“সর্বোচ্চ আদালতের নবতম সিদ্ধান্ত ২০১৮ র রায়টিকে কার্যত বাতিল করে দিয়েছে”, বললেন শবরীমালা মামলার আইনজীবী জে সাই দীপক

0
497

এক নজরে

  • সর্বোচ্চ আদালতের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের পর ২০১৮ র রায় কার্যকর করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। কেরালা সরকারের সাবধান হওয়া উচিৎ।
  • “অপরিহার্য ধর্মীয় রীতিনীতি জাতীয় একশৈল ধারণার প্রয়োগে হিন্দু ধর্মের আব্রাহামীকরণ ঘটছে, কারণ এতে হিন্দু ধর্মের বৈচিত্র্য, বিবিধতার কোনো স্বীকৃতি নেই।
  • সংবিধানকে অপরিবর্তনীয় বলে দাবি করলে, কিংবা তার উপর স্থায়িত্বগুণ আরোপের চেষ্টা করলে তা সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের আদর্শের বিরুদ্ধেই যায়।

মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) নিজেদেরই পূর্বতন একটি রায়কে (সেপ্টেম্বর ২০১৮) প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এবং আরও চার বিচারক যথা রোহিন্টন নরিম্যান, এ এম খানউইলকর, ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং ইন্দু মলহোত্রার বেঞ্চ ৩-২ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পুরো বিষয়টির ভার অন্তত সাত বিচারপতির এক বৃহত্তর বেঞ্চের হাতে অর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিচারপতি নরিম্যান ও চন্দ্রচূড় বিরুদ্ধ মত ব্যক্ত করেন।

শবরীমালা সহ সাম্প্রতিক কিছু রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু জটিলতা প্রকাশ্যে এসেছে, যেগুলি সামলানোর জন্য বৃহত্তর একটি বেঞ্চকেই উপযুক্ত সাব্যস্ত করা হয়েছে সংখ্যাগুরু রায়ে। সংবিধানের ধারা ২৫ ও ২৬ এ আলোচিত ধর্মচর্চার স্বাধীনতা (যা কিনা ধারা ১৪ এ আলোচিত মৌলিক অধিকার থেকেই উদ্ভূত) এবং অনুচ্ছেদ ২৫(১) এ ব্যবহৃত “সার্বিক শান্তি, সুরক্ষা, নৈতিকতা ও সুস্বাস্থ্য” শব্দবন্ধের প্রযোজ্যতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অতএব, “অপরিহার্য ধর্মীয় রীতিনীতি” বিষয়ে “নৈতিকতা” বা “সাংবিধানিক নৈতিকতা” কতদূর ব্যবহার্য, তা নিরূপণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

রায় ঘোষণার পর, ওইদিনই স্বরাজ্য কথা বলেছিল শবরীমালা মামলায় পান্ডালম রাজপরিবার এবং ধর্ম ও চেতনা পক্ষের আইনজীবী জে সাই দীপকের সঙ্গে। আমরা বুঝতে চেয়েছিলাম আয়াপ্পা স্বামীর ভক্তবৃন্দের কাছে এই রায়ের মানে কী, এবং জটিল প্রশ্নগুলি একসাথে বৃহত্তর এক বেঞ্চের সামনে রাখার অর্থই বা কী।

 

প্র. ৩-ভোটে, শবরীমালা মামলার পুনর্বিবেচনার আর্জিগুলো অধিক সদস্যের এক বেঞ্চের আওতায় আনা হলএই রায় কীভাবে দেখছেন?

উ. দেখুন, আমি এই মামলায় যাঁদের প্রতিনিধিত্ব করি, সেই পান্ডালম রাজপরিবার এবং ধর্ম ও চেতনা পক্ষ মনে করে এই সিদ্ধান্তে তাঁদেরই অবস্থান সমর্থিত হয়েছে। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ র রায়ের ব্যাপারে প্রথম থেকেই তাঁরা বলে এসেছেন যে রায়টি যথেষ্ট দুর্বল, কারণ তা ধর্মজীবনে একটি সাধারণ মন্দিরের মৌলিক ভূমিকা এবং শবরীমালা আয়াপ্পা মন্দিরের বিশেষত্ব – দুইই অনুধাবন করতে ব্যর্থ। শবরীমালার অধিষ্ঠাতা দেবতার বিশেষ প্রকৃতির জন্যই এই মন্দির অন্যরকম।

২০১৮ র রায়ে ধর্মনিরপেক্ষ আদালত আবারও একবার তাঁদের নিজস্ব মাপকাঠিতে ধর্মাচার ও ধর্মচর্চায় বদল আনার চেষ্টা করেছিলেন, যদিও সে কাজে তাঁদের ঠিক উপযুক্ত বলা যায় না বোধহয়। আবার এও দেখা গেছিল যে মন্দিরে সম্পূর্ণ বিশ্বাসহীন কিছু ব্যক্তি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করছিলেন।

নির্দিষ্ট ভাবে বললে, আর্জিতে আমরা তুলে ধরেছি কেন আইন ৩(খ), যা পূর্বের রায়ে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করা হয়েছিল, শবরীমালা মন্দিরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই সমস্ত কারণেই নানা প্রশ্ন উঠে আসে (সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে উল্লিখিত), আর তাই আমাদের আর্জি গৃহীত হয়।

আজকের রায়ে স্পষ্টভাবেই ২০১৮ র রায়ের বিভিন্ন অংশ নিয়ে আপত্তি প্রকাশ পেয়েছে, আর তাই যতক্ষণ না বৃহত্তর বেঞ্চ মামলার নিষ্পত্তি করেছেন, ওই রায়ের বলবৎযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে। আমার ধারণা আবেদনকারীরা সকলূই এই রায়কে স্বাগত জানাবেন। সামনের ১৬ নভেম্বর মন্দির খুলবে এবং তীর্থযাত্রার পুণ্যপর্ব শুরু হবে, সকলের চোখ এখন সেদিকেই।

 

প্র. অধিকাংশ বিচারপতিই সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের আগের রায় নিয়ে খুব একটা নিশ্চিত ননতাহলে পূর্বতন রায়ের উপর একটি স্থগিতাদেশ তো জারি করাই যেত, তাই না?

উ. আমাদের মনে হয়, আজকের সংখ্যাগুরু রায়ের অনুচ্ছেদ ৪-৮ এ উত্থাপিত প্রশ্নগুলি সরাসরি পূর্বের রায়ে ব্যবহৃত তথ্য, আইনি ভিত্তি ও স্বতঃসিদ্ধগুলিকে আঘাত করছে।

তাছাড়া, পুনর্বিবেচনার সমস্ত আর্জি ও পূর্ববর্তী লিখিত আবেদনগুলির ভার আরও বেশি সদস্যের একটি বেঞ্চকে দেওয়ার অর্থ এই যে, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কখনোই আগের সিদ্ধান্ত লাগু করা যাবে না।

সুতরাং, এ মামলায় যে রায় এখনো বহাল রয়েছে তা হল ১৯৯১ এ এস মহেন্দ্রন বনাম ত্রিবাঙ্কুরের সচিবের মামলায় কেরালা উচ্চ আদালতের রায়, যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে জননে সক্ষম বয়সের মহিলাদের শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশ করতে না দেওয়ার প্রথা সাংবিধানিক এবং অধিষ্ঠাতা দেবতার প্রকৃতির সাথে সরাসরি জড়িত। শুনুন কেরালা উচ্চ আদালতের রায়, যা কার্যকর করা কেরালা সরকারের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি –

“৪৪. আমাদের সিদ্ধান্তগুলি এই –

১. ১০-৫০ বছর বয়সী মহিলাদের পবিত্র পাহাড়ে ওঠা এবং শবরীমালা মন্দিরে পূজা দেওয়ার উপর যে নিষেধ রয়েছে, তা আবহমান কাল ধরে প্রচলিত প্রথার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

২. দেবাস্বম বোর্ডের এই নির্দেশিকা ভারতীয় সংবিধানের ধারা ১৫, ২৫ ও ২৬ এর পরিপন্থী নয়।

৩. এই নিষেধাজ্ঞা হিন্দু উপাসনালয় (প্রবেশাধিকার) আইন, ১৯৬৫ এর বিরুদ্ধে নয়। কারণ, এখানে দুই গোষ্ঠী বা দুই শ্রেণির মধ্যে বিভেদ রা হয় নি। এমনকী, কেবল নির্দিষ্ট বয়সের নারীদেরই মন্দিরে ঢোকা বারণ, সমগ্র নারীজাতির নয়।

৪৫. এই সকল সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বাদী পক্ষ অর্থাৎ ত্রিবাঙ্কুর দেবাস্বম বোর্ডকে নির্দেশ দিচ্ছি যাতে বছরের কোনো সময়েই ১০-৫০ বছর বয়সী মহিলাদের সংশ্লিষ্ট পাহাড়ে উঠতে বা মন্দিরে পূজা দিতে না দেওয়া হয়। তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ কেরালা সরকারকে নির্দেশ দিচ্ছি যেন আগের নির্দেশ কার্যকর করতে পুলিশ শহ সবরকম সাহায্য দেবাস্বম বোর্ডকে দেওয়া হয়।”

 

প্র. যতদিন না পরবর্তী বেঞ্চে শুনানি শুরু হচ্ছে, ততদিন তো বিষয়টি বিচারাধীনও নয়তাহলে কি এই সময়ের মধ্যে [কেন্দ্র] সরকার পুণ্যার্থীদের ভাবাবেগ সুরক্ষিত করতে আইন আনতে পারে? তা কি উচিৎ হবে? এদিকে কেরালা সরকার তো বলছে স্থগিতাদেশ না থাকায় তারা গত বছরের আদেশই পালন করবে

উ. এ বিষয়ে এখন কেরালা সরকারও ভাবনাচিন্তা করছে আবার, কারণ নতুন রায় পড়ে তারাও বুঝেছে আগের রায়ের বৈধতা, ও তাই কার্যকারিতা প্রশ্নাতীত নয়। তাই আমার বিশ্বাস তারা সতর্কভাবেই পদক্ষেপ নেবে।

অন্যদিকে, আজকের সিদ্ধান্তে আরও বিভিন্ন সম্পর্কিত বিষয় সংশ্লিষ্ট আলোচনার বৃত্তে চলে এসেছে। তাই অনেকেই চাইছেন কেন্দ্র সরকার আদালতের আগেই হস্তক্ষেপ করে শবরীমালা মন্দির মামলা সহ সমস্ত ধর্মীয় প্রথা নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করুক। তার সুযোগও যথেষ্ট।

২০১৯ এ ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নির্বাচনী ইস্তেহারে যখন শবরীমালা মন্দির নিয়ে বিতর্কটি স্থান পেয়েছিল, তখন কেরালায় আয়াপ্পা ভক্তদের দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির উপর এই রায়ের প্রভাব কী হবে তা বোঝার চেষ্টাই তারা এখন করছে বলে ধরে নেওয়াই যায়।

 

প্র. অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে বিবিধ বিষয় (দরগা-মসজিদে মুসলিম মহিলাদের প্রবেশ, অপার্সী পুরুষদের সাথে বিবাহিত পার্সী নারীদের এজিয়ারিতে প্রবেশ এবং দাউদি বোহরা জনগোষ্ঠীতে স্ত্রী যৌনাঙ্গ কর্তনের প্রথা) শবরীমালা বিতর্কের সাথে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা রয়েছেবিচারপতি নরিম্যান বলছেন, মামলার আর্জিতে বিষয়গুলি ছিলও না, এবং বিষয়গুলি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন বেঞ্চের বিচারাধীনএই মামলার সাথে ওইসব বিচারাধীন বিষয়গুলো একত্রিত করা কি আদৌ আইনসম্মত? যেখানে শবরীমালার সাথে এদের আকাশ – পাতাল তফাৎ, সেখানে এদেরকে এক খোপে রাখা তত্ত্বগতভাবেও ঠিক হল কি?

উ. আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত ২০০৬ এর প্রাথমিক লিখিত আর্জিগুলোর আলোকে বুঝতে হবে। সে সময় আবেদনকারীরা কী ধরণের সুরাহা চেয়েছিলেন তা তা জানা দরকার। আদালতের নথি থেকে ১৩ অক্টোবর ২০১৭ র রায়ের সেই অংশটি তুলে দিলাম, যেখানে প্রাথমিক আর্জি উদ্ধৃত রয়েছে। প্রসঙ্গত, সেদিনের রায়েই মামলাটি তিন বিচারপতির বেঞ্চ থেকে এক সাংবিধানিক বেঞ্চের হাতে অর্পিত হয়।

“ভারতীয় সংবিধানের ধারা ৩২ কর্তৃক অনুমোদিত এই জনস্বার্থ মামলায় আবেদনকারীরা প্রার্থনা করেছেন যেন আদালত কেরালা সরকার, ত্রিবাঙ্কুর দেবাস্বম বোর্ড, শবরীমালা মন্দিরের প্রধান তন্ত্রী, পাঠানমথিত্তার জেলাশাসক ও তাদের আধিকারিকদের যথাবিহিত নির্দেশ দেন যাতে শবরীমালার মন্দিরে ১০-৫০ বছর বয়সী মহিলা পুণ্যার্থীদের প্রবেশাধিকার সুনিশ্চিত হয়, যা প্রথাগত ভাবে এতদিন তাঁরা পেতেন না। এছাড়া কেরালা হিন্দু উপাসনালয় (প্রবেশাধিকার) আইন, ১৯৬৫ এর খণ্ড ৪ এর আধারে প্রস্তুত কেরালা হিন্দু উপাসনালয় (প্রবেশাধিকার) সংক্রান্ত নিয়মকানুন এর নিয়ম ৩(খ) কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার দাবি তাঁরা রেখেছেন, কারণ তা ভারতীয় সংবিধানের ধারা ১৪, ১৫, ২৫ ও ৫১ক(ঙ) র পরিপন্থী। মহিলা তীর্থযাত্রীদের সুরক্ষা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়ার আবেদন তাঁরা করেছেন, এবং প্রার্থনা করেছেন যেন ধর্মীয় উপাসনালয়ের রীতিনীতির সাথে জড়িত অসাম্যের বিষয়ে একটি সাধারণ নির্দেশিকা জারি করা হয়।”

ফলে, আলোচনার ক্ষেত্রটি বড়ো করে সংখ্যাগুরু রায়ে ভুল কিছু করা হয় নি। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক আদালত ধর্মচর্চা, ধর্মতত্ত্ব এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অপরিহার্য ধর্মাচারের প্রশ্নে কতদূর হস্তক্ষেপ করতে পারে, বৃহত্তর পরিসরেই তা জানা জরুরি।

মনে হয় এই লক্ষ্যেই সমস্ত কিছু এক সাথে করে বৃহত্তর বেঞ্চের সামনে রাখা হল। পান্ডালম রাজপরিবার এবং ধর্ম ও চেতনার আবেদন পত্রে স্পষ্ট ভাবেই দাবি করা হয়েছে যে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ র রায়ে হিন্দু ধর্মের আব্রাহামিকরণ ঘটেছিল। আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালত সাবধান হবেন এবং এক ধর্মের মাপকাঠিতে অন্য ধর্মের বিচার করতে যাবেন না।

সংখ্যালঘু রায়ের ব্যাপারে বলতে চাই, মহামান্য বিচারপতিরা মূল প্রাথমিক আর্জিখানি পড়ে তার ব্যাপ্তি অনুধাবন করার চেষ্টা করলে ভালো করতেন। মামলাটি শবরীমালাতে সীমাবদ্ধ থাকবেই বা কেন, এই প্রশ্নটাই দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের মনে আসছেই না।

 

প্র. প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ লিখেছেন, ভারতের সমাজ বহুধা বিচিত্রএখানে একই ধর্মমতের দুই গোষ্ঠীও একই দেবতার পূজা পদ্ধতি বা প্রথা নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেই পারেনঅতীতে কিন্তু সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় প্রায়শই দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আবশ্যকীয় ধর্মীয় প্রথা নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন, তাহলে এই বক্তব্যে কি সেই প্রচেষ্টাকেই কাঠগড়ায় তোলা হল?

উ. ঠিক তাই। আমি তো মনে করি এই বক্তব্য আত্মসমালোচনার লক্ষ্মণ। হয়তো মহামান্য আদালত উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে ধর্মীয় বিষয়ে ঘন ঘন হস্তক্ষেপ করে তাঁরা ভক্তদের অধিকার ও তাঁদের কাছে অমূল্য ধর্মকর্মকেই বিপন্ন করে ফেলেন অনেক সময়। এই আত্মসমালোচনা থেকেই আশা করি ধর্মীয় ব্যাপারে বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপের একটি সীমা নিরূপিত হবে, যা সংবিধান – প্রতিশ্রুত ধর্মাচরণের অধিকারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

 

প্র. বিচারপতি আর এফ নরিম্যান কিন্তু দাবি করেছেন, “সংশ্লিষ্ট প্রথা হিন্দু ধর্মের পক্ষে অপরিহার্য কি না, তাই আদালতের বিচার্য, মন্দিরের বিশেষত এক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়।” এই উক্তি অবশ্যই বহু ঈশ্বরবাদী হিন্দু ধর্মের বিবিধতা তথা প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সাথে খাপ খায় নাঅত্যাবশ্যক ধর্মীয় প্রথা নিয়ে বিধান দেওয়ার পক্ষে আদালত কতটা উপযুক্ত বা অনুপযুক্ত সেটাই তো তাহলে সন্দেহাধীন হয়ে গেল?

উ. বিচারপতি নরিম্যানকে সম্মান জানিয়েই আমি তাঁর মতামতের প্রতি অসম্মতি জ্ঞাপন করতে চাই। ঠিক এই সমস্যাটিই আমরা পুনর্বিবেচনার আর্জিতে তুলে ধরেছি। আমাদের মনে হয়, এই একশৈল দৃষ্টিভঙ্গির জন্য হিন্দু ধর্মের আব্রাহামীকরণ ঘটছে, কারণ একই ধর্মের ভেতর প্রচুর সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব তথা সাম্প্রদায়িক বৈচিত্র্য উপেক্ষিত হচ্ছে। আশা করি পরবর্তী বৃহত্তর বেঞ্চ এই সমস্যার স্থায়ী, বোধগম্য সমাধান করতে সফল হবেন।

 

প্র. সংবিধানের হিন্দি সংস্করণে ধারা ২৬ এ “সম্প্রদায়” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, এবং ইংরেজি সংস্করণে “ডিনমিনেশন” শব্দটিআপনি বলেছেন, হিন্দি শব্দটির ভাবনা উপেক্ষা করে ইংরেজি শব্দটি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা আদালতের ভুল হয়েছে। কারণ, হিন্দি শব্দটি ধর্ম নয়, বরং ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নির্দেশ করে। কিন্তু, বিচারপতি নরিম্যান ও চন্দ্রচূড় আপনার যুক্তি খারিজ করে বলেছেন যে “রিলিজিয়াস ডিনমিনেশন” বলতে কী বোঝায় তা আদালতের আগের বিভিন্ন রায়ে যথেষ্ট স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে “রিলিজিয়াস ডিনমিনেশন কী” এবং “আদালত কারোর ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করতে পারে কি না” – এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও কি বৃহত্তর বেঞ্চের কাছে আশা করছেন?

উ. অবশ্যই করছি। সংখ্যাগুরু রায়ে নথিভুক্ত প্রশ্নগুলো যতটা পরিব্যাপ্ত, তাতে এই প্রশ্নদুটোর উত্তর দেওয়া আবশ্যিক বলেই মনে করি। হিন্দু ধর্মের কাছে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ হিন্দু ধর্মের সম্প্রদায় আর আব্রাহামীয় “রিলিজিয়াস ডিনমিনেশন” এ বিস্তর ফারাক। এক ধর্মের ধ্যান ধারণা অন্য ধর্মে প্রয়োগ করতে পারেন না মহামান্য আদালত। হিন্দু ধর্ম আব্রাহামীয় নয়, কোনোদিন হবেও না। এই বিশেষত্ব মাথায় রেখে তাই আশা করছি সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় সকল ধর্মের জন্য সমান মাপকাঠি তৈরি করতে গিয়ে হিন্দু ধর্মের আব্রাহামীকরণ ঘটিয়ে বসবেন না।

 

প্র. শিরূর মঠ মামলায় (১৯৫৪) সর্বোচ্চ আদালতের সাত বিচারপতির বেঞ্চ বলেছিলেন, অপরিহার্য ধর্মানুষ্ঠান কোনগুলি, তা নির্ধারণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। অথচ এই মত পরবর্তীতে গৃহীত “অপরিহার্য ধর্মীয় প্রথা” শীর্ষক নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। এ যাত্রায় কি তাহলে সাতের বেশি বিচারপতির বেঞ্চ দেখতে পাব আমরা?

উ. ওই মামলায় যা বলা হয়েছিল আর দরগা কমিটি কিংবা শবরীমালা মামলায় (২০১৮) যে রায় দেওয়া হয়েছে তা পরস্পরবিরোধী। সাত বিচারপতির বেঞ্চ নিশ্চয়ই শিরূর মঠ – পরবর্তী মামলাগুলি পুনর্বিবেচনা করে ওই মামলায় করা পর্যবেক্ষণের সাথে বর্তমান নীতি বা আইনের সামঞ্জস্য আনতে সক্ষম হবেন। তাছাড়া, এতে করে শিরূর মঠের প্রকৃত আমদানি নিয়ে অনেক ভুল ধারণার অবসান হবে।

 

প্র. বিচারপতি নরিম্যান ও চন্দ্রচূড় বলেছেন ভারতীয় সংবিধান প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের কাছে পবিত্র। ইদানীং এই ভাবনা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এরকম চিন্তা কতটা স্বাস্থ্যকর?

উ. দিনের শেষে আমরা মনে করি, ধর্মীয় হোক বা বিচারবিভাগীয়, ভিন্ন মতকে সম্মান করথেই হবে। একথা ঠিক যে আমাদের সকলকেই সংবিধানের কাঠামো মেনেই চলাফেরা করতে হয়। সাথে সাথেই বলব, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও কিছু সংবিধান বিরোধী নয়, এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ র সিদ্ধান্তে তার প্রতি সুবিচার হয় নি, সেটাও সংবিধানের দৃষ্টিতেই। সোজা কথায়, আমাদের অবস্থান অসাংবিধানিক বা অতিসাংবিধানিক মোটেও নয়। সংবিধান, যা সংখ্যালঘু রায়ে “পবিত্র গ্রন্থ” বলে বর্ণিত, তা আমাদের সকলকেই সুরক্ষা দেয়।

তাই বলে এও ভুলে গেলে চলবে না যে সংবিধান ইতোমধ্যেই শতাধিক বার সংশোধিত হয়েছে নানাবিধ কারণে। নেহরু – গান্ধী পরিবারের আমলে তো কেবল রাজনৈতিক কারণেই একাধিক বার পরিবর্তিত হয়েছে এই গ্রন্থ। সুতরাং, এখন একে স্থায়ী বা অপরিবর্তনীয় বলে ধরে নিলে তা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিকতার পথে অন্তরায় হয়ে পড়বে।

আচ্ছা বলুন তো, ভারতীয় বা দেশজ যে কোনো আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় রীতি – প্রথার সমর্থনে যে কোনো অবস্থানকেই অসাংবিধানিক ঠাউরে নেওয়ার অর্থ ঠিক কী? ভারতীয় সংবিধান ধর্মের সাথে চুক্তিবদ্ধ, এবং সংবিধানের ছত্রে ছত্রে তা পরিস্ফূট। আশা করি বিচারবিভাগ চুক্তির শর্তগুলিকে সম্মান করে চলবেন, “সাংবিধানিক নৈতিকতার অজুহাতে বারংবার ধর্মের এক্তিয়ারে ভাগ বসানোর পরিবর্তে।

অরিহন্ত পাওয়ারিয়ার মূল সাক্ষাৎকারটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন সূর্যদেব।