দুর্গা-স্তোত্র

0
3047

মাতঃ দুর্গে! সিংহবাহিনি সর্ব্বশক্তিদায়িনি মাতঃ শিবপ্রিয়ে! তোমার শক্ত্যংশজাত আমরা বঙ্গদেশের যুবকগণ তোমার মন্দিরে আসীন, প্রার্থনা করিতেছি,– শুন, মাতঃ, ঊর বঙ্গদেশে, প্রকাশ হও।।

 

মাতঃ দুর্গে! যুগে যুগে মানবশরীরে অবতীর্ণ হইয়া জন্মে জন্মে তোমারই কার্য্য করিয়া তোমার আনন্দধামে ফিরিয়া যাই। এইবারও জন্মিয়া তোমারই কার্যে্য ব্রতী আমরা, শুন, মাতঃ, ঊর বঙ্গদেশে, সহায় হও।।

 

মাতঃ দুর্গে! সিংহবাহিনি, ত্রিশূলধারিণি, বর্ম্মআবৃতসুন্দরশরীরে মাতঃ জয়দায়িনি! তোমার প্রতীক্ষায় ভারত রহিয়াছে, তোমার সেই মঙ্গলময়ী মুর্ত্তি দেখিতে উৎসুক। শুন, মাতঃ, ঊর বঙ্গদেশে, প্রকাশ হও।।

 

মাতঃ দুর্গে। বলদায়িনি, প্রেমদায়িনি, জ্ঞানদায়িনি, শক্তিস্বরূপিণি ভীমে, সৌম্যরৌদ্ররূপিণি! জীবনসংগ্রামে ভারতসংগ্রামে তোমার প্রেরিত যোদ্ধা আমরা, দাও, মাতঃ, প্রাণে মনে অসুরের শক্তি, অসুরের উদ্যম, দাও, মাতঃ, হৃদয়ে বুদ্ধিতে দেবের চরিত্র, দেবের জ্ঞান।।

 

মাতঃ দুর্গে। জগৎশ্রেষ্ঠ ভারতজাতি নিবিড় তিমিরে আচ্ছন্ন ছিল। তুমি, মাতঃ, গগনপ্রান্তে অল্পে অল্পে উদয় হইতেছ, তোমার স্বর্গীয় শরীরের তিমিরবিনাশী আভায় ঊষার প্রকাশ হইল। আলোক বিস্তার কর, মাতঃ, তিমির বিনাশ কর।।

 

মাতঃ দুর্গে! শ্যামলা সর্ব্বসৌন্দর্য্যঅলঙ্কৃতা জ্ঞান প্রেম শক্তির আধার বঙ্গভূমি তোমার বিভূতি এতদিন শক্তিসংহরণে আত্মগোপন করিতেছিল। আগত যুগ, আগত দিন, ভারতের ভার স্কন্ধে লইয়া বঙ্গজননী উঠিতেছে, এস, মাতঃ, প্রকাশ হও।।

 

মাতঃ দুর্গে। তোমার সন্তান আমরা, তোমার প্রসাদে, তোমার প্রভাবে, মহৎ কার্য্যের মহৎ ভাবের উপযুক্ত হই। বিনাশ কর ক্ষুদ্রতা, বিনাশ কর স্বার্থ, বিনাশ কর ভয়।।

মাতঃ দুর্গে! কালীরূপিণি, নৃমুণ্ডমালিনি দিগম্বরি, কৃপাণপাণি দেবি অসুরবিনাশিনি! ক্রূর নিনাদে অন্তঃস্থ রিপু বিনাশ কর। একটিও যেন আমাদের ভিতরে জীবিত না থাকে, বিমল নির্মল যেন হই, এই প্রার্থনা, মাতঃ, প্রকাশ হও।।

 

মাতঃ দুর্গে! স্বার্থে ভয়ে ক্ষুদ্রাশয়তায় ভারত ম্রিয়মাণ ভারত। আমাদের মহৎ কর, মহৎপ্রয়াসী কর, উদারচেতা কর, সত্যসঙ্কল্প কর। আর অল্পাশী, নিশ্চেষ্ট, অলস, ভয়ভীত যেন না হই।।

 

মাতঃ দুর্গে! যোগশক্তি বিস্তার কর। তোমার প্রিয় আর্য্যসন্তান, লুপ্ত শিক্ষা, চরিত্র, মেধাশক্তি, ভক্তিশ্রদ্ধা, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য্য সত্যজ্ঞান আমাদের মধ্যে বিকাশ করিয়া জগতকে বিতরণ কর। মানব সহায়ে দুর্গতিনাশিনি জগদম্বে, প্রকাশ হও।।

 

মাতঃ দুর্গে! অন্তঃস্থ রিপু সংহার করিয়া বাহিরের বাধাবিঘ্ন নির্ম্মূল কর। বলশালী পরাক্রমী উন্নতচেতা জাতি ভারতের পবিত্র কাননে, উর্ব্বর ক্ষেত্রে, গগনসহচর পর্ব্বততলে, পূতসলিলা নদীতীরে একতায় প্রেমে, সত্যে শক্তিতে, শিল্পে সাহিত্যে, বিক্রমে জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ হইয়া নিবাস করুক, মাতৃচরণে এই প্রার্থনা, প্রকাশ হও।।

 

মাতঃ দুর্গে! আমাদের শরীরে যোগ বলে প্রবেশ কর। যন্ত্র তব অশুভবিনাশী তরবারি তব অজ্ঞানবিনাশী, প্রদীপ তব আমরা হইব, বঙ্গীয় যুবকগণের এই বাসনা পূর্ণ কর। যন্ত্রী হইয়া যন্ত্র চালাও, অশুভহন্ত্রী হইয়া তরবারি ঘুরাও, জ্ঞানদীপ্তিপ্রকাশিনী হইয়া প্রদীপ ধর, প্রকাশ হও।।

 

মাতঃ দুর্গে! তোমাকে পাইলে আর বিসর্জ্জন করিব না, শ্রদ্ধা ভক্তি প্রেমের ডোরে বাঁধিয়া রাখিব। এস মাতঃ, আমাদের মনে প্রাণে শরীরে প্রকাশ হও।।

 

বীরমার্গপ্রদর্শিনি, এস! আর বিসর্জ্জন করিব না। আমাদের অখিল জীবন অনবিচ্ছিন্ন দুর্গাপূজা, আমাদের সর্ব্ব কার্য্য অবিরত পবিত্র প্রেমময় শক্তিময় মাতৃসেবাব্রত হউক, এই প্রার্থনা মাতঃ, ঊর বঙ্গদেশে, প্রকাশ হও।।

Next articleমুখপাত
ঋষি অরবিন্দ
অরবিন্দ ঘোষ; ১৫ই আগস্ট, ১৮৭২-৫ই ডিসেম্বর, ১৯৫০) ছিলেন বাঙালি রাজনৈতিক নেতা, আধ্যাত্মসাধক এবং দার্শনিক। তাঁর পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ এবং মাতামহ রাজনারায়ণ বসু। অরবিন্দ ঘোষ বাল্যকালে ইংল্যান্ডে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে গমন করেন এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে ট্রাইপস পাস করেন। দেশে ফিরে এসে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার অণুজ বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে বিপ্লবী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি কংগ্রেসের চরমপন্থী গ্রুপের নেতৃত্বে থাকাকালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে (১৯০৫-১৯১১) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী কালে তিনি পুদুচেরীতে আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন।