যাপন কৌশল

0
455

লিখেছেন দর্পণা রায়

গতকাল রহড়া বাজারে কিছু ফলমূল কেনার সময় দুটো বাচ্চা ১০-১২ বছর বয়সী ছেলে ভিক্ষা চাইছিল। ময়লা টি-শার্ট ও হাফ প্যান্ট পরা। প্রথমে আমফান ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত ভেবে ব্যাগ খুলতে গিয়ে ওদের দেখে কী ভেবে প্রশ্ন করলাম, “তোর নাম কী?”
ছেলেটা উত্তর দিল “প্রেম”।
“ও, আর তোর নাম?”
সম্ভবত ‘প্রেম’ শুনে আমাকে তেমন প্রভাবিত মনে না হওয়ায় অন্য ছেলেটি বেশ ফর্মাল কায়দায় বলল, “আমার নাম শেখ….”।
“ও আচ্ছা।”
ওরা তবুও “দিদি কিছু সাহায্য করো না, কাকু কিছু দাও না” বলে আমাদের দু’জনকে ঘিরে ঘুরঘুর করতে লাগল। বললাম, “ছুঁবি না, দূর থেকে।” তারপরেও ঘ্যানঘ্যানানি গেল না দেখে মনে হল বলি, ‘তোরা তো চুরি ছিনতাই করতে ওস্তাদ। ভিক্ষা চাইছিস কেন?’ চুপ করে রইলাম। দেখতে দেখতে আর একটাও জুটে গেল কৌটো নিয়ে।
শেষে প্রায় হুমড়ি খেয়ে হাত বাড়নোয় বলে ফেললাম, “টিটাগড় যা, ওখানে জাকাত পাবি।”
ছেলেগুলো সরে গেল; কিন্তু আমার বর গেলেন আমার ওপর প্রচণ্ড খেপে। অকারণে কেন ঝামেলা আমন্ত্রণ করছি? রীতিমতো গজগজ করতে করতে ফলগুলো ব্যাগে ভরেই আমাকে বাইকে নিয়ে চলে এলেন। রাস্তায় মাছ ও কিছু সব্জি কেনার ইচ্ছা ছিল। ওঁর মেজাজ দেখে আর কোথাও দাঁড়াতে বললাম না।
বাড়ি ফিরে ঝাড়ের বাচ্চা ঝাড়। রাজ্যের কী পরিস্থিতি আমি কি জানি না? যা মনে এল বললেই হল? পরিণতি ভাবব না? কেন শুধু ছেলে দুটোকে অমন করে বললাম? দুটো বাচ্চা!
আমি চাপা গলায় বললাম, “বাচ্চা? ওরা সবকটা পটেনশিয়াল …!”
“যা-তা বকলেই হল? তুমি কিছুতেই নিজের একবগ্গা চিন্তা ভাবনা পাল্টাবে না। জানো না, জায়গাটা বামপন্থীদের। ছেলেগুলো কিছু রিঅ্যাক্ট করলে তখনই পাঁচটা ছেলে এসে আমাদের ঘিরে ধরত?”
“কিন্তু আমি তো খারাপ কিছু বলিনি। আমি কার কাছে জিনিস কিনব, কাকে সাহায্য করব, সেটা আমার ব্যাপার…”
“বোকার মতো কথা বোলো না। সব সময় নিজের ভাবনাটা কেন সবার সামনে এক্সপ্রেস করছ? তুমি অলরেডি পুরো পাবলিকেশন ইন্ডাস্ট্রিতে মার্কড। তোমার একটা বইয়ের কনটেন্ট নিয়ে পুলিস একজনকে অলরেডি হ্যারাস করেছে। তার ওপর বিজেপি নেতারা তোমার বই উদ্বোধন করেছেন। তোমার বই আর কেউ করতে চায় না। এখন যদি তোমাকে দাঙ্গা ইনস্টিগেট করছ বলে কেস দিয়ে ভেতরে ভরে দেয়, আমাদের কী হবে ভেবে দেখেছ? তার সঙ্গে যদি আমাকেও জড়ায়, তাহলে আমি ইম্মিডিয়েট গর্ভনমেন্ট সার্ভিস থেকে সাসপেন্ড হয়ে যাব। শুধু জামিন করাতেই নিঃস্ব হয়ে যাব। সুতরাং যা করবে এগুলো মাথায় রেখেই। যদি সপরিবারে বিপদে পড়তে চাও তো যা ইচ্ছা করো।”
“মুর্শিদাবাদের একটা ছেলে হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে নিজের যা-তা আচরণ ফলাও করে ফেসবুকে পোস্ট করছে – পুরো ফ্যামিলির নাম করে করে – অমুকের মেয়েকে রিসর্টে নিয়ে গিয়ে এতবার এই করেছি, তমুকের বৌ তো আমাকে দিয়ে এই করায়, সেই করায়। ম.ব্যা আমাদের সাপোর্ট করছে। কীসের ভয়? সব মুসলমান ছেলেরা যেন আমার মতোই হিন্দু মেয়েদের …যাই হোক ঐ ভাষা ইউজ় করছি না। এসব ওপেনলি বলার জন্যও তাকে ভয় পেতে হয় না, পুলিস মিছিমিছি অ্যারেস্ট করলেও এফআইআর নেয় না! আর আমি দুজনকে তাদের নিজেদের আপনজনেদের কাছে গিয়ে দান নিতে বলেছি বলে পুলিস অ্যারেস্ট করবে?”
“সে তো ফেসবুকে পোস্ট করেছে, রাস্তায় কিছু বলেনি…”
“বলছ কী? হাসালে! ওরা রাস্তাঘাটে তো যা বলছে তার কয়েকশো গুণ করে দেখায়। আর আমি তো ফেসবুকে ইঙ্গিতে কিছু পোস্ট করেছি দেখলেও তুমি ডিলিট করতে বলো।”
“যদি বোঝালেও না বোঝ কিছু করার নেই। তুমি অকারণে ট্রাবেল ইনভাইট করছ। বারবার বলছি, রাজ্যের পরিস্থিতি খুব খারাপ।”
আমার জীবনসঙ্গী একেবারে যথার্থ বলেছেন। সে জন্য আমাকে সাবধানে বাক-সংযম করে থাকতে বলাটাও একজন যথার্থ সংসারী দায়িত্ববান পুরুষের কর্তব্য। আমি বিপদে পড়লে তিনি উদ্ধার করতে গিয়ে যে সর্বস্ব খোয়াবেন, তাও আমি জানি। তাই সর্বদা সত্যটা চেপে রাজনৈতিক মন্তব্য এড়িয়ে চলাটাই আমাদের টিঁকে থাকার আপাতত সেরা কৌশল। এমনকি ভয়ে ভয়ে কোন কোন কথার কী মানে দাঁড়ায় ভেবে মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে রাখাটাই জীবন যাপনের একমাত্র উপায়।
উনি সত্যিই একেবারে ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনাদের ভাবতে বলছি, ঠিক এই কারণেই কি আমাদের গর্জে ওঠা উচিত নয়?”