হিন্দু মহাসভার জন্যই জলপাইগুড়ি ভারতে

কম্যুনিস্ট ম্যাপের তিন জেলা পাকিস্তানে

দেশবিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাঞ্জাব ও বাংলার সীমানা নির্ধারণের জন্য ইংরেজ সরকার বিচারপতি স্যার সিসিল র‍্যাডক্লিফের নেতৃত্বাধীন সীমানা কমিশন গঠন করে। কমিশনে স্যার র‍্যাডক্লিফ সহ পাঁচজন সদস্য ছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারপতিদ্বয় শ্রী বিজন কুমার মুখোপাধ্যায় ও শ্রী চারুচন্দ্র বিশ্বাস ও মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বিচারপতিদ্বয় জনাব আবু সালেম মোহাম্মদ আক্রাম ও জনাব এম এ রহমানকে সদস্য মনোনীত করা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য আর একটি বিষয় হল, এই কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে র‍্যাডক্লিফের নাম প্রস্তাব করেছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের একচ্ছত্র অধিপতি জনাব মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ।

স্বাধীনতার আগে উত্তরবঙ্গ বলতে ছিল রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং। কোচবিহার তখন ছিল দেশীয় করদমিত্র রাজ্য। প্রাক স্বাধীনতা পর্বে উত্তরবঙ্গের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল – সবকটি ছিল হিন্দুপ্রধান। একমাত্র মালদহ জেলার ইংরেজবাজার, দিনাজপুরের শহরে মুসলিমদের সংখ্যা হিন্দুদের কাছাকাছি ছিল। তবে জলপাইগুড়ি শহরে সীমিত সংখ্যায় একটি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপস্থিতিও ছিল। তখন উত্তরবঙ্গের দুই জেলায় দু’জন নবাব ছিলেন, জলপাইগুড়ি আর বগুড়ায়। তাঁরা শহরে বাস করতেন।  উত্তরবঙ্গের ওইসব জেলায় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল কৃষক ও গ্রামীণ। অবশ্য কিছু ছোট জমিদার, জোতদার ছিল।

স্বাধীনতার পূর্বে আদমশুমারিতে জলপাইগুড়ির জনবিন্যাস নিম্নরূপ ছিল –

১৯৪১ সালের Census –

মোট জনসংখ্যা – ১০, ৮৯, ৫১৩ –

বর্ণহিন্দু – ২, ২৬, ৯৪৩ –

তপশিলী হিন্দু – ৩, ২৫, ৫০৪ –

মুসলমান – ২, ৫১, ৪৬০ –

অন্যান্য বা প্রকৃতি উপাসক – ১৫, ৩০০ –

জলপাইগুড়ি জেলার জনবিন্যাসের ধর্মভিত্তিক কাঠামো মুসলিম লীগের পক্ষে পাকিস্তান হওয়ার পথকে সুগম করে দেয়। মুসলিম লীগ ওই জেলার সদর মহকুমাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছিল। তাছাড়া, জলপাইগুড়ির প্রভাবশালী নবাব মোশারফ হোসেন দীর্ঘদিন মন্ত্রী ছিলেন। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লিগেও তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। জলপাইগুড়ির নবাবের প্রভাব খর্ব করার মতো কোনও গোষ্ঠী বা হিন্দু কংগ্রেসে ছিলোনা। তখম হিন্দু মহাসভার ব্যাপ্তিও ছিল সীমিত। কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি তখন ছাত্র ও যুবদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

প্রয়াত শ্রী পাখি ঘটক, শ্রী বাদল সরকার, শ্রী ঘনশ্যাম মিশ্র, শ্রী অনিলধর গুহনিয়োগীর কথা কে শুনবে? আর রইল ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি। তারা তো মুসলিম লীগের সাথে যোগ দিয়ে জলপাইগুড়িকে পাকিস্তানে যোগ দেওয়ানোর পরিকল্পনা করছে! জলপাইগুড়ি ভারত না পাকিস্তান – তাতে সিপিআই র কিছু আসে যায়? তারা স্বপ্ন দেখছিল আর একটি সিসিপি হবে (অর্থাৎ কম্যুনিস্ট পার্টি অফ পাকিস্তান)। সিপিআই দেশবিভাগের সমর্থনে ১৯৪৩ সালে যে মানচিত্র প্রকাশ করেছিল তাতে জলপাইগুড়ি জেলা সহ মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর জেলাকে পাকিস্তানে রাখা হয়েছিল।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। হিন্দু মহাসভার জন্মলগ্ন থেকেই জলপাইগুড়ি জেলা ও সদর শহরে দলের সাংগঠনিক কাঠামো বেশ শক্তিশালী ছিল। ১৯৩১ এবং ১৯৪১ সালের census এ সাঁওতাল-ওঁরাও উপজাতির সংখ্যা জলপাইগুড়িতে কম ছিলোনা। ‘প্রকৃতি পুঁজারী’ হিসেবে তাঁদের দেখানোয় হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন। চা বাগান অঞ্চলে ওঁরাও জনজাতি ও সাঁওতালদের হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করার কাজ করেন জেলার বিশিষ্ট জননেতা শ্রী কাশীশ্বর চক্রবর্তী। তিনি ‘সত্যম শিবম’ ধর্মীয় চিন্তা প্রচার করেছিলেন। জলপাইগুড়ি জেলা কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের একাংশও এই জনজাতি সমূহ, বিশেষ করে – রাভা, কোচ, পালিয়া-মোরঙ, চুতিয়া-মেচ, গাড়ো, টোটো প্রভৃতিদের হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই কাজের জন্য তাঁদের কংগ্রেস থেকে show cause করা  হয় এই বলে যে এই পর্যায়ের সাম্প্রদায়িক কাজকে কংগ্রেস কোনমতেই এবং কোনও অবস্থাতেই সমর্থন করেনা।জাতীয় কংগ্রেস census boycott করেছিল। জেলার নেতারা কংগ্রেসের এই অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত না মেনে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে ‘হিন্দু মহাসভা’ তে যোগ দেন।

Census কে কেন্দ্র করে জেলা কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেছিলেন জেলা কংগ্রেসের কর্ণধার শ্রী যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, শ্রী শ্রীনাথ হোড়, প্রখ্যাত কবিরাজ শ্রী সতীশ চন্দ্র লাহিড়ী। এঁরা হিন্দু মহাসভায় যোগ দিয়ে প্রকৃতি উপাসকদের ‘হিন্দু’ হিসাবে census এ উল্লেখ করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে সফল হয়েছিলেন। এর ফলে জলপাইগুড়ি জেলা পুরোপুরি পাকিস্তানে চলে যাবার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। শত অনিচ্ছা সত্বেও তেঁতুলিয়া সহ পাঁচটি থানাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল। তেঁতুলিয়া পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ফলে তেঁতুলিয়ার মানুষের মনে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা অবিস্মরণীয়। প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক ও সোশ্যালিস্ট নেতা শ্রী সতীনাথ ভাদুড়ীর কলমে তা পরিস্ফুট হয়েছে। তাঁর “গণনায়ক”গল্পে রাজবংশী পুরোহিতের জিজ্ঞাসা – ‘বাপ্-পিতামহ’র আমল থেকে আমরা রয়েছি – পাকিস্তানে চলে গেলেই হল?’

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ঐতিহাসিক অধ্যাপক ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষ

 

কিছু কথা – আলোচ্য প্রবন্ধটির মূল লেখক হলেন শ্রী চিনতু সেন ও এটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল “যুগের ডাক” নামক এক পাক্ষিক  সংবাদপত্রে; প্রকাশ কাল – জুলাই ২৮, ২০১৮।