বঙ্গের জন্য আবার

0
633

বঙ্গের কথা ভেবেই কিছু কথা প্রকাশ করেছে বঙ্গদেশ পত্রিকা কয়েকদিন আগে, হয়তো কিছুটা নিষ্ফল আশা রেখেই। এই শস্য-শ্যামলা বঙ্গদেশে যে মরীচিকাময় মরুভূমির উৎপত্তি হবে তা হয়তো মধুকবিও স্বপ্নে ভাবেননি, তা সে যতই তিনি উপমার ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করে থাকুন না কেন! আর দোষ সদাবিশ্বাসী বঙ্গসন্তানদেরও, বারবার এক কর্মপথে যাওয়ার পরেও যারা আলাদা ফলের আশা করেন। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধানভাঙ্গে এ কথা আমরা জেনেছি বাগধারায়, কিন্তু কেবল ব্যাকরণের জাঁতাকলেই আটকে থেকেছে সে, আয়ত্ত করতে পারিনি তার অর্থ। তাই আশা করেছি আবার যে হয়তো রাজনীতিকে অতিক্রম করে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী হয়তো অন্য পথে হাঁটবেন। কিন্তু যে পথ তাঁর চেনা, চিরকাল যে পথে তিনি বিচরণ করেছেন এবারও সেই রাস্তাতেই এগিয়েছেন তিনি। Robert Frost’এর ‘Road not taken’ কবিতায় তিনি বেছে নিয়েছিলেন জনপ্রিয়তাকে বাদ দিয়ে অবিচরিত পথকেই, যা কাতর ছিল কোন পথের চরণচিহ্নের। সেই সিদ্ধান্তই গড়ে দিয়েছিল কিছু তফাৎ। কিন্তু বিধির বিধান খণ্ডাবার নয় এই ক্ষেত্রে, এবং তাই কোন নব চিত্রায়নের সৌভাগ্য অধরাই থেকে গেল এযাত্রা। 

প্রথমে করোনা এবং পরবর্তীতে আমফান, এই দুই দুর্যোগে পশ্চিমবঙ্গ জর্জরিত আপাতত। করোনার ক্ষেত্রে প্রথমত পরীক্ষা, এবং পরবর্তীতে মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো, রেশনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ইত্যাদি নানা অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এই বিষয়ে প্রবাসী বাঙালিদের কিছু অভিযোগের বিরুদ্ধেও খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন তৃণমূলের এক প্রধান নেত্রী। সেই বিষয়ে ইতিপূর্বে প্রবাসী গবেষক শ্রী রুদ্রপ্রসন্ন ব্যানার্জির চিঠি এবং প্রখ্যাত চিকিৎসক শ্রী ইন্দ্রনীল বসুরায়ের চিঠি বঙ্গদেশ পত্রিকা প্রকাশ করেছে। করোনার প্রকোপ এখনো ক্রমবর্ধমান আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে, এবং সেই রুগীর সংখ্যা প্রায় চার হাজারের কাছাকাছি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে। এছাড়া রয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর বিষয়, যে প্রসঙ্গে রেল মন্ত্রকের অনেক সমস্যা দেখা দেয় রাজ্যের থেকে ছাড়পত্র পেতে। এমন আরো নানা সমস্যা সম্পর্কে রাজ্যবাসী মোটামুটি অবহিত। 

এই সমস্ত কিছুর মাঝে এসে জুটল আমফান ঝড়, যা আবার আমাদের রাজ্যের পরিকাঠামোর দৈন্যদশাকে প্রকট করে দিল রাজ্যবাসীর সামনে। ২০ তারিখ দ্বিপ্রহরে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম আছড়ে পড়ে এই ঝড়, এবং মেদিনীপুর, দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া এবং হুগলীতে মূল ধাক্কা দেয়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও উড়িষ্যা এবং বাংলাদেশে এই প্রলয়তাণ্ডব পরিলক্ষিত হয়। তার প্রস্তুতি প্রশাসনিক স্তর থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল কিছুদিন আগে থেকেই, অন্তত সেরকমই শোনা গিয়েছিল। কিন্তু ঘটনা ঘটে যাবার পরে চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীতই দেখা যায়। 

যখন দেখা যায় যে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা আমফানের প্রলয়ে জর্জরিত তখন বিভিন্ন সূত্রে কথা ভাসিয়ে দেওয়া হয় যে কেন্দ্রীয় সরকার এই বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর নয়। এর মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ বপনের চেষ্টা হয় এই বলে যে আমরা নিজেদের খেয়াল নিজেরাই রাখতে পারব। অথচ কাজের বেলায় দেখা যায় যে কলকাতা পৌরনিগম সমস্ত অঞ্চলে পরিষেবা স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ। কলকাতা এবং অন্যান্য অঞ্চলে বিদ্যুৎ পরিষেবা, পানীয় জল পরিষেবা ইত্যাদি এখনো পর্যন্ত স্বাভাবিক হয়নি সর্বত্র। কলকাতায় বিশেষ করে পৌরনিগম এবং কলকাতার বেসরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সিইএসসির মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব বারবার ফুটে উঠছে সকলের সামনে, যার ফলে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে জনবিক্ষোভ নজরে আসছে আমাদের।

আদপে এর পেছনে অন্য কোন কাহিনীও থাকতে পারে, সরকারের থেকে দোষ ঘুরিয়ে বেসরকারি সংস্থাকে কাঠগড়ায় তোলার ক্ষেত্রে। বিশেষ করে এই সংস্থার সাথে শাসক দলের সুসম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত। কাজেই তারা সরকারের ক্ষতে মলম প্রলেপের জন্য কিছুটা দায়ভার গ্রহণ করতেই পারে, যাতে তারা কলকাতায় তাদের উচ্চ বিদ্যুৎ মাশুল লাগু রেখে যেতে পারে। তেমনই বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের আওতাধীন জায়গাতেও। তাণ্ডবের ফলে উৎপাটিত বৃক্ষসমূহ এখনো পড়ে রয়েছে সেই পথের উপরে। কলকাতা পুর নিগমের উপর আস্থা হারিয়ে অনেক বাসিন্দা তাই নিজেদের উদ্যোগে অথবা অর্থব্যয়ে নিজেরাই সেই বিষয়ের নিষ্পত্তি করেছেন।

এছাড়া কেন্দ্রীয় ন্যাশনাল ডিসাস্টার রেসপন্স ফোর্স বা উড়িষ্যা থেকে আগত তাদের উড়িষ্যা ডিসাস্টার র‍্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সও যথেষ্ট সাহায্য করেছে। তার মাঝেও দুইদিন পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী নেতাদের দুর্যোগ পর্যালোচনার করতে যাওয়ার পথে বাধা দেবার ঘটনাও আমাদের নজরে এসেছে, যা আবার দেখায় যে এই ঘোর দুর্দিনেও পরিষেবার থেকে রাজনীতির প্রতিই আগ্রহ শাসকদলের বেশি। এই ব্যর্থতার কথা কেবল বিজেপি নয়, বরং কেন্দ্রের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের লোকসভার নেতা পর্যন্ত প্রকাশ করেছেন, এবং প্রধানমন্ত্রীকে সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবার আবেদন পর্যন্ত করেছেন। শেষ পর্যন্ত রাজ্য সরকারের আবেদনে ভারতীয় সেনা মাঠে নেমে বিভিন্ন জায়গায় সমস্যা মেটাতে শুরু করে, যা আদপে আমাদের রাজ্যের নিজস্ব পরিকাঠামো এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুর্বলতাকেই প্রকট করে। এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমস্ত বক্তব্যকে প্রহসনে পরিণত করে। 

কেন্দ্রীয় অর্থসাহায্য, এবং এই দুর্যোগকে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে হিসাবে ঘোষণার দাবিতে সরব হয়েছিল বিভিন্ন অংশ, যার মধ্যে বিছিন্নতাবাদী এবং  বাম দলেরা অন্যতম। মমতাও অর্থসাহায্যের দাবি জানান এবং প্রধানমন্ত্রীকে নিজে পরিদর্শনে আসার অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রী পরেরদিন উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি পরিদর্শনপূর্বক আপাতত ১০০০ কোটি টাকা অনুদানের ঘোষণা করেন। আশ্চর্যজনক বিষয় হল ইতিপূর্বে মমতা ২০০৯ সালের আয়লা ঝড়ের সময় কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেন ত্রাণ না দিতে। এতক্ষণে তিনি বিষাদে এই আত্মোপলব্ধি করলেন হয়তো যে ভুল, সবই ভুল। এবার আশা যাক জাতীয় বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে। বস্তুত, আমাদের সংবিধানে বা দুর্জয় ব্যবস্থাপনা আইনে জাতীয় বিপর্যয় বলে ঘোষণার কোন বিধি নেই। এই ব্যাপারটি সংজ্ঞায়িত পর্যন্ত নয়। স্বাভাবিকভাবে দেশের সংবিধান এবং আইন সম্পর্কে অনাস্থা রাখা মানুষ যে সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবেন না তা বলাই বাহুল্য। 

সব মিলিয়ে এ কথা বলতেই হয় যে সব কিছুর মাঝে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হল পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ যারা হয়তো এই কঠিন সময়ে কিছুটা সুরাহা এবং সুশাসন আশা করতে পারত সরকারের থেকে। কিন্তু রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে মনে হয় সেই সম্ভাবনা অতিশয় ক্ষীণ। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সুযোগ সুবিধা, যেমন কৃষি ঋণ বা চিকিৎসা বিমা, থেকে তারা বঞ্চিত থেকে গেছে বহুদিন। আবার রাজনৈতিক বোড়ে হিসাবে ব্যবহৃত হতে হচ্ছে তাদের এই দুঃসময়ে। বাঙালির এই দুঃস্বপ্নের শেষ কোথায়, বা আদৌ আছে কিনা তা হয়তো কেবল বিধাতাই বলতে পারবেন।