কাশীর বিদ্যার্থীরা নন, জনাব শামিম আহমেদরাই আসল বিদ্বেষী

কয়েকদিন ধরে পৃথিবী তোলপাড়। আনন্দবাজার বিক্ষুব্ধ। জনাব শামিম আহমেদ কাশীর বিদ্যার্থীদের আকাট মূর্খ বলছেন। ব্যাপার আর কিছুই নয় কাশীর ধর্মবিজ্ঞান বিভাগে (আজ্ঞে হ্যাঁ, সংস্কৃত নয়) ফিরোজ খান নামক এক মুসলমান অধ্যাপককে ওবিসি কোটায় নিয়োগ করা হয়েছে। কাশীর বিদ্যার্থীরা সবিনয়ে জানিয়েছেন যে ফিরোজ খান সংস্কৃতজ্ঞ এবং তাঁকে সংস্কৃত বিভাগে রাখা হলে কারুর কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ধর্মবিজ্ঞান বিভাগে এমন কাউকে রাখা প্রয়োজন যিনি হিন্দু এবং হিন্দুধর্মকে সেভাবেই দেখবেন।

হিন্দুদের প্রতি অসমব্যবহার

খ্রীষ্টান মিশনারী কলেজগুলি সরকারী সাহায্যে চলে। কিন্তু আকছারই হয় যে এই সব কলেজের পদগুলি খ্রীষ্টানদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। দিল্লীর সেণ্ট ষ্টিফেন্স কলেজ ৯৫ ভাগ সরকারী আনুকূল্যে চলে কিন্তু ৫০ ভাগ সীট খ্রীষ্টনদের জন্য সংরক্ষিত। আলিগড়ের মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনদিন কোন অমুসলমান অধ্যক্ষ হন নি। সংখ্যাগুরু হিন্দুর দেশে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যলয়ে হিন্দু অধ্যাপক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

অধিক কি দিল্লীর জিসাস ও মেরী কলেজের অধ্যক্ষের বিজ্ঞাপনটি দেখুন। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে স্পষ্টই বলা হচ্ছে যে ক্যাথোলিক খ্রীষ্টান ছাড়া কেউ অধ্যক্ষ পদের জন্য আবেদন করতেও পারবেন না। আলিগড়ে শিয়া এবং সুন্নী ধর্মচর্চার দুইটি বিভাগ আছে।সুন্নী বিভাগে কোনদিন অমুসলমান দূরস্থান, কোন শিয়া অধ্যাপকও নিয়োগপ্রাপ্ত হন নি। আর শিয়া বিভাগেও এক কাহন। কিন্তু আনন্দবাজার বা শামিম আহমেদ এদের নিয়ে চিন্তিত নন। ওঁদের এক কথা, সংখ্যাগুরুরা এ দেশে কত্ত খারাপ!

নিয়োগে দুর্নীতি?

বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন গবেষক-ছাত্র এবং বর্তমানে নাগপুরের এক অধ্যাপক সৌরভ দ্বিবেদী এই নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ করছেন। ২৬ জন হিন্দু ওবিসি উচ্চমানের ছাত্রকে সরিয়ে রেখে ফিরোজ খানকে নিয়োগের পিছনে এই দুর্নীতির তদন্ত আবশ্যক, তিনি বলছেন

কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস

ম্যাকলের শিক্ষা ভারতকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল বলে পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা করেন ১৯০৬ সালে। কাশীর সুপ্রাচীন শিক্ষা সংস্কৃতিকে উদ্ধার করা এবং হিন্দু সমাজকে পথ দেখাবার জন্য ছিল এনার পণ। তিনি বৃটিশের কাছ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ নিতে অস্বীকার করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ অর্থ হিন্দু সমাজ যোগান দেয়।

কাশীতে ভারতীয় সভ্যতামূলক দুইটি বিভাগ আছে। সংস্কৃত এবং ধর্মবিজ্ঞান। ধর্মবিজ্ঞান শাখার প্রবেশপথে লিখিত আছে (উপরে প্রদত্ত) যে সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাড়া বাকীরা এই বিভাগে প্রবেশ করার অধিকারী নন।

ভারত স্বাধীন হবার সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি (এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়) নিয়ে সংবিধান নিয়ামক সভায় বিতর্ক হয়। এই বিশ্বাবিদ্যালয়গুলি কি  নিজ নিজ পথে চলবেন না কি তাঁদের সেকুলার হতে হবে? এর উত্তরে ডঃ আম্বেদকর বলেন যে

“Now, Sir, there is one other point to which I would like to make reference and that is the point made by Prof. K. T. Shah that the proviso permits the State to continue to give religious instruction in institutions the trusteeship of which the State has accepted. I do not think really that there is much substance in the point raised by Prof. Shah. I think he will realise that there have been cases where institutions in the early part of the history of this country have been established with the object of giving religious instruction and for some reason they were unable to have people to manage them and they were taken over by the State as a trustee for them. Now, it is obvious that when you accept a trust you must fulfil that trust in all respects. If the State has already taken over these institutions and placed itself in the position of trustee, then obviously you cannot say to the Government that notwithstanding the fact that you were giving religious instruction in these institutions, hereafter you shall not give such instruction. I think that would be not only permitting the State but forcing it to commit a breach of trust. In order therefore to have the situation clear, we thought it was desirable and necessary to introduce the proviso, which to some extent undoubtedly is not in consonance with the original proposition contained in sub-clause (1) of article 20”

সংক্ষেপে আম্বেদকরের কথার অর্থ হল,

  • এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মের পঠনপাঠন চলবে।
  • পণ্ডিত মালব্যজী যে রকম বিচারধারা রেখেছেন, তাও বজায় থাকবে।

স্পষ্টই হচ্ছে যে ধর্মবিজ্ঞান শাখায় মুসলমান অধ্যাপক সংবিধান পরিপন্থী। মজার কথা, জনাব ফিরোজ খান যিনি এই বিভাগে নিয়োজিত হয়েছেন, তিনি নিজেই বলছেন যে রামের জীবনীর সাথে নাকি হিন্দুধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। সিরাতে রাসুলাল্লা কি কোন সেকুলার বিভাগে পড়ানো হয়?

 

কেন ম্যাক্সমুলার, আল-বিরুনী এঁরা সংস্কৃত শেখেন?

হ্যাঁ, ভাষা আর ধর্ম সম্পূর্ণ পৃথক। সেই জন্যই ধর্মবিজ্ঞান শাখার স্থাপনা যাতে সেখানে ধর্মের শিক্ষা দেওয়া যায়। অধ্যাপক সৌরভ দ্বিবেদীর মতে এই বিভাগে সংস্কৃত সাহিত্য নয়, প্রায়োগিক ধর্মের শিক্ষা দেওয়া হয়। এবার জনাব শামিম প্রভৃতি অনেকে বলছেন কেন ম্যাক্সমুলার সংস্কৃত শিখেছেন, তাঁরা কি অনেক বড় হিন্দু নন? এ কথা একেবারেই অসার। ম্যাক্সমুলার প্রভৃতিদের ইউরোপীয়রা নিয়োগ করেছিল ভারতের শিক্ষা সংস্কৃতি বোঝার জন্য। হ্যাঁ ম্যাক্সমুলার নিশ্চয়ই সংস্কৃতজ্ঞ, কারণ তাঁর কাজই ছিল সংস্কৃত আর ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইউরোপের সহজপাচ্য করা। তার মানে কিন্তু ম্যাক্সমুলার হিন্দুধর্ম বিশারদ হলেন না। অর্ধ নিরক্ষর গদাধরকে আমরা ধর্মগুরু মেনে নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলি, ম্যাক্সমুলারকে নয়।

আল-বিরুণী ছিলেন দ্বাদশ শতকের এক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, পুরাণজ্ঞ। কিন্তু তিনি রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেছেন কিভাবে গজনীর মামুদ সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন করেছিলেন। মামুদের  হাতে হিন্দুদের সহস্রে সহস্রে নিপাত যাবার কাহিনীতে তাঁর হর্ষ আর প্রীতি উথলে পড়েছিল।

শোলডন পোলোক এইরকম এক সংস্কৃতজ্ঞ। ইনি সংস্কৃত ভাষার কথোপকথনের প্রসারের ভীষণ বিরোধী, বিভিন্ন বিভাগে সংস্কৃত পড়ানোরও বিরোধী। ইনি কাশ্মীর ৩৭০ ধারা লোপের বিরোধী। ভারতকে ভারত না বলে দক্ষিণ এশিয়া বলতে চান। কাজেই সংস্কৃত পড়লেই ধার্মিক কেউ হয় না।

 

জনাব শামিম আহমেদ সমীপেষু

জনাব শামিমের মতে

যে দেশে কল্পনা কিংবা মহাকাব্যের নায়কের জন্মস্থান পরাজিত করে ইতিহাসকে, যে ভূমির আইনে যুক্তির উপরে স্থান পায় বিশ্বাস, সেখানে ফিরোজ খানকে সংস্কৃত পড়াতে দেওয়া হবে না এবং কেন তিনি বৈদিক সাহিত্য পড়াবেন, এমন সব প্রশ্ন তোলা সহজ এবং তার ‘বৈধতা’ পাওয়া আরও সহজ।

তাহলে ওনার মতে রামমন্দিরের সুপ্রীম কোর্টের রায়ের পিছনে আছে বিশ্বাস। জনাব তো আইনজ্ঞ বা ইতিহাসজ্ঞ নন, তাই ওনার এই ভ্রান্তিকে ক্ষমা করে দেওয়াই যায়। না, সুপ্রীম কোর্টের রায়ের পিছনে আছে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন যা দেখিয়েছে বাবরি মসজিদের নীচে আছে পুরানো মন্দির। কে কে মুহম্মদ, ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থানের আঞ্চলিক অধিকর্তা নিজে জানিয়েছেন স্বচক্ষে দেখা বিষ্ণুমন্দিরের কথা।

প্রশ্ন হল, জনাব আপনি তো বেদান্তের অধ্যাপক, সকলের ব্যথা নিজের মনে করার কথা। রাম মন্দিরের বিরোধী হতে পারে সেই মুসলমান যে আল্লার রাজত্ব স্থাপন করতে কাফেরদের প্রতিটি মন্দিরের নিকেশ চায়, অথবা সেই লিবারেল যে হিন্দুদের নিকেশ করে সেকুলার রাজ চায়। মহাভারত পাঠী আপনি কি তাই চাইতে পারেন? নিশ্চয়ই নয়, তাহলে আপনার বেদান্ত তো খালি পেটকোওয়াস্তে হয়ে যাবে, নয় কি? অবশ্য এটা ঠিক যে আপনি ধর্ষক শিশুপালের সহমর্মী, কৃষ্ণের নন। কি ভাগ্যিস্ আপনি ধর্মবিজ্ঞান পড়ান না?