রাখালদাসের সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের শতবর্ষ স্মরণে সাবর্ণ পরিবার

0
895

বঙ্গদেশ ডেস্ক:প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও আন্তর্জাতিক ইতিহাস উৎসবের আয়োজন করেছে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার পর্ষদ, দেখতে দেখতে যা ১৬তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। এই ষোড়শ আন্তর্জাতিক ইতিহাস উৎসবে এবছরের থিম ‘সিন্ধু সভ্যতা’ এবং ‘থিম কান্ট্রি’ হিসেবে থাকছে দু’টি দেশ—ফ্রান্স ও শ্রীলঙ্কা। সিন্ধু সভ্যতাকে ফুটিয়ে তুলে স্মরণ করা হবে বিশ্ববন্দিত বাঙালি ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কলকাতার বড়িশার সাবর্ণ সংগ্রহশালায় আগামী ১৩ থেকে ১৬ ফ্রেব্রুয়ারি আয়োজন করা হয়েছিল এই উৎসবের।

দীর্ঘ ১০০ বছর আগে আবিষ্কৃত প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস-কে ফিরে দেখা গিয়েছে এই আন্তর্জাতিক ইতিহাস উৎসবে। ‘সিন্ধু সভ্যতা’ স্মরণের পাশাপাশি
এবারের উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল দেশ-বিদেশের পুতুল। ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স, ভিয়েতনাম সহ দশটি দেশ থেকে আনা হচ্ছে বিভিন্ন ‘প্রাচীন’ পুতুল। এছাড়াও ছিল আন্দামান বা নাগাল্যান্ডের আদিবাসীদের তৈরি দেশীয় পুতুলের সম্ভার। প্রদর্শিত করা হবে লোথাল বা ঢোলাভিরার মতো ওই এলাকার বিশেষ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, খ্রীষ্টপূর্ব ২৯০০ সালে ওড়িশার কেওনঝড় এলাকার মানুষের ব্যবহৃত হাতের বালা।সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার পর্ষদের সম্পাদক দেবর্ষি রায় চৌধুরীর বক্তব্য, প্রতিবছর আমাদের ইতিহাস উৎসবের নির্দিষ্ট থিম বরাদ্দ থাকে। ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এ বছরের বিশেষ থিম ‘সিন্ধু সভ্যতা’।

বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত সিন্ধুর লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যা বদলে দেয় গোটা ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসকে। কিন্তু বেঁচে থাকতেই তিনি দেখেছিলেন কীভাবে তাঁর প্রাপ্য কৃতিত্ব হাতিয়ে নিচ্ছে ব্রিটিশরা। এবং তিনি যা দেখে যেতে পারেননি, তা হলো—নিজ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও তাঁকে সম্মান দেয়নি।

মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদনটি রচনা করা হয়েছিল ১৯২০ সালে, এবং সেটি তৈরি করেছিলেন রাখালদাসই। কিন্তু সেটিকে গোপন করার চেষ্টা করেছিলেন জন মার্শাল। অথচ ১৯২২ সালে রাখালদাসের জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি সম্পাদনা করে তিনি তৈরি করেন তাঁর বিখ্যাত ‘Mohenjodaro and the Indus Civilisation’ বইটি।

রাখালদাস ১৯২০ সালে প্রথম সিন্ধু নদীর শুকনো গর্ভে স্তূপ বা ঢিবির সন্ধান পেয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে তিনি গ্রিকদের বিজয়স্তম্ভ খুঁজতে শুরু করেন সেখানে। তাঁর উপর মার্শালের নির্দেশ ছিল গান্ধার যুগের (১ম থেকে ৫ম শতক) ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধানের, যাতে জে টি হুইলারের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় যে ভারতীয় সভ্যতার শিক্ষালাভের সূচনা হয়েছিল গ্রেকো-রোমান সভ্যতার কাছ থেকে। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশদের বিশ্বাস ছিল যে, ভারতীয়দের পক্ষে নিজে থেকে সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণীর স্থাপত্য ও ভাস্কর্য নির্মাণ অসম্ভব, নিশ্চয়ই তারা নিশ্চয় অন্য কারো থেকে শিখে বা অনুকরণ করে সেগুলো তৈরি করেছিল।

প্রথম পর্যায়ের খননকাজ থেকে বেরিয়ে আসে কুষাণ যুগের (২য়-৩য় শতক) একটি বুদ্ধ স্তূপ বা ঢিবি। মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের মুহূর্ত ছিল অনেকটা এমন: রাখালদাস স্তূপ খোঁড়ার সময় বুঝতে পারেন যে কোনো মাটির তৈরি পাত্রের ভেতরের অংশ সেখানে রয়েছে। তিনি সেই পাত্রে কোনো ফাটল রয়েছে কিনা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন। ঠিক তখনই আঘাতে তার আঙ্গুল কেটে যায় এবং ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে তিনি বুঝতে পারেন, এটি ছিল মাইক্রোলিথ এবং এরপর আরও অনেক মাইক্রোলিথ সেখান থেকে উদ্ঘাটিত হতে থাকে।

রাখালদাস বুঝতে পেরেছিলেন, এগুলো হলো আদি-ইতিহাসের (proto-history) জিনিসপত্র। আদি-ইতিহাস বলতে বোঝানো হয়েছে, প্রাগৈতিহাস (pre-history) ও ইতিহাসের মধ্যবর্তী সময়কাল, যখন একটি নির্দিষ্ট সভ্যতা বা সংস্কৃতি লিখতে শুরু হয়নি বটে, কিন্তু ওই একই সময়ে অন্য কোনো সভ্যতা বা সংস্কৃতিতে লেখার প্রচলন শুরু হয়েছে। প্রাপ্ত মাইক্রোলিথগুলো নিয়ে তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন এবং পেয়ে যান মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের পথ।

মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা এই আবিষ্কারের ফলে ভারতীয় সভ্যতা এক ধাক্কায় চলে গেল মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতার (বিশ্বের প্রাচীনতম দুই সভ্যতা) সমসাময়িক পর্যায়ে। যদি মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার না হতো, তাহলে ব্রিটিশরা কখনোই মেনে নিত না যে ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস তাদের চেয়েও পুরনো সভ্যতা।

তবে এই প্রদশর্নীতে উপেক্ষিত চন্দ্রকেতুগড়ের সভ্যতা। কলকাতা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে একটা ছোট্ট গ্রাম বেড়াচাঁপা। সেখানেই ঘুমিয়ে ছিল ২৫০০ বছরের ইতিহাস। প্রাচীন ভারতের মানচিত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল চন্দ্রকেতুগড়। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় যিনি মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কার করেছিলেন তিনি চন্দ্রকেতুগড় পরিদর্শন করেন। সেই সময় টেরাকোটার স্তুপ খুঁজে পান।১৯২০ সালে ‘বসুমতী’ সংবাদপত্রে চন্দ্রকেতুগড় নিয়ে নিজের ভাবনার কথা লিখেছিলেন তিনি। ১৯২২-২৩ সালের ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের বার্ষিক প্রতিবেদনে কাশীনাথ দীক্ষিত লেখেন, “চন্দ্রকেতুগড় বাংলার প্রাচীনতম জনবসতিগুলির অন্যতম।”