বঙ্কিমচন্দ্রের রাজসিংহ উপন্যাস ও বর্তমানে ঘটে চলা লাভ জেহাদ প্রসঙ্গ

আমাদের সমাজে ‘লাভ জেহাদ’ (Love Jihad) হল পরিচয় গোপন করে, প্রলভন দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে হিন্দু নারীদের সঙ্গে প্রেম করে বিবাহ এবং তারপর ধর্মান্তরকরণ। ইংরাজী শব্দ ‘লাভ’ (Love)-এর অর্থ ভালবাসা এবং আরবী শব্দ ‘জেহাদ’ (Jihad)-এর অর্থ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য অমুসলিমদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের যুদ্ধ। সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দু সমাজের নারীরা এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তারা কখনো অজান্তেই, কখনো অলীক প্রলোভনে, কখনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ভিন্ন ধর্মের পুরুষের সাথে প্রণয় সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু বিয়ের পরে তাদের জীবনে নেমে আসছে ভয়ানক পরিণতি।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রাজসিংহ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে। রাজসিংহ উপন্যাসের বিষয়বস্তুর দিকে নজর দিলে দেখতে পাই তা যেন বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি সত্য কাহিনি। আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে হিন্দুবিদ্বেষী ঔরঙ্গজেবের প্রতিশোধ স্পৃহা ও কর্তৃত্ব জাহিরের বাসনায় এক হিন্দু নারীর প্রতি তার লালসার কাহিনি তুলে ধরেছেন। তিনি সেই হিন্দু নারীর মাধ্যমে এক প্রতিবাদী, হিন্দু গর্বে গর্বিত, মুসলিম এর প্রলোভন ত্যাগী এক আদর্শ হিন্দু নারী চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন। সেই নারী চরিত্র ছিলেন রূপনগরের রাজপুত রাজকন্যা চঞ্চলকুমারী। সেই সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র যোধপুরী বেগমের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে একজন হিন্দু নারীর মুসলিম ঘরে বিবাহ হলে কি পরিণতি হয় সে দিকটি তুলে ধরেছেন।

আমরা এবার ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে বর্ণিত হিন্দু নারীর আদর্শ, হিন্দু পরিচয় রক্ষার লড়াই এবং তা বর্তমানকালে লাভ জেহাদ প্রসঙ্গে কতটা শিক্ষণীয় সে বিষয়ে আলোচনা করব। সেইসঙ্গে যোধপুরী বেগমের মুসলিম জীবনের কষ্টের কাহিনি থেকে হিন্দু নারীদের শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।

চঞ্চল কুমারী কর্তৃক ঔরঙ্গজেবকে প্রত্যাখ্যান ও বর্তমান সময়ে শিক্ষণীয় বিষয়

রূপনগরের রাজকন্যা ছিলেন চঞ্চল কুমারী। তিনি ছিলেন নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি গর্বিত এক নারী। এক ছবি বিক্রেতা যখন তাকে একাধিক মুসলিম রাজার ছবি দেখাচ্ছিল তখন রাজকুমারী বলেন, “হিন্দু রাজার তসবীর আছে?” (রাজসিংহ, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) উত্তরে সেই ছবি বিক্রেতা মানসিংহ, বীরবল, জয়সিংহ এর ছবি দেখাল। আর তখনই আমরা চঞ্চল কুমারী কে দেখতে পাই হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসেবে। বঙ্কিমচন্দ্র তার মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন, “এই সকল হিন্দু নয়, ইহারা মুসলমানের চাকর।” (রাজসিংহ, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

এরপর সেই ছবি বিক্রেতা ঔরঙ্গজেবের ছবি দেখায়। তার উত্তরে চঞ্চলকুমারী এক অতি ভয়ানক কিন্তু তার হিন্দু হৃদয় এর কাছে গৌরবের কাজ করেন। তিনি বলেন, “আমি এই আলমগীর বাদশাহের চিত্রখানি মাটিতে রাখিতেছি সবাই ইহার মুখে এক একটি বাঁ পায়ের নাতি মার। কার নাতিতে উহার নাক ভাঙে দেখি।” হিন্দু গৌরবে গর্বিত চঞ্চলকুমারী ছিলেন অন্য প্রকৃতির। তামাম হিন্দুস্থানের সম্রাজ্ঞী হওয়ার সুযোগকে হেলায় পরিত্যাগ করে তিনি বলেন, “উপায় যাই হোক আমি মোঘলের দাসী কখনও হইব না।” (রাজসিংহ, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)।  

চঞ্চলকুমারীর সখী নির্মলকুমারীর প্রতি তার উক্তিগুলি বর্তমান সময়ের হিন্দু নারীদের অবশ্যই অনুপ্রাণিত করবে, জাগ্রত করবে। “তুই কি মনে করছিস্ যে, আমি দিল্লীতে গিয়া মুসলমান বানরের শয্যায় শয়ন করিব? হংসী কি বকের সেবা করে?… দিল্লীর পথে বিষ খাইব তবু সেখানে যাইবনা…আর উপায় কি সখী? কে এমন বীর পৃথিবীতে আছে যে, আমায় উদ্ধার করিয়া দিল্লীশ্বরের সহিত শত্রুতা করিবে? রাজপুতানার কুলাঙ্গার সকলেই মোঘলের দাস – আর কি সংগ্রাম আছে না আছে প্রতাপ…”

চঞ্চলকুমারী অনায়াসেই ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে বিবাহ করে মোঘল সম্রাজ্ঞী হতে পারতেন। কিন্তু নিজ ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি ছিল তার গভীর ভালবাসা। তিনি ছিলেন হিন্দু গর্বে গর্বিত নারী। ঔরঙ্গজেবের প্রস্তাব তিনি হেলায় পরিত্যাগ করে তিনি সাহায্য চেয়েছেন হিন্দুকুলভূষণ রাজসিংহের কাছে। বর্তমান সমাজের হিন্দু নারীদেরকেও চঞ্চলকুমারীর আদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হতে হবে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনীর মাধ্যমে ফুটে ওঠেছে তার আদর্শ। তিনি চঞ্চলকুমারী চরিত্রের মাধ্যমে হিন্দু নারীর উদ্দেশ্যে হিন্দু গর্বে গর্বিত হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। বিধর্মীর সব ছলনা, প্রলোভন, চাপকে ধ্বংস করে বর্তমান সময়ের হিন্দু নারীদের নিজ পরম্পরার প্রতি তাই শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন এবং তার ধারন ও বহন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ উপন্যাসের ‘যোধপুরী বেগম’ এবং বর্তমান হিন্দু নারীদের শিক্ষণীয় বিষয়

রাজসিংহ উপন্যাস অনুসারে ঔরঙ্গজেবের প্রধান মহিষী ছিলেন যোধপুরের রাজপুত রাজকন্যা, যিনি যোধপুরী বেগম নামে পরিচিত। বঙ্কিমচন্দ্র যোধপুরী বেগম চরিত্রের মাধ্যমে বিধর্মে বিবাহ হওয়া এক হিন্দু নারীর নিদারুণ কাহিনি তুলে ধরেছেন। লেখক তার সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি হিন্দুর মেয়ে, মুসলমানের ঘরে পড়িয়া ভারতেশ্বরী হইয়াও তাঁহার সুখ ছিলনা।” (রাজসিংহ, দ্বিতীয় খণ্ড, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ) যোধপুরী বেগম যখন জানলেন ঔরঙ্গজেব আবার এক হিন্দু নারীকে বিবাহ করিবে, তখন তিনি বলেন, “হে ভগবান! আমাকে বিধবা কর! এ রাক্ষস আর অধিক দিন বাঁচিলে হিন্দুনাম লোপ পাইবে।” (রাজসিংহ, দ্বিতীয় খণ্ড, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)

যোধপুরী বেগমের এই বিলাপ থেকে আমরা ধারনা করতে পারি একজন হিন্দু নারীর মুসলিম ঘরে বিবাহ হলে তার কত অত্যাচার সহ্য করতে হয়। একজন হিন্দু নারী মুসলিম ঘরে বিবাহ করলে তার কতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তার পরিচয় বঙ্কিমচন্দ্র আরও স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন যোধপুরী বেগমের এই উক্তিতে, “রাজকুমারীকে বলিবে, হিন্দুর কন্যা হইয়া মুসলমানের ঘরে না আসেন। আমরা আসিয়া নিত্য মরণ কামনা করিতেছি। বলিবে যে, তসবীর ভাঙ্গার কথাটা বাদশাহ শুনিয়াছেন, তাকে সাজা দিবার জন্যই আনিতেছেন।…বলিও বরং বিষ খাইও তথাপি দিল্লীতে আসিওনা।” (রাজসিংহ, দ্বিতীয় খণ্ড, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)

বর্তমান সময়ে হিন্দু নারীদের এই কাহিনি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। আমরা দেখি পরিচয় গোপন করে, লোভ দেখিয়ে, নিজ কর্তৃত্ব জাহির করার জন্য, বর্তমান সমাজের ‘ঔরঙ্গজেবরা’ হিন্দু নারীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছে। তাদের নানানভাবে প্রলোভিত করে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করছে। তারপর সেই হিন্দু মেয়ের জীবনে নেমে আসছে, বঙ্কিমচন্দ্রের রাজসিংহ উপন্যাসে যোধপুরী বেগমের মত করুণ পরিণতি। তাই রাজসিংহের যোধপুরী বেগমের থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং বর্তমানে একাধিক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে হিন্দু নারীদের সদা সচেতন থাকা প্রয়োজন।

রাজসিংহ: আদর্শ হিন্দু নারী সত্ত্বার উপন্যাস, হিন্দু নারীদের শিক্ষণীয় বিষয়

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার কালজয়ী রাজসিংহ উপন্যাসে আদর্শ হিন্দু নারীর গৌরব গাথা রচনা করেছেন। শক্তিশালী মুসলিম শাসকের লালসার বলি হওয়া এক হিন্দু নারীর করুণ চিত্রও তুলে ধরেছেন। চঞ্চলকুমারীর প্রত্যেকটি বয়ানে তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী সত্ত্বা ফুটে ওঠে। হিন্দু নারীর পরম্পরাগত ঐতিহ্যের দিকটি উন্মোচিত হয়। রাজসিংহের প্রতি তার একটি পত্রে আমরা এই দিকটির পরিচয় পাই। “আমার দূরদৃষ্টিক্রমে, দিল্লীর বাদশাহ আমার পাণিগ্রহণ করিতে মানস করিয়াছেন। অনতিবিলম্বে তাঁহার সৈন্য, আমাকে দিল্লী লইয়া যাইবার জন্য আসিবে। আমি রাজপুতকন্যা, ক্ষত্রিয়কুলোদ্ভবা – কি প্রকারে তাহাদের দাসী হইব? রাজহংসী হইয়া কেমন করে বক সহচরী হইব? হিমালয়নন্দিনী হইয়া কি প্রকারে তুরকী বর্ব্বরের আজ্ঞাকারিণী হইব? আমি স্থির করিয়াছি, এ বিবাহের অগ্রে বিষভোজনে প্রাণত্যাগ করিব।” (রাজসিংহ, তৃতীয় খণ্ড, পঞ্চম পরিচ্ছেদ)

আবার বঙ্কিমবাবু নির্মলকুমারীর মাধ্যমে বিবাহিত হিন্দুনারীর সতীত্বের দিকটি তুলে ধরেছেন। যারা কখনো কোনো পরপুরুষ, বিধর্মী পুরুষের সামনে মাথা ঝোঁকায় না। যখন ঔরঙ্গজেব নির্মলকুমারীকে নানা হুমকি ও প্রলোভন দিচ্ছিলেন তখন আমরা তাকে বলতে শুনি, “হিন্দুর মেয়ে আগুনে পুড়িয়া মরিতে ভয় করেনা। হিন্দুস্থানের বাদশাহ কি কখন শুনেন নাই যে, হিন্দু মেয়ে, হাসিতে হাসিতে স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত চিতায় পুড়িয়া মরে? আপনি যে মরণের ভয় দেখাইতেছেন, আমার মা মাতামহী প্রভৃতি পুরুষানুক্রমে সেই আগুনেই মরিয়াছেন। আমিও কামনা করি, যেন ঈশ্বরের কৃপায় আমিও স্বামীর পাশে স্থান পাইয়া আগুনেই জীবন্ত পুড়িয়া মরি।” (রাজসিংহ, ষষ্ঠ খণ্ড, পঞ্চম পরিচ্ছেদ)

বঙ্কিমচন্দ্র তার উপন্যাসের মাধ্যমে একজন আদর্শ হিন্দু নারীর চরিত্র চঞ্চলকুমারী, নির্মলকুমারীদের মধ্যে তুলে ধরেছেন। বর্তমান সময়ের হিন্দু নারীগণের তা অনুসরণ করা উচিত। তাদের এ বিষয়ে জানা উচিত যে তাদের বিধর্মী প্রেমিক তাকে ধর্মান্তরিত করে বিবাহ করছে যতটা না ভালোবেসে তার থেকে বেশি কর্তৃত্ব বিস্তার, প্রতিশোধ স্পৃহা এবং হিন্দু নারী সম্ভোগের লালসা থেকে। ঠিক যেমনভাবে ঔরঙ্গজেব চেয়েছিলেন চঞ্চলকুমারীকে। বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দু নারীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন একজন হিন্দু নারীকে সর্বদা আদর্শবান, হিন্দু গর্বে গর্বিতা, হিন্দু নারী ঐতিহ্যে বলবান হলে তাকে কোনো শক্তিই দমিয়ে রাখতে পারবেনা। ঠিক যেমন চঞ্চলকুমারীকে পারেনি।

পরিশেষে বলব, চঞ্চলকুমারীকে, ঔরঙ্গজেবের লালসার হাত থেকে রাজসিংহ রক্ষা করেছিল। বর্তমান সমাজে এরকম ‘রাজসিংহ’ বৈশিষ্ট যুক্ত হিন্দু পুরুষ এবং নারীকে চাই। যারা সমাজে ঘটে চলা লাভ জেহাদের হাত থেকে হিন্দু সমাজকে রক্ষা করবে। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, ‘হিন্দুর অনিষ্ট করিতে তাহার জন্ম’ এরকম ঔরঙ্গজেব আমাদের সমাজে যত্রতত্র ঘুরে বেরাচ্ছে। তাদের হাত থেকে হিন্দু সমাজকে রক্ষা করার দায়িত্ব হিন্দু সমাজের নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই নিতে হবে।