসানুল্লার যথেষ্ট পরিচিতি ছিল। নাজ়িমুদ্দিনের ভাই শাহাবুদ্দিনও বাংলা ও ভারতের রাজনীতে যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্মদাতা খাজা সেলিমুল্লাহর বংশের সঙ্গে আত্মীয়তা ছিল। কাশ্মীরি উত্তরাধিকার (সম্ভবত মায়ের তরফে) সূত্রে বাংলার সঙ্গে উর্দুতেও অভ্যস্থ ছিলে এই পরিবার। ইংলন্ডের ডানস্টেবল গ্রামার স্কুল (Dunstable Grammar School)-এ কিছুদিন পড়ার পর ভারতে এসে ম্যাট্রিকুলেশন দেন। তারপর উত্তরপ্রদেশের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমএও কলেজে (MAO College) ভর্তি হন এবং আলিগড় থেকে সমাজতত্ত্বে বিএ পা করে পুনরায় বিদেশে পড়তে চলে যান। ভালো টেনিস খেলোয়াড় হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যথেষ্ট পরিচিতি জন্মেছিল সেই সময়। ইংলন্ডে গিয়ে কেম্ব্রিজ বিশ্বিদ্যালয়ের (Cambridge University) ট্রিনিটি কলেজ (Trinity College) থেকে পড়ে ব্যারিস্টার ডিগ্রী (Barrister-at-Law) লাভ করে দেশে ফেরেন। ১৮৪৭-৪৯-এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহম্মদ হাসানের কাছে আইনে ডক্টরেট ( Doctor of Laws) লাভ করেন। [Main article: Prime Minister of Bengal]
ইংলন্ড থেকে ফিরে ভাই শাহাবুদ্দিনের মাধ্যমে বাংলার রাজনীতিতে অভিষেক হয়। প্রত্যাশিতভাবে মুসলিম লীগ ছিল সেই তাঁদের আরাধ্য ক্ষেত্র। ১৯২২ সালে নির্বাচনে জিতে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হয়ে ১৯২৯ পর্যন্ত পদে থাকেন। অতঃপর বাংলার শিক্ষামন্ত্রী ( Education minister) এবং ক্রমশ ১৯৩৪-এ ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল (Viceroy’s Executive Council)-এর সদস্য হিসাবে ১৯৩৭ পর্যন্ত বহাল থাকেন। এইসময়ই ১৯৩৪ সালেই ভূষিত হন নাইট উপাধিতে। সংকীর্ণ কিন্তু অভিজাত সাম্প্রদায়িক মানসিকতার সৌজন্যে এক সময় মুসলিম লীগ প্রেসিডেন্ট জিন্নাহর সঙ্গে তাঁর ঘণিষ্ঠতা বাড়ে এবং লীগের এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন।[24]:332[25]

১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী হিসাবে লড়ে ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ (KPP)-র নেতা ফজ়লুল হকের কাছে নাজ়িমুদ্দিন পরাজিত হন। তবে আইসসভায় (legislative assembly) কৃষক প্রজা পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিরঙ্কুশ না পাওয়ায় সমর্থন নিতে হয় মুসলিম লীগের, যার সৌজন্যে ফজ়লুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেও নাজ়িমুদ্দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী (home minister) হন। এই পদে থাকেন ১৯৪৩ পর্যন্ত।
১৯৪৯০-৪১ নাগাদ ফজ়লুল হকের সরকারের সঙ্গে জোট ভেঙে বিরোধী নেতা হিসাবে নাজ়িমুদ্দিন বাংলার মন্ত্রীসভায় প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। তখন বাঙালী জাতীয়তাবাদের জন্য তাঁকে বেশ ভাবিত দেখায়।.[24]:332 ১৯৪৩-এ রাজনৈতিক বিতর্কের জেরে ফজ়লুল হককে গভর্নর জন হার্বাট ( John Herbert) বরখাস্ত করলে নাজ়িমুদ্দিন বাংলার প্রধানমন্ত্রীত্ব পেয়ে যান। সারা ভারতবর্ষে প্রথম ও একমাত্র মুসলিম সরকার তৈরি হল এই বাংলার বুকে। ক্ষমতা লাভ করেই পাকিস্তানের দাবিতে নাজ়িমুদ্দিন সোচ্চার হয়ে ওঠেন[24]:332, যদিও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের স্বরূপ সম্পর্কে তাঁর বা তাঁদের স্পষ্ট কোনও ধারণাই ছিল না। [27]:17

যাইহোক, ১৯৪৩-এ খ়াজা নাজ়িমুদ্দিন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলে সুহ্‌রাবর্দিকে নাগরিক সরবরাহ মন্ত্রকের (Ministry of Civil Supply ) দায়িত্ব দেন। এই সময়ই বাংলায় দেখা দেয় কুখ্যাত মন্বন্তর। বাংলার গভর্নর রিচার্ড কেসি (Richard Casey) নাজ়িমুদ্দিনকে শুধু অনুপযুক্ত বলে ক্ষান্ত থাকেননি, সেই দুর্ভিক্ষকে নাজ়িমুদ্দিন সরকারের ইচ্ছাকৃত ও দমনে অনীহা আছে বলেও অভিযোগ করেন97[23]। সুরাবর্দি পাল্টা প্রত্যাক্রমণ করেন: কেন্দ্র সরকার ও কালোবাজারির দল একজোট হয়ে রাজ্যে চাল, গম ইত্যাদির পরিবহন বন্ধ করে দুর্ভিক্ষ ঘটিয়েছে। অন্যদিকে লেখিকা মধুশ্রী মুখার্জী সুরাবর্দিকে আড়াল করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল (British Prime Minister Winston Churchill)-কে দায়ী করে বলেছেন, যুদ্ধের জন্য রেশন সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে মার্কিন দেশ থেকে আসা অনুদান তিনি বাংলায় আসতে দেননি[24]। কিন্তু ঘটনা হল, সুরাবর্দির তাঁর আর এক অ-চর্চিত মহান কীর্তি Scorched-Earth কৌশল যার দ্বারা জাপানি সেনাকে প্রতিহত করার জন্য হাজার খানেক জেলে ডিঙি জালিয়ে পূর্ব দিকের জলপথ অবরোধ করেন[25]। তার ফলেই মূলত ত্রাণ পৌঁছানোর রাস্তা রুদ্ধ হয়ে অনাহার ও দুর্ভিক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। লর্ড ওয়াভেল (Lord Wavell) ভাইসরয় হয়ে ত্রাণ কার্যে সেনা নামানোর আগে ত্রাণের ব্যবস্থাই করা যায়নি। ততদিনে অবশ্য কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পর রবিশষ্যের আগমণে পরিস্থিতি কিছুটা আয়ত্তে এসে গিয়েছিল। বাংলার হিন্দুরা তো বটেই, ইন্ডিয়ান প্রেস (Indian press) ও হিন্দু প্রেস (Hindu press) এই কাগজগুলিও দুর্ভিক্ষের জন্য সরাসরি এই বাংলা দরদী নেতাকেই দায়ী করেছিল[26]।
স্বভাবতই মন্ত্রীসভায় নাজ়িমুদ্দিনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ওঠে। সম্ভবত লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যার দায় এড়িয়ে পরিস্থিতির সুযোগ নিতেই সুরাবর্দি বাংলার প্রিমিয়ার বা প্রধানমন্ত্রী নাজ়িমুদ্দিন বিরুদ্ধেই প্রচার চালাতে লাগলেন। আস্থাভোটে ৯৭/১৬০ ভোটে নাজ়িমুদ্দিন হেরে যাওয়ার পর কংগ্রসের নেতা ও মন্ত্রীসভার স্পীকার নওসর আলির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। কিন্তু সেই সুযোগে ১৯৪৫-র সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসেন হুসেন শাহ সু্‌হ্‌রাবর্দি।

কিন্তু আশ্চর্য এটাই যে, ইচ্ছাকৃত বা অবহেলাজনিত বা অবিবেচনাজাত দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির পটভূমিকা থাকা সত্ত্বেও সুরার্বিরই নেতৃত্বে পুনরায় মুসলিম লীগকেই বাংলার জনতা শাসনভার তুলে দিয়েছিল। ক্ষমতা পেয়েই সুহ্‌রাবর্দি ক্যাবিনেটে হিন্দু সদস্য সংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমাতে শুরু করেন। এর জন্য কংগ্রেসও তাঁর কড়া সমালোচনা করেছিল[26]। এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার মাসুল অতঃপর বাংলাকে কড়ায় গণ্ডায় চোকাতে হয়েছিল, যদিও ভাবীকাল তা ভুলে গেছে।
গদিচ্যুত হলেও ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত নাজ়িমুদ্দিন পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান হিসাবে তুমুল কংগ্রেস বিরোধী[24] দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রচারক ও পাকিস্তানের দাবিদার হয়ে যান।[25]

এরপরের রক্তাক্ত ইতিহাস কিচুটা আগেই বর্ণিত হয়েছে। ১৯৪৬-এ যখন ভারতবর্ষ জুড়ে মুসলিমরা পাকিস্তানের দাবিতে সোচ্চার, পশ্চিম সীমান্তে রোজ রক্তপাত, দেশভাগ না করে উপায় নেই [28], সেই সময় ঘোষিত হল মুসলিম লীগের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ যার উদ্দেশ্য ছিল নাকি শান্তিপূর্ণ উপায়ে কিন্তু জোরালোভাবে পাকিস্তানের দাবি তুলে ধরা। তা ১৬ই আগস্ট কলকাতায় অক্টারলোনি মনুমেন্টের তলায় বাঙালী হিন্দুদের ওপর মুসলিমদের ঐতিহাসিক বিজয়ের কথা স্মরণ করিয়ে যে শান্তিপূর্ণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন সুরাবর্দি, তাতেই বারুদে অগ্নি-সংযোগ হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় এমন কেউ ছিল না যে সুরাবর্দির নিন্দা করেনি। বহুদিন পর্যন্ত তাঁর পরিচয় ছিল ‘গুণ্ডাদের রাজা’, যিনি শুধু সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেননি, ঘাতক বাহিনী নিয়োগ করে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা করিয়েছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিসকর্মী, ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন, ঐতিহাসিক দেবেন্দ্র পাণিগ্রাহী, ঐতিহাসিক যুথিকা রায়, ব্রিটিশ ঐতিহাসিক লিওনার্ড মোসলে থেকে মুসলিম ঐতিহাসিক ইয়াসমিন খান, এমনকি বাংলাদেশী মুসলিম ঐতিহাসিক হারুন-অর-রশিদ পর্যন্ত সবাই যেখানে নিজেদের ভাষায় দাঙ্গার জন্য পুরোভাগে শাহিদ সুরাবর্দিকে দায়ী করেছেন, সেখানে হিন্দু বাঙালী ঐতিহাসিক জয়া চট্টোপাধ্যায় নিজের অনুপম ইতিহাসবেত্তায় হিন্দু নেতাদের ভূমিকা খুঁজে পেছেছেন। “Hindu culpability was never acknowledged. The Hindu press laid the blame for the violence upon the Suhrawardy Government and the Muslim League.” গোপাল মুখার্জী সম্পর্কে তাঁর অভিমত – “was a major goonda at the time, who could command a force of around 500 men”. দুই হিন্দু বাঙালী ঐতিহাসিক জয়া চ্যাটার্জী ও মধুশ্রী মুখার্জী ছাড়া দেশি-বিদেশি বাকি ঐতিহাসিকরা কেউ কিন্তু এই নির্মম শাসকের দোষ ঢাকার চেষ্টা করেননি। যেখানে মুসলিম আক্রমণে বরাবর হিন্দু মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি নারকীয়তার শিকার হয়েছে, সেখানে এঁদের মতো মহীয়সী নারীরা কীভাবে এমন দৃষ্টিকোণ লাভ করতে পারেন, সেটাও গবেষণার বিষয়।
যাইহোক, জিন্না ও মুসলিম লীগের দাবি অনুযায়ী যখন দেশভাগ মেনে নেওয়া হল, তখন সুরাবর্দি অবিভক্ত বা সংযুক্ত বাংলার প্রস্তাব রেখেছিলেন। ব্যাপারটায় কংগ্রেস ও তার সহযোগী হিন্দু মহাসভা[51] তো বটেই, নাজ়িমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগও ঠিক রাজি ছিল না। জিন্নাহ্ অবশ্য ক্রমে সুরাবর্দিকে মত ও মদত দুটোই দিয়েছিলেন[4][5][6][7]। জিন্নাহ্ নিজের দূরদৃষ্টিতে বাঙালী মুসলিমদের স্বার্থে মেনে নেওয়ার মধ্যেও একটি ভূ-রাজনৈতিক (geo-strategic) গুরুত্বও খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই পাকিস্তানের অঙ্গীভূত না হলেও স্বাধীন বাংলা মুসলিম শাসিত হলে তা ভারতের বদলে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘণিষ্ঠ হবে বলেই তাঁর বিশ্বাস ছিল[31][27], যে বিশ্বাস পরবর্তীতে অভ্রান্ত প্রমাণ হয়েছে। তবে বাংলাকে সেই স্বাধীনতা দিতে তাঁর উত্তরসূরীরা এত আপত্তি করবে এবং এত রক্ত ঝরাবে সেটা অনুমান করেছিলেন কিনা জানি না।
যাই হোক, দাঙ্গায় কলকাতাকে বিধ্বস্ত এবং নোয়াখালিকে হিন্দুশূন্য করার অমর কৃতিত্ব নিয়ে সুরাবর্দি দেশভাগের প্রাক্কালে যখন পুনরায় বাংলার অখণ্ডতা নিয়ে ভাবিত হয়ে উঠলেন ও সংযুক্ত বাংলা (United Bengal)-র দাবি পেশ করলেন, তখন তো রাজি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এত কিছুর পরেও হিংসা ও দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং সীমা বিতর্ক (border disputes) এড়ানোর দোহাই দিয়ে সুরাবর্দি বাংলার দ্বিতীয় বিভাজনের (second partition) বিরুদ্ধে সংযুক্ত বাংলার চিত্র তুলে ধরলে পরে, তাতে সায় দিয়েছিলেন শরৎ চন্দ্র বসু, কিরণ শঙ্কর রায়, আব্দুল হাসিম, সত্যরঞ্জন বক্সি ও ফজ়লুল কাদের চৌধুরী[29][30]। সেই মর্মে সুরাবর্দির সঙ্গে কংগ্রেস নেতা শরৎ বসুর রফাও হয়ে গিয়েছিল, যে কংগ্রেসের বাংলা শাখা (Congress Party’s Bengal section) ও মুসলিম লীগের বাংলা বিভাগের (Muslim League’s Bengal Division) জোট সরকার গড়া হবে[28]। যুক্তি – সাম্প্রদায়িক বিভাজন নয় বরং বাংলার অখণ্ডতা রক্ষা করা জরুরি, যা কিনা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই সম্ভব। অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবকদের মধ্যে কিরণ শঙ্কর রায় পরে চক্রান্ত থেকে সরে যান বলে জানা যায়।

উপরন্তু জিন্নাহ্ নিমরাজি হলেও খ়াজা নিজ়ামুদ্দিন ও তাঁর ভাই খ়াজা শাহাবুদ্দিন, নরুল আমিন ও মহম্মদ আক্রাম প্রমুখ নেতারা সম্ভবত উর্দুভাষী বা উর্দুর পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গেই থাকতে চেয়েছিলেন। মজার ব্যাপার (India Office Records, Political and Secret Department Records (1756–1950), Category L/P&S, Record 5/250, 3/79, ভাইসরয়কে পাঞ্জাব গভর্নরের পাঠানো পাক্ষিক Fortnightly Report (February 1947) অনুযায়ী পাকিস্তানের অন্যতম দাবিদার নাজ়িমুদ্দিন এক প্রশ্নের জবাবে বিনীতভাবে বলেন, পাকিস্তান বলতে কী বোঝায় তিনি জানেন না, বস্তুত মুসলিম লীগের কেউই জানে না [″he did not know what Pakistan means and that nobody in the Muslim League knew.″] অর্থাৎ ভারত ভাগ করে পাকিস্তান গঠনের মাত্র ৬ মাস আগেও মুসলিম লীগ নেতাদের কাছে সাম্প্রদায়িক অনুপ্রেরণা ছাড়া পাকিস্তানের মৌলিক রূপরেখা সম্পর্কে কোনও স্বচ্ছ ধারণাই ছিল না।

ওদিকে সুরাবর্দি ভারত থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ গড়ার জন্য রীতিমতো স্বাধীনতা আন্দোলন ঘোষণা করে নিজের সমর্থকদের নিয়ে বিস্তর পদযাত্রা করে কংগ্রেসকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছিলেন[32]। পরিকল্পনা মাফিক সুরাবর্দি দিল্লিতে ও আব্দুল হালিম কলকাতায় যথাক্রমে ২৭ ও ২৯ এপ্রিল ১৯৪৭ সাংবাদিক বৈঠকে সেই মহান প্রস্তাব পেশও করেন[29]। কিন্তু প্রত্যাশিতভাবে বাঙালী হিন্দুরা বেড়ালের কণ্ঠে কীর্তন শুনে ভাবসাগরে ডোবেনি এবং বাংলা ভাগের পক্ষেই ভোট দেয়।

১৯৪৭ সালে নাজ়িমুদ্দিন ফের মুসলিম লীগের দলীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সু্‌হ্‌রাবর্দির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের সভাপতি (chairman) হন[31]। এরপর সু্‌রাবর্দির তোলা ‘অখণ্ড বাংলা’-র প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতা করে মন্ত্রীসভায় তুমুল ঝড় তোলেন। সংঘাতের অন্যতম দিক ছিল – বীভৎস গণহত্যা করানোর পরেও জনদরদী সুহ্‌রাবর্দি ছিলেন মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি, যেখানে রাখঢাক না করে নাজ়িমুদ্দিন ছিলেন অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতিভূ।[30] নিজ়ামুদ্দিনের সেই চাপেই পশ্চিমবঙ্গকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় ভারতে রাখা গেলেও পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের আগ্রাসী জঠরানলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল[28]। 14 August 1947.:26–27[32]:6–7[27] থেকে শুরু হল নরহত্যার এক নতুন ধারাবাহিক যা এখনও শেষ হয়নি।

পূর্ব বাংলার মাটিতে পাকিস্তানের অধিকার সুনিশ্চিত করার পুরস্কার স্বরূপ ভারত ভাগের সময় নিজ়ামুদ্দিন পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীত্ব লাভ করে মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গ শাখার ওপর প্রশ্নাতীত আধিপত্য লাভ করেন[31] [10]। শুধু তাই নয়, ১৪ আগস্ট ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ নিজে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (PML) দলের সভাপতিত্ব ছেড়ে নাজ়িমুদ্দিনকে সেই পদে জায়গা করে দেন। পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েই পাকিস্তান ফেডারেশনে (federation of Pakistan) যোগদানের পক্ষে ভোট দিয়ে পূর্ববঙ্গের প্রশাসনে রদবদল করে রক্ষণশীল ও উর্দুপন্থী মুসলিমদের ক্ষমতায় বসান। জিন্নাহ্ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ১ নভেম্বর ১৯৪৭ থেকে নাজ়িমুদ্দিন পাকিস্তনের কার্যনির্বাহী গভর্নর জেনারেলও নিযুক্ত হন। বরং তাঁর আর স্বাধীন বাংলার পৃথক অস্তিত্ব দাবি করায় পাকিস্তানের মাটিতে কিছুটা একটেরে হয়ে পড়েন সুহ্‌রাবর্দি।

চলবে