লাভ জিহাদ: আইন নয়, হিন্দুদের পাঁচটি অসাম্য বুঝে তার মোকাবিলা করতেই হবে

0
924

– রাঘবন জগন্নাথন

 

বর্তমানে “লাভ জিহাদ” রোধের জন্য উত্তর প্রদেশের আইনের খসড়া সম্পর্কিত এবং বিবাহ বা সহবাসের জন্য সঙ্গী নির্বাচনে একজন মহিলার অধিকার সুনিশ্চিত করা নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় সম্পর্কিত দুটি সংবাদ প্রতিবেদনের দ্বারাই হিন্দুদের সমাজের বাস্তবরূপটিকে বুঝে একটি সাধারণ সত্যের সম্মুখীন হওয়া উচিত: ধর্মান্তর বা জনসংখ্যার হ্রাসপ্রাপ্তির মত কিছু গুরুতর বিষয়গুলির উদ্বেগকে সমাজ উপেক্ষা করলে দেশের আইন এবং আদালত তার সমাধান কখনই করতে পারে না।

যেমন বিবাহের সময় ধর্মান্তরের ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে সমাজ যতদিন না নিজে থেকে কোনও পদক্ষেপ নেবে ততদিন কোনও আইনই কিছু করতে পারবে না, ঠিক তেমনই সমাজ এই ধর্মান্তরের সংখ্যাটিকে না কমাতে পারলে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মের কিছু মানুষের ধর্ম পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি না করতে পারলে, সমস্ত ধর্মান্তর বিরোধী আইনই ব্যর্থ হবে।

খ্রিষ্টান বা ইসলাম ধর্মের চেয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষকেই পাঁচ প্রকারের অসাম্যের সম্মুখীন হতে হয় এবং তাঁরা যদি এর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ না নেন, তবে আস্তে আস্তে পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থান ভারতের সমগ্ৰ জনগণকেই এই অসাম্যগুলি গ্ৰাস করে ফেলবে।

ধর্মান্তর এবং এর প্রতিকার স্বরূপ হিন্দু ধর্মের দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো

প্রথম অসাম্য হল ধর্মান্তর এবং এর প্রতিকার স্বরূপ হিন্দু ধর্মের দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো। দুটি আগ্ৰাসী, সম্প্রসারণশীল, সাম্রাজ্যবাদী ধর্ম দ্বারা উত্থিত বাধা বিপত্তিগুলির মোকাবিলার জন্য আপনার কাছে যদি কোনও ধর্মান্তর বা পুনর্ধর্মান্তরের কৌশল না থাকে, তবে হিন্দুদের অন্যান্য ধর্মে রূপান্তরের বহির্মুখী প্রবাহের হ্রাসের কোন আশা আপনি করতে পারেন না।

এই জনসংখ্যার সংগ্ৰামে এই দুই পুরুষতান্ত্রিক ধর্মই তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে অর্থ, সংস্থান এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার সাহায্য নেয়, অন্যদিকে হিন্দুরা নিরস্ত্র অবস্থায় নিজেদের রক্ষা করে। এই কৌশলটি পরাজয়ের পথকে আরও প্রশস্ত করে। আপনি নিরস্ত্র অবস্থায় বন্দুকের সামনে লড়াই করতে পারবেন না কিংবা কোন আইনের দ্বারা বন্দুককের নিষেধাজ্ঞা জারি করতেই পারেন, কিন্তু তা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। কিন্তু নিজেদের রক্ষা করার জন্য হিন্দুরা এই কৌশলকেই বেছে নিয়েছেন।

দুটি ধর্ম যদি ধর্মান্তরের চেষ্টা করতে থাকে এবং এই বিশেষ ধর্মটি যদি নিজেকে রক্ষার জন্যও প্রস্তুত না থাকে, তবে এর পরিণাম পরাজয় ছাড়া আর কী হতে পারে?

পিতৃতন্ত্র

দ্বিতীয় অসাম্য হল পিতৃতন্ত্র। সমস্ত আব্রাহামীয় ধর্মই পুরুষতান্ত্রিক এবং বিশেষত ইসলাম অন্যান্য সব ধর্মের থেকেই একটু বেশি পুরুষতান্ত্রিক। কিন্তু একমাত্র হিন্দু ধর্মই নিজস্ব সংস্কৃতিতে আজও বজায় রেখেছে, কারণ আমরা মেয়েদের (মাতৃগর্ভেই হত্যা না করে) চাকরির জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছি, কিন্তু আন্তর্ধর্মীয় বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা প্রদানে আমরা অক্ষম।

সবচেয়ে খারাপ বিষয় হল যে, যদি কোনও হিন্দু মহিলা এই ধরনের বিবাহে তাঁর ধর্মীয় পরিচয় বা লিঙ্গের যথোপযুক্ত অধিকারের জন্য লড়াই করেন, তবে হিন্দু সমাজ তাঁদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে না এবং আমাদের রাজনৈতিক নেতাগণ এবং আদালত “সাম্প্রদায়িকতা” সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট ভাব প্রকাশ করবে।

আদালত এ ক্ষেত্রে সমভাবে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে। পূর্বে উল্লেখিত এলাহাবাদ হাইকোর্টের মামলায় গঠিত বেঞ্চের মূখ্য বিবৃতিটিতে নিম্নলিখিত বিবরণ দিয়েছে:

আমরা প্রিয়াঙ্কা খারওয়ার এবং সালামাতকে হিন্দু ও মুসলিম হিসাবে পৃথকভাবে দেখি না,বরং এঁরা দুজনেই হলেন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যাঁরা স্বেচ্ছায় এবং স্বাচ্ছন্দ্যে প্রায় এক বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে ও সুখে একসাথে বসবাস করছেন।

ভারতীয় সংবিধানের ২১ নাম্বার অনুচ্ছেদে আদালতগুলি এবং বিশেষত সাংবিধানিক আদালতগুলিকে জনগণের ব্যক্তিগত জীবন ও স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিতভাবে বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তাঁর পছন্দের কোনও ব্যক্তির সাথে থাকার অধিকারটি ব্যক্তিগত জীবন ও স্বাধীনতার অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে হস্তক্ষেপ করা দু’জনেরই ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারের উপর গুরুতর আঘাত আনার মত অপরাধ রূপে চিহ্নিত হবে।“

এই বিবৃতিটির‌ সমস্যা তার সাংবিধানিক উদ্দেশ্যটি নয়, তবে সমাজের অন্তর্নিহিত বাস্তবচিত্রটি উপেক্ষা করাই হল এর সবচেয়ে বড় ভুল। যে মহিলা তাঁর জাতি বা ধর্ম বহির্ভূত কোনও পুরুষকে বিবাহের উদ্দেশ্যে তাঁর পরিবারকে পর্যন্ত অস্বীকার করে তাঁর স্বামীর পরিবারে শান্তি স্থাপন করেন, তাঁরা পরবর্তীতে দুটি জায়গাতেই ঠাঁই পান না। তিনি আন্তর্ধর্মীয় বিবাহের পরও যদি তাঁর ধর্মীয় পরিচয় বজায় রাখতে চান, তবে সেগুলি ত্যাগ করার জন্য তাঁর উপর গোপনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয় এবং তাঁর সন্তানদেরও বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সাধারণত মহিলারা তাঁদের সন্তানদের তাঁর স্বামীর সংস্কৃতি এবং রীতিনীতি মেনেই বড় করে তুলতে বাধ্য হন; এমতাবস্থায় প্রিয়াঙ্কা ইচ্ছা করলেও তাঁর হিন্দু পরিচয় ধরে রাখতে সক্ষম হবেন, তার সম্ভবনা কত?

এমনকি, যে সমস্ত ক্ষেত্রে একটি মুসলিম ছেলে নিজেকে হিন্দু হিসাবে একটি মেয়ের সামনে উপস্থাপন করে এবং সহবাস করার পরে তার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করে বলে সে আসলে আনন্দ নয়, আহমেদ, এমতাবস্থায় সম্পর্কটিকে নিয়ে এতটা আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল হওয়ার পর কোন মহিলা তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে এবং প্রতারণার বিরুদ্ধে তার অধিকারের জন্য লড়াই করার সাহস পাবে?

এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষিতা মহিলারা তাঁদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য তাঁদের নিপীড়কের সাথেও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, সুতরাং কোনও এক প্রিয়াঙ্কা ধর্মান্তরিত না হয়ে তাঁর নিজস্ব পরিচয় ধরে রাখার সাহস পাবেন এমন সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। ভারতীয় সমাজে আন্তর্ধর্মীয় বিবাহের ক্ষেত্রে একজন মহিলার চেয়ে একজন পুরুষের কাছে নিজস্ব পরিচয় বজায় রাখাটাই সহজ হয়।

সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা আন্তর্ধর্মীয় বিবাহে একজন পুরুষের চেয়ে মহিলার প্রতি এরূপ অসম আচরণটাকে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে।

ব্যক্তিগত আইন এবং সামাজিক রীতিনীতি

তৃতীয় অসাম্য ব্যক্তিগত আইন এবং সামাজিক রীতিনীতির সাথে সম্পর্কিত। হিন্দুদের পার্সনাল ল মুসলমান বা খ্রীষ্টানদের চেয়ে আলাদা। হিন্দুদের  বিবাহ অনুষ্ঠানগুলিতে যে সমস্ত নিয়ম এবং রীতিনীতি অনুসরণ করা হয়, তার মধ্যে কোন প্রকার ধর্মান্তরকরণের বিষয় থাকে না। নিকাহ বা খ্রিস্টান পাদ্রী দ্বারা সম্পাদিত চার্চের মধ্যে অনুষ্ঠিত বিবাহ অনুষ্ঠানের আগে ধর্মান্তরকরণ বাধ্যতামূলক।

এই আইনটি একমাত্র সফলভাবে প্রণীত হবে যখন পার্সনেল ল আইনী  না হয়ে কেবল সামাজিক স্থিতির বিবরণ হবে। আর মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ বন্ধ করতেই হবে। এই আইনটি আন্তর্ধর্মীয় বা একই ধর্মের মধ্যেই বিবাহে মুসলিম ও হিন্দু উভয় মহিলাদেরই তাঁদের বৈবাহিক অধিকারকে আরও সুরক্ষিত করবে। আর প্রয়োজন বোঝানোর সাধারণ হিন্দু নারীদেরকে যে তাঁরা এই মুসলমান নিকাহ বা গির্জার বিবাহে রাজি হয়ে কি হারাতে পারেন। তাঁদের সঙ্গে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন।

হিন্দু সমাজকে তার যুবক যুবতীদের সঠিক জীবনসঙ্গী নির্বাচনের জন্য সচেতন হওয়ার নির্দেশ দিতে হবে এবং ভিন্ন ধর্মের কাউকে বিবাহের সময় তাঁরা অজান্তেই যেন কোনও ফাঁদে পা না দেন, তার সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।

মুসলিম রীতিনীতি

চতুর্থ অসাম্যটি মুসলিম মহিলা এবং তাঁদের সম্প্রদায়ের পুরুষদের তাঁদের প্রতি আচরণের সাথে সম্পর্কিত। অনেকে মুখ অবধি বোরখা পড়েন এবং অন্যদের মাথা অবধি আচ্ছাদিত থাকে। উভয় প্রকারের মহিলাদেরকেই পুরুষদের বিশেষত ভিন্ন ধর্মের পুরুষদের থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করা হয়।

সুতরাং, মুসলিম পুরুষরা হিন্দু মহিলাদের সাথে সহজেই সাক্ষাৎ করতে এবং কথা বলতে পারলেও, একজন বোরখা পরিহিতা মুসলিম মহিলারা বা মেয়েরা ধর্মানুসারেই নিজেদেরকে ভিন্ন সম্প্রদায়ের পুরুষদের বা ছেলেদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। খুব অল্প সংখ্যক ভিন্ন জাতির পুরুষরা যথেষ্ট তৎপরতার সাথে মুসলিম যুবতী এবং অল্প বয়সী নারীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন বা সাক্ষাৎ করেন।

কেবল মুসলিম সমাজের আধুনিকায়ন এবং নারীদের প্রতি তাঁদের নিজস্ব পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমেই এই অসমতাগুলির সাথে মোকাবিলা করা সম্ভবপর হবে, তবে অল্প সময়ের মধ্যে এই বিষয়টি বাস্তবায়িত করা অসম্ভব। সুদূর ভবিষ্যতে সমাজের মধ্যে এই অসমত্বটি বজায় থাকবেই।

ইসলামী নিয়মে ধর্মত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড

পঞ্চম অসাম্যটি মুসলিম সমাজের কোন ব্যক্তির ধর্মত্যাগ সম্পর্কে এর নিয়মাবলীর সাথে সম্পর্কিত। নাসিম নিকোলাস তালেব তাঁর স্কিন ইন দ্য গেম পুস্তকটিতে লিখেছেন যে, মুসলিম জনসংখ্যা নিম্নলিখিত দুটি অসাম্য নিয়ম অনুসরণ করার ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে।

দুটি অসাম্য নিয়মগুলি হল নিম্নরূপ। প্রথমত, ইসলামী আইন অনুযায়ী, কোনও অমুসলিম পুরুষ একজন মুসলিম মহিলাকে বিবাহ করলে তাঁকেও ইসলাম ধর্ম গ্ৰহণ করতে হবেএবং যদি কোনও সন্তানের পিতা মাতার মধ্যে যে কোন একজনও মুসলিম হয়, তবে সন্তানটিও মুসলিম হবে। দ্বিতীয়ত, মুসলিম ধর্ম গ্ৰহণ করা অপরিবর্তনীয়, কারণ ইসলাম ত্যাগ করা এই ইসলামীয় আইনে সবচেয়ে বড় অপরাধ, যার অনুমোদিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।”

হিন্দুরা যদি তাঁদের অধিকার ধরে রাখতে চান এবং এই জনসংখ্যার সংগ্ৰামে জয়ী হতে চান, তবে তাঁদের এই অসাম্যতাগুলি ভালো করে বুঝতে হবে এবং এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্ম অনেকটা হোটেল ক্যালিফোর্নিয়ার মত: যে কোনও ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু কেউ (সহজেই) ত্যাগ করতে পারে না। হিন্দু ধর্ম এর ঠিক বিপরীত: যে কোনও ব্যক্তিই ধর্মত্যাগ করতে পারে, তবে খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তিই সহজে এই ধর্ম গ্ৰহণ করতে পারে।

আইনগুলি একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে গিয়ে এই অসমতাগুলি সংশোধন করতে পারে না। সমাজকেই এই সমস্যাটি সম্বন্ধে পরিচিত হতে হবে এবং এর মোকাবিলা করতে হবে।

স্বরাজ্য পত্রিকার সম্পাদক রাঘবন জগন্নাথনের মূল লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল উক্ত পত্রিকায়। অনুবাদ করেছেন অর্ণব। মতামত লেখকের, বঙ্গদেশ পত্রিকা তার জন্য দায়ী নয়।