বিধাতার হাতে লেখা গান – ২৬

অভীক মুখোপাধ্যায়

(পঞ্চবিংশতিতম পর্বের পর)

পর্ব – ২৬

আমেরিকান রাষ্ট্রপতি হওয়ার একটা অলিখিত নিয়ম আছে। বিবাহিত হতে হয়। অবশ্য ব্যতিক্রম তো থাকেই। যেমন এখনও পর্যন্ত অবিবাহিত রাষ্ট্রপতি একজন হয়েছেন — জেমস বুকানন। ফিসফাস কথা চলে যে তিনি নাকি সমকামী ছিলেন। তো যাই হোক, ব্যতিক্রম কোনোদিন উদাহরণ হতে পারে না। তাই হাসিমুখে বিবাহিত হতে হয় বলেই ধরে নিন।

আর এদিকে আমাদের দেশের তাবড় সব নেতা মন্ত্রীদের দিকে তাকান। বেশিরভাগই আবার অবিবাহিত। কেউ বিবাহিত হলেও তা স্বীকার করেন না। ভারী অদ্ভুত! তাই না?

আসলে এই অবিবাহিত থাকার ব্যাপারটাকে সামনে আনা কিন্তু প্রগতিশীল মানসিকতার উন্মেষ। এবং আমেরিকার মতো তথাকথিত প্রগতিশীল একটি দেশ বাস্তবে বিশ্বের সবথেকে সাংঘাতিক মৌলবাদী সামাজিক চিন্তা নিয়ে চলে। তাই সেখানে প্রেসিডেন্টের পদে আসার আগে বিয়ে করাটা অলিখিত ভাবে ‘মাস্ট ডু’এর তালিকায় পড়ে। আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ালে তা সাংঘাতিক অপরাধ বলেই ধরে নেয় জনতা জনার্দন। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কিন্তু আর্থিক কেলেঙ্কারিতে বা দেশদ্রোহীতার কাজ করে সরে যেতে বাধ্য হননি, বরং সেক্স স্ক্যান্ডালে ফেঁসে চাপ খেয়ে গেছেন এমন নজির রয়েছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেশের কোনো প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিকে এহেন অভিযোগ মাথায় নিয়ে ধাক্কা খেতে হয়নি।

মোদ্দা কথা হল ফার্স্ট লেডি চাইই চাই! যদি স্ত্রী মারা যান / গিয়ে থাকেন, ডিভোর্স হয়ে যায়, তাহলে রাষ্ট্রপতির কন্যা হবেন ফার্স্ট লেডি।

আমেরিকার মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলরকে শেষমেশ রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্যেই বিয়ে করতে হল। প্রেম ছিলই, কিন্তু ফোকাসে অনড় ছিলেন জন এফ কেনেডি। তাঁর জীবনে একটা কথাই ছিল মূলমন্ত্র — ‘কেনেডি পরিবারের বড় ছেলে হোয়াইট হাউসে যাবে।’ বড় নাহয় নেই, পরের জনই যাবে। নাহলে খোলা গাড়িতে দিওয়ানা – মস্তানার মতো ঘুরতে থাকা, গ্ল্যামারাস মহিলাদের বিছানায় নিয়ে গিয়ে তোলায় সিদ্ধহস্ত, ধনী যুবক জন এফ কেনেডির বিয়ে করার দরকারটা কী ছিল?

জনের ডাকনাম বা পরিচিত মহলে অসম্ভব চালু একটা নাম ছিল — জ্যাক। এবার এটাকেই ব্যবহার করব, বন্ধুরা। জ্যাক জ্যাকিকে পেয়ে গেল। জ্যাকি মানে জ্যাকলিন কেনেডি একজন অত্যন্ত সুন্দরী পেজ থ্রি লেভেলের রমণী। একেবারে আদর্শ ফার্স্ট লেডি। লোকজনে বলে, জ্যাকলিনের একটা স্পেশালিটি ছিল যে তিনি জ্যাকের সঙ্গে কোনো যুবতীর রাতকাটানো নিয়ে কোনো ধরণের বিরূপ মত প্রকাশ করতেন না। হাত খুলে দেদার খরচ করা আর আমেরিকার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভদ্রমহিলা হয়ে ওঠাতেই তাঁর মনের শান্তি বজায় ছিল। তবে এসবই অন্যদের মুখের ঝাল খাওয়ার মতো ব্যাপার। সত্যি নাহলেও হতে পারে। কারণ জ্যাক কিন্তু জ্যাকির হাত কোনোদিনও ছাড়েননি। এবং যখনই সুযোগ আর সময় এসেছে, তখনই দুজনে একসঙ্গে জনতার সমক্ষে এসেছেন।

ওদিকে জ্যাকের জীবনে অন্য একটা সমস্যা চলছিল। আগেও একাধিক বার লিখেছি, ছোটবেলা থেকে ভুগতে থাকা রোগ আর স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা। শিরদাঁড়ার হাড় ভেঙে যাচ্ছিল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তিনি আর হাঁটতে চলতে অবধি পারছিলেন না। যে লোকের এমন দশা, তিনি রাষ্ট্রপতি কীভাবে হবেন? জ্যাক চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘অপারেশন করা কি সম্ভব?’ কিন্তু তখনো এই রোগের অপারেশন করার মতো ঠিকঠাক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। ডাক্তার বললেন, এমনও হয়েছে যে অনেকে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। পাপা জো মানা করলেন — ‘অপারেশন করাতে হবে না। রুজভেল্টও তো হুইলচেয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তুমিও হয়ে যাবে।’

কিন্তু জন এফ কেনেডি অপারেশন করালেন এবং ফলস্বরূপ কোমায় চলে গেলেন। বেশ কিছুদিন জ্ঞান ফেরেনি। শেষে একজন পাদ্রীকে ডেকে এনে অন্তিম ক্রিয়াকর্ম করার ব্যবস্থা শুরু হয়। ডাক্তারেরা বললেন, আরো ক’টা দিন দেখা যাক। অবশেষে জ্ঞান ফিরল। মাস তিনেক পর হুইলচেয়ারে বসে বেরোলেন জন তিনি ডাক্তারদের বললেন — ‘যে কোনো মূল্যে আমাকে আমার পায়ে দাঁড় করিয়ে দিন।’ আবার অপারেশন করা হল। জন এবার নিজের পায়ে হেঁটেই সংসদে প্রবেশ করলেন।

জনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভাবচলেন, ব্যাটা রেস থেকে ছিটকে গেছে। কিন্তু জন অন্য দুটো চালে বাজী মাত করলেন। প্রথম কাজটা ছিল রেডিও ভাষণে গিয়ে নিজেকে একজন ফৌজি, একজন ফাইটার হিসেবে তুলে ধরে বললেন যে মৃত্যুর মুখ থেকে কীভাবে ফিরে আসতে হয়, তা তিনি জানেন। দ্বিতীয় কাজটা ছিল হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থাতেই তিনি একটা বই লিখে ফেলেছিলেন — প্রোফাইলস ইন করেজ। এই বইতে তিনি আটজন সাহসী মার্কিন সেনেটরের কাহিনি লিখেছিলেন। এই আটজনের মধ্যে তিনি নিজের নাম রাখেননি, কিন্তু সুচারুভাবে নিজের মতবাদকে ঢুকিয়ে দিলেন পাতায় পাতায়। বই বেস্টসেলার হল। পুলিৎজার পেল। নিন্দুকেরা বলল, অসুস্থ হয়ে বই কী করে লিখল? কাউকে দিয়ে লিখিয়েছে!

বইয়ের বক্তব্য ছিল জনের। আর লিখেছিলেন জ্যাকলিন। জ্যাকলিনই চেয়েছিলেন জনের নামে বই বেরোক। কারণ জ্যাকলিনের ফার্স্ট লেডি হয়ে ওঠার উদগ্র বাসনা ছিল।

পাপা জো কিন্তু তখনো বেশ সক্রিয়। তাঁর ইচ্ছে ছিল, জন প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। তার পরের ভোটে রাষ্ট্রপতি। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সবথেকে প্রভাবশালী তথা অভিজ্ঞ নেতা লিন্ডন জনসনকে পাপা জো বললেন — ‘আপনি জ্যাককে উপ – রাষ্ট্রপতি পদের জন্য প্রার্থী করে দিন, আপনার ইলেকশন ক্যাম্পেইনের সব খরচের দায়িত্ব আমি নেব।’

জনসন না বলে দিলেন। তিনি জানালেন যে, তিনি রাষ্ট্রপতি পদে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ভাবছেন না। পাপা জো’র অফার ফিরিয়ে দেওয়াতে ববি কেনেডি খুব ক্ষেপে গেল। ইনিও এক বর্ণময় চরিত্র। পরে পরে ববির কথাও আসবে।

সমস্ত বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারের একজন করে সদস্য সার্বজনীন মুখ হয়। সে ভালো মানুষ হয়ে থাকে। কোনো খারাপ কাজ নিজের হাতে করে না। আর একজন করে সদস্য এমন থাকে, যে যেকোনো ভাবেই হোক না কেন পথের কাঁটা সরিয়ে প্রথমজনের বসার জন্য মসনদ তৈরি করে। সেটাকে বজায় রাখার ব্যবস্থা করে। একটি রিপোর্টে একবার এই ববি কেনেডির সঙ্গে সঞ্জয় গান্ধীর তুলনা করা হয়েছিল।

আসলে জন এফ কেনেডির গল্প লিখতে বসলে পাপা জো, ববি বা জ্যাকলিনকে বাদ দেওয়াটা অসম্ভব। এই তিনজন ছিলেন জনের জীবনের তিনটি স্তম্ভ। একটি স্তম্ভও যদি দুর্বল হতো, তাহলে কিন্তু জন কোনোভাবেই রাষ্ট্রপতি হতে পারতেন না।

জ্যাকলিনের একটা বড় গুণ ছিল। তিনি প্রায় সমস্ত ইউরোপিয়ান ভাষায় কথা বলতে পারতেন। জন এফ কেনেডি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে যখন প্রথমবার প্যারিসে গিয়েছিলেন, তখন গাড়ি থেকে নেমে জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন — ‘ইনি হলেন জ্যাকলিন কেনেডি, আমেরিকার ফার্স্ট লেডি। আর আমি এঁর ড্রাইভার।’

(ক্রমশঃ)