কংগ্রেসের সহিত প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের মতবিরোধ ও বিচ্ছেদ (৩)

0
1098

অভীক সরকার

(পূর্ব প্রকাশিতর পর)

কংগ্রেস ত্যাগের প্রসঙ্গটি ঠাকুরের কাছে উত্থাপিত হয় ১৯৬৪ সালে, যখন তিনি অনুভব করেন যে, তফসিলি জাতির শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য গান্ধী এবং নেহরুর থেকে তিনি যে প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন, তা ভঙ্গ করা হয়েছে। এই বছর হজরত মহম্মদের অবশিষ্টাংশ কাশ্মীরের শ্রীনগরের হজরতবল মসজিদ থেকে চুরি গেছে বলে একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য খুলনায় ৪ঠা জানুয়ারি থেকে দাঙ্গা শুরু হয় এবং তা পরদিন যশোরে ছড়িয়ে পড়ে এবং আতঙ্কগ্রস্ত শরণার্থীরা ভয়ঙ্কর নৃশংসতার কাহিনী সঙ্গে নিয়ে ডাউন বরিশাল এক্সপ্রেসে করে শিয়ালদহ স্টেশানে এসে পৌঁছতে থাকে।

সার্বিকভাবে ১৯৬৪ সালে প্রায় ৪০০ হাজার তফসিলি জাতিভুক্ত কৃষক উদ্বাস্তু হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পার করে। এদের সদ্য আগমন এবং পূর্ব পাকিস্তানের দাঙ্গার বীভৎস কাহিনী পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশকেও উত্তপ্ত করে তুলেছিল – বিশেষত সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে অর্থাৎ দুই চব্বিশ পরগণায় ও নদীয়ায় এবং বিশেষত কলকাতায়, যেখানে ১০ই জানুয়ারি থেকে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গা জোর কদমে শুরু হয়েছিল। এর সতর্কীকরণ ব্যবস্থা হিসাবে চব্বিশ পরগণার বনগাঁ ও হাবড়ায় এবং নদীয়ার ধুবুলিয়া শিবির, তাহেরপুর বসতি এবং কুপার শিবিরে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত কার্ফু জারি করা হয়েছিল।

সতর্কীকরণ ব্যবস্থা হিসাবে নদীয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যাঁরা এই বিশৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার জন্য গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁদের বেকার ভাতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যখন পুলিশ কেবল নমঃশূদ্র শরণার্থীদের লক্ষ্য করে দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছিলেন, তখন ঠাকুর ১৯৬৪ সালের ৬ই মার্চ বনগাঁতে শরণার্থীদের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে কংগ্রেস সরকারের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদের চিহ্নস্বরূপ আইনসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।

তারপর তিনি বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে নমঃশূদ্রদের যথাযথ পুনর্বাসনের দাবিতে অনেকগুলি সভা করেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে শোনা যায় তিনি পাকিস্তানের সংখ্যালঘু রক্ষা কমিটির কার্যকলাপকেও সমর্থন করছিলেন। এটি পূর্ব পাকিস্তানে একটি অর্থনৈতিক অবরোধের প্রস্তাব দিয়েছিল।

সেই বছরেই ২৪শে মার্চ, হাবড়ার একটি সভায় ঠাকুর প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে তফসিলি জাতিভুক্ত শরণার্থীদের পুনর্বাসন বিষয়ে দেশভাগের সময়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা ভঙ্গ করার জন্য দোষারোপ করেছিলেন। তিনি হাবড়া ও বনগাঁয় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং নমঃশূদ্র শরণার্থীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তা এবং পুলিশি তদন্তের সমালোচনা করেছিলেন। এখানে তিনি একটি নির্দিষ্ট নমঃশূদ্র কিশোরীর উপর নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেছিলেন।

ঠাকুর ভারতের প্রতিরক্ষা দপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, জনগণের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য ১৯৬৪ সালের ১৯শে এপ্রিল গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সেই বছরের একই মাসে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকেও অনুরূপ অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের দুজনকেই ৩রা জুন পর্যন্ত কোলকাতার দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে আটক করে রাখা হয়েছিল। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় একটি জিজ্ঞাসু প্রশ্ন করেন: বাংলার তফসিলি আন্দোলনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নেতার দুটি ভিন্ন পথ কি অবশেষে স্বাধীন ভারতের একটি কারাগারে এসে মিলিত হল?

১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রদীপ কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে, প্রমথ ঠাকুর স্বীকার করেন যে তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সাফল্যটি হল পূর্ব বাংলায় অভিবাসিত নমঃশূদ্রদের একত্রিত করে তাদের মতুয়া মহাসংঘের একটি ছাতার তলায় নিয়ে আসতে সক্ষম হওয়া। যাইহোক, তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে তিনি পরে বুঝতে পেরেছেন যে, যে কংগ্রেসের সঙ্গে তিনি এত সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা কোনও দিন তাঁর নিজের লোক ছিলেন না এবং যে মতুয়ারা বামপন্থার সঙ্গে যুক্ত, তারাও উপলব্ধি করবে যে বামপন্থা তাদের নয়!

প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের পুত্র এবং মতুয়াদের চতুর্থ সংঘপতি কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর একটি প্রতিবেদনে দাবি করেন যে তাঁর পিতা ১৯৬৪ সালে বিধানসভার উপনির্বাচনে যে হাঁসখালির আসনটি তিনি ত্যাগ করে গেছিলেন, তাতে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের প্রতিনিধিত্বকে তিনি সমর্থন করেছিলেন। মণ্ডল মহাশয় কিন্তু সাফল্যের মুখ দেখেননি। ১৯৬৭ সালের মধ্যে ঠাকুরের কংগ্রেস-বিরোধী মনোভাবটি টাল খেয়ে গিয়েছিল এবং তিনি ভারতের সাধারণ নির্বাচনটিতে একটি বঙ্গ কংগ্রেসের টিকিটের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নবদ্বীপের সংসদীয় আসনে ঠাকুর তাঁর নিকটতম কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বী জে. সি. বিশ্বাসকে ৮৯ হাজার ভোটের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছিলেন এবং তিনি মোট ভোটের ৬১.২৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন।

বঙ্গ দলিত আন্দোলনে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের ভূমিকার পর্যালোচনা ঠাকুর ১৯৬৭ সালের নির্বাচনেই অন্তিম বার জয়লাভ করেছিলেন। ১৯৭১ ও ১৯৭৭ উভয় নির্বাচনেই তিনি সিপিআই (এম) এর প্রতিনিধিদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। এই ঘটনা নির্দেশ করে যে, তখন শরণার্থী ও তফসিলি জাতির ভোট ব্যাঙ্ক বামপন্থী দলের দিকে ঝুঁকে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই ভোট ব্যাঙ্ক ১৯৭৭ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে সমস্ত ক্ষমতাকে কমিউনিস্টদের প্রতি চালিত করতে পারত। ১৯৪৭ সালের পরে বাংলায় দলিত রাজনীতিতে ঠাকুরের এই সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকাটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ছিল না। একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে তিনি তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষণের মত একটি ইতিবাচক কার্যকলাপের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি এর পরিবর্তে জোর দিয়েছিলেন আমূল সামাজিক সংস্কারের উপর এবং সংগঠন ও আত্মনির্ভরতার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবে তিনি নমঃশূদ্রদের উপর এমন ঈশ্বরদত্ত আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে, যাঁরা যাঁরা তাঁর গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁরা সকলে অনশনে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁকে মতুয়া মহাসংঘাধিপতি হিসেবে, ধর্মীয় গুরু হিসাবে তাঁর মুক্তির দাবিতে দরখাস্ত জমা করেন – তাঁর কারাবাস এই গোষ্ঠীর ধর্মীয় কার্যকলাপকে গভীরভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।

তিনি ছিন্নমূল ও অশিক্ষিত একদল মানুষ যারা একদিকে ইসলামপন্থী দমন-পীড়নের কবলে ছিল ও অন্যদিকে তাদের জীবন-জীবিকার জন্য সংগ্রাম করে যেতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বৌদ্ধিক সহায়তা ও আধ্যাত্মিক মার্গ প্রদর্শন করিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে বঙ্গ তফসিলি জাতির মানুষদের আধ্যাত্মিক শক্তির পুনর্জাগরণের সম্পূর্ণ কৃতিত্বের অধিকারী একমাত্র প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের প্রচেষ্টা।

তিনি বৃহত্তর হিন্দু স্বার্থের প্রতি অবিশ্রান্তভাবে বিশ্বস্ত থেকেছেন এবং যাতে তাঁর স্বজাতির স্বার্থ আরো ভাল ভাবে সিদ্ধ হতে পারে তার জন্য তিনি বর্ণ হিন্দুদের সঙ্গে জোট বাঁধতেও দ্বিধাবোধ করেননি। প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন মতুয়া মহাসংঘ ছটিয়ে ছিটিয়ে থাকা নমঃশূদ্র গোষ্ঠীকে একত্রিত করা এবং ওরাকান্দির স্বর্ণালী দিনগুলিকে স্মরণে রেখে ঠাকুরনগরকে একটি নব সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্রে পরিণত করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিল।

১৯৬৪ সালে যখন ঠাকুর গ্রেপ্তার হন, তাঁকে পুলিশি প্রতিবেদনে এমন একজন নেতা হিসেবে ব্যখ্যা করা হয়েছিল যাঁর “পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের উপর বিশেষত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের উপর যথেষ্ট প্রভাব ছিল”। পাকিস্তান প্রকল্প থেকে বাঙালি তফসিলি সম্প্রদায়কে দূরে রেখে সুসংহত করা এবং ভারতে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য তাঁর যে প্রচেষ্টা, তা তাঁকে তাঁর পিতামহ গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমান আসনে অধিষ্ঠিত করেছে, যিনি তথাকথিত অস্পৃশ্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের দুঃখ-দুর্দশা কিছুটা হ্রাস করেছিলেন। দণ্ডকারণ্য ও আন্দামানে যে বাঙালি তফসিলি জাতির মানুষদের পাঠানো হয়েছিল, তাদের জীবন ও জীবিকার উৎকর্ষ সাধনের জন্য তিনি অবিরাম তাদের আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে গিয়েছিলেন এবং মনোবল বৃদ্ধি করেছিলেন।

যদিও সমাজের বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রটি তখনও বাঙালি ভদ্রলোকদের দ্বারা অবদমিত ছিল, তবু মতুয়া মহাসংঘ তার অনুগামীদের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে কারণ মতুয়া মহাসংঘ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ৭০-৮০টি কেন্দ্রের উপর আধিপত্য বিস্তার করে আছে। প্রমথ ঠাকুর ছাড়া ঠাকুর পরিবারের আরো বেশ কয়েকজন মানুষ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। চতুর্থ সংঘপতি কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর বনগাঁ থেকে সাংসদ হিসাবে যোগদান করেছিলেন। তাঁর ছোট ভাই মঞ্জুল কৃষ্ণ ঠাকুর প্রথম তৃণমূল সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রকের মন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেছিলেন। স্বর্গীয় কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরের বিধবা পত্নী মমতা বালা ঠাকুরও বনগাঁ থেকে সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমান এবং পঞ্চম এবং বর্তমান সংঘাধিপতি শান্তনু ঠাকুর বিজেপির প্রতিনিধি হিসাবে ২০১৯ সালে সেই একই আসনে জয়লাভ করেছেন।

ঠাকুরের কৃতিত্বের কারণেই বিভাজনোত্তর পশ্চিমবঙ্গে নমঃশূদ্রদের সামাজিক ও শিক্ষাগত সম্মান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০১১ এর আদমশুমারি অনুযায়ী, নমঃশুদ্রদের সাক্ষরতার হার হল ৭৯.৫২ শতাংশ, যা সমগ্র রাজ্যের গড় সাক্ষরতার হার অর্থাৎ ৭৬.২৬ এর চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। নমঃশুদ্ররা কৃষির উপর তাদের ঐতিহ্যবাহী নির্ভরতা কমিয়ে দিয়ে আধুনিক পেশা গ্রহণ করা শুরু করেছে। ২০১৫ সালের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে যে বাঙালি হিন্দু শরণার্থীরা এসেছিলেন এবং বলা বাহুল্য যে তাঁদের মধ্যে মতুয়ারা ব্যাপক সংখ্যায় এসেছিলেন – তাঁদের সম্মানজনক নাগরিকত্বের পথটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় সংসদে পাশ হওয়া নাগরিক সংশোধনী আইন প্রশস্ত করে দেয়। প্রমথ ঠাকুর এবং মতুয়া মহাসংঘ ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও সামাজিকভাবে বিভক্ত একটি সম্প্রদায়কে একটি নব প্রকল্পিত স্থানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং বিভাজনোত্তর ভারতে তাঁদের সমষ্টিগত পরিচয় পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিলেন।

(সমাপ্ত)