আমিনার সুরক্ষা

0
1564

জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য্য

অভিজিৎ চক্রবর্তী এবং তার স্ত্রী অপর্ণা । প্রায় আধঘণ্টা ব্যারাকপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে শিয়ালদা গামী ডাউন ট্রেনের জন্য । ঘড়িতে প্রায় রাত দশটা ছুঁই ছুঁই । ব্যারাকপুর চিড়িয়ামোড়ের সামনে তাদের গাড়িটা সেই যে খারাপ হল আর কোনভাবেই এঞ্জিন স্টার্ট হল না । অগত্যা একটি নিকটবর্তী গারাজে গাড়ি জমা করে অভিজিৎ আর অপর্ণা এই মুহূর্তে ব্যারাকপুর স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বেশ অসহিষ্ণু, হবে নাই বা কেন, অনেকটা রাস্তা, সেই বালীগঞ্জ, পোঁছতে বারোটা তো বাজবেই । অভিজিৎ এবার না পেরে খিঁচিয়ে উঠল, “ব্লাডি ভক্তদের সরকার, একটা ট্রেনও ঠিকঠাক চালাতে পারে না, এরা আবার বুলেটের স্বপ্নে ভারতের গরীবকে প্রতিনিয়ত ইমোশনালি রেপ করছে, কিন্তু কিছু করার নেই, ওই যে রাম মন্দিরের আফিম খাইয়ে এরা এখন পার্লামেন্টে ৩০০ প্লাস, অ্যাবসোলিউট রাবিশ! এদের………” “অনুগ্রহ করে শুনবেন, শিয়ালদা যাওয়ার গাড়ি, ডাউন গ্যালপিং শান্তিপুর লোকাল দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে” । যাক, আজকের জন্য অন্তত অভিজিৎ এর হাত থেকে কেন্দ্রের ক্যাপিটালিস্ট, শোষণকারী সরকার বেঁচে গেল ! অপর্ণা স্মার্টফোনে কিছু একটা দেখে খুব খুশি হয়ে বলে উঠল, “গ্রেইট! এই ট্রেনটা ব্যারাকপুরের পর ডাইরেক্ট শিয়ালদা, মাঝে কোনও স্টপেজ নেই, যাক, তাহলে, ইট্স আ ম্যাটার অফ হাফ অ্যান আর(HOUR)!” । অভিজিৎ কিন্তু অপর্ণার মতন ক্ষমাই পরম ধর্মের মুডে নেই, “হুঃ ফেকু সরকারের ট্রেন, সেটা আবার গ্যালপিং! দেখবে সব স্টেশনে হল্ট করতে করতে যাবে, আচ্ছা অপর্ণা, তোমরা কি করে এই ফেকুদের বিশ্বাস করো, দি এন্টায়ার সিস্টেম is কোল্যাপ্সিং, তুমি কি এতটাই নাইভ, দেখেও বুঝতে পারো না যে স্রেফ হিন্দুত্বের রাবিশ ফিড করে এরা দেশটাকে আমেরিকার হাতে বেচে দিতে চায়, দেখছো না বেসরকারিকরণের নামে কি নোংরা খেলায় মতেছে এই মধ্যযুগীয় ফ্যানাটিকগুলো, পুরোটাই একটা বিরাট মিথ্যার ওপর চলছে!” অপর্ণা বুঝলো তার ইমম্যাচিওরড উল্লাস অভিজিৎ কে হার্ট করেছে, “আই অ্যাম স্যরি অভিজিৎ, আই ডিডন্ট মীন ইট, কাম অন চিল আউট, এইতো, ট্রেন ঢুকছে!”

অভিজিৎ চক্রবর্তী, বালীগঞ্জ নিবাসী । কলকাতার একটি অতিবাম মনস্ক উনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক আর স্ত্রী অপর্ণা মধ্য কলকাতার নামকরা উনিভার্সিটির ইংরাজির অধ্যাপিকা । তাদের বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে, এখনও কোনও সন্তান হয়নি, “নট দা রাইট টাইম” অভিজিৎ এর ভাষায় । অভিজিৎ ছোটবেলা থেকেই বামপন্থী ঘরানার মধ্যে থেকেছে, হবে নাই বা কেন, বাবা সুজনজিত চক্রবর্তী ছিলেন বাম আমলের ডাকসাইটে মন্ত্রী, কিন্তু বাম জামানার অবসানের পরপরই সুজনজিত বাবুর দ্বিতীয় অ্যাটাকটা হয় । পিস হ্যাভেনে সেইদিন কমরেডদের ঢল নেমেছিল,সুজনজিত বাবুকে শেষবারের মতন লাল সেলাম জানাতে । অনেক প্রৌঢ় কমরেড অভিজিৎ কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে, “এখন তোমরাই আশা ভারশা, দেশটাকে, এই রাজ্যটাকে ওই গেরুয়া ধর্মীয় উন্মাদদের হাতে বিকেয়ে যেতে দিয়ো না অভি ।” সেই থেকেই অভিজিৎ এর ডিক্টেটরশিপ অফ প্রলেতারিয়াতের লড়াই তিব্র গতিতে চলছে, উনিভার্সিটির ক্লাস হোক কিংবা সিয়্যাটেলে ডেমোক্র্যাটদের অভ্যর্থনায় সেমিনারে লেকচার, সব জায়গাতেই অভিজিৎ তুলোধোনা করে অবশ্যই অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে কিভাবে ভারত থেকে আমেরিকা কিংবা ইয়োরোপের কিছু দেশ ডানপন্থীদের কবলে পরে বিশ্বের ‘সংখ্যালঘুদের’ হত্যালীলায় মেতেছে । অভিজিৎ এর আবেগ, বিশ্লেষণ, প্রতিবাদী লড়াই অভিজিৎ কে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি, কিন্তু এখানে সে ডানপন্থীদের চক্ষুশূল হয়েছে সঙ্গত কারণেই , কিন্তু ভারতের সেকিউলারিজমকে বাঁচিয়ে রাখতে অভিজিৎ এর সংগ্রাম আগামী দিনে তীব্রতর হবে । অপর্ণাও উদ্বাস্তু পরিবার থেকে উঠে আসা বাম মনস্ক নারী, বলাই বাহুল্য, অভিজিৎ এর যথার্থ সহযোদ্ধা । তারা স্বপ্ন দেখে, শ্রেণী বিপ্লবের মাধ্যমে, উগ্র হিন্দুত্বকে পরাজিত করে একদিন এপার বাংলা আর ওপার বাংলা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে, সেই দিন হবে প্রকৃত বিশ্ব মানবতার জয় আর হিংসার কাঁটাতারের পরাজয় ।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু ধিরে চলছে, এখনও হলুদ সিগন্যাল । ব্যারাকপুরে একটি নিমন্ত্রণ রক্ষা করে ফেরার সময় গাড়িটা গেল খারাপ হয়ে, তাই বাধ্য হয়ে ট্রেন জার্নি, নয়ত অভিজিৎ সর্বতোভাবে চেষ্টা করে কেন্দ্রের এই সাম্প্রদায়িক সরকারের ‘সরকারি মাধ্যমগুলিকে’ বর্জন করার, কিন্তু আজ ভাগ্য সহায় নয় । ট্রেনের যে কামরায় অভিজিৎ আর অপর্ণা উঠেছে সেটিতে কোনও দ্বিতীয় যাত্রী নেই, একে তো রবিবারের রাত, প্রায় দশটা, তারমধ্যে গ্যালপিং ট্রেন । যাইহোক, একদিক থেকে ভালই হয়েছে ট্রেনের ভিড়টার মধ্যেও আজকাল কেমন যেন একটা উগ্র হিন্দুত্বের ছোঁয়া লেগেছে, কেন্দ্রীয় সরকারকে কিছু বললেই আজকাল এরা রে রে করে দেশদ্রোহী তকমা সেঁটে দিচ্ছে, কোথায় যে এর শেষ সেটা ভেবেই অভিজিৎ শিউরে ওঠে, বাঁচা গেল! শিয়ালদা অবধি কোনও ভক্তের ভণ্ডামি সহ্য করতে হবে না । এইসব ভাবতে ভাবতেই অভিজিৎ এর চোখ পরল অপর্ণার দিকে । জানলার ধারে বসা অপর্ণার এলোমেলো চুল ওকে আরও সেনসুয়াস করে তুলেছে । এবার অপর্ণা একটু চমকে উঠে অভিজিৎ এর দিকে তাকালো । অভিজিৎ এর চাহনির ভাষায় অপর্ণা হঠাৎই একটি টিনএজারের মতন লজ্জা লজ্জা একটা হাসি দিলো । অভিজিৎ অপর্ণার ঠোঁটের একদম সামনে নিজের ঠোঁটাটা নিয়ে গেলো, অপর্ণা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, মাদকাতা আরও বাড়ছে ঠিক এই সময় হিন্দিতে কারা যেন চিৎকার করে উঠল, ‘খালি গাড়ি হ্যায়, পকর, পকর!” । অভিজিৎ আর অপর্ণা সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলো ট্রেনটা হলুদ সিগন্যাল এর জন্য টিটাগড় স্টেশনে গতিবেগ কমিয়ে দিয়েছে আর কয়েকটি যুবক ট্রেনটির সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়চ্ছে তাতে উঠবে বলে । একটি ছেলে বিদ্যুতগতিতে লাফ দিয়ে উঠে পরল, “রফিক, পকর পকর”, ট্রেনের যুবকটি রফিককে হ্যাঁচকা টানে তুলে নিলো, “ফিরোজ কো পকর” তিনজন যুবক চলন্ত ট্রেনে একে একে লাফ দিয়ে উঠলো, অভিজিৎ দের বাধ্য হয়ে রোম্যান্সে ইতি টানতে হলো । ট্রেনে উঠেই উল্লাসে চিল চিৎকার জুড়ে দিলো তিনজন, চলন্ত ট্রেনের বাইরে ঝুলে গালাগালি, ট্রেনের মধ্যে লম্ফঝম্প, অপর্ণা কিছুটা বিরক্ত, “অসভ্য, অশিক্ষিত কতগুলো, ঠিক এই কম্পার্টমেন্টেই উঠতে হল!” । কিন্তু অভিজিৎ এর উত্তর, “অপর্ণা, তোমার বিরক্তির মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে, সরকারের বঞ্চনা সংখ্যালঘুদের প্রতি আজ ওদের অশিক্ষার অন্ধাকারে ঠেলে দিয়েছে, এদের এই আচরণের জন্য সরকারই তো চরম দায়ি, অপর্ণা, তোমার – আমার লড়াই তো এদের অধিকারের জন্যই, তাই নয় কি?” অপর্ণা লজ্জা পেয়ে, “স্যরি, আসলে এরকম একটা আবেগঘন মুহূর্তে এই ইন্ট্রুশনটা মানতে পারি নি, ঠিকই আমার এইভাবে রিয়াক্ট করাটা একেবারেই উচিৎ হয় নি, ড্যাম ইট!”

“আরে সুলেমান ভাই, জারা উধার দেখো, ক্যায়া জ্বলওয়া, একদম ক্যাটরিনা, লুট লো ভাইজান!” অপর্ণাকে দেখতে পেয়ে ওই তিনজনের মধ্যে এই পৈশাচিক উল্লাস । মুহূর্তের মধ্যে ওই তিনজন কম্পার্টমেন্টের সবকটা জানলা আর দরজা লাগিয়ে দিয়ে ঘিরে ধরল অভিজিৎ আর অপর্ণাকে ।

সুলেমান টিটাগড়ের নামকরা গুণ্ডা, খুন, ডাকাতি, ইত্যাদির জন্য জেল খেটেছে দুইবার, ওদের টার্গেট ছিল আজকের এই গ্যালপিংটা, উদ্দেশ্য ছিনতাই, আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন, আজ ছিনতাইয়ের সাথে উপরি পাওনা জুটবে কারন তারা জানে এই ট্রেনটা শিয়ালদার আগে থামে না, পুরোটাই ওরা করে অঙ্ক কষে । অভিজিৎ ঘাবড়ে গেলেও গলা চড়িয়ে বলল, “কেয়া চাহিয়ে ভাই, ডিস্টার্ব মত করো!” । একটা প্রচণ্ড ঘুষিতে অভিজিৎ ছিটকে পরে গেলো, অপর্ণা আর্তনাদ করে উঠলো । অভিজিৎ আতঙ্কে, ব্যাথায় কাঁপতে কাঁপতে বললো, “মারছ কেন, আমি তো তোমাদের অধিকারের জন্যই লড়াই করছি, কেয়া চাহিয়ে, প্যায়সা? বহুত হ্যায়, সব লে লো, হমে ছোর দো!” । সুলেমান বিকটভাবে, হেসে উঠলো, “আরে বাবু, প্যায়সা তো হামি নিবোই তার সাথে তোর বিবিকে দিবি, লম্বা সফর, শিয়ালদা যানা হ্যায়, মস্তি করনা হ্যায়!” । অপর্ণা ফুঁসে উঠলো, “এই জানোয়ারের দল………” একটা সপাটে চড়, অপর্ণা ছিটকে পরলো অভিজিৎ এর কাছে । সুলেমান এবার পকেট থেকে ছুরি বার করে, “বিবি কো দিবি, তো তোদের ছেড়ে দিব, নয়তো এখানেই হালাল করবো দোনো কো, লড়কি কো দে, নেহি তো মর!” । অভিজিৎ ঠক ঠক করে কাঁপছে, তার সারা শরীর ভিজে গেছে, কিন্তু সেটা যে কেবল ঘামের জল নয় সেটা অভিজিৎ বুঝতে পেরে আরও আতঙ্কিত হয়ে উঠলো । এইভাবে মরতে হবে সে ভাবতেও পারছে না, পাশে অপর্ণা কাতরাচ্ছে, কিন্তু সেইদিকে দেখার মতন অবস্থায় অভিজিৎ এই মুহূর্তে নেই, তার বিশ্বাসে এত বড় আঘাতে সে মানসিকভাবে আপাতত পঙ্গু । “কেয়া সোচা, লড়কি দিবি নাকি মরবি?” সুলেমানের হুমকি, ছুরিটা আলোয় জ্বলজ্বল করছে । অভিজিৎ কেঁদে ফেলল, “অপর্ণা, তুমিই পারো আমাকে বাঁচাতে, ওরা যা বলছে……” চড় খেয়ে অপর্ণা প্রায় বেহুঁশ হয়ে গেছিল কিন্তু অভিজিৎ এর এই “আর্তি” তার সম্বিত ফিরিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিলো, “তুমি পাগল হয়ে গেলে, কি বলছো তুমি বুঝতে পারছো, ওরা আমাকে ধর্ষণ করতে চাইছে আর তুমি আমাকে তাতে সায় দিতে বলছো, এতটাই দামি জীবন তোমার কাছে!” “ডার্লিং এত শরম কিসের, এখানে কেউ নেই, কোই নেহি দেখেগা!” কি উল্লাস! অভিজিৎ প্রাণ ভয়ে সুলেমানকে সমর্থন করে বললো, “ও ঠিক বলেছে, কেউ তো নেই এখানে, কেউ জানতেও পারবে না এই স্ক্যান্ডেলের ব্যাপারে! অপর্ণা বি রিসনেবল, কোনটা বেশি দামি, তোমার শরীর নাকি তোমার স্বামীর জীবন? একটু সময়ের তো ব্যাপার, মনে করো একটা দুঃস্বপ্ন, আর…………” অপর্ণা হতবাক, তার বিপ্লবী, অদমনীয়, আদর্শবাদী স্বামীর এই ভিখারির দশা দেখে, এটা তো দুঃস্বপ্নের থেকেও মারাত্মক, কে বেশি অপরাধী আজ, সুলেমান না অভিজিৎ? “অপর্ণা?” অভিজিৎ এর অস্ফুস্ট ভিক্ষা ! অপর্ণা, বুঝে গেল আজ শরীরের যুক্তিই হচ্ছে প্রধান যুক্তি, যেখানে শিক্ষিতা অপর্ণা আর তথাকথিত দেহাতি মহিলার শরীর শিকারির লালসায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে । অপর্ণা আর প্রতিবাদ করলো না, কেবল চোখের ভাষায় অভিজিৎ কে বুঝিয়ে দিলো যে সুলেমানের ‘স্যাটিসফ্যাকশনে’ অপর্ণা রেজিস্ট করবে না, ‘বিপ্লবী’ অভিজিৎ দীর্ঘজীবী হবে! “ডার্লিং, নো টেনশন, তুমহে তো আমি আদর করবো, কষ্ট দিবো না, কসম সে”, সুলেমান ‘অভয়’ দিলো!

সুলেমান রীতিমত কোলে তুলে অপর্ণাকে একটু দুরের একটা সিটে নিয়ে শুইয়ে দিলো, এর আগেও সে মালাউন নারী ভোগ করেছে, কিন্তু এরকম ‘হাই-ফাই, বড়া ঘরের মস্ত’ মালাউন বেটি সে আগে পায় নি, তাই সে খুব সতর্কভাবে অপর্ণার দশ হাজার টাকা দামের ঢাকাই জামদানিটা খুলে ধুলোয় ফেলে দিলো । ট্রেন সোদপুর ছেড়ে গতি নিয়েছে । সুলেমান কথা রাখলো, অপর্ণাকে সে প্রাণখুলে ‘আদর’ করতে থাকলো, ধিরে ধিরে সুলেমান অপর্ণার শরীরের নেশায় বুঁদ হয়ে যেতে লাগলো, অভিজিৎও হয়ত কোনও দিন অপর্ণার মধ্যে এইভাবে বুঁদ হয়ে যেতে পারেনি । অপর্ণা চুপ করে কেবল অভিজিৎ এর দিকে তাকিয়ে থাকলো, চোখটা ঝাপসা হয়ে গেলেও স্পষ্ট দেখতে পেলো অভিজিৎ দাঁতে নখ কাটছে, অপর্ণার ‘পারফর্মেন্সের’ ওপর নির্ভর করছে তার জীবন! ট্রেন বেলঘড়িয়া আর দমদমের মাঝে আবার দাঁড়িয়ে গেলো । সুলেমানের কামনার উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে গেছে, অপর্ণার শরীরের ওপরই সে গা এলিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে । আবার ট্রেন চলতে শুরু করলো । দমদম পার হয়ে যাওয়ার পর সুলেমানের মনে হোল, এরকম মালাউন বেটি সে হয়তো আর পাবে না, তাই আবার অপর্ণার ওপর চেপে বসে নিজের কামনার শেষ বিন্দুটুকু নিংড়ে দিতে থাকলো, অপর্ণা আর্তনাদ করলো না । অবশেষে ট্রেন শিয়ালদার আগে ইন্টারলকিংয়ের সিগন্যালে দাঁড়াতেই, “ভাইজান, আব নিকলতে হ্যায়” অভিজিৎ এর কাছ থেকে টাকা পয়সা নেওয়ার পর সুলেমান অপর্ণার মোবাইলটা নিয়ে, “ডার্লিং, তুম আজ ছা গই, হামার নম্বর তুমাকে দিলাম, মজা নিতে হলে কল দিবে,” আর অভিজিৎ এর দিকে তাকিয়ে সুলেমানের চাপা হুঙ্কার, “যো হুয়া ভুল যাও, পুলিশে বললে, তোর বিবিকে ঘরে ঢুকে খাবো, কুছ মাত ক্যাহেনা, কিসিকো ভি, বাই ডার্লিং ।“

ওরা নেমে গেলো, অভিজিৎ কাঁপতে কাঁপতে অপর্ণার কাছে গেলো, অপর্ণা শাড়িটা পরে নিয়েছে, জনালার বাইরে তাকিয়ে আছে, চুলটা হাওয়ায় এলোমেলো, আর মুখে চড়ের কালশিটে দাগ এই যা ! সিয়ালদাতে নেমে অভিজিৎ ট্যাক্সি নিলো, অপর্ণা চুপ, কিন্তু তার যে হাঁটতে খুবই যন্ত্রণা হচ্ছে অভিজিৎ বিলক্ষণ বুঝতে পারছিলো কিন্তু সেই মুহূর্তে চুপ থাকাটাই সে ‘যুক্তিসঙ্গত’ মনে করলো । বাড়ি পৌঁছে অভিজিৎ শুধু বললো, “অপর্ণা, পিলস খেয়ে নিয়ো, কোনও দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে যায়, আর যা হয়েছে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাও, ওই পরিস্থিতিতে কম্প্রোমাইজ না করলে, তুমি – আমি দুজনেই খুন হতাম । ওরা গরীব, অশিক্ষিত, সেক্স স্টার্ভড হয়ে জানোয়ার হয়ে গেছিলো, কিন্তু আমরা তো শিক্ষিত, ভদ্র সমাজে বাস করি, এসব জানাজানি হলে, স্ক্যান্ডেল, আমার কারিয়ার, তোমার কারিয়ার, এভরিথিং উইল বি অ্যাট স্টেক, তাই এটা নিয়ে, থানা পুলিশ করলে সিচুয়েশন আরও বিগড়াবে, লেট ইট গো ।” অভিজিৎ ভেবেছিলো অপর্ণা হয়তো রাগে ফেটে পরবে, কিন্তু অপর্ণা সেরকম কিছুই করলো না, কেবল ধির স্বরে বললো, “আমি স্নান করতে যাচ্ছি, গাটা ভীষণ চটচট করছে ।”

সেই ঘটনার পর মাস দুয়েক কেটে গেছে । অভিজিৎ সামনের মাসে ন্যু ইয়র্ক যাচ্ছে, সোশালিজমের আর মাইনরিটি রাইটস এর ওপর সেমিনারে লেকচার দিতে, রাজ্য পলিটব্যুরোতেও গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিজিৎ কে আনা হচ্ছে মেহনতি আর সংখ্যালঘুর জন্য তার লড়াকু আর অনমনীয় সংগ্রামের জন্য । অপর্ণাও খুব তাড়াতাড়ি ইংরাজির অ্যাসিসট্যান্ট হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট হতে চলেছে । আর হ্যাঁ, অপর্ণা পিলসগুলো রেগুলার খেয়ে গেছে তাই কোনও ‘দুর্ঘটনা’ হয় নি, এক্কেবারে যাকে বলে ‘পিকচার পারফেক্ট’ ।

শনিবারের দুপুর, ক্লাস সাসপেন্ড, অভিজিৎ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছে, অপর্ণাকে নিয়ে “পিটার ক্যাট” যাওয়ার প্লান, অপর্ণার একটু ‘রিক্রিয়েশনের’ দরকার, এই কয়েক মাসে কম ঝক্কি তো যায়নি ওর ওপর দিয়ে! বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে অভিজিৎ একজোড়া জুতো দেখলো । “উফ, এখন আবার কে এলো, একটু অবসরের জো নেই!” অভিজিৎ স্পষ্টতই বিরক্ত । কিন্তু ড্রয়িং রুমে তো কেউ নেই, তাহলে কে এসেছে? হঠাৎ ওপর থেকে একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ । অভিজিৎ এর বুকটা কেঁপে উঠলো, অপর্ণার কি হলো, বাড়িতে কে ঢুকেছে? ছুটে গিয়ে দরজা ঠেলতেই …………………… অপর্ণা আর তার ওপরে এক অচেনা পুরুষ …………… কিন্তু না, এতো অচেনা পুরুষ নয়, একি, এতো সেই সুলেমান! “অপর্ণা! হাউ কুড ইউ!” অভিজিৎ এর ভিতরের পুরুষ চিৎকার করে উঠলো । “দাদা, চিল্লাবেন না, এটা ভদ্দর লোকের পাড়া, সব ক্যায়া সোচেগা!” “তোর এতো সাহস, আমি তোকে পুলিশে দেবো, বাস্টার্ড!” অভিজিৎ চিৎকার করতেই সুলেমান ছুরি বার করলো, “চুপ সালা, মাদার……… এখানেই তোকে খতম করে দিবো” “উসকো ছোড় দো, কুছ নেহি হোগা, তুম আব যাও, বাদমে মিলেঙ্গে” অপর্ণার আদেশে সুলেমান শান্ত হোল, “ঠিক হ্যায় জানেমন, ইস বকরি কো সব বাতা দো, বাই ডার্লিং” সুলেমান বেড়িয়ে গেলো । অভিজিৎ স্তম্ভিত, “এসব কি অপর্ণা, তুমি এতো নিচে নেমে গেছো, আমার, আমার পরিবারের মান সন্মান, এগুলো কিছু ম্যাটার করলো না তোমার কাছে!” অপর্ণা ঠাণ্ডা গলায় বললো, “অভিজিৎ ওভার রিয়াক্ট কোরো না, রিল্যাক্স” অভিজিৎ আর মেজাজ ধরে রাখতে না পেরে একটা সপাটে চড় কষালো অপর্ণার গালে, “ইউ বিচ, কাটা জিনিসের খুব লোভ লেগেছে না, সেদিন ট্রেনেও দেখছিলাম একবারের জন্যেও তুই প্রতিবাদ করলি না, তোদের মতন মেয়েদের……” অপর্ণা একটা সজোরে চড় মারলো অভিজিৎ কে, “সাট আপ, ইউ হিপোক্রিট, কাওয়ার্ড” অভিজিৎ ছিটকে পরে গেলো, অপর্ণার এই চড়ে সুলেমানের সেদিনের ঘুষির থেকেও বেশি জোর ছিলো । অপর্ণা ফেটে পরলো, “কোথায় ছিলো তোমার পুরুষত্ব, তোমার আর তোমার পরিবারের স্টেটাস সেদিন যখন আমাকে বিক্রি করলে নিজের প্রাণ বাঁচাতে, একটা পুলিশে কমপ্লেইন্ট করতে তোমার সেদিন বুক কেঁপেছিল, যদি সুলেমান আবার এসে তোমাকে মারধর করে, তোমার বাড়িতে আমায় আবার ধর্ষণ করে, তোমার বিরাট স্ক্যান্ডেল হয়ে যেত তাহলে! সুলেমান আমায় ধর্ষণ করলে সেটা হয়ে যায় গরীবের অশিক্ষার ফ্রাস্ট্রেশন, না, আসলে সুলেমান তো তথাকথিত সংখ্যালঘু তার ওপর গুণ্ডা, ওর বিরুদ্ধে কিছু বললে তো তোমার সংখ্যালঘুদের নিয়ে ন্যাকা কান্না করে যে পলিটিক্যাল আর ফাইন্যান্সিয়াল গেইন হয় তাতে বিরাট ধাক্কা লাগতো, আর দ্বিতীয়ত, তুমি ভয় পাও সুলেমানের বিরুদ্ধে কোনও স্টেপ নিলে ও তোমাকে আবার ধোলাই দিতে পারে । বাহ! কি বিপ্লবীর সাথে আমি ঘর করেছি, আসলে আগে বুঝতাম না, কিন্তু এখন বুঝি তোমরা আসলে সংখ্যালঘু বলে প্রীতি দেখাও না, ওটা তোমাদের ভয়ে করতে হয়, না করলে যে হালাল হয়ে যাবে আর এছারা পলিটিক্যাল গেইন তো তোমাদের আছেই । আজ বুঝি, কেন আমার বাপ কাপুরুষের মতন উদ্বাস্তু হয়েছিল, তোমরা সব ক্লীব, ঘৃণ্য কাপুরুষ, গো টু হেল !” অভিজিৎ স্তম্ভিত, তাও চীৎকার করে ঊঠলো, “অপর্ণা, মুখ সামলে কথা……” অপর্ণা ফুঁসে ঊঠলো, “মুখ সামলে! কোথায় ছিল সেদিন ট্রেনের মধ্যে এই দম, কেন, সেদিন লড়লে না কেন? মরতাম দুইজনে, সন্মানের সাথে, কিন্তু না তোমাকে তো বাঁচতে হবে, তাই আমাকে না, সেদিন তুমি বিক্রি করলে নিজের বিবেককে, নিজের মনুষ্যত্বকে । তোমার জন্য এখন আমার একটাই এক্সক্ল্যামেশন, ছিঃ” । অভিজিৎ বাকরুদ্ধ, তাকে কোনওদিন তার সবথেক কট্টর বিরোধীও এইভাবে আক্রমণ করে নি যেটা আজ করলো তার স্ত্রী, বাম মনস্ক, নারীবাদী, মুক্তমনা, অপর্ণা । অভিজিৎ আজ বুঝতে পারলো ধর্ষণের ব্যাথা, সেই ব্যাথাটা আজ সে রন্ধে রন্ধে অনুভব করছে, সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু এখনও অপর্ণা ব্রহ্মাস্ত্রটা ছোঁড়ে নি, অভিজিৎ কিছুটা সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলো অপর্ণা অভিজিৎ এর সামনে এসে একটা কাগজ তার হাতে দিলো । “অপর্ণা, কি এটা” অভিজিৎ এর কাঁপা কাঁপা গলা, “এটা ডিভোর্সের কাগজ, যত তাড়াতাড়ি সাইন করে দেবে তোমার শরীরের পক্ষে মঙ্গল, আমি সাইন করে দিয়েছি ।” অভিজিৎ, “তুমি আমাকে একটা ভুলের জন্য এত বড় শাস্তি দিচ্ছো! তুমি আমাকে এত বড় শাস্তি দিতে পারো না, আমার সারা জীবনের সন্মান………” অপর্ণা, “হ্যাঁ, তোমার এই সন্মান যাতে আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তাইতো এই ব্যাবস্থা ।” “মানে, এসব কি ধরণের ননসেন্সিকাল কথাবার্তা, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে!” অভিজিৎ কাঁপছে থর থর করে, আবারও অপর্ণা ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলো, “আমি একদম প্রকৃতস্থ অবস্থায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দেখো সেদিন তুমি নিজের প্রাণ বাঁচাতে আমাকে বিক্রি করলে, কে জানে আবার কোনও দিন, কোথাও, কোনও সংখ্যালঘু গরীব আমায় ধর্ষণ করতে চাইবে আর তুমি আবারও আমায় বিক্রি করবে, এইভাবে কোনও দিন কেউ স্যাটিসফায়েড না হয়ে দিলো তোমায় খুন করে আর বিবেকের দংশনে সারাজীবন কাতরাবো আমি, আর তার থেকেও বড় কথা এইভাবে স্বামী যদি বিশ্বমানব হয়ে স্ত্রীকে বিলোতে থাকে নিজের প্রাণ বাঁচাতে, তাহলে আমার বুদ্ধি আমায় বলে সেরকম কাউকে খুঁজে নিতে যার সাথে ঘর করলে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাবারও সাহস করবে না কেউ আর সেরকম একজন পুরুষকে আমি পেয়েছি আমার জীবনে, এখন থেকে আমি তার বিবি  ।” অভিজিৎ অবাক হয়ে দেখছে, এতো সিনেমাকেও হার মানায়! অপর্ণা ব্যাগ থেকে একটা বোরখা বার করে সেটা পরে নিলো । “অপর্ণা!” অভিজিৎ এর আর্তনাদ, “অপর্ণা নয়, আমিনা বিবি, আমি খুঁজে নিয়েছি এক প্রকৃত পুরুষকে যে আমাকে শরীরের নিরাপত্তা দিতে পারবে, বাকিটা হার্ডলি ম্যাটারস” অভিজিৎ ডুকরে উঠলো, “কে সেই ব্যাক্তি?” অপর্ণার থুরি আমিনা বিবি হো হো করে হেসে উঠলো, “সেদিন ট্রেনে যে আমায় এত ‘আদর’ করলো, আজ যাকে ঘরে দেখলে তারপরেও প্রশ্ন করছো, কে সে ব্যাক্তি! তুমি কি অন্ধ নাকি বিশ্বমানবতার দোহাই দিয়ে ন্যাকামি করছো!” “সুলেমান!” অভিজিৎ ভেঙে চুড় চুড় হয়ে গেলো, “হ্যাঁ” অপর্ণা ওরফে আমিনা বিবির গলায় এক অদ্ভুত উল্লাস, “আর বাই দা ওয়ে, সুলেমান গরীব নয়, নিজের এলাকায় দাপ দেখিয়ে অ্যাফ্লুয়েন্ট ভাবে থাকে, তোমরা বিশ্ব মানবরা এই প্রাইড আর পুরুষাকার কোনও দিন বুঝতে পারবে না, তাইতো তোমরা চিরদিনের সর্বহারা!” আমিনা বিবি দরজার দিকে এগিয়ে গেলো, অভিজিৎ স্পষ্ট শুনলো একটা ব্যাঙ্গ মেশানো গলা, “খুদা হাফিজ, কমরেড!”