সরেজমিনে কি ঘটেছিল: মুসলিম মেয়ের সাথে সম্পর্কের জেরে দিল্লিনিবাসী রাহুল রাজপুতের খুন

0
657

স্বাতী গোয়েল শর্মা

 

উত্তর-পশ্চিম দিল্লির আদর্শ নগরে মুলচাঁদ কলোনীতে বাংলোলাইন পেরিয়ে একটি সরু গলি আছে যেখানে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্তদের বাস, ২০ বছর বয়সী রাহুল রাজপুতের বাড়ি ছিল এখানেই।

৭ অক্টোবরের রাতে নিজের বাড়ির কাছেই একদল বস্তিবাসী তাকে বেধড়ক পেটায়, যার ফলে পরে রাহুলের মৃত্যু হয়।

রাহুলের বাড়ি

প্রত্যেকটি জায়গায় পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। রাহুলের বাড়ির বাইরে একদল যুবকের ভিড়, যারা পুলিশের লোকেদের কাছ থেকে খবর নেওয়া সাংবাদিকদের আর রাহুলের আত্মীয়স্বজনদের দেখছে। যদিও এই বিষয়ে তাদের মুখে কোন কথা নেই।

বাড়ির ভেতরে প্রবেশপথের কাছেরই একটা ছোট বদ্ধ ঘরে পুরুষেরা একত্রিত হয়ে শোক প্রকাশ করছেন, আর মহিলাদের ফুঁপিয়ে কান্না আর বিলাপের শব্দ আসছে আরো ভেতরের একটা ঘর থেকে।

রাহুলের মা রেণুকার সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়ছে যখন রাহুল তাকে পিটিয়ে হত্যাকারীদের সাথে কথা বলতে বাড়ির বাইরে গেল।

৭ অক্টোবরের সন্ধ্যেবেলায় প্রায় ছ’টা বাজছিল তখন। শেগুফা আমার ‘ দেবরানীর’ (দেবরের বউ) ফোনে ফোন করে বলল রাহুলকে বাইরে এসে কারুর সাথে দেখা করার জন্য ডাকল। রাহুল তখনি বেরিয়ে গেল এই বলে যে কিছু ছেলে তার সাথে তার টিউশন ক্লাসের ব্যাপারে কথা বলতে চায় আর সে এখনই ফিরে আসবে।”, জানিয়েছেন রেণুকা।

শেগুফা একজন মুসলিম মহিলা, রাহুলের বন্ধু, এবং খুব সম্ভবত  দুজনের প্রেমঘটিত সম্পর্ক ছিল।যে দলটি রাহুলকে খুন করে তাতে ছিল শেগুফার ভাই, খুড়তুতো ভাই আর তাদের বন্ধুরা। রিপোর্ট অনুযায়ী রাহুলের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে তারা বেশ রাগান্বিত মনে হচ্ছিল।

রাহুলের পুরোনো নম্বরটি আর ব্যবহারযোগ্য না থাকায় সে সম্প্রতি নিজের চাচীর নম্বর দিয়েছিল তার বন্ধুদের।

রেণুকা কোনরূপ সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছেন, আর বলেছেন ছেলের মৃত্যুর দিন তিনি শেগুফাকে প্রথম দেখেন। দলের অন্য একজনকেও তিনি চেনেন না।

রাহুলের বেরিয়ে যাওয়ার কিছু মিনিট পরেই কিছু ছেলে এসে রেণুকাকে খবর দেয় যে রাহুলকে বেধড়ক পেটানো হচ্ছে। খানিকক্ষণ পরেই তাঁর দেবর ধর্মপাল রাহুলকে আহত অবস্থায় বাড়ি নিয়ে আসেন। “রাহুলকে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল কিন্তু ওর শরীরের ওপর একফোঁটা রক্তের দাগও ছিল না। আমরা তাকে শুইয়ে দিই আর হলদি-দুধ খাওয়াই।”, তিনি বলেন।

“ওর অবস্থার অবনতি হয়। আমরা তখনি পাশের ডাক্তারখানায় তাকে নিয়ে যাই, কিন্তু শরীরে আঘাতের কোনরকম চিহ্নই ছিল না, ডাক্তার কী চিকিৎসা করবেন? তারপরই রাহুল প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায়। আমরা দ্রুত তাকে বাবু জগজীবন রাম হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তার বলেন যে প্রথমে কোভিড-১৯ টেস্ট করতে হবে। আমরা তার কাছে  আবেদন জানান আমার ছেলের চিকিৎসা করতে, যাবতীয় টেস্ট আমরা করিয়ে নিচ্ছি পরে। তারা আমার ছেলেকে ভর্তি নেন, কিন্তু  ১১ টার মধ্যে তাঁরা রাহুলকে মৃত ঘোষণা করেন।”

শেগুফা সেই সময়ে হাসপাতালে উপস্থিত ছিল। রেণুকা মনে করে বলেন যে সে কাঁদছিল। তাঁরা একে অপরকে দেখলেই তাঁদের কোন কথা হয়নি।

পরের দিন দুপুর তিনটেয় পরিবার দেহ পায়। রিপোর্ট অনুযায়ী, যে ডাক্তার পোস্ট মর্টেম করেছেন তিনি জানিয়েছেন যে মারের চোটে প্লীহা ফেটে যাওয়ার কারণে রাহুলের মৃত্যু হয়।

রাহুলের একটি ১৬ বছর বয়সী বোন আছে, সে স্কুলে পড়ে। তার পরিবার তার ঠাকুমা আর চাচার পরিবারের সাথে বাস করে।

স্কুলের পড়া শেষ করে রাহুল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওপেন লার্নিংয়ে বি.এতে  ভর্তি হয়েছিল। এটা ছিল তার দ্বিতীয় বর্ষ। লকডাউন শুরু হওয়ার আগে ফ্রিডম ইংলিশ অ্যাকাডেমি নামে আদর্শ নগরের একটি অলাভজনক সংস্থায় রাহুল দেড় বছর ধরে বিনামূল্যে ইংরেজি পড়িয়েছিল। মাত্র একমাস আগে সে বাড়ি থেকে টিউশন ক্লাস করানো আরম্ভ করে।

“সারাদিন কাজ করেও সে ফ্রিডম স্কুল থেকে কিছুই পেত না। ও বলত এই অভিজ্ঞতা তাকে পরবর্তীকালে কাজ পেতে সাহায্য করবে। লকডাউনে আমাদের আর্থিক সংকটের সময়ে রাহুল বাড়ি থেকে ক্লাস করানোর ব্যবস্থা করে। এমনকী আমিও একটা কাজ শুরু করি।”, তিনি জানান।

এই সংকটের কারণ হল রাহুলের বাবা সঞ্জয় কুমার লকডাউন শুরু হওয়ার কিছু সপ্তাহ আগেই একটি নতুন গাড়ি কিনেছেন, তিনি পেশায় ক্যাব চালক। পরবর্তী চার বছরের জন্য তাঁকে মাসে ১৭,০০০ টাকা কিস্তি গুনতে হবে।

দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকা আম আদমি পার্টির নেতারা পরিবারের সাথে দেখা করে গিয়েছেন, আর মিডিয়ায় ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন।

রেণুকা জানিয়েছেন যে তিনি শুনেছেন যে ফ্রিডম অ্যাকাডেমিতেই রাহুল আর শেগুফার আলাপ হয়। “আমি শুনেছি ও সেখানকার একজন ছাত্রী ছিল। ওই সংস্থায় বস্তি এলাকার গরীব ছেলেমেয়েদেরই পড়ানো হয়। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই। এমনকি আমিও খবর পড়েই এসব জানতে পারছি।”, তিনি বলেছেন।

রাহুলের বাড়ির বাইরের দলটিও খুঁটিনাটির ব্যাপারে নিশ্চিত নয়।

দীনেশ ভরদ্বাজ নামে এক প্রতিবেশীর কথায় তাঁদের এলাকায় সকলেই হিন্দু এবং সবাই মিলেমিশেই থাকেন।

রাজু নামের এক ব্যক্তি দলটির কাছে এগিয়ে আসেন আর নিজেকে রাহুলের ফুফা (পিসে) বলে পরিচয় দেন, আর বলেন যে রাহুলের পরিবারের সাথে কোন সম্প্রদায়েরই কোন শত্রুতা নেই, দোষীদের কঠিনতম শাস্তি দাবী করেন, তারা যেইই হোক না কেন, যাতে আগামী দিনে একটি উদাহরণ স্থাপিত হয়।

রাজু ওই এলাকারই বাসিন্দা এবং জানিয়েছেন যে পরিবারেরই কেউই জানেন না হত্যাকারী কারা বা তারা কোথায় থাকে।

গলির বাইরে বাঁদিকে ৫০ মিটার মত দূরে দলটি রাহুলকে পেটাতে আরম্ভ করে। এক দোকানদার নাম না প্রকাশের অনুরোধ করে জানিয়েছেন যে তিনি ঝগড়াটা দেখেছিলেন, ” ১৪-১৫ জন ছেলে হবে। তারা ওকে টেনে রাস্তার ভেতর দিকে নিয়ে চলে গেল, ফলে আমরা একেবারেই দেখতে পেলাম না আর। কিন্তু ওইখানে লাগানো সিসিটিভিতে সবই ধরা পড়েছে।”, বলেছেন তিনি।

পুলিশ এখন পর্যন্ত পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে, কিন্তু মাত্র দুজনের নাম জানিয়েছে – মনোয়ার হুসেন, হাসিবুলের ছেলে আর মহম্মদ রাজ, পিতা আব্দুল মাহার আফরোজ। পুলিশের কথা অনুযায়ী বাকিরা নাবালক। তারা সকলেই জাহাঙ্গীরপুরির বাসিন্দা, মাত্র দু কিলোমিটার দূরেই এই এলাকা।

বাঙালি উদ্বাস্তুদের নিয়ে গঠিত জাহাঙ্গীরপুরী মূলত মুসলিমপ্রধান এলাকা। ডিসেম্বর থেকেই এই এলাকা সিএএ বিরোধী আন্দোলনের কারণে উত্তপ্ত হয়ে আছে কয়েক মাস ধরে।

জাহাঙ্গীরপুরীর সি ব্লকের “দুই নম্বর গলির” বাইরে, পুলিশের খবর অনুযায়ী যেখানে এক অভিযুক্তের বাড়ি, বাসিন্দারা বলেছেন তাঁরা এই ধরণের কোন ঘটনার কথা শোনেননি। সরু গলিটার ভেতরে, যেখানে প্রত্যেক দুটো দোকান পরে খোলাখুলি মাংস ঝুলছে, বাসিন্দারা আমাকে হাসিবুল আর তার স্ত্রী মর্জিনা বিবির কাছে নিয়ে গেল।

হাসিবুলের কথায় তাঁর ছেলে খুনী নয়। “কিছু ছেলেরা এসে তাকে তাদের সাথে জোর করে নিয়ে গেল,” তিনি বলেছেন।

“৮ অক্টোবর আমি সারাদিন হাসপাতালেই ছিলাম। আমার স্ত্রী আর পুত্রবধূ উভয়ই গর্ভবতী ছিল। আমি বাড়ি ফিরতেই পুলিশ মনোয়ারকে খুঁজতে আসে।”, তিনি জানালেন।

হাসিবুল বলেছেন যে তাঁর ছেলে শান্তভাবে নীচে নেমে এসে পুলিশের সাথে কথা বলে, যেটা প্রমাণ যে সে জানতই না ছেলেটা মারা গেছে।

“আমার ছেলে মেয়েটা বা তার ভাই কাউকেই চেনে না, যারা এই ষড়যন্ত্র করেছে। আমার ছেলেকে দয়া করে বাঁচান,” বললেন হাসিবুল, যাঁর তিন ছেলে আর একটি ছোট মুদির দোকান আছে।

অন্য বাসিন্দারা কথা বলতে রাজি হননি।

কলোনির অপর প্রান্তে এইচ ব্লক জেজে ক্যাম্পাস নামে কিছু বাড়ির জটলা আছে, জেজে মানে ঝুগগি ঝোপড়ি। এই মুসলিম প্রধান বস্তি থেকে পুলিশ মেয়েটির ভাই মহম্মদ রাজ সহ বাকি চার অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে।

একটি খবরের চ্যানেলকে প্রত্যক্ষদর্শী শেগুফা এই কথাগুলি জানিয়েছে:

“আমি ওই দিন রাহুলের সাথে ছিলাম (৭ অক্টোবর।) রাহুলের শরীর ভালো ছিল না। সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ আমার খুড়তুতো ভাই (নাবালক হওয়ার কারণে নাম প্রকাশ করা হয়নি) আমাকে ডেকে বলে সে রাহুলের সাথে কথা বলতে চায়, কিন্তু ওর নম্বর বন্ধ আসছিল। আমি বলি হ্যাঁ ও আর ওই নম্বর ব্যবহার করছে না, তার বদলে তার চাচীর নম্বর তাকে দিই।”

“আমার ভাই রাহুলকে বাইরে এসে পাঁচ মিনিটের জন্য কথা বলতে ডাকে। রাহুল ফোনটা কেটে আমাকে জিজ্ঞেস করে তার যাওয়া উচিত হবে কিনা। আমি বলি হ্যাঁ, চলো গিয়ে পাঁচ মিনিটের জন্য কথা বলে আসি। আমি ভাইকে ফোন করে জানাই যে রাহুল রাজি আর সে ওই জায়গায় আসতে পারে। কিন্তু তাদের দেখা হতেই দলটা রাহুলকে মারতে আরম্ভ করে। আমি তাদের থামাতে চেষ্টা করলেও তারা থামেনি।”

অভিযুক্তদের কলোনী

জেজে ক্যাম্পের একজন প্রধান, ডেপুটি প্রধান, সেক্রেটারি আর ডেপুটি সেক্রেটারি আছে – সকলেই মুসলিম। প্রধান শেখ ইশাক বলেছেন তিনিই ওই চারজনকে ছেলেকে গ্রেফতার করিয়েছেন। “পুলিশ আমার কাছে অভিযুক্তদের ফটো নিয়ে এসে তাদের নাম বলে। আমি তাদের প্রত্যেকটা বাড়ি দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে যাই আর তাদের গ্রেফতার করাই। তারা খুন করে থাকলে তাদের ফাঁসি হোক,” তিনি বলেছেন।

“কিন্তু নির্দোষদের ফাঁদে ফেলবেন না। আমি এটাই বলতে চাই। যেমন অন্য চ্যানেলগুলো করছে সেভাবে এটাকে হিন্দু-মুসলিম মোড় দেবেন না,” বলেছেন তিনি।

এক কামরার যে ভাড়ার বাড়িটিতে শেগুফা থাকে, সেখানে একজন ছোট ভাই ছাড়া কেউ নেই, খালি পড়ে আছে।

শেগুফার মা

প্রতিবেশীদের কথায় শেগুফার বয়স প্রায় ২২। তার বাবা আবদুল মাহার আফরোজ একজন দিন মজুর। তার চারজন ভাই আর সে একমাত্র বোন। মহম্মদ রাজ তার থেকে বয়েসে ছোট। পরিবারটি মাত্র কয়েক বছর আগে ভাগলপুর থেকে দিল্লি এসেছিল। ভাড়ায় থাকে তারা।

“তারা খুবই গরীব,” এক প্রতিবেশী বলেছেন। খুড়তুতো ভাইটির বাড়ি দুটো বাড়ি পরেই।

মূল প্রবন্ধটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন শুভম ক্ষত্রী। প্রবন্ধ ও ছবিগুলির প্রকাশের অনুমতির জন্য স্বরাজ্যের কাছে ঋণী।