ভাষাগত অতল গহ্বরে ভারত

0
684

সমস্ত ভারতীয় ভাষায় এর সর্বব্যাপী উপস্থিতি সত্ত্বেও, আধুনিক যুগে সংস্কৃত ভাষাকে দূরে সরিয়ে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে।

 

ভারতের কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী (Central Reserve Police Force) হ’ল বিশ্বের বৃহত্তম পুলিশ বাহিনী । ২০০৫ সালে এই মহান বাহিনীতে যোগদানের পরে, তার সমস্ত অফিসিয়াল সাইনবোর্ডে এক অদ্ভুত স্লোগান দেখতে পাই  “সিআরপিএফ সদা অজয়; ভারত মাতা কি জয়”( CRPF Sada Ajay; Bharat Mata Ki Jay) এক স্লোগানটি দেখার পর আমি খুব আনন্দিত এবং বিস্মিত হয়েছিলাম।  বিস্মিত হওয়া পিছনে আসলে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছিল, কারণ এটি ঘোষণা মাত্র পরোক্ষভাবে যার দ্বারা বোঝানো হয়েছে  সিআরপিএফ কখনই বিজয়ী হবে না এবং ভারত মাতার গৌরবের কারণ হয়ে উঠতে পারবে  না!  এটি একটি অনন্য ভাষাগত প্রকাশের উদাহরণ, যার দ্বারা একাধিক উপায়ের বদলে মাত্র একটি বাক্যের মাধ্যমে কয়েকটি শব্দের মধ্য দিয়ে ভাবটা সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো।

সংবিধানের ৩৫১ ধারায় ভারত ইউনিয়নকে মূলত হিন্দি ভাষা বিকাশের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কারণ স্বরূপ লিখিতভাবে বলা হয়েছে, “…যেহেতু হিন্দি ভাষার শব্দভান্ডারের অন্তর্গত বেশিরভাগ শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে গৃহীত হয়েছে…” কিন্তু  এর মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই, যেহেতু সংস্কৃত ভাষা হলো আদি ভাষা এবং সব ভারতীয় ভাষার শব্দভাণ্ডারের প্রাথমিক উৎস, ঠিক যেমন লাতিন ভাষা থেকে ইউরোপীয় ভাষাগুলোর উৎপত্তি হয়েছে ।  কিন্তু যখন জনসাধারণের শিক্ষা জ্ঞাপনের অংশ হিসাবে সংস্কৃতকে পড়ানো এবং শেখানোর কোনো সদিচ্ছা গ্রহণ করা হয় না, তখন এই সাংবিধানিক উদ্দেশ্য অর্জন করা ভীষণ ভাবে অসম্ভব।

আমাদের পূর্বপুরুষরা শত আগ্রাসন, কলহ, যুদ্ধ এবং অযাচিত অস্তিত্ব সংকটের মধ্যেও ভারতীয়তার প্রতি তাদের নিরন্তর ভালোবাসা ও অবিচল সংযুক্তির মধ্য দিয়ে আমাদের সভ্যতা জ্ঞান, গ্রন্থ ও নীতিগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।  যাই হোক, গত শতক জুড়ে তথ্যবিনিময়ের প্রভূত উন্নতি সত্ত্বেও আমাদের সামূহিক ‘অবিদ্যা’  বা “সাংস্কৃতিক অজ্ঞতা”(agnotology) মেকলেবাদের (Macaulayism) মাধ্যমে  সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

মেকলেবাদ হ’ল শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে প্রথাগত এবং প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা, দেশজ সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং কণ্ঠস্বরকে নিয়মিতভাবে মুছে ফেলার মাধ্যমে ভারতীয় মনের উপপনিবেশায়ন ঘটানো। আমাদের সম্মিলিত ‘অবিদ্যা’ একটি প্রক্রিয়া বা মাধ্যম। এটি আমাদের কাছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞাতসারে অবতীর্ণ হয়ে একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদেরকে নির্মূল করার লক্ষ্যে বিকশিত হয়। এই অবিদ্যারও রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রসারণ উভয়ই আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় করা হয়।

আমরা সর্বদা পূর্বনির্ধারিত জ্ঞান-ভিত্তিক সভ্যতার জ্ঞান অর্জন করেছি। শত বৎসরের চেষ্টায়, আমরা মূলত সংস্কৃত ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান ও সাহিত্যের একটি বিশাল সংগ্রহশালা তৈরি করা হয়েছিল।  আমাদের “ঋকবেদ” বিশ্বের প্রাচীন জ্ঞাত গ্রন্থগুলির মধ্যে একটি।  আমাদের “মহাভারত” এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘতম কবিতা রচিত। তাদের প্রাচীনত্বের চেয়েও বৃহৎ, প্রশস্ত, গভীর, পরিণতিশীল এবং সর্বোপরি আমাদের প্রাচীন গ্রন্থগুলির অমূল্য জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টি এককথায় অপ্রতিরোধ্য।

সবচেয়ে অবাক করে দেওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে আমরা আমাদের পাবলিক শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হিসাবে আমাদের মহান প্রাচীন গ্রন্থগুলি যেমন – বেদ, উপনিষদ, মহাভারত, রামায়ণ, অর্থশাস্ত্র বা পঞ্চতন্ত্র পাঠ্যপুস্তক হিসাবে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করি না বা পড়ায়ই না। যে গ্রন্থগুলি, যে কাউকে তাদের সভ্যতার জন্য গর্বিত করে তুলতে সক্ষম তা ধীরে ধীরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।  অন্য যে কোনও দেশে এ জাতীয় বিষয়কে “জাতীয় লজ্জা”-র বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হবে।  আমি বহুদূর পর্যন্ত যেতে পারি এটা বলার জন্য যে  আমাদের  সভ্যতার সঙ্গে চরম  বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছে। এখানে, আমি বলতে দ্বিধা বোধ করছি, আমরা এই অপকর্মটি করে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বোধ করি না বরং গর্ব করি।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১এ- ধারায় শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার (আর টি ই বা RTE ) হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।  আর টি ই একটা  প্রযুক্তি মাত্র। শিক্ষায় কোন বিষয়বস্তু পড়ানো হবে তা নিয়ে কোনই বক্তব্য নেই। কাজেই আর টি ই মেকলেবাদকে ভীষণ বিগুণিত করেছে।   কোনোপ্রকার ভনিতা বা ব্যজস্তুতি ছাড়াই বলা যায়, যে আমাদের মাতৃভাষা আমাদের অবজ্ঞার সমার্থক হয়ে উঠেছে। সর্বব্যাপী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবং ইংরেজি  শিক্ষায় পারদর্শীতার সাথে সাথে, মাতৃভাষায় আমাদের নিরক্ষরতা আমাদের অবজ্ঞার সাথে প্রতিযোগিতা করছে।

এক শতাব্দীরও আগে স্বামী বিবেকানন্দ মিশনারি শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বলে গেছিলেন,

“বালক বিদ্যালয়ে গিয়া প্রথমেই শিখিল তাহার পিতা মূর্খ, দ্বিতীয় শিখিল তাহার পিতৃপিতামহ সকলেই উন্মাদ ছিলেন, তৃতীয় শিখিল যে তাহার শিক্ষকরা সকলেই ভন্ড, এবং চতুর্থতঃ শিখিল যে তাহার যত আদি পবিত্র পুস্তক , সবেতেই ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা লেখা আছে! কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে এইভাবে শিখিতে শিখিতে বালক তাহার পিতৃ পিতামহের সংস্কৃতি থেকে চির বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মগর্ব সম্পন্ন একটি অপদার্থে পরিণত হইল।”

শ্রদ্ধেয়  আনন্দ কুমারস্বামী  ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিপদ সম্পর্কে অনেক আগে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন, তাঁর মতে:

“একটি প্রজন্মের ইংরেজী শিক্ষা আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য সমূলে উৎপাটন করার জন্য যথেষ্ট এবং আমাদের গোড়া বা শিকড় থেকে বঞ্চিত করে একটি ছদ্মবেশী, দোঁ-আশলা, ভাসা ভাসা শিক্ষিত করে তোলা হয় এবং ব্যাপারটা অনেকটা অন্ত্যজ শ্রেণীর প্যারিয়াহ প্রজাতির মতো যারা পূর্বাঞ্চলীয় বা পশ্চিমাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত নয়, অতীত বা ভবিষ্যতেও অস্তিত্ব নিশ্চিত নয়। ভারতের জন্য এই শিক্ষাব্যবস্থা সর্বাধিক বিপদ ডেকে আনবে। ভারতের আধ্যাত্মিক অখণ্ডতা হ্রাস পাবে। সমস্ত ভারতীয়দের কাছে জ্বলন্ত সমস্যা হচ্ছে, শিক্ষাগত সমস্যা যা সবচেয়ে কঠিন এবং দুঃখজনক সমস্যা।”

1921 সালের 20শে অক্টোবর, মহাত্মা গান্ধী বলেন,

“আমি পরিসংখ্যানকে সফলভাবে চ্যালেঞ্জ করে কোনপ্রকার ভয় ছাড়াই বলছি যে, ভারত আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশত বছর আগে যা নিরক্ষর ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি নিরক্ষর এখন। অনেকটা বর্মার মতো, কারণ ব্রিটিশ প্রশাসকরা যখন ভারতে এসেছিল, তখন তারা প্রকৃতিগত ভাবে যেরকম ছিল সেভাবে  যেমন তেমন জিনিসপত্রে হাতে না দিয়ে, তা নির্মূল করতে শুরু করেছিল।তারা মাটিটি আঁচড়ে ফেলে মূলের দিকে তাকাতে শুরু করে এবং পরে মূলকে ছেড়ে যায় এবং সুন্দর গাছটিও ধ্বংস হয়ে যায়।”

গান্ধীর এই মন্তব্য শ্রদ্ধেয় ধর্মপালকে উৎসাহিত করেছিল এবং তিনি ব্যাপকভাবে গবেষণা কার্য চালান এবং প্রাক ব্রিটিশ বিষয়ক তাঁর গবেষণামূলক কাজ The Beautiful Tree প্রকাশ করেন।

ভাষা নীতি নিয়ে গণপরিষদের বিতর্কগুলির তল্লাসি আমরা কেন এবং কীভাবে এই জাতীয় ভাষাগত অজ্ঞতার অতলে ডুবে গেলাম তা বুঝতে আমাদের সহায়তা করতে পারে।  পন্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র সংস্কৃত ভাষাটিকে সরকারী ভাষা হিসাবে উজ্জ্বলভাবে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন:

“…… .. আপন মহিমার সম্পর্কে তুমি মৃত,নিজ সংস্কৃতি ও সভ্যতায় মহৎ এবং মহান তার কাছে তুমি মৃত, সে সম্পর্কে তুমি অজ্ঞ।  তুমি আলেয়ার পিছনে ছুটে চলেছোএবং নিজের মহান সাহিত্যে থাকা সর্বোৎকৃষ্ট উপাদানটি  কখনোই উপলব্ধি করার চেষ্টা করোনি।  ভারতে বসবাসকারী কেউ সংস্কৃতকে উপেক্ষা করে পালাতে পারবে না। এমনকি হিন্দিকে এই দেশের রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য যে প্রস্তাবনাটি আপনি প্রস্তাবিত করেছেন  সেই অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন সংস্কৃত ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ সেই ভাষার শব্দভাণ্ডারে গ্রহণ করা হয়েছে। আপনি সংস্কৃতকে প্রকৃতপক্ষে এই পরোক্ষ স্বীকৃতি দিয়েছেন কারণ সংস্কৃত ব্যতীত আপনি অসহায় ও শক্তিহীন। “

সংস্কৃতিবান ও বুদ্ধিমান মানুষ হওয়ার কারণে ডঃ আম্বেদকর ঠিকই অনুভব করেছিলেন যে একমাত্র শক্তিশালী ও সম্পদশালী সংস্কৃত ভাষা আমাদের সভ্য পুনর্জাগরণের সেরা পন্থা হবে।  তিনি সমানভাবে সচেতন ছিলেন যে, অন্য কোনও ভারতীয় ভাষা বিজ্ঞান, কলা, আইন ও প্রশাসনের মাধ্যম হিসাবে যোগ্য হওয়ার ক্ষেত্রে সংস্কৃতের মতো এত বৃহৎ বহুমুখীতা ছিল না।  তিনি সম্ভবত সাংবিধানিক দোহাই  দিয়ে ইংরেজীকে চিরকাল ধরে রাখার সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্যটি বুঝতে পেরেছিলেন। সুতরাং, গণপরিষদে তিনি সংস্কৃতকে অফিশিয়াল ভাষা হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন কিন্তু পরে তা বিরোধিতার কারণে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন  পরবর্তী দিনে সভ্যতার পুনরুত্থান রোধ করতে সংস্কৃতকে জনশিক্ষা থেকে  অঘোষিত জননীতির মাধ্যমে ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হবে। তাঁর এই আশঙ্কায় পুরোপুরি সত্যি হয়েছিল।

আম্বেদকর সঠিক প্রমাণিত হয়েছিলেন‌। সংস্কৃত ভাষার দ্বারা মাতৃসুলভ পুষ্টির বঞ্চনার অভাবে হিন্দি এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষাগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে অনাথ হয়ে পড়েছে।যদিও ইস্রায়েল একই সময়ের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মৃত হিব্রু ভাষাকে  পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছে। এই দুইয়ের মধ্যে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য ! হিন্দি ভাষার  উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ভাষা থেকে। ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনের সাথে একনাগাড়ে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু তার নিজস্ব প্রাণশক্তিটি হারিয়েছে এবং সরকারী ভাষা হিসেবে রয়ে গেছে। যদিও উপনিবেশীয় ভাষা ইংরেজী এখনও সবকিছুর ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করে রেখেছে।

ওনাম হচ্ছে তাঁর ‘প্রজা’র মঙ্গল সম্পর্কে নিজেকে সন্তুষ্ট করতে পুণ্যময় রাজা মহাবালির বার্ষিক সফরের স্মরণে একটি জনপ্রিয় উৎসব। তেমনি, গান্ধীর দেড়শতম জন্মবার্ষিকী দিয়ে শুরু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার খবরাখবর সঠিক পরিসংখ্যান নেওয়ার জন্য গান্ধীজীর ‘আত্মা’ কে আহ্বান করে আমাদের নতুন ওনাম শুরু করা উচিত,যাতে করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে বিস্তৃত অবিদ্যা, সভ্যতা নির্মূল করে রেখেছে এবং সর্বোপরি মাতৃভাষা সম্পর্কে নিরক্ষরতা তৈরি করছে,আশা করা যায় অন্তত মহাত্মার প্রতি শ্রদ্ধার সাথে এই বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে ।

উল্লেখযোগ্য ব্যপার হচ্ছে যে, আমি ইংরেজিতে লিখতে বিব্রত বোধ করি তবে আজ আমার কাছে অন্য কোনও বিকল্প আছে কি?

  লেখক এম নাগেশ্বর রাও বরিষ্ঠ আই পি এস অফিসার। মতামত ব্যক্তিগত। মূল ইংরাজী থেকে অনুবাদ করেছেন দীপান্বিতা।