‘একুশে’র মিথ, ‘জয় বাংলা’র মিথ্যা – ১

ভাষা আন্দোলনের আদি কুশীলবদের বাংলা প্রীতি

0
2301

পর্ব ১ ভাষা আন্দোলনের আদি কুশীলবদের বাংলা প্রীতি

[১৯৫২র ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ অমর একুশেহিসেবেই পরিচিত। বাংলাদেশের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ‘-এর ন্যারেটিভে এই দিনটি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। একুশেনিয়ে আবেগ আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও কিছু কম নেই। এ প্রসঙ্গে উদ্বাস্তু পরিবারে জন্ম নেওয়া এক পূর্ববঙ্গীয়ার জিজ্ঞাসা, “একুশে ফেব্রুয়ারি বললেই পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা আবেগে কেঁদে ফেলেন। কিন্তু সাধারণ বাঙালির কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি কি ভাষা দিবসনা ধোঁকা দিবস‘?” তাঁর উষ্মার কারণ, ভাষা আন্দোলনের মাত্র কয়েক বছর আগে, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বকে স্বীকৃতি জানিয়ে বাংলার এই মুসলমান জনগণই হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করে নিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান স্থাপনের পরেও পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালী হিন্দুর উপর নির্যাতন থেমে থাকেনি। ১৯৫০এ সংঘটিত হয় সারা পূর্বপাকিস্তান জুড়ে ভয়াবহ হিন্দু গণহত্যা, পশ্চিমবঙ্গে শরণ নিতে হয় বিশিষ্ঠ নমঃশূদ্র নেতা ও পূর্বপাকিস্তানের তৎকালীন আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে। বাহান্নর তথাকথিত ভাষা আন্দোলনের ফলে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৬২তে পাবনা ও রাজশাহীতে, এবং ১৯৬৪ ও ১৯৬৫তে ঢাকা ও অন্যান্য এলাকায় ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও ১৯৯২, ২০০১ ও ২০১৩১৪ সালে হিন্দুদের উপর ঘটে নারকীয় সংহার। এইসব দাঙ্গায় যে হাজার হাজার হিন্দু নিহত হয়েছিল, হিন্দু নারী ধর্ষিতা হয়েছিল, গৃহহীন হয়েছিল যে বহুসংখ্যক  হিন্দু পরিবার, তাদের ভাষাও কি বাংলা ছিল না? যে ভাষাভিত্তিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, “তুমি কে? আমি কে? বাঙ্গালী, বাঙ্গালী“, সেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক পরেও কেন পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ পড়ে হিন্দু সাহিত্যিকদের লেখা? আজও কেন সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতন চলে অবিরাম? হিন্দুর জনসংখ্যা কেন নেমে আসে মাত্র আট শতাংশে? নাকি প্রচারের ঢক্কানিনাদে প্রকৃত সত্য চাপা পড়ে গেছে?]

তাহলে কেমন ছিল ভাষা আন্দোলনের চরিত্র? কি ছিল তার উদ্দেশ্য? আর কেমনই বা বাংলাদেশের এই তথাকথিত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ‘-এর স্বরূপ?

এই সকল প্রশ্নের উত্তরের অন্বেষণ বঙ্গদেশের এই ধারাবাহিকে।

 

১৯০৫ সালে কার্জন বঙ্গ বিভাজনের ঘোষণা করলে নবাবী শাসনের অবসানের পর অবসাদে ভোগা বাংলার মুসলিম নেতৃত্ব ফের রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করার দিকে মনোনিবেশ করে। ১৯০৬এ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ। কার্জনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও তাঁরা নিরাশ হননি, বরং নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকতর অংশীদার হওয়ার দাবি জানাতে থাকেন। বঙ্গীয় আইন সভা ও সরকারি চাকরিতে অতিরিক্ত প্রতিনিধিত্ব এবং বিভিন্ন ধর্মীয় দাবিতে ১৯২৩ সালে পরবর্তীকালে ‘Butcher of Bengal’ হিসেবে কুখ্যাত হোসেন সোহরাওয়ার্দী, জামাতউলেমাবাংলার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদি, খিলাফত পুনঃ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও অন্যান্য বিশিষ্ট মুসলমান নেতৃবর্গ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে একটি সমঝোতায় পৌঁছান যা পরিচিত হয় বেঙ্গল প্যাক্ট হিসাবে।

এই সমঝোতার অন্যতম প্রধান শর্তগুলি ছিল:

. জনসংখ্যার ভিত্তিতে বঙ্গীয় আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব

. সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের জন্য ৮০ শতাংশ সংরক্ষণ, যতদিন না সম্মিলিত ভাবে মুসলমানদের ৫৫% পদ করায়ত্ত হয়

. মসজিদের সামনে বাদ্য সহকারে শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ

. ধর্মীয় কারণে গরু জবাইয়ের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না

অর্থাৎ বাংলার মুসলমান নেতৃত্বের কাছে প্রথম থেকেই দুটি লক্ষ্য ছিল

এক, বঙ্গের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমান আধিপত্য বিস্তার।

দুই, বাংলার সমাজ জীবনে দেশজ হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাবকে খর্ব করে ইসলামী তথা আরবী সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা।

দেশবন্ধুর মৃত্যুতে চুক্তি তখন কার্যকর না হলেও দুদশকের কিছু পরে বাংলার বিভাজন ও পূর্ব পাকিস্তান স্থাপনের মাধ্যমে তাঁদের সেই আকাঙ্খা পূরণ হয়।

কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্যত্র।

পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব থেকেই এর রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে পাকিস্তানের প্রবক্তারা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং দিল্লি ও আলীগড় কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবিগণ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে থাকেন। ভারতে হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের অনুকরণে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ ১৯৪৭র ১৮ই মে মাসে হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত উর্দু সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন।

পূর্ববঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে ও কর্মস্থলে নিজেদের আধিপত্য হারানোর আশংকায় প্রমাদ গুনলেন বঙ্গের পাক প্রবক্তারা। উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে অবহিত করার জন্য ১৯৪৭র ২৯শে জুলাই তৎকালীন বহুল প্রচারিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু এই বিরোধিতা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ নেতৃত্বের পৃষ্টপোষকতায় পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই অফিস আদালতে শুধুমাত্র ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহৃত হতে শুরু হওয়ায় সেই বছরের ৩১শে ডিসেম্বর শহীদুল্লাহ তকবীর পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার ভাষা সমস্যা’ নামে আরও একটি প্রবন্ধে বাংলা ভাষার সাথে সাথে উর্দুর পরিবর্তে আরবী ভাষাকে অগ্রাধিকার দেন:

মাতৃভাষার পরই স্থান ধর্মভাষার, অন্তত মুসলমানদের দৃষ্টিতে। এই জন্য আমি আমার প্রাণের সমস্ত জোর দিয়া বলিব, বাঙালার ন্যায় আমরা আরবী চাই। […] সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম সার্থক হইবে, যে দিন আরবী সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হইবে। […] কিন্তু বর্তমানে আরবী পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি বৈকল্পিত ভাষা ভিন্ন একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণের যথেষ্ট অন্তরায় আছে। [1]

পাকিস্তান সৃষ্টির দুই সপ্তাহের মাথায় ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৪৭এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়  ‘তমদ্দুন মজলিশ’ নামে একটি ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন।[2] কিছুদিন পরেই ১৯৪৭র ১লা সেপ্টেম্বর এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয় যার শিরোনাম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা: বাংলা না উর্দু?। এই পুস্তিকায় প্রকাশিত হয় মোট তিনটি নিবন্ধ।  প্রবন্ধকাররা ছিলেন কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদএর সম্পাদক আবুল মনসুর আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহের হোসেন এবং আবুল কাশেম স্বয়ং। পুস্তিকার প্রথম প্রবন্ধে অধ্যাপক আবুল কাশেম বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ও শিক্ষা মাধ্যমের প্রধান ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানান।

কতটা নিখাদ ও অসাম্প্রদায়িক ছিল তাঁদের এই বাঙ্গালী চেতনা ও ভাষা প্রীতি?

বাঙ্গালী, অর্থাৎ বাঙ্গালী হিন্দুর থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে গিয়ে বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে বাংলা ভাষার প্রতি বিরূপতা সৃষ্টি হয় (পরবর্তী এক অধ্যায়ে আমরা এর আলোচনা করেছি) তা ভঞ্জন করতে কাজী মোতাহের হোসেন উপরোক্ত পুস্তিকায় দাবি করেন যে, মুসলিম শাসকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমেই বাংলা ভাষার বিকাশ হয়েছে এবং মুসলমানদের ব্যবহারের জন্য বাংলা একটি উপযোগী ভাষা হিসেবে পরিগণিত হবার যোগ্য! পুস্তিকার অন্তর্গত রাষ্ট্রভাষা ও পূর্বপাকিস্তানের ভাষা সমস্যানিবন্ধে তিনি লেখেন:

মোগল যুগে বিশেষ করে আরকান রাজসভার অমাত্যগণ, বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধির জন্য অকাতরে অর্থব্যয় করেছেন। মুসলমান সভাকবি দৌলত কাজী এবং সৈয়দ আলাওল বাংলা কবিতা লিখে অমর কীর্তি লাভ করেছেন। […]

এতদিন মুসলমান কেবল হিন্দুর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিশ্চিন্ত আরামে বসে বলেছেন যে, হিন্দুরা বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানীভাবে ভরে দিয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ত তা চলবে না। এখানে ইসলামী ঐতিহ্য পরিবেশন করার দায়িত্ব মুখ্যতঃ মুসলমান সাহিত্যিকদেরই বহন করতে হবে। তাই আজ সময় এসেছে, মুসলমান বিদ্দ্বজ্জন পুঁথিসাহিত্যের স্থলবর্তী বাংলা সুসাহিত্য সৃষ্টি করে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে দেশবাসীর পরিচয় স্থাপন করবেন; তবেই মাতৃভাষা সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ হবে এবং ইসলামী ভাবধারা যথার্থভাবে জনসাধারণের প্রাণের সামগ্রী হবে তাদের দৈন্য ও হীনতাবোধ দূর করবে।

পূর্বোক্ত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ প্রবন্ধে ডঃ শহীদুল্লাহও একই সুরে বাংলা ভাষায় হিন্দুর অবদানকে অস্বীকার করে লিখেছিলেন:

ভারতে মুসলিম যুগের পূর্বেও পুরাতন বাংলা ভাষা ছিল। ইহার জন্য বাংলা বৌদ্ধ সমাজের নিকট ঋণী। সেইরূপ পাঠান আমলে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য মুসলমান আমীর ও সুলতানদের সহায়তায় গড়িয়া ওঠে এবং সমৃদ্ধশালী হয়। […] ব্রিটিশ আমলেও বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের দান নগণ্য নয়, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইয়াছে।[3]

আবুল মনসুর আহমেদ ১৯৩৭র নির্বাচনের পরে বাংলার মুসলীম লীগের সাথে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৪০ সাল থেকে পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। পাকিস্তানের দাবিতে জনমত গঠন করতে ১৯৪৬র ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’ এর প্রধান খলনায়ক হোসেন সোহরাওয়ার্দী ঘনিষ্ঠ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ওই একই বছরে প্রকাশ করেন দৈনিক ইত্তেহাদ। এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে আবুল মনসুর আহমেদ হন পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। মুসলমানি বাংলাভাষার অন্যতম প্রবক্তা মনসুর আহমেদ পুস্তিকার নিবন্ধে (‘বাংলা ভাষাই হইবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা‘) পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন যে, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে নির্ধারণ করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত বাংলাভাষী মুসলমান অশিক্ষিত হিসাবে বিবেচিত হবেন:

উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারী চাকুরির ‘অযোগ্য’ বনিয়া যাইবেন। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফারসীর জায়গায় ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারী কাজের ‘অযোগ্য’ করিয়াছিল।

তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল,

এই পুস্তিকাটি বেশী কপি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। যাঁদের কাছে সেটা বিক্রি করার চেষ্টা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই তখন ছিলেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার  বিরুদ্ধে। শুধু শিক্ষিত জনসাধারণ নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক ছাত্রেরও অভিমত তাই ছিল। সেজন্য তাঁরা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এমন কি মুসলিম হল, ফজলুল হক হল ইত্যাদি ছাত্রাবাসেও এ নিয়ে প্রথম দিকে কোন ছোটখাট ঘরোয়া বৈঠকের আয়োজন করাও ছিল কষ্টসাধ্য।[4]

লক্ষ্য করার বিষয়, পুস্তিকাটির প্রধান উদ্যোক্তা আবুল কাশেমের প্রতিষ্ঠানের নাম সভ্যতা পরিষদবা ‘সংস্কৃতি পরিষদ’ না হয়ে হয়েছিল তমদ্দুন মজলিস। এমনই ছিল তাঁর বাংলা প্রীতি। কাশেম কোন ব্যতিক্রম ছিলেন না। ভারত ভাগ হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম যে দৈনিক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় তার নাম রাখা হয়েছিল পয়গাম। সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী। ১৯৪৭ সালে ঢাকায় আরো একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় যার নাম রাখা হয়েছিল জিন্দেগী। ১৯৪৮এ মাওলানা আকরাম খাঁ প্রকাশ করেন দৈনিক আজাদ। এরপর আসে ইত্তেফাক, ইনসান, ইনসাফ। এইসব দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীshতে চলা আন্দোলনকে সমর্থন করে লেখালেখি করে। কাশেমের উদ্যোগে ১৯৪৮র অক্টোবরে গঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের  সদস্য ছিলেন ইত্তেফাক, ইনসানইনসাফ পত্রিকার সম্পাদক ত্রয়ী। এছাড়াও ছিল ইত্তেহাদ ও বামপন্থী নওবেলাল। খেয়াল করবেন, শহীদুল্লাহর প্রবন্ধ দুটির প্রকাশক যথাক্রমে দৈনিক আজাদতকবীর। বাংলা ভাষার জন্য এহেন গভীর মমতা আর ভালোবাসা জাগানো সম্পাদকীয় বের হতো এইসব আরবী ও উর্দু নামের পত্রিকাগুলো থেকে। একটা পত্রিকারও বাংলা নাম রাখা হয়নি!

বাংলা প্রীতি নয়, রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হয়ে গেলে চাকরিতে বাংলাভাষী মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানদের থেকে পিছিয়ে পড়বে, মূলত এই আশঙ্কা থেকে তথাকথিত ভাষা আন্দোলনের জন্ম; তৎকালীন মুসলিম সমাজের সাধারণ শ্রমিক ও কৃষিজীবী অংশের কাছে রাষ্ট্রভাষা কোন বিশেষ মাথা ব্যাথার বিষয় ছিল না। আর ভাষা আন্দোলন উত্তর ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্র সাময়িকীতে উর্দু ছায়াছবির আলোচনা যদি কোন ইঙ্গিত দেয় তবে ভাষা আন্দোলনের পূর্বে শিক্ষিত বাংলাভাষী মুসলমান সমাজের কাছেও উর্দু ভাষা ছিল যথেষ্ট আদৃত।[5]

এই যখন পরিস্থিতি তখন পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলা ভাষার সমর্থনে গর্জে উঠলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

(ক্রমশঃ) 

 

পাদটীকা

[1] বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ১ম খন্ড, আনন্দধারা প্রকাশন, ১৯৭০, পৃ:

[2] ‘তমদ্দুন মজলিশ’ বিষয়ক আলোচনা বদরুদ্দীন উমরের পূর্বোক্ত বইয়ের ‘তমদ্দুন মজলিশের প্রাথমিক উদ্যোগ’ শীর্ষক অধ্যায়ের উপর ভিত্তি করে।

[3] মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’, দৈনিক আজাদ, ২৯ জুলাই ১৯৪৭,

[4] বদরুদ্দীন উমর, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৯

[5] বাংলাদেশ ফিল্ম আরকাইভ থেকে ষাটের দশকের বিভিন্ন চলচ্চিত্র সাময়িকীর (সাজঘর, সচিত্র সন্ধানী, চলন্তিকা ইত্যাদি) উপর গবেষণা করে লট হোক (Lotte Hoek) তাঁর ‘Cross-wing Filmmaking: East Pakistani Urdu Films and Their Traces in the Bangladesh Film Archive’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, উর্দু ছায়াছবি বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে শুধু জনপ্রিয়ই ছিল না, এই জনপ্রিয়তার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল:

From these magazines, it is clear that there was an audience for Urdu films in East Pakistan that was at ease reading Bengali. Urdu films made in East Pakistan, that is to say, were not aimed solely at local “Urdu speakers” or more distant West Pakistani cinema halls.

Indeed there was a Bengali market for Urdu films. This is evident from […] the debates in the 1960s among Bengali filmmakers themselves about the reasons why Bengali audiences were not interested in Bengali films. The financial logic that so many point at to explain the making of Urdu films in East Pakistan is unlikely to have been predicated exclusively on audiences in far away multilingual but much less densely populated West Pakistan or non-Bengali Urdu speakers in the East. The dimensions of the market are hinted at by the fact that profit for East Pakistani films in the densely populated East Bengal was not in Bengali films but in Urdu films.

(Lotte Hoek, ‘Cross-wing Filmmaking: East Pakistani Urdu Films and Their Traces in the Bangladesh Film Archive’, BioScope: South Asian Screen Studies, Volume 5 Issue 2, July 2014, https://journals.sagepub.com/doi/abs/10.1177/0974927614547989)