পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন: বঙ্গীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা

সদ্য সমাপ্ত পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন, অনতিবিলম্বে আগতপ্রায় দেশের সাধারণ নির্বাচন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙ্গালী হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তির ভূমিকা সম্পর্কে  কিছু কথার  অবতারণাই এই লেখার উদ্দেশ্য। তাত্ত্বিক ভাবে ভারতীয় রাজনীতিকে প্রধানত তিনটি School of Thought র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারি – দক্ষিণ, মধ্য ও বাম।  আবার বাম ঘরানাকে মধ্যপন্থী এবং অতি/ উগ্রবাদী বামপন্থা ( মাও বা নকশাল ) এই ভাগে ভাগ করতে পারি যদিও অনেকেই এই শ্রেণী বিভাজনের সাথে একমত নাও হতে পারেন। আমি মোটামুটি একটি মোটা দাগের বিভাজন করার চেষ্টা করেছি মাত্র। এখানে একটি বিষয় বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, ভারতীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলির অধিকাংশকেই আমরা কোনো বিশেষ School of Thought র ধাঁচে পুরোপুরি ফেলতে পারিনা যদিও এখানেও সেই মোটামুটি মোটাদাগের একটি বিভাজন করা যায়- বিজেপি অর্থাৎ দক্ষিণপন্থী, কংগ্রেস অর্থাৎ মধ্যপন্থী।  বিজেপির প্রতিষ্ঠা, তার কারণ ও পূর্বোক্ত ইতিহাস নিয়ে অধিক বাক্যব্যয় করা সমীচীন বোধ করিনা কারণ সেই ইতিহাসের সাথে অধিকাংশই অবগত বা তা অতি সহজেই প্রাপ্য।

ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি সঙ্ঘ পরিবারের একটি রাজনৈতিক সংগঠন – যদিও ১৯৮০ সালে পার্টির মুম্বাই অধিবেশন এ বাজপেয়ীজী গান্ধীবাদী সমাজবাদের কথা বলেছিলেন, পার্টির মূল আদর্শের ভিত্তিভূমি সংঘের হল সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্ব। রাজনৈতিক পন্ডিতদের অপর একটি বহুল আলোচিত বিষয় – ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তি যে দলের জন্মদাতা (জনসঙ্ঘের উত্তরসূরী হিসেবে) সেই বঙ্গভূমিতেই দল কেন প্রসার লাভ করতে পারলোনা – বর্তমান কালের পরিপ্রেক্ষিতে তার  অন্বেষণ করা হবে এই প্রবন্ধে। 

দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের বন্ধ্যা বাম শাসনের পর তৃণমূল শাসনের (nemesis বললে অসুবিধা থাকতে পারে বলে মনে হয়না) জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আজ বেশ কিছু জ্বলন্ত সমস্যার সামনে দাঁড়িয়। নিরবিচ্ছিন্ন ধারায় বেআইনি অনুপ্রবেশ যা পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের আমল থেকেই চলছে তা বর্তমান সরকার রোধ করেনি। বরং

আরো অধিক নরমপন্থা অবলম্বন করেছে। রোহিঙ্গা ইস্যু জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অতি বিপদজনক সেখানেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার চোখ বন্ধ করে থাকার নীতি নিয়েছেন।  যেখানে তারই দলের মুসলিম স্থানীয় নেতারা কিছু স্থানিক সংগঠনের মাধ্যমে এই রোহিঙ্গাদের শুধু স্থান দেয়াই নয় ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র তুলে দিচ্ছেন যা নিয়ে তারা হারিয়ে যাচ্ছে ভারতের জনারণ্য। অধিকাংশ  লিবারেল বুদ্ধিজীবীদের যুক্তি হলো রোহিঙ্গারা শুধু এই কারণেই জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপদ নন কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে দেশের কোন থানায় সন্ত্রাস সংক্রান্ত কোন কাজে এখনো যথেষ্ট সংখ্যক এফআইআর হয়নি।

কিন্তু এটিই একমাত্র সত্য নয় – দেশের অধিকাংশ নিরাপত্তা সংস্থার গোপন রিপোর্ট যা কেন্দ্র সরকার সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়েছিলো তার প্রতি এই লিবারেল বুদ্ধিজীবীরা ভ্ৰূক্ষেপও করেননি। এখন প্রশ্ন হলো রোহিঙ্গারা ভারতে পালিয়ে এলে অসুবিধা কি ? লিবারেল মহল থেকে এ যুক্তিও দেয়া  হচ্ছে ভারত যখন উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের সংখ্যালঘু যেমন পাকিস্তানী হিন্দু/ বাংলদেশী হিন্দু/বৌদ্ধ/ জৈন এদের ক্ষেত্রে নরমপন্থা নিয়ে চলছে বা অন্তত চলতে চায় তখন রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে সমস্যা কি ? এ সমস্যার সম্মুখীন আমরা এর মধ্যেই হয়েছি এবং সেটি অসমে। অসমে দীর্ঘকাল কংগ্রেস শাসনে অনুপ্রবেশ চলতে দেওয়ায় আজ সেটি কি ভয়ঙ্কর অবস্থা ধারণ করেছে সে নিয়ে বাগবিস্তার এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। অসম-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলা ধুবড়ি, বরপেটাতে জনসংখ্যার চরিত্র বদলানো থেকে শুরু করে সামাজিক টানাপোড়েন (যার সাক্ষী আমি স্বয়ং ব্যক্তিগতভাবে) আর যেখানেই তথাকথিত সংখ্যালঘুরা সংখ্যায় অধিক হয়ে পড়েন সেখানকার বাকি অধিবাসীদের জীবন সম্মন্ধে সবাই অল্পাধিক অবহিত।

এখন প্রশ্ন হলো বাংলায় আগামী নির্বাচনে ২২/২৪ আসন দখলের স্বপ্ন দেখা দলটি এই বিষয়ে কি করেছে স্থানীয় ভাবে বা জাতীয় ভাবে। যতদূর মনে পড়ে নীতিগতভাবে বিজেপি রোহিঙ্গা বিতাড়নের পক্ষে. অসম থেকে ইতিমধ্যে জনা সাতেক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বাংলায় ? বিজেপি যাকে সরাবার জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সেই মমতা ব্যানার্জী বিরোধী থাকাকালীন যেভাবে প্রতিনিয়ত সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী নিয়ে আওয়াজ তুলতেন বিজেপির কেউ কি সেই কাজ করছেন ? তারা তো পারতেন অসমে যেমন ৭০ দশকের শেষদিকে তুমুল অসম আন্দোলন হয়েছিল রোহিঙ্গা/বাংলাদেশী  অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে  সেরকম কোনো তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে। রাজ্যে আসলে কত জন রোহিঙ্গা রয়েছেন – কতজন রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিচয়পত্র নিয়ে আর কতজন বেআইনিভাবে অবস্থান করছেন পশ্চিমবঙ্গে তার কোনো ধারণা আমাদের স্পষ্ট ভাবে নেই। কেন্দ্রে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল খুব সহজেই এই কাজটি করতে পারতো – অন্তত এই তথ্য থাকলে বিরোধী আন্দোলনের  narrative গঠনের প্রক্রিয়াটি সহজ হতে পারতো। 

এবার বাংলদেশ থেকে আগত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্বের বিষয়টির ওপর মনোযোগ দেওয়া যাক।  সেটিকে সুষ্ঠূ ভাবে সমাধানের বদলে অসমে NRC টুকুও যথাযোগ্যভাবে বাস্তবায়ন হলো না। আর বিজেপি এর মধ্যেই বাংলায় NRC করা হবে বলে উদ্বাহু  ঘোষণা শুরু করেছে।  যার ফলে NRC র বিরোধীরা অসমে এই প্রসঙ্গে বিজেপির নাজেহাল দশায় উৎসাহী হয়ে ইতিমধ্যে বাংলাতেও সেই ভয়কে পুঁজি করে বিজেপি বিরোধিতার রাজনীতি সহজেই শুরু করে দিয়েছেন।

আর একটি বিষয় খুবই দৃষ্টিকটু লাগে চোখে এবং সেটি হলো উন্নয়নের।  ব্যক্তি অধিকার বা সামাজিক প্রগতিশীলতার নামে হিন্দুসমাজের বিভাজনের প্রচেষ্টা। অবশ্য এই প্রবণতা বর্তমানে সারাদেশেই আছে। যেখানে কংগ্রেস বা বামপন্থীদের বিন্দুমাত্র ক্ষমতা অবশিষ্ট আছে সেখানেই এটি দৃঢ় ভাবে বিদ্যমান। কারণ? তাঁরা জানেন সমাজকে যত বেশি খণ্ডিত করে হাতে identity politics র গাজর ধরিয়ে দেওয়া হবে ততই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের জয়ের সম্ভবনা উজ্জ্বল। হিন্দু সমাজের প্রত্যেকটি বর্গ যত নিজেদের একে অপরের শত্রূ হিসেবে জানতে শিখবে ততই তাদের লাভ।  এই জন্যই কর্নাটকে হঠাৎ করে লিঙ্গায়তদের জন্য আলাদা ধর্মর বিষয়টি সামনে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে মতুয়াদের জন্য পৃথক ধর্মের দাবিও উঠছে কোনো কোনো মহল থেকে।  এ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে আরো বেশি করে জাতিভিত্তিক উন্নয়ন বোর্ড গড়ে দেয়া হচ্ছে – লেপ্চা /গোর্খা/ নমশূদ্র ইত্যাদি।

একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারিনা যে লেপ্চা বা গোর্খা বা নমশূদ্র এদের ন্যূনতম উন্নয়ন চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান, জীবিকা এগুলো কি এক এক জাতির জন্য এক এক রকম ? যদি সকলের জন্য আলাদা বোর্ড গড়ে উন্নয়ন করতে হয়. তাহলে অদূর ভবিষ্যতে যদি তাদের জন্য পৃথক সরকারের দাবি ওঠে তখন কি করা হবে?

কিন্তু এর বিরুদ্ধে সংঘের যে narrative অর্থাৎ সমাজ তার বিভিন্নতা নিয়েই একজোট থাকবে সেই উদ্দ্যেশে কি কোনো কাজ হয়েছে? সমাজকে যেভাবে খণ্ডিত করার কাজ চলছে তার বিপরীতে কোনো সমান্তরাল narrative কি দিতে পেরেছি আমরা? যেখানে প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীন পক্ষ থেকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে খণ্ডিত হয়ে যেতে সেখানে তাকে রোধ করার কি চেষ্টা করছি আমরা? মাঠে ময়দানে রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রয়োজন অবশ্যই আছে  কিন্তু সমান্তরাল ভাবে প্রয়োজনীয় হল একাডেমিক গবেষণা।পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের কাছ থেকে এ বিষয়টির মডেলটি শিক্ষণীয় বলেই বোধ হয় – ময়দানের সংগঠনের সাথে সাথে বুদ্ধিজীবী ক্ষেত্রটিকে কিভাবে কুক্ষিগত করে রেখে নিজপক্ষের সমর্থনকারী narrative বানানো যায়।  বিজেপি সে উদ্দ্যেশে কি কোনো কাজ করেছে? হলে সবচেয়ে খুশি বোধ হয় আমরাই হবো। 

রাজ্যে যেভাবে হিন্দু বাঙ্গালীর সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে টেলিভিশন সর্বত্র – এক বিজাতীয় সংস্কৃতির শব্দ থেকে আচার আমাদের সামনে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরা হচ্ছে তার বিরুদ্ধেও আমরা নিশ্চুপ। 

এই সমস্ত অপচেষ্টার বিরুদ্ধে যেটুকু প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে তার অধিকাংশই গা-গরম করা বক্তব্য বা  মাঠে ময়দানে লড়াই করার অঙ্গীকার কিন্তু সেই লড়াইয়ের দুটি মাত্রা – একটি তৃণমূল স্তরে সংগঠন কে শক্তিশালী করা যা প্রতিনিয়ত ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমেই করা সম্ভব। এমন তো নয় যে রাজ্য সরকার কোনো ইস্যু তুলে দেয়নি বিরোধীদের হাতে কিন্তু পূর্বতন বিরোধী নেত্রী – আজ তাঁর যত বিরোধিতাই করি না কেন এটি বলতেই হবে যে তিনি সেইসময় (বামফ্রন্ট থাকাকালীন) তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়েও যেভাবে রাজ্য সরকারকে নাজেহাল করে ছাড়তেন তার কিয়দংশও চোখে পড়েনা বর্তমান বিরোধীদের মধ্যে। কোনো ইস্যুকে জীবিত রাখা এবং কিভাবে সেটি রাজনীতির বিষয় করে তোলা যায় সেটি বর্তমান বিরোধীরা শিখতেই পারেন তাঁর কাছ থেকে।

অন্য মাত্রাটি হলো সমান্তরাল পরিকল্পনা – যার মধ্যে পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রচার যেমন থাকবে তাঁর সাথেই থাকা উচিত বিপরীত হিন্দুত্ববাদী  narrative ( তথ্যসূত্র সহকারে) যা পশ্চিমবঙ্গের মতো বুদ্ধিজীবী রাজ্যে আরো বেশি করে প্রয়োজন। কিন্তু সেরকম কোনো পরিকল্পনা মনে হয় এখনো সুদূরপরাহত।

পরিশেষে এটুকুই বলার ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভোট বা সমর্থন আমরা উন্নয়নের সাথে উপরিউক্ত সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কারণগুলির জন্যেও দিয়েছিলাম।  কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ক্ষমতায় আসার পরই বিজেপি নেতৃত্ব সম্পূর্ণ বিস্মৃত হলেন তাদের core vote bank র কথা।  তাঁরা হয়তো ভাবলেন মুসলিমদের পাশে চেয়ে,  একহাতে কোরান অন্যহাতে কম্পিউটার দিয়ে তাঁরা এই কাঙ্খিত সমর্থনটিও জুটিয়ে নেবেন আর taken for granted হিন্দুরা তাঁদের ছেড়ে আর  কোথায় যাবে! ভোট দেবে কেউ আর বিকাশের বেলা “সবার সাথে সবার বিকাশ”- সেক্ষেত্রে ধৈর্য্যচ্যুতি  ঘটতে বাধ্য। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল নিঃসন্দেহে একটি অশনি সংকেত – অবিলম্বে হিন্দুদের taken for granted ভাবা বন্ধ করলে হয়তো এ অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যেতেও পারে নাহলে আর একটি India Shining এবং তার ভয়াবহ ফলাফলের জন্য তৈরী হওয়াই ভালো।