বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
দ্বিতীয় পর্বের পর

পাকিস্তানের দাবি ও প্রতিক্রিয়া

“পাকিস্তান”, (The Land of Pure) শব্দটি চৌধুরী রহমত আলি ১৯৩৩-এ একটি প্যামফ্লেটে প্রথম ব্যবহার করেন, যার মধ্যে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বা North West Frontier Province (Afghania), কাশ্মীর, সিন্ধ এবং বালুচিস্তানের দাবি ছিল। তখন শব্দটা তেমন রাজনৈতিক গুরুত্ব পায়নি।[28] কিন্তু ১৯৩৫-এ Government of India Act দ্বারা ‘Provintial Autonomy Headed by Indians’ বা ‘ভারতীয় প্রশাসক পরিচালিত প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসন’ চালু হওয়ার পর ভারতীয় ভোটারের সংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লক্ষ দেখে মুসলিমরা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, শিক্ষার ভাঁড়ার যে গোল্লা। [29]

বস্তুত, ১৯৩৭-এর ভারতীয় প্রাদেশিক নির্বাচনে (Indian provincial elections, 1937) মুসলিম অধ্যুষিত ‘ইউনাইটেড প্রভিন্স’-এর ৬৪ খানা মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসনের মধ্যেও মুসলিম লীগ কোনও মতে ২৯টা দখল করতে পারে।[29] আর মুসলিম প্রধান পাঞ্জাব ও বাংলাতেও স্থানীয় দলগুলির কাছেও লীগ কোনও প্রতিদ্বন্দিতাই সৃষ্টি করতে পারেনি। পাঞ্জাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও শিরোমণি আকালি দল-এর সমর্থন নিয়ে সিকন্দর হায়াত খান নির্বাচন জিতে প্রদেশ সরকার গঠন করে।[29] বাংলায় মুসলিম লীগকে এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে ‘কৃষক প্রজা পার্টি’র সঙ্গে জোট বাঁধতে হয়।[29] অন্যদিকে কংগ্রেস ১৫৮৫-র মধ্যে ৭১৬টি আসন জিতে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ১১টি প্রদেশের মধ্যে ৭টিতে সরকার গঠন করে। উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস নির্বাচন জিতেও মুসলিম লীগকে সরকারে অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। শর্ত একটাই মুসলিম লীগ শুধু মুসলিমদের প্রতিনিত্ব করা ছেড়ে সর্বজনীন জনপ্রতিনিধিত্ব করুক।[28] কিন্তু গোবলয়ে ‘হিন্দী’ বলিয়েদের সঙ্গে সহাবস্থান? তাও ‘শুধু মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব’ করার ঊর্ধ্বে উঠে? – কভি নহী। মুসলিম লীগ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। হিন্দুদের অগ্রগতিতে তথা হিন্দু প্রধান কংগ্রেসের শাসনে মুসলমানরা নিরাপদ নয়, এই বিশ্বাস সাধারণ মুসলমান জনমানসে অকারণেই জেঁকে বসল বা বসানো হল।[30]

ব্রিটিশ সরকার কোনও একজন ব্যক্তি নয়। স্বায়ত্ব শাসন দেবার পর ১৯৩৯-এ ভাইসরয় লিনলিথ্‌গো সাহেব ভারতীয় নেতাদের সাথে আলোচনা না করেই ভারতের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ ঘোষণা করে দিলেন।[30] দেশে সমস্যার অভাব? তার ওপর যুদ্ধের বোঝা! কংগ্রেসের নেতারা প্রতিবাদে পদত্যাগ করলেন। মজার খবর, শাসকদের মদতপুষ্ট[31] মুসলিম লীগ মহা আনন্দে “Deliverance Day,” (from Congress dominance) বা ‘মুক্তি-দিবস’ উদ্‌যাপন করল এবং ব্রিটিশ সরকারকে যুদ্ধে সমর্থনও জানাল।[30] কিন্তু লিনলিথ্‌গোর চোখে গান্ধী আর জিন্নায় প্রভেদ নেই।
এরপরের ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। লাহোরে অনুষ্ঠিত ১৯৪০-এর মার্চে মুসলিম লীগের তিনদিন ব্যাপি বার্ষিক অধিবেশনের প্রথম দিনই জিন্না দু ঘণ্টায় দুর্দান্ত ইংরেজিতে তুখোড় বক্তৃতা দিয়ে ‘দ্বিজাতি তত্ব’ বা Two-nation theory ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন। ঐতিহাসিক ট্যালবট ও সিংহের ভাষায়, “Muslims and Hindus … were irreconcilably opposed monolithic religious communities and as such no settlement could be imposed that did not satisfy the aspirations of the former.”[30] অধিবেশনের শেষ দিনে “Lahore Resolution” বা “পাকিস্তান দাবি”।[30] মুসলমান সংখ্যাধিক্য আছে এমন অঞ্চলগুলো অর্থাৎ দেশের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তের প্রদেশগুলো নিয়ে তৈরি হবে সার্বভৌম ‘পাকিস্তান’ – পবিত্র ভূমি। তিন দশক আগে গঠিত হলেও মুসলিম লীগ এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমস্ত মুসলমানকুলের সমর্থন পেল। ঐতিহাসিক ইয়াসমিন খান লিখেছেন, “Although it was founded in 1909 the League had only caught on among South Asian Muslims during the Second World War. The party had expanded astonishingly rapidly and was claiming over two million members by the early 1940s, an unimaginable result for what had been previously thought of as just one of the numerous pressure groups and small but insignificant parties.”[32] বিপিনচন্দ্র পাল খিলাফতি ও মুসলিম লীগ সম্পর্কে দুই দশক আগেই যে বলেছিলেন, “Common enemy of Indian Nationalism in its truest and broadest sense” জিন্নার নেতৃত্বে লীগ তা প্রমাণ করেই ছাড়ল।

এরপর কংগ্রেসের নেতৃত্বে ১৯৪০-এ লিনলিথগো পাকিস্তানের ধারণাকে সেভাবে গুরুত্ব না দিয়ে ভারতকে ডোমিনিয়ন স্টেটাস ( Dominion status) দিতে চাইলেন। কিন্তু হিন্দু আধিপত্যের ভয়ে ‘আগস্ট প্রস্তাব’-এ ভবিষ্যৎ সংবিধানে সংখ্যাঘুদের স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিতে হল।[33] প্রস্তাবে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস কেউ সন্তুষ্ট নয়। কংগ্রেস ‘আইন অমান্য’ আন্দোলন শুরু করল।[34] ১৯৪২-এ কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়ো’ (Quit India) আন্দোলন শুরু করায় নেতারা ১৯৪৫ পর্যন্ত জেলে বন্দী থাকেন। সেই সুযোগে মুসলিম লীগ নিজেদের বিচ্ছিন্নতাবাদী মতবাদকে জোরালো করতে থাকে।[35][36]

এরপর ১৯৪২-এ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে মুসলিম লীগের অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয় না। তাদের তৎপরতা কেন্দ্রীভূত থাকে সাম্প্রদায়িক শক্তি সঞ্চয়ের মধ্যে।[36][37] অবশ্য বাংলায় মুসলিম লীগের জোট সরকারে শামিল হিন্দু মহাসভাও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আভ্যন্তরীণ অশান্তি না বাড়িয়ে ব্রিটিশ সরকারকে সহযোগিতার করার পক্ষে ছিল। [38] তখনও পর্যন্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর হিন্দু মহাসভা মুসলিমদের সঙ্গে মৈত্রী ও সহাবস্থানের পক্ষে ছিল, যেটা পরবর্তী পরিস্থিতিতে বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯৪২-৪৫ পর্যন্ত বাংলায় একের পর এক দুর্ভিক্ষ ও বন্যায় সরকারি নিস্পৃহতা দেখে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ প্রশাসনের সঙ্গে হিন্দু মহাসভার মনোমালিন্য বাড়তে থাকে। ১৯৪৬-এ কিছু ঘটনার পর তা স্থায়ী বিচ্ছেদের রূপ পায়।

কলকাতা দাঙ্গা

১৯৪৬-এ নৌ বিদ্রোহ সহ কয়েকটা বিদ্রোহ হয়। ইংল্যান্ডেও লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসে। সর্বভারতীয় নায়ক সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘আজ়াদ হিন্দ ফৌজ’ নিয়ে “দিল্লী চলো” বলে দেশকে স্বাধীন করার প্রয়াস বিফল। মানুষটার চরিত্র দেশবাসীর মনে বিদেহী হয়ে অনুপ্রেরণা দিলেও তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণ জাপানে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার পর আর পাওয়া যায়নি। এই অশান্ত সময়ে পাকিস্তানের দাবিতে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে দাঁড়িয়েছিল নৈমিত্তিক ঘটনা।
১৯৪৬-এর ১৬ই জুন ক্যাবিনেট মিশন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব দিলে গণপরিষদে (Constituent Assembly) হিন্দু আধিপত্যের আশঙ্কায় [39][14] জিন্না সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ গণপরিষদের নির্বাচনে কংগ্রেসের দখলে ছিল ২০৮টি, মুসলিম লীগের দখলে মাত্র ৭৩টি আসন। এছাড়া ইউনিয়নিস্ট পার্টি ১টি, ইউনিয়ানিস্ট মুসলিম ১ট, ইউনিয়ানিস্ট শিডিউলড কাস্ট ১টি, শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশন ১টি, কৃষক প্রজা পার্টি ১টি, শিখ (নন-কংগ্রেস) ১টি, কমিউনিস্ট পার্টি ১টি ও নির্দল ৮টি আসনে জয়ী ছিল।[40] জুলাই মাসে জিন্না বম্বেতে নিজের বাড়িতে একটি প্রেস কনফারেন্স করে স্পষ্ট যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন – Muslim league was “preparing to launch a struggle” এবং তার পরিকল্পনাও তৈরি – “have chalked out a plan”.[9] [41] শুধু তাই নয় মুসলমানদের পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি মানা না হলে তারা প্রত্যক্ষ সংগ্রামে (“direct action”) অবতীর্ণ হবে। পরিকল্পনার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জিন্না জবাব দেন, “Go to the Congress and ask them their plans. When they take you into their confidence I will take you into mine. Why do you expect me alone to sit with folded hands? I also am going to make trouble.”[9 [41] পরিষ্কার হুঁশিয়ারি, তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না, এবং মুসলিমরা গোলমাল করবেই।

সমঝোতা বা আলোচনার সুযোগ না দিয়ে পরের দিনই জিন্না ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ আগস্ট ঘোষণা করলেন Direct Action Day, যার ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ ভারতে মুসলিমদের নিজস্ব বাসভূমির জন্য শান্তিপূর্ণ দাবি তোলা। এ জন্য একটি সাধারণ হরতালের ডাক দেওয়া হয়।[41][42][46] তা বাংলার প্রধানমন্ত্রী (আজকের পরিভাষায় মুখ্যমন্ত্রী) হুসেন শাহিদ সুরাবর্দি দিনটি উদযাপনের এমন চমৎকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, যে ১৬ আগস্ট সকাল থেকে কাফের কোতল দিয়ে দিনের শুভারম্ভ হয় এবং অক্টারলোনি মনুমেন্টের নীচে তাঁর বক্তৃতা শুনতে হাজির হয় দশ হাজার সশস্ত্র মুসলিম জনতা।[44] আর বক্তৃতায় মন্ত্রীমশাই মুসলিম শাসক দ্বারা হিন্দুদের পদানত করে রাখার গৌরবোজ্জবল ইতিহাস স্মরণ করিয়ে এমন শান্তির বাণী শোনালেন যে, ১৬-২০ আগস্টের মধ্যে কলকাতার বুকে সরকারি হিসাবে ৪-৫ হাজার[35] লাশ পড়ে গেল, গৃহহীন হল ১ লক্ষের বেশি মানুষ।[43][45][46] ও বেসরকারি গণনায় ২০ হাজারের বেশি লাশ পড়ে গেল। সঙ্গে গনিমতের মাল নিয়ে চড়ুইভাতি তো ছিলই। এই সৎ প্রচেষ্টাই ইতিহাসে “Great Calcutta Killing of August 1946” নামে কুখ্যাত হয়ে আছে। দিনটা “The Week of Long Knives” নামেও বিখ্যাত। [46][47][48]
১৯৪৬-এর ১৬ই আগস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশন দিবসে অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ সরকার একদিকে ছুটি ঘোষণা করেছিল, আর অন্যদিকে নিচ্ছিল জিন্নার সাংবিধানিক পদ্ধতিকে বুড়ো আঙুল দেখানো ঘোষণা “We will either have a divided India or a destroyed India” “India divided or India burned”[41] বাস্তবায়নের প্রস্তুতি, মানে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা কমানোর একটা পরিকল্পিত উদ্যোগ। ময়দানে সুরাবর্দির বক্তৃতা শোনার জন্য মহা মিছিলের আয়োজন হল। ১৬ই আগস্ট ছিল রমজানের ১৮তম দিন, যেদিন হজ়রত মহম্মদ মাত্র ৩১৩ জন সাচ্চা মুসলমান নিয়ে হিদেনদের বিরুদ্ধে বদর যুদ্ধে জিতেছিলেন, যে জয় পরবর্তীকালে বিধ্বংসী মক্কা জয়ের পথ খুলে দিয়েছিল।[41][44] এমন পবিত্র দিনেই রক্ত স্নানের অনুপ্রেরণা দিতে জিন্নার তরবারি শোভিত ছবিতে ছেয়ে গেল গোটা শহর;[44] সঙ্গে মুসলিম লীগের মুখপত্র The Star of India-য় প্রকাশিত উত্তেজক বার্তা। অন্যান্য মুসলিম পত্র-পত্রিকাতেও ছিল ‘হিদেন’ (এক্ষেত্রে বলা বাহুল্য ‘হিন্দু’) বিনাশ করে বাংলার ভূমিকে পবিত্রকরণে ডাক ছিল। তৎকালীন মেয়র সৈয়দ মহম্মদ উসমানও একটি লিফলেট বিলি করে শান্তিবার্তা দেন, “কাফের! তোদের ধ্বংসের আর দেরি নেই। সার্বিক হত্যাকাণ্ড ঘটবেই!”[44] Programme for Direct Action Day, Star of India, Published: 13 August 1946 পত্রিকায় দিনটির পুরো কর্মসূচী বর্ণিত ছিল।“

দিনটা ছিল শুক্রবার। শুধু সুরাবর্দি নয়, লীগ নেতৃত্ব থেকে মসজিদের ইমামদের প্রতিও নির্দেশ ছিল জুম্মার নামাজ়ের পর অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা দেওয়ার, যে দায়িত্ব তারা খুব যত্ন সহকারে পালন করে কাফের বধের ডাক দেয়। অত্যুৎসাহী কিছু জেহাদির আবার অত তর সয়নি, অনেক জায়গায় শুক্রবারের প্রার্থনা শুরুর আগেই হিন্দুদের দোকান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা শুরু হয়ে যায়, বিশেষত যেগুলো লীগের ডাকা হরতালে সাড়া না দিয়ে খোলা ছিল। কংগ্রেসের নেতৃত্বে হিন্দুদের তরফ থেকে সংগঠিত হয়েছিল ‘অখণ্ড ভারত’-এর আবেগ।[45]

নামাজ়ের পর হাজার হাজার উত্তেজিত সশস্ত্র জনতা অক্টারলোনি মনুমেন্টের দিকে রওনা হয় ২টো নাগাদ সুরাবর্দি ও বাকি মুসলিম লীগ নেতাদের বক্তৃতা শুনতে যদিও গোলমাল শুরু হয়েছিল সকাল ১০টারও আগে থেকে।[46][49] সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে বড় মুসলিম সমাবেশ ছিল সেটা।[49] জিন্নার স্বপ্নের পাকিস্তানে যাতে বাংলার অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হয়, সেই মর্মে নেতারা যে যার সাধ্যমতো হিন্দু বিনাশ ও বিতাড়নের ডাক দিয়ে গনগনে বক্তব্য রাখেন।

কতজন জমায়েত হয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্ন সূত্রের বিভিন্ন দাবি। Central Intelligence Officer’s রিপোর্ট অনুযায়ী সংখ্যাটা ছিল ৩০ হাজার যেখানে কলকাতা পুলিসের Special Branch Inspector-এর মতে ছিল ৫ লক্ষ। পরের সংখ্যাটা অবিশ্বাস্য বেশি। The Star of India-র প্রতিবেদকদের মতে প্রায় ১ লক্ষ সশস্ত্র মুসলিম জড়ো হয়েছিল। প্রধান বক্তা ছিলেন খাজা নাজ়িমুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী (মুখ্যমন্ত্রী) হুসেন শাহিদ সোহ্‌রাবর্দি। কেউ কারও চেয়ে কম যান না। তার মধ্যে নাজ়িমুদ্দিন পরিষ্কার বলেন, ইংরেজ নয় মুসলমানদের আসল লড়াই কংগ্রেস ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে। নিজের শান্তির বার্তা দেওয়ার ছলে বক্তৃতায় দাবি করেন বেলা ১১টা পর্যন্ত মুসলিমরাই নাকি আক্রান্ত হয়ে শুধু প্রতিরোধের জন্য পাল্টা মার দিয়েছে এবং সমস্ত আহত ব্যক্তিই মুসলমান। ব্যাস্! এটাই ছিল আগুনে পেট্রল ঢালার পক্ষে যথেষ্ট।[3][46] বিজয়োল্লাসে মত্ত লাখ খানেক (উইকিপিডিয়ার হিসাবে ১০ হাজার) সশস্ত্র উন্মত্ত মুসলিম লীগ সমর্থক হিন্দু নির্মূলীকরণের মহান ব্রত নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। পাথেয় ছিল প্রিমিয়ার সোহ্‌রাবর্দির প্রশাসনিক সদিচ্ছা। ফ্রেডরিক ব্যুরো সাহেবের গভর্নরকে লেখা রিপোর্টে পাওয়া যায় – Central Intelligence Officer-এর বয়ান, “He [the Chief Minister] had seen to police and military arrangements who would not interfere”, আর মিলিটারি নিয়োজিত বিশ্বস্ত প্রতিবেদকের বক্তব্য, “He had been able to restrain the military and the police” – দুটোই অনুরূপ; অর্থাৎ সুরাবর্দির বক্তৃতায় ছিল পুলিস ও সেনাকে নিষ্ক্রিয় রাখার আশ্বাস।[46] এটা অবশ্য কলকাতা পুলিস রিপোর্টই করেনি।

ধর্মতলায় মানে মনুমেন্টের ঠিক পাশেই একটি হিন্দু মালিকানার অস্ত্র-বিপণী ছিল। সেখানেই সর্বপ্রথম হামলা ও লুঠতরাজ হয়। দোকানের মালিক ও কর্মীদের মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। এরপর হিন্দুদের দোকান-পাট, দপ্তর ও বাড়ি বাড়ি ঢুকে চলে পুরুষদের মুণ্ডচ্ছেদ বা হাত-পা কেটে ফেলা আর মেয়েদের ধর্ষণ করে নৃশংস উপায়ে খুন কিংবা যৌন দাসত্বের জন্য অপহরণ।[46][50] হ্যারিসন রোডে লরি ভর্তি করে মুসলিম গুণ্ডারা ইট-পাটকেল, বোতল বোমা নিয়ে এসে হিন্দু দোকানে লুঠপাট অগ্নি সংযোগ শুরু করে।[51] সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ শহরে কার্ফিউ জারি হয়।[52] কিন্তু এমন কার্ফিউ যে ১৭ই আগস্ট মুসলিম অধ্যুষিত মেটিয়াবুরুজের লিচুবাগানে এলাকার কেশোরাম কটন মিল (Kesoram Cotton Mills) নামে একটি সূতীবস্ত্র কারখানায় সবচেয়ে বড়ো হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। গার্ডেন রিচ Garden Reach Textile Workers’ Union-এর প্রেসিডেন্ট লীগ নেতা সৈয়দ আবদুল্লা ফারুকির নেতৃত্বে কুখ্যাত মুসলিম গুণ্ডা এয়লাম মিস্ত্রি বিশাল মুসলিম জনতা নিয়ে একটি বাহিনী মিলে ঢুকে ৬০০ হিন্দু শ্রমিক, যাদের অধিকাংশ উড়িয়া ও কিছু বিহারী, তাদের নির্মমভাবে মুণ্ডচ্ছেদ করে। শুধু যে দুজনের হাত-পা কেটে মরার জন্য ফেলে রাখা হয়েছিল, তারা দৈবাৎ বেঁচে গিয়ে ফারুরির বিরুদ্ধে মেটিয়াবুরুজ থানায় নালিশ জানাতে পারে ও তাদের মুখে এই বর্ণনা পাওয়া যায়।[53] উইড়িষ্যার এক মন্ত্রী ছুটে আসেন কেশোরাম কটন মিলে মৃত শ্রমিকদের খবর পেয়ে।[54] মৃত শ্রমিকের সংখ্যাটা ছিল ১০ হাজারেও বেশি।।[47] বাংলার গভর্নর ফ্রেডরিক ব্যুরো (Frederick Burrows) অবশ্য বড়লাট লর্ড ওয়াভেল (Lord Wavell) নিজের রিপোর্টে সোহ্‌রাবর্দির ছুটির দিন ঘোষণার সাফাই গেয়ে বলেছেন— “Suhrawardy put forth a great deal of effort to bring reluctant British officials around to calling the army in from Sealdah Rest Camp. Unfortunately, British officials did not send the army out until 1.45 am on 17 August.” যদিও বহু নারকীয়তার ব্যাপকতার বর্ণানাও তাতে পাই।

সুরাবর্দির একটি অনুমান আংশিক সত্য প্রমাণ হয়েছিল। প্রথমটায় হিন্দুরা সত্যিই প্রত্যাঘাত তো দূর কোনও প্রতিরোধও করতে পারেনি, বরং শহর ছেড়ে পালাচ্ছিল। হাওড়া ব্রীজ আর হুগলী নদী ভরে গিয়েছিল পলাতকের ভিড়ে।[55] সুরাবর্দির ধারণা ছিল, কয়েশো বছর মুসলিম শাসনে থেকে হিন্দুদের মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে গেছে – (“…don’t have it in their genes to resist Muslims”) এবং হিন্দুদের দৃঢ় বিশ্বাস তারা দুর্বল আর মুসলিমরা ভয়ঙ্কর (“Hindus were of the firm belief that they (Hindus) were weak and Muslims were strong and ferocious”)।[56] তাই তাদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস হবে না। তাছাড়া কলকাতার ৬৪% হিন্দু জনতার বেশির ভাগই শান্তশিষ্ট, আর হাওড়া ও হুগলি ছাড়া কাছাকাছি আর কোনও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা নেই। সুতরাং নির্বিবাদে সাফ করো। পুলিস যাতে সাফাই অভিযানে বাধা দিতে না পারে, তাই লালবাজার কন্ট্রোল রুমে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মশাই প্রহরায় ছিলেন। [43][44][47][48] অভিযান সফল করতে পুলিস কনস্টেবলদের মধ্যে বিহারী হিন্দুদের সরিয়ে ইউনাইটেড প্রভিন্স (অধুনা উত্তর প্রদেশ) থেকে মুসলিম ও পাঠান সেনা নিয়োগ করা হয়। এই কনস্টেবলরাও মুসলিমদের হিন্দু নারী-শিশু ধর্ষণ ও নারকীয় খুনে মদত দিয়েছিল।[56]

দু দিন ধরে হিন্দুপ্রধান এলাকায় অবাধে যে লুঠতরাজ, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ চলেছিল, তা নৃশংসতার নজির হয়ে থাকতে পারে। বিভিন্ন সূত্রের গণনায় মৃতের সংখ্যা ৪০০০ থেকে ২০,০০০-এর মধ্যে যে কোনও জায়গায় হতে পারে। তবে মাত্র ৩৫০০ দেহ দাহ-সৎকারের খবর আছে।[56] সমকালীন ব্রিটিশ ও ভারতীয় ঐতিহাসিকরা সরকারি বা সরকার অনুমোদিত তথ্যের ওপরই নির্ভর করায় উইকিপিডিয়া সহ তদানীন্তন ভাইসরয় ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় উভয় সম্প্রদায়ের ৪০০০-৫০০০ মানুষ মারা যাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। সরকারি হিসাবে অবশ্য ২৬ আগস্ট পর্যন্ত কলকাতা ও হাওড়ার শুধু রাস্তা থেকেই মৃতদেহ উদ্ধার হয় ৩৪৬৮টি।[57] [Calcutta Municipal Gazatte, August 24, 1946] কত দেহ যে ভূগর্ভস্থ নর্দমায়, খালে কিংবা গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল, তার হিসাব পাওয়া ছিল অসাধ্য। খুব কম করে বললেও ১৬-১৭ এই দু’ দিনে অন্তত ৭০০০ হিন্দু মারা গিয়েছিল বা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল।[56]
আমরা শুধু দেশভাগে দেশান্তরী হওয়ার খবর রাখি। কিন্তু কলকাতা গণহত্যার সময় বাংলা ছেড়ে অন্য রাজ্যে পালিয়ে বাঁচতে মরিয়া কত হিন্দু পরিবারে যে হাওড়া স্টেশনে থিকথিক করছিল ঐ কদিন, তার গোণাগুন্‌তি নেই।[55][56] যারা জলপথে রওয়া হয়েছিল, তাদের নৌকো তাড়া করে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।[56] ঠিক এমনটাই পরিকল্পনা ছিল সুরাবর্দির। হিন্দুদের ভয়াবহভাবে মেরে এমন আতঙ্কিত করে দেওয়া, যাতে তারা বাংলা ছেড়ে পালাতে পথ না পায়। কলকাতা সহ গোটা বাংলায় মুসলিম সংখ্যাধিক্য তৈরি করা গেলে দেশভাগের সময় বাংলাকে পাকিস্তানে ঢোকানো যাবে। কলকাতার পর তাঁর লক্ষ্য ছিল হাওড়া, হুগলি ও ২৪ পরগণার মতো শিল্পোন্নত জেলাগুলিকেও হিন্দু-লঘু করে পাকিস্তানে শামিল করা;[56] কারণ এই জেলাগুলি না পেলে পাকিস্তানি বাংলার অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে থাকবে।

চলবে