– চিন্ময়ানন্দ অবধূত
নাম সর্দার স্বরণ সিং। ১৯৪৬ সালের অবিভক্ত পঞ্জাবের খিজর হায়াত খান সরকারের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পরে চাচা নেহরুর আমন্ত্রণে মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। তিনি বিভিন্ন দফায় ইস্পাত, খনি, রেলওয়ে, খাদ্য এবং কৃষি দফতরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু নেহরু অচিরেই বুঝতে পারেন স্বরণ সিং একজন দক্ষ কূটনীতিবিদ। তাই চীন পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় তাঁকে দেখা যেতে থাকে। লালবাহাদুর শাস্ত্রী স্বরণ সিংয়ের প্রতিভার সম্পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছিলেন, তাঁর ওপর বিদেশমন্ত্রকের দায়িত্ব অর্পণ করে।ইন্দিরা গান্ধীর জমানাতেও বিদেশমন্ত্রক স্বরণ সিংয়ের দায়িত্বে ছিল, পরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ভার দেওয়া হয়।
ভিন্দ্রানওয়ালের মত গোখরো সাপের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কিছুদিনের মধ্যেই আকালি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু আকালি দলের নেতারা খোলাখুলি প্রতিবাদ করতে পারছিলেন না, প্রাণের দায়ে। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য লোঙ্গোয়াল শরণাপন্ন হয়েছিলেন অভিজ্ঞ কুটনীতিবিদ স্বরণ সিংয়ের।
স্বরণ সিং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে বোঝাতে সমর্থ হলেন আকালি নেতারাও ভিন্দ্রানওয়ালের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে চান। এদিকে ইন্দিরা গান্ধী তো আলোচনায় বসতে আগ্রহী ছিলেন আগে থেকেই, কেননা তিনি বুঝতে পারছিলেন খালিস্তান সমস্যা একটি ক্যান্সারের আকার ধারণ করছে।
‘ধর্মযুদ্ধ মোর্চার’ আন্দোলনের ফলে লোঙ্গোয়াল ছাড়া আকালি দলের প্রধান নেতারা তখন কারারুদ্ধ। প্রকাশ সিং বাদল ছিলেন লুধিয়ানা জেলে, তোহরা সরকারী আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন ফিরোজপুর জেলে। প্রথমে স্বরণ সিং নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে রাতের অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক নেতার সঙ্গে দেখা করে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করলেন। কিছুদিন পর ১৯৮২ -র ১৫ ই অক্টোবর স্বরণ সিংয়ের অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধী আকালি নেতাদের মুক্তি দিলে স্বরণ সিং আকালি শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা আলোচনায় বসে বোঝাতে সমর্থ হলেন, ইন্দিরা গান্ধী আনন্দপুর সাহিব রেজল্যুশনের দাবি দাওয়া খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করতে পারেন। আপাততঃ কেন্দ্র থেকে পঞ্জাবের কিছু ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তি, যেমন জলবন্টন সমস্যা ইত্যাদির দিকে নজর দেওয়া উচিত। আকালি দলের ত্রিমূর্তির তখন “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।” ভিন্দ্রানওয়ালে নামক বিষধর সর্পের ফণা তাঁদের মাথার ওপর দুলছে, যে কোনো মূহুর্তে ছোবল মারতে পারে। তাই আনন্দপুর সাহিব রেজল্যুশনে উল্লিখিত দাবিগুলোর থেকে অনেক কম দাবি দাওয়াতেই তাঁরা রাজি।
এবার আর একটা গাঁট, ভিন্দ্রানওয়ালের মত গোখরোকে বাগ মানানো। স্বরণ সিংয়ের মত সাপুড়ে অবশ্য চীন বা পাকিস্তানের মত বিদেশী ব্ল্যাক মাম্বাদের সঙ্গে পরিচিত। তাই ভিন্দ্রানওয়ালের সামনাসামনি হওয়ার জন্য খুব একটা চিন্তিত ছিলেন না তিনি। তাছাড়া ঘাঘু ডিপ্লোম্যাট ভালোই বুঝেছিলেন, ভিন্দ্রানওয়ালে আসলে ভীতু।
সেই স্বরণ সিং একদিন সটান গুরু নানক নিবাসে ভিন্দ্রানওয়ালের ঘরে গিয়ে হাজির হলেন। একসময় ঘর ফাঁকা হয়ে যেতে ভিন্দ্রানওয়ালেকে খোলাখুলি বললেন ভিন্দ্রানওয়ালেকের চ্যালা চামুন্ডারা যে বন্দুক নিয়ে মোটরসাইকেলে করে গুন্ডামি করে বেড়াচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে যেকোনও সময় তাতে ফুলস্টপ বসিয়ে দিতে পারে। আর তার আর আকালি দলের এই “ধর্মযুদ্ধ” শিখেদের ভালোর থেকে ক্ষতি করছে বেশি। সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকার কোনও কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ভিন্দ্রানওয়ালে এইসব আন্দোলন বন্ধ করুক আর ভালোয় ভালোয় গুরু গোবিন্দ সিং নিবাস ছেড়ে চক মেহতায় নিজের ডেরায় ফিরে যাক আর ধর্মকর্মে মন দিক। স্বরণ সিং এটাও জানিয়ে দিতে ভুললেন না যে ম্যাডাম স্বয়ং আকালিদের সঙ্গে একটি মিটমাটে রাজী হয়েছেন। তবে হ্যাঁ, ভিন্দ্রানওয়ালের যদি ব্যক্তিগত কোনও দাবিদাওয়া থাকে সেটা অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকার বিবেচনা করে দেখবে।
ভিন্দ্রানওয়ালে “হিন্দু সরকারের শিখেদের প্রতি বঞ্চনার নীতি” নিয়ে তার স্বভাবসিদ্ধ বক্তৃতা শুরু করতেই স্বরণ সিং সরাসরি তাকে মূল বক্তব্যে আসতে বললেন। শেষপর্যন্ত ঠিক হল ভিন্দ্রানওয়ালের দুই শিষ্য অমৃক সিং আর তারা সিংকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে হবে। আর আকালি দলের সঙ্গে একটা রফা হলেই ভিন্দ্রানওয়ালের শিষ্য, যাদেরকে পুলিশ ‘ধর্মযুদ্ধ মোর্চা’ -রসময় গ্রেফতার করেছিল, তাদের মুক্তি দিলেই ভিন্দ্রানওয়ালে চক মেহতায় ফিরে যাবে।
স্বরণ সিং এরপর ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর সঙ্গে হওয়া আকালি দল আর ভিন্দ্রানওয়ালের সঙ্গে আলোচনার ফলাফল ব্রিফ করলেন। ম্যাডাম তো খুব খুশি, তবে বললেন একটি ক্যাবিনেট সাব কমিটি তৈরী করা হবে আকালিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য। ঐ সাব কমিটিতে থাকবেন প্রণব মুখার্জি, আর ভেঙ্কটরামন, পি ভি নরসিমা রাও আর পি সি শেঠি।
১৯৮২ -র ২ রা নভেম্বর দলের শীর্ষ নেতা চতুষ্টয় প্রকাশ সিং বাদল, গুরচরণ সিং তোহরা, জগদেব সিং তালওয়ান্ডি এবং বলবন্ত সিং ঐ সাব কমিটির সঙ্গে আলোচনায় বসেন। দুই তরফই মতৈক্যে পৌঁছলেন যে আকাশবাণী স্বর্ণমন্দির থেকে গুরুবাণী প্রচার করবে, অল ইন্ডিয়া গুরদোয়ারা অ্যাক্টের সম্প্রসারণ করা হবে, শিখেরা ডোমেস্টিক ফ্লাইটে একটি ছোট কৃপাণ নিয়ে যেতে পারবে, অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরের কাছাকাছি সব তামাক, মদ এবং মাংসের দোকান বন্ধ করা হবে। প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি জলবন্টন সমস্যা আর চন্ডীগড়ের পঞ্জাবের অন্তর্ভুক্তিকরনের ব্যাপারটা মীমাংসা করারও আশ্বাস দেওয়া হল।
পরেরদিন, অর্থাৎ তিন তারিখ সকালে পার্লামেন্ট ভবনে পি ভি নরসিমা রাওয়ের ঘরে ক্যাবিনেট কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি সি আলেকজান্ডার, ক্যাবিনেট সেক্রেটারি সি আর কৃষ্ণস্বামী, হোম সেক্রেটারি টি এন চতুর্বেদী আর স্পেশাল সেক্রেটারি (হোম) পি পি নায়ার এবং স্বরণ সিং নিজে। মিটিংএ ঠিক করা হল চার তারিখে গৃহমন্ত্রী পি সি শেঠি পার্লামেন্টে আকালি আর সরকারের মধ্যে সমঝোতার ওপরএকটি বিবৃতি দেবেন।
বিবৃতিতে লেখা থাকবে –
১. সমস্ত ধর্মীয় দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে
২. কেন্দ্রীয় সরকার ‘আনন্দপুর সাহিব রেজল্যুশন’ অনুসারে পঞ্জাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা যায় কিনা সেটা নিয়ে একটি কমিশন তৈরী করবে
৩. ১৯৮১ -র ৩১ শে ডিসেম্বর হওয়া চুক্তি অনুযায়ী পঞ্জাব জলসম্পদ বন্টনে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল তা পূরণ করার চেষ্টা করা হবে
৪. চন্ডীগড়কে পঞ্জাবের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, কিন্তু তার বিনিময়ে পঞ্জাব হরিয়ানাকে ফজিলকা আর আবোহার দেবে না, অন্যভাবে এর মিটমাট হবে
৫. ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতা সংগ্রামে শিখেদের ভূমিকা নিয়ে একটি অধ্যায় থাকবে।
চার তারিখেই এই বিবৃতির একটি কপি আকালি নেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
৪ তারিখ সকালে আকালি দলের নেতারা অমৃতসরের এসজিপিসি অফিসে বসে সরকারী বিবৃতির জন্য অপেক্ষা করছেন। অধৈর্য্য হয়ে একজন স্বরণ সিংকে ফোন করে বসলেন। স্বরণ সিং সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন প্রণব মুখার্জিকে। প্রণববাবু উত্তর দিলেন বিবৃতির একটি কপি ইতিমধ্যেই অমৃতসরে পাঠানো হয়েছে। গৃহমন্ত্রী পার্লামেন্টে বিবৃতিটি পাঠ করলেই আকালি দলকে সেটা দেওয়া হবে।
বারোটা নাগাদ আকালি দলের থেকে আর একটি ফোন এল।আকালি নেতারা ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন তাঁরা বিবৃতির কপি পেয়েছেন, কিন্তু তাতে সাবকমিটির সঙ্গে মিটিংয়ে যেসব আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বাসঘাতকতায় বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ আকালি দল ঠিক করেছেন ‘জনযুদ্ধ মোর্চা’ চালিয়ে যাবেন।
স্বরণ সিংয়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। প্রণববাবুকে ফোন করায় প্রণববাবু উল্টে জানতে চাইলেন এই অবস্থায় কি করণীয়? স্বরণ সিং শুধু কোনওমতে বলতে পারলেন ভবিষ্যতে তিনি এই ব্যাপারে কোনও আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন না।
১৯৮২ -র ৪ নভেম্বর পার্লামেন্টে গৃহমন্ত্রী পি সি শেঠি যে বিবৃতিটি পাঠ করেন তাতে আকালি দলের সঙ্গে সাবকমিটির মিটিংয়ে যা ঠিক হয়েছিল তার কোনও উল্লেখই ছিল না। শুধু বলা হয়েছিল সরকার আকালি দলের সবরকমের ধর্মীয় দাবি দাওয়া মেনে নিলেও আকালি দলের অন্যান্য রাজনৈতিক দাবি দাওয়ার জন্য তা ফলপ্রসূ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ সরকার নিজের কথার খেলাপ করল, আর পুরো দোষটা চাপিয়ে দিল আকালিদের ঘাড়ে।
কিন্তু একরাতের মধ্যেই সরকারের এই পাল্টি খাওয়ার কারণ কি?
কিছুদিন পরে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রের সাংবাদিক জি এস চাওলাকে গৃহমন্ত্রকের স্পেশাল সেক্রেটারি পি পি নায়ার বলেন, তিন তারিখ রাত্রি এগারোটা নাগাদ বিবৃতির পরিবর্তন করেন ইন্দিরা গান্ধী নিজে।
জৈল সিংকে গৃহমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিলেও শকুনি মামা জৈল সিংয়ের প্রভাব ইন্দিরা গান্ধীর ওপর থেকে পুরোপুরি মুছে যায়নি। জরুরী অবস্থা ঘোষণার পর যে মুষ্টিমেয় কংগ্রেস নেতা ইন্দিরা গান্ধীর সিদ্ধান্তের খোলাখুলি সমালোচনা করেছিলেন, স্বরণ সিং ছিলেন তার মধ্যে একজন। জৈল সিং ইন্দিরা গান্ধীকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন, স্বরণ সিংয়ের পরিবর্তে যদি ইন্দিরা পুত্র রাজীব সমাধানসূত্র খুঁজে বের করতে পারেন তবে ভবিষ্যতে রাজীবের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রাস্তা প্রশস্ত হবে। আরও একটা কারণ, রাজীব গান্ধী ছাড়াও জৈল সিং নিজেও আর একজনের রাজনৈতিক কেরিয়ার গড়ে দিতে চাইছিলেন। চাইছিলেন খালিস্তান সমস্যার সমাধানের কৃতিত্বে যাতে রাজীবের সঙ্গে আরও একজনের নাম যোগ হয়, রাজনীতির আঙিনায় জৈল সিং যাঁর ধর্মপিতা বলে পরিচিত ছিলেন, তিনি হলেন পঞ্জাবের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং।
শুধুমাত্র স্বজনপোষণ আর পরিবারতন্ত্র কায়েম রাখার জন্য আকালি দল আর স্বরণ সিং, দুই তরফের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করা হল। বিশ্বাসঘাতকতা করা হল পঞ্জাবের জনগণের সঙ্গে, যার দাম ভবিষ্যতে পঞ্জাবের শিখ আর হিন্দু উভয় ধর্মের লোকদের দিতে হয়েছিল নিজেদের রক্ত দিয়ে, ইন্দিরা গান্ধীকে দিতে হয়েছিল নিজের জীবন দিয়ে।
(ক্রমশ)
তথ্যসূত্রঃ
১. The Khalistan Conspiracy. GBS Sidhu.