হিন্দু রাষ্ট্রের অনুধ্যান – ১

হিন্দুত্ববুক্স ও বঙ্গদেশ পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে আমরা আভাস চ্যাটার্জী, আই এ এস, দ্বারা লিখিত The Concept of Hindu Nation বইটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করছি। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা। আমরা অনুমতির জন্য ভয়েস অফ ইণ্ডিয়ার কাছে ঋণী।

হিন্দু রাষ্ট্রের অনুধ্যান

 

– আভাস চ্যাটার্জী

 

বিগত বেশ কিছু বছর ধরে, ‘হিন্দুত্ব’ আর ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ পরিভাষাটি বেশ লোকমুখে চর্চিত হয়ে এসেছে। বিশেষতঃ ১৯৮৮ সালের মধ্যবর্তী সময় থেকে যখন রামজন্মভূমির মুক্তিকরণের আন্দোলন জনসমর্থন লাভ করা শুরু করেছে এবং ১৯৯৩ সালে যখন ভারতীয় জনতা পার্টি উত্তরপ্রদেশ ও অন্যান্য উত্তরদেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনে দুর্বিষহ পরাজয়ের সম্মুখীন হয়, তখন থেকে। এই সমস্ত বছরগুলিতে, হিন্দুত্ব ও হিন্দুরাষ্ট্র আমাদের পারিপার্শ্বে সব জায়গায় স্পষ্ট প্রতিভাত হতে থাকে, যেমন – আমাদের সংবাদপত্রের কলামে এবং সম্পাদকীয় বিভাগে, আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতায়, রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহারে ও বিবৃতিতে। এর সমর্থনে হোক বা এর চরমতম বিরোধিতায় হোক, সকলে ইদানীং বেশ গুরুত্ব দিয়ে হিন্দুত্ব এবং হিন্দু রাষ্ট্রের প্রতি তাঁদের মতামত প্রকাশ করছিলেন। এই চর্চিত বিষয়গুলি এই সময়ে নিরন্তরভাবে সমস্ত আলোচনাকে অবদমিত করে রেখেছিল।

১.১ কিছু বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা

এই সমস্ত আলোচনা সত্ত্বেও, ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ পরিভাষাটির মানে যে আদতে কী, তা আমাদের কাছে কোনোদিন পরিষ্কার করা হয়নি। সমস্ত বক্তৃতা, সম্পাদকীয় বিভাগ এবং প্রতিবেদন সত্ত্বেও হিন্দু রাষ্ট্র বা হিন্দু জাতির অর্থ নিয়ে কিছু প্রাথমিক ধোঁয়াশা রয়েই গেছে।

আমাদের চোখে কিছু ভবিষ্যত্দর্শী বিবৃতি চোখে পড়ে, যেমন – ‘আমরা একটি হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করব’ অথবা ‘হিন্দু রাষ্ট্রের নির্মাণ কেউ আটকাতে পারবে না’ অথবা ‘হিন্দুরাষ্ট্র কখনই তৈরী হবে না’ এবং আরো অনেক কিছু। এই ধরণের বিবৃতি অবশ্যই প্রমাণ করে যে আজ অবধি কোনো হিন্দু রাষ্ট্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কিন্তু যদি তাই হয়, তাহলে ঐ একই সময়ে কেউ কী করে হিন্দুদের জাতীয় মর্যাদার (অস্মিতা) কথা বলে?

কোনো জনসভায় আমাদের দেশের একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি প্রায় সকলের কাছে হিন্দু রাষ্ট্রের একজন সর্বাধিনায়ক হিসেবে সম্মানিত, তাঁর কাছে একজন উৎসাহী শ্রোতা এই স্লোগান তোলেন, ‘তিনিই এই দেশে একা রাজত্ব করবেন যিনি হিন্দুত্বের স্বার্থে পাশে দাঁড়াবেন’। [১]

উক্ত রাজনৈতিক নেতা এই স্লোগানটির নিষিদ্ধকরণে বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় করেননি এবং তিনি সমস্ত শ্রোতাদের বলেন, “দয়া করে আপনারা বলুন যে সেই একমাত্র সারাদেশ শাসন করবে, যে সমস্ত জাতির স্বার্থে কাজ করবে”। এটা খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে ‘হিন্দু’ আর ‘জাতি’ এই পরিভাষাদ্বয় একেবারেই ভিন্ন। কিন্তু যদি তা হয়, তাহলে কীভাবে সেই একই নেতা হিন্দু রাষ্ট্রের কথা উচ্চারণ করেন?

যেকোনো সংখ্যক নেতা যাদের হিন্দু রাষ্ট্রের সমর্থক হিসেবে পরিচিত, তাঁরা বারংবার বলতে থাকেন যে এই ধারণা ভারতীয় সংবিধানের বর্তমান রূপ অনুযায়ী একেবারেই ভুল নয়; এতে কোনোরকম ভুল নেই। তাঁরা বলেন, বরঞ্চ ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের সন্তুষ্ট করার পদ্ধতিতে বেশ কিছু নীতিভ্রষ্টতা লক্ষ্য করা গেছে। তাই আমরা এই জনমোহিনী পদ্ধতির প্রতিবাদ করছি। তা ঠিক আছে, কিন্তু যদি তাই হয়, তবে এই সমস্ত জনমোহিনী পদ্ধতিগুলি ব্যতিরেকে কি কখনো একটি হিন্দু রাষ্ট্র তার নিজস্ব অস্তিত্ব লাভ করতে পারে?

আমার কাছে এই সমস্ত ধন্দ ভীষণই নিরর্থক বলে বোধ হয়। যতদূর পর্যন্ত আমি বুঝে উঠতে পেরেছি, তার থেকে বুঝেছি যে হিন্দু জাতি বা হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণাটি অত্যন্ত সহজ। এটাকে খুব বেশি হলে মাত্র পাঁচটা শব্দগুচ্ছেই বর্ণনা করা যায় এবং এই পাঁচটি শব্দ হল : আমরা হিন্দুরা হলাম একটি জাতি। অনুগ্রহ করে আমার শব্দগুলিকে ভালো করে খেয়াল করুন : আমরা হিন্দুরা হলাম একটি জাতি। ১৯৪৬ সালে যখন মুসলিম লিগের ভারত ভাগের দাবি এবং একটি পৃথক রাষ্ট্র তথা পাকিস্তানের গঠনের দাবি নিয়ে গুরুতর বিতর্ক শুরু হয়েছে, কেউ একজন মহম্মদ আলি জিন্নাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি শুধু পাকিস্তানের কথা বলে যাচ্ছেন। আপনার এই পাকিস্তানের ধারণাটি আপনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন? আপনি এর মাধ্যমে আসলে বলতে কী চান?” জিন্না প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, “অবশ্যই। মাত্র পাঁচ শব্দে ব্যক্ত করতে পারি”। তারপর তিনি সেই বিখ্যাত পাঁচটি শব্দ উচ্চারণ করলেন : “আমরা মুসলিমরা হলাম একটি জাতি”। এবং তারপর তিনি সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা, অসামঞ্জস্য এবং হিন্দুদের সঙ্গে একত্রে অবস্থান করার অসম্ভাব্যতা ইত্যাদি সম্পর্কিত তাঁর বিতর্কের বিষয়গুলিকে আরো বিস্তৃত করে ব্যাখ্যা করা শুরু করেন। অবিভক্ত ভারতের মুসলমানদের বাস্তবিকই একটি পৃথক রাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমার কিছু তীব্র সন্দেহ আছে। কিন্তু, ওই ধারণার পরিপূরক হিসেবে আমরা হিন্দুরা যে একটি জাতি, তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, এটি একশ শতাংশ সত্য। আমরা হিন্দুরা মুসলিম বা খ্রিস্টানদের মত কেবল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নই, আমরা নিজেরা স্বয়ং একটি জাতি। এই ‘হিন্দু’ পরিভাষাটিই আমাদের জাতিগত পরিচয়। “ আমরা হিন্দুরা একটি জাতি” – এটি একটি সহজ, সাধারণ এবং অভ্রান্ত সত্য। দুর্ভাগ্যবশতঃ, আমরা এই সহজ সত্যটিরও মর্মোপলব্ধি করতে ব্যর্থ এবং এই ব্যর্থতার বীজটি আমাদের সমস্ত ভুল ধারণা ও দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেই নিহিত।

১.২ জাতি কাকে বলে?

আমাদের ভুল ধারণাটির জন্ম হয়েছে এই বাস্তবতা থেকে যে আমরা সত্যকারে একটি জাতির(nation) সংজ্ঞা নিরূপণ ও মর্মোদ্ধারের চেষ্টা করিনি। আমরা সাধারণতঃ জাতি বলতে দেশ, একটি ভূখণ্ড, পৃথিবীর একটা নির্দিষ্ট অংশ বুঝে থাকি। কিন্তু জাতি বলতে সেরকম কোনো জমির টুকরো বোঝায় না। একটি জাতি বলতে একটি গোষ্ঠী অথবা সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে বোঝায় যাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে একটি বিশেষ অঞ্চলে বাস করছেন, যাঁদের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আছে এবং যাঁরা নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির উৎকর্ষতার গুণে বিশ্বের অন্যান্যদের থেকে পৃথক একটি পরিচিতি লাভ করেছেন। একটি জাতির সংস্কৃতিগত বিশিষ্টতা নির্ভর করে তার বর্ণ, অথবা ধর্ম, অথবা ভাষা অথবা এই সকল বিষয়ের একটি সমন্বয়ের উপর, কিন্তু সর্বোপরি তাদের অবশ্যই একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি থাকতে হবে যা তাদের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করবে। তৃতীয়ত, একই সংস্কৃতির হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ বিভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু এই সকল বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানগুলি তাঁদের মধ্যে মোটের উপর একটি ঐক্যতান সৃষ্টি করে, এবং তাঁদের হৃদয়ে গর্বের অনুভূতি সৃষ্টি হয় যা তাঁদের সমগ্র বিশ্বের থেকে একটি পৃথক পরিচিতি বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে অনুপ্রাণিত করে। সবশেষে, এই সকল বিষয়ের অন্তিম ফলাফলস্বরূপ, এই গোষ্ঠীর মানুষের তাদের ঐতিহ্যবাহী বাসস্থানের ইতিহাস সম্পর্কে একটি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে; এর নিজস্ব নায়ক ও খলনায়ক আছে, এর নিজস্ব গৌরব ও লজ্জার দৃষ্টিভঙ্গি আছে, সাফল্য ও ব্যর্থতা আছে, জয় ও পরাজয় আছে।

যে গোষ্ঠীর এই উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আছে, এবং যে দেশে তারা ঐতিহ্যগতভাবে বাস করছেন এবং যেখানে তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, সেটিই সেই জাতির মাতৃভূমি – সেটিই তাদের ঐতিহ্যগত বাসস্থান। কিন্তু কোনো ভূখণ্ড কখনো নিজে একটি রাষ্ট্র হতে পারে না। অন্যার্থে, একটি রাষ্ট্র কখনোই একটি ভূখণ্ডগত অংশ নয়, বরং তা একটি আবেগ যার একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ভিত্তি আছে। যেহেতু, শ্রী অরবিন্দ ঘোষ বলেছিলেন, “একটি রাষ্ট্র নিঃসন্দেহে একটি সম্প্রদায়ের আবেগের বাহ্যিক প্রকাশ, তা সে একই রক্তের আবেগ হোক বা একই ধর্মের আবেগ হোক, অথবা সম স্বার্থের বিষয়ে আবেগ বা এর মধ্যে কোনো একটি অথবা সকল প্রকার আবেগের সমন্বিত রূপ”।

যখন থেকে আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা শুরু করব, আমরা তৎক্ষণাৎ দেখতে পাব যে হিন্দুরা কেবল নিজেদের কাছে একটি জাতি নয়, বরং আমরা বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন জাতি যারা এখনো অবধি পৃথিবীতে টিকে আছি। হিন্দু সংস্কৃতির এই স্বতন্ত্রতা আমাদের সমগ্র বিশ্বের থেকে বেশ পৃথক একটি পরিচিতি দান করেছে। আর আমাদের জাতির এই পৃথক সংস্কৃতিটিই হল ‘সনাতন ধর্ম’। এই সনাতন ধর্মের বেশ কয়েকটি শাখা প্রশাখা আছে। এক্ষেত্রে আমাদের আছে বৈদিক ও তান্ত্রিক, বৌদ্ধ ও জৈন; আমাদের আছে শৈব ও বৈষ্ণব, শাক্ত ও শিখ, আর্য সমাজ ও কবীরপন্থী; এর মধ্যে আয়াপ্পার উপাসক এখন আছে কেরালায়, সার্ণ–র উপাসক ছোটোনাগপুরে এবং দোনি-পোলো-র উপাসক আছে অরুণাচল প্রদেশে। বস্তুতঃ এখানে সনাতন ধর্মের প্রচুর সংখ্যক গঠনগত এবং কার্যগত বিভিন্নতা আছে, কিন্তু এই বিভিন্নতার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে একটি আধ্যাত্মিকতার প্রবাহ চলতে থাকে যা আমাদের সকলকে হিন্দুতে পরিণত করে এবং আমাদের একটি সহজাত ঐক্যের অনুভূতি প্রদান করে।

হিন্দুদের ক্ষেত্রে বর্ণ, ভাষা ও আঞ্চলিক ঐতিহ্যের কারণে বেশ কিছু সংখ্যক পার্থক্য আছে। কিন্তু হিন্দুত্বের পরিচয়ের প্রাথমিক কথা অর্থাৎ ঐক্য এবং সম্প্রীতি সমস্ত ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেয় এবং সনাতন ধর্মের এই একই আবেগের প্রবাহ নিখিল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে।

১.৩ হিন্দুরা এবং তাদের বাসস্থান

হিন্দুদের ঐতিহ্যগত বাসস্থান হচ্ছে ভারতবর্ষ। এটা একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক সত্তা। পৃথিবীতে খুব স্বল্প সংখ্যক এমন দেশ আছে, যাদের বাসস্থানের সীমানা প্রাকৃতিকভাবেই খুব স্পষ্ট করে টানা হয়েছে, যাদের মধ্যে আমাদের দেশ অন্যতম। আমাদের প্রকৃতি মা স্বয়ং এই সীমানা সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর তা তিনি আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রেই দান করেছেন – কারণ ভারতবর্ষ নিজেই হিমালয় ও হিন্দুকুশ পর্বতবেষ্টিত এবং ভারত মহাসাগর, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর দিয়ে অপরের থেকে পৃথকীকৃত একটি ভূখণ্ড। এমন বোধ হয় যে, প্রকৃতি অথবা পরমেশ্বর নিজে একটি নির্দিষ্ট জাতির মাতৃভূমি হিসেবে বিশেষভাবে এই দেশটির নির্মাণ করেছেন। এবং হিন্দুরাও এই ভূমির সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে জড়িয়ে আছে, এখানে বসবাস করেছে, তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা এখানে গড়ে তুলেছে এবং নয় নয় করে প্রায় ৬০০০ হাজার বছর ধরে তারা এই মাটিকে পবিত্র মৃত্তিকা বলে জ্ঞান করে এসেছে। অবশ্যই, যখন আমি ভারতবর্ষকে হিন্দুদের মাতৃভূমি হিসেবে উল্লেখ করছি, এটা মাথায় রাখতে হবে যে, বর্তমানের যে বিভক্ত ভারতবর্ষে আমরা বাস করছি আমি তার কথা বলছি না । কিন্তু আমি আমাদের সেই মাতৃভূমির কথা বলছি যা গান্ধার থেকে কামরূপ এবং কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ক্রমাগত বিস্তৃত।

ইহাই প্রকৃতপক্ষে হিন্দু জাতির ধারণা অথবা আমরা যাকে হিন্দুত্ব বা হিন্দু রাষ্ট্র বলি, এটি তাই।
এই প্রসঙ্গক্রমে যে নির্মম সত্যটিকে আমাদের স্বীকার করতে হবে তা হল আমরা প্রায় এক হাজার বছর ধরে বিদেশী শত্রুদের আমাদের দেশে রাজত্ব করার জন্য পরাধীন হয়ে ছিলাম। তারা বর্বরোচিত অত্যাচার ও অর্থনৈতিক প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের দেশের একটা নির্দিষ্ট অংশের মানুষকে তাদের পূর্বপুরুষের সংস্কৃতি ত্যাগ করতে এবং বিদেশী শত্রুদের সংস্কৃতি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু আরো দুঃখের বিষয়, কিছু প্রজন্ম কেটে যাওয়ার পর এইসব অভাগা মানুষেরা ভুলে যায়, যে সংস্কৃতি তারা গ্রহণ করেছে সেটা একটা বিদেশী সংস্কৃতি – এমন একটা সংস্কৃতি যা অন্য কোনো জাতির এবং তাদের উপর তা বলপূর্বক আরোপ করা হয়েছে। তারা এই বিদেশী সংস্কৃতিকে তাদের নিজেদের ভাবতে থাকে, এ প্রতি একটা আসক্তি গড়ে তোলে এবং নিজেদের এর সঙ্গে পরিচিত করে তোলে। এভাবে বিদেশীদের পরাধীনতা আমাদের জোড়া দুর্ভাগ্যের দিকে টেনে নিয়ে যায়, যেখানে একদিকে আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাসভূমির বেশ কিছু অংশের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় এবং পরের দিকে আমাদের জাতির কিছু অংশ আমাদের থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যায়।

কিন্তু এই অধীনতা কখনোই স্বয়ং একটা জাতির সত্তাকে ধ্বংস করেনি। এমনকি জাতির চরিত্র, মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং বিন্যাস এই দাসত্বকরণের ফলে পরিবর্তিত হয় না। একটি জাতি সত্যই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। সেখানে এমন পরিস্থিতি আসতে পারে যেখানে একটি জাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে এবং এর জাতীয় স্বতন্ত্রতা একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু একটি জাতির নিজের অধীনতা কখনই তার ধ্বংস বা পরিবর্তন অথবা তার চরিত্রের পরিবর্তনকে সূচিত করে না। এই দুটি একেবারেই সমার্থক নয়। দাসত্ব চলাকালীন দীর্ঘকাল ধরে একটা জাতি ভালো থাকতে পারে এবং হেসেখেলে টিকে থাকতে পারে।

আমরা হিন্দুরা কেবল একটা জাতি, ঠিক যেমন জার্মানরা একটি জাতি, আর্মেনিয়ানরা একটি জাতি, কুর্দরা একটি জাতি এবং ইহুদিরা একটি জাতি। জার্মান জাতিদের লক্ষ্য কর। তাঁদের ঐতিহ্যগত বাসস্থানকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ইহা কখনোই তাদের জাতীয় সত্তাকে দুর্বল করে দেয়নি। মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তাঁরা তাঁদের বাসভূমির পুনঃ-একত্রীকরণ অর্জন করেছিল এবং এই জাতিটি তাদের মূল বাসভূমি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল। ইহুদিদের ক্ষেত্রে তারা বাস্তবিক অর্থেই নিজের মাতৃভূমির ওপর সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। প্রায় ২০০০ বছর ধরে, তারা তাদের ঐতিহ্যগত বাসস্থান থেকে পৃথক ছিল। কিন্তু এর জন্য কখনোই ইহুদি জাতিসত্তা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ইহুদিরা তাঁদের জাতি রক্ষা করেন এবং এত অত্যাচার ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পরেও প্রায় ২০০০ বছর পরে তাঁরা তাঁদের ঐতিহ্যগত বাসস্থানে তাঁদের রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। হিন্দুরাও একটি জাতি হিসেবে নিজেদের ধরে রেখেছে তা সে যতই গত সহস্র বছর ধরে যে কেউ আমাদের বাসভূমির উপর রাজত্ব করুন না কেন। এই জাতিটির সারবস্তু এখনো একই রয়ে গেছে। এর বিষয়বস্তু এবং অস্তিত্বও একই রয়ে গেছে।

 

১.৪ স্বামী বিবেকানন্দের দৃষ্টিভঙ্গি

আমরা হিন্দুরা যে একটি জাতি তা একেবারেই কোনো নতুন ধারণা নয়। এই ধারণাটি আমাদের মধ্যে বহুদিন ধরে আছে, এমনকি আমাদের সমগ্র ইতিহাস জুড়ে আছে। আমি খুব বেশিদিন পূর্বে এটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি না। আমি নিজেকে আধুনিক সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছি। আপনি যদি দয়ানন্দ সরস্বতীর লেখা পড়েন তবে হিন্দুরা যে একটি জাতি, আপনি সেই ধারণাটি দেখতে পাবেন। বঙ্কিমচন্দ্র ও শ্রীঅরবিন্দের লেখনীতেও আপনি একটি স্পষ্ট ও দৃঢ় ধারণা পাবেন যে, আমরা হিন্দুরা একটি জাতি এবং শুধুমাত্র কোনো সাধারণ ধর্মীয় সম্প্রদায় নই। বীর সাভারকারের দৃষ্টিভঙ্গিও একই ছিল যা তিনি অত্যন্ত দৃপ্তভাবে তাঁর বিখ্যাত বই ‘হিন্দুত্ব’ তে তুলে ধরেছেন। যাইহোক, এই ধারণাটির সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠ বক্তা হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর স্বল্প তথাপি ঘটনাবহুল জীবনে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে স্পষ্টভাবে এবং নিরন্তর ঘোষণা করে গেছেন যে – আমরা হিন্দুরা একটি জাতি।
আমি আপনাদের স্বামীজির শিকাগো ধর্ম সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনের প্রথম ৫ মিনিটের সংক্ষিপ্ত সম্বোধনটি মনে করিয়ে দিতে চাই। সেই বক্তৃতায় স্বামীজি তাঁর আমেরিকান শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “ আমি আপনাদের প্রত্যেক শ্রেণী ও বর্ণের লক্ষাধিক হিন্দুদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই”। তারপর তিনি তিনটি বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন যা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমে তিনি বলেছিলেন, “আমি অত্যন্ত গর্ব অনুভব করি যে আমি এমন একটা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যারা সমগ্র বিশ্বকে সহনশীলতা ও সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার শিক্ষা দিয়েছে”। তারপর তিনি বলেছিলেন, “আমি এমন একটা জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গর্বিত যারা সমগ্র বিশ্বের সকল ধর্ম ও সকল জাতির নিপীড়িত ও উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দান করেছে”। তিনি একটি উদাহরণ উদ্ধৃত করেন যে, যখন রোমান কর্তৃক জিউসের পবিত্র মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তখন আমরা হিন্দুরা ইহুদীদের আশ্রয় দিয়েছিলাম ও তাদের তত্ত্বাবধান করেছিলাম । তৃতীয় বাক্যে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমি এমন একটা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গর্বিত যারা বৃহৎ জরথুস্ত্রীয় জাতিকে আশ্রয় দান করেছেন এবং এখনো তাদের টিকে থাকা অংশকে প্রতিপালন করে চলেছেন”।

এইভাবে, পরপর তিনটি বাক্যে স্বামীজি প্রথমে “একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়”, তারপর “একটি জাতি” এবং তারপর আবার “একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়”-এর কথা বলে তাঁর গর্বের কথা ঘোষণা করেন। [২]

এখানে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই যে স্বামীজি ‘ধর্ম’ ও ‘জাতি’-কে সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর কাছে এই দুটির মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। এটাও অত্যন্ত ব্যাপকভাবে স্পষ্ট যে তিনি ঠিক কোন ধর্ম বা কোন জাতির কথা বলছেন এবং জাতিত্বের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও সহজে জানা যায়।

স্বামী বিবেকানন্দের অনেক লেখা ও বক্তৃতায় আমরা হিন্দু জাতির নবজাগরণের, হিন্দু জাতির পুনরুত্থানের ও হিন্দু জাতির পুনরুজ্জীবনের প্রায় শত শত প্রসঙ্গ-উল্লেখ পাই। প্রকৃতপক্ষে হিন্দু জাতির পুনরুত্থান ছিল তাঁর চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রীয় বিষয়। যে কেউ তাঁর লেখায় অসংখ্য অভিব্যক্তি খুঁজে পাবেন, যেমন –‘হিন্দুদের জাতীয় দর্শন’, ‘ হিন্দুদের জাতীয় ঐতিহ্য’ ইত্যাদি। তিনি ক্রমাগত হিন্দুদের জাতীয় গৌরব ও নিয়তি, তাদের জাতীয় তত্ত্ব এবং ইতিহাস, তাদের জাতীয় সচেতনতা এবং উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করতে থাকেন। তিনি হিন্দুদের জাতীয় সাহিত্য, তাদের জাতীয় চরিত্র, তাদের জাতীয় মেরুদণ্ড ও কর্মদক্ষতার কথা বলেন। তিনি হিন্দুদের জাতীয় প্রাসাদ-ইমারত, হিন্দু জাতির বেঁচে থাকার লক্ষ্যমাত্রা, হিন্দুদের জাতীয় কাজ এবং হিন্দু জাতির ধারকের কথা বলেছেন। বস্তুতঃ, তাঁর সমস্ত লেখনী, বক্তৃতা এবং সাক্ষাৎকার এই ধরণের অভিব্যক্তিতে পূর্ণ।

স্বামীজি হিন্দু জাতির অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য যে হিন্দু ধর্ম তথা সনাতন ধর্ম, তা নিয়ে সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন ছিলেন।
এক জায়গায়, তিনি বলছেন যে, হাজার বছরের দাসত্ব ও এক শতাব্দীর স্বৈরশাসন সত্ত্বেও হিন্দু ধর্ম যে এখনো টিকে আছে, তার কারণ তারা তাদের জাতীয় জীবনের প্রাথমিক উপাদান অর্থাৎ ধর্মকে কখনো পরিত্যাগ করেনি। এখানে ধর্ম বলতে তিনি কেবল সনাতন ধর্মকে বুঝিয়েছেন। অন্যত্র তিনি বলেছেন যে, সনাতন ধর্ম স্বয়ং আমাদের জাতীয় জীবন। আবার অন্য জায়গায় তিনি বিবৃত করেন যে, হিন্দু জাতি এখনো টিকে আছে কারণ কেউ তার অন্তরাত্মা তথা সনাতন ধর্মকে ধ্বংস করতে পারবে না। তিনি আরো বিবৃত করেন যে, সনাতন ধর্মই আমাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে আমরা হিন্দুরাই এমন একটি জাতি যারা কোনোদিন অপর কোনো জাতি বা ভূখণ্ডকে আক্রমণ করতে যাইনি। একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, হিন্দুদের জাতীয় জীবনের সারাংশটি হল আধ্যাত্মিকতা এবং আমাদের হিন্দুদের সদাসর্বদা এই জাতীয় ধারণাটিকে যে কোনো কিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে হবে এবং এও বলেছেন যে যদি আমরা এই আধ্যাত্মিকতাকে পরিত্যাগ করে ফেলি, তাহলে একটি জাতি হিসেবে আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাব। [৩]

স্বামীজী একটি বার্তা দিয়েছিলেন – “একম সদ বিপ্র বহুধা বদন্তি” যা হিন্দু জাতির অস্থি-মজ্জায় সমাহিত হয়ে গেছে। তিনি চিহ্নিত করে বলেন যে বিদেশী আগ্রাসনের প্রভাবে আমাদের সহস্রাধিক মন্দির নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু সেগুলির আবার পুনরুত্থান হয়েছে কারণ এটাই আমাদের জাতীয় জীবন-প্রবাহ। স্বামীজী হিন্দুদের সঙ্গে অন্যান্য জাতির পার্থক্য সূচিত করেন এই বলে যে – ফরাসী জাতির জাতীয় উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক মুক্তি, ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক প্রতিভা এবং হিন্দুদের ক্ষেত্রে তা ছিল আধ্যাত্মিকতা। এক অনুষ্ঠানে তিনি এটাও দাবি করেন যে নিখিল বিশ্বের সমস্ত জাতির মধ্যে হিন্দুরা সর্বাপেক্ষা বেশী উদার এবং তিনি এও যোগ করেন, “আমি এই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে এই কথা বলছি না, আমি বলছি কারণ এটাই সত্য”।

এভাবে প্রমাণিত হয় যে স্বামী বিবেকানন্দের এ বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা ছিল এবং শতাব্দীর প্রারম্ভেই তিনি মূলভাবটি (মূল মন্ত্র)নিয়ে দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে আমরা হিন্দুরা একটি জাতি এবং আমাদের জাতির সেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যটি হল – সনাতন ধর্ম।

আমরা হিন্দুরা যে স্বয়ং একটি জাতি এবং কোনো সাধারণ ধর্মীয় সম্প্রদায় নই – এই প্রাথমিক সত্যটি এই শতাব্দীতে আমাদের প্রথম জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে সাহায্য করেছিল যা স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯০৫ সালে যখন বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল তখন সমগ্র হিন্দু সমাজ জাতীয় অনুপ্রেরণা নিয়ে উঠে এসেছিল। সেই সময়, কারোর মনে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ ছিল না যে আমরা হিন্দুরা একটি জাতি। এই কারণে আমাদের এই কোলকাতায় পবিত্র কালীঘাট মন্দিরে কালী মায়ের সামনে প্রায় ৫০০০০ মানুষ শপথ নিয়েছিল যে তারা তাদের বাসভূমি থেকে ইংরেজদের ছুঁড়ে ফেলে দেবে। প্রায় ৫০০০০ মানুষ রাস্তা দিয়ে মিছিল করে যায় ও পবিত্র গঙ্গা নদীতে একডুব দেওয়ার পর তারা তাদের কপাল তিলক দ্বারা রঞ্জিত করে এবং তারপর তারা হাতে ভগবৎ গীতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই দিনগুলোতে কেউ সনাতন ধর্ম ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পায়নি। সেখানে চিন্তার একটি স্বচ্ছতা ছিল যে ভারতীয় জাতির একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল সনাতন ধর্ম।

১.৫ একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি : ‘ভারতীয় জাতি’

যাইহোক, জাতির একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি ভারতে অতি শীঘ্রই প্রকাশিত হয়েছিল। যেহেতু মুসলিমরা ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল, তাই তারা তাদের দাবি উত্থাপন করা চালিয়ে গিয়েছিল আর তারা ইংরেজদের সহিংস ইসলামীয় অস্ত্রের মাধ্যমে সমর্থনও জুগিয়েছিল – এর জন্য নরমপন্থী হিন্দু নেতারা আরো শিথিল উপায়ন্তর খুঁজছিলেন। সম্মুখসমরে এই ইসলামীয় গুণ্ডামির মোকাবিলা করার বদলে তাঁরা এর অনুশীলনকারীদের সমন্বিত করতে চেয়েছিলেন। আর এই সুযোগে তাঁরা আমাদের জাতীয়তাবাদকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার পন্থা খুঁজছিলেন। তাঁরা অস্বীকার করতে থাকেন যে বহু প্রাচীন যুগ থেকেই আমরা হিন্দুরা একটি জাতি হিসেবে অবস্থান করে আসছি এবং এর পরিবর্তে তাঁরা ঘোষণা করতে থাকেন যে ভারত এখনো ‘একটি রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথে’ এবং ভারতীয় রাষ্ট্র হিন্দু ও মুসলিমদের সমন্বয়ে একদিন গড়ে উঠবে। এটা আত্ম-প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই নতুন প্রস্তাব ১৯২০ সালে ভারতীয় রাষ্ট্রের বিকল্প ধারণাটিকে কিছুটা উস্কে দেয়। সজ্ঞানে হোক বা অজ্ঞানে, এই নতুন ধারণার নির্মাতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী –যদিও সনাতন ধর্মের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তাঁর নেতৃত্ব চলাকালীন তিনি যে কয়েকটি বড় ভুল করে ফেলেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল – আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টাটি। এই প্রচেষ্টাটি একেবারে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। এটি পরিশেষে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল কারণ এর নিয়তিই তাই ছিল – এটি তাঁকে ভারতে জাতির একটি নতুন ধারণা গড়ে তোলার পথে নিয়ে যায়। গান্ধীজীর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যপূরণের জনা অন্য নেতারাও এই ধারণাটির প্রচার করতে শুরু করেন। সবশেষে, যখন পণ্ডিত জহরলাল নেহরু এই রাজনৈতিক পরিবেশকে অবদমিত করতে এলেন, তিনি এই মিথ্যাচারকে আরো বেশী করে প্রচার করতে থাকেন এবং এই নতুন বিকল্প ধারণাটির শিকড় আরো ব্যাপকভাবে ও আরো গভীরে বিস্তৃত হতে সাহায্য করেন।

এই বিকল্প ধারণাটি ছিল : ভারতীয় মাটিতে যে সকল মানুষ থাকেন, তাঁরা একত্রে একটি রাষ্ট্র গঠন করেন। এই ধারণা অনু্যায়ী, এই দেশের সমস্ত অধিবাসী – সে তারা এ দেশের সংস্কৃতি মেনে চলুক অথবা কোনো বিদেশী সংস্কৃতি আয়ত্ত করুক, তারা এই দেশের প্রতি বিশ্বস্ত হোক বা না হোক, এই দেশের ঐতিহ্যের প্রতি কারো যে রকম ব্যবহারই থাকুক, যে কেউ এ দেশের সংস্কৃতিকে জঘন্য এবং শয়তানের পথ বলেও যদি মনে করে – তবু তাদের একত্রিত হয়ে একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে।

এই নতুন ধারণাটিকে একটি নতুন নামও দেওয়া হয়েছিল – ভারতীয়। এইভাবে এই নতুন ধারণাটি জাতীয়তাবাদের মৌলিক ধারণাটিকে অর্থাৎ আবেগের ঐক্য এবং তা থেকে যা যা প্রতিভাত হয় ইত্যাদিকে চিরবিদায় জানিয়েছিল। ইহা রাষ্ট্রকে একটা ভৌগোলিক অস্তিত্বে পরিণত করে দিয়েছিল। যদিও সত্য হল এই যে একটি রাষ্ট্র কখনোই একটি ভৌগোলিক সত্তা নয় এবং একটি রাষ্ট্র যদি তার ঐতিহ্যগত বাসস্থানের অভ্যেস হারিয়েও ফেলে, তাও তা একটি রাষ্ট্রই থাকে।

তাই, বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, হিন্দুরা একটি জাতি নয়, একটি সাধারণ ধর্মীয় সম্প্রদায় মাত্র। ঠিক যেমন মুসলমানরা একটি সম্প্রদায়, খ্রিস্টানরা একটি সম্প্রদায় ইত্যাদি। আর এই সকল সম্প্রদায়কে একত্রে রেখে নির্মিত হয় ‘ ভারতীয়’ জাতি। এভাবে, গান্ধী-নেহরু যুগে

‘ভারত’ ও ‘ ভারতীয়’ শব্দ দুটির অর্থ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। আর আমরা হিন্দুরা একটি জাতির মর্যাদা হারিয়ে কেবল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত হলাম – নিছকই রাষ্ট্রের সাধারণ একটি অংশ মাত্র।
এটা স্পষ্টত প্রমাণিত যে এই দুটি বিকল্প ধারণা একই সময়ে বৈধ হতে পারে না। এটা একান্তই আপনার বিচার্য বিষয় যে কোন দৃষ্টিভঙ্গিটা সঠিক এবং কোনটি ভুল।

কিন্তু এতেই বিষয়টি শেষ হয়ে যায় না। এটা ছিল একটা ভৌগোলিক বা বিমিশ্র জাতির নতুন ধারণা, যা জহরলাল নেহরু ১৯৪৭ সাল থেকে তাঁর সমস্ত ক্ষমতা ও মর্যাদা ব্যবহার করে প্রচার করতে থাকেন যাতে তা হিন্দুদের মননের মধ্যে গেঁথে যেতে পারে – তাই এর বেশ কতগুলি উল্লেখযোগ্য প্রভাব আছে। এই প্রভাবগুলি নেহরুযুগের সমস্ত নীতির ভিত্তি-প্রস্তর নির্মাণ করে এবং অচিরেই হিন্দুদের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়।
হিন্দুদের প্রথম তাৎপর্য এই ছিল যে তারা সবচেয়ে বড় গোষ্ঠী ছিল। এটি অন্য সকল সম্প্রদায়ের জন্য খুবই বিপজ্জনক ছিল। দ্বিতীয়ত, যেহেতু এই সম্প্রদায়টি অন্য সকল গোষ্ঠীর জন্য বিপজ্জনক ছিল, তাই একে যত বেশী দুর্বল করা হবে তা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যের জন্য তত বেশী ভাল হবে। তৃতীয়ত, অন্য সকল সম্প্রদায়ের ভালো হলে তাতে রাষ্ট্রেরও হত কারণ তাদের অংশগ্রহণ আমাদের জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলি যোগ করেছিল।
তাই, এই তত্ত্বটি প্রচারিত হয় – “হিন্দু গোষ্ঠীকে আভ্যন্তরীণ বিভাজন সৃষ্টি করে, এর সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে, এর উপর অপমান বর্ষণ করে একে যত পার দুর্বল করে দাও। অন্যান্য যে সকল উপায়ে তুমি এই কাজ করতে পার, তাই কর”। আমি নিশ্চিত যে আমায় শ্রোতাবন্ধুদের কাছে পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করতে হবে না যে কীভাবে গত ৫০ বছর ধরে এই তত্ত্বের অনুসরণে আমাদের দুর্বল করার জন্য নানা প্রকারের প্রচেষ্টা চলেছে। একটি ছোট্ট প্রতিচ্ছবির মাধ্যমে আপনার সেই সকল কথা মনে পড়বে।

চতুর্থত, এই নতুন ধারণার সঙ্গে সঙ্গে অপর একটি নতুন ধারণা যার নাম সর্বধর্ম সমন্বয়–কে প্রচার করা হয়েছিল। এটি সুপারিশ করে যে যেহেতু আমাদের রাষ্ট্র অসংখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমাবেশে গঠিত হয়েছিল, তাই ভারতের জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে সেই সকল মতবাদ বা সকল সম্প্রদায়ের ধর্মকে মান্যতা দেওয়া উচিত এবং তাদের সম মর্যাদার আসনে বসানো উচিত। বলা হয় যে, আমরা আমাদের মননে যে স্থানে ভগবৎ গীতাকে রেখেছি, সেই একই স্থানে কুরআন ও বাইবেলকেও রাখতে। যে নিষ্ঠা আমাদের জাতীয় উপাসনার খাতিরে শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ ও ভগবান বুদ্ধ-র প্রতি আছে, সেই একই নিষ্ঠা যেন আমরা মহম্মদ ও যীশু খ্রিস্টের প্রতিও রাখি এবং সেইরূপ আচরণ করি। এই বিদেশী সংস্কৃতিকে আমাদের নিজের সংস্কৃতি বলে গ্রহণ করার বিষয়টি একটি সুবিধাযোগ্য স্লোগান-সর্বধর্ম সমন্বয়–এর মাধ্যমে আরো দৃঢ়তা লাভ করেছিল।

পঞ্চমত, যেহেতু এই সর্ববৃহৎ গোষ্ঠীর স্বতন্ত্রতা ছিল সনাতন ধর্ম, তাই এটি খুব প্রয়োজনীয় ছিল। আমাদেরও বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয়েছিল যে অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভালোর জন্য আমাদের সনাতন ধর্ম-র গতি মন্দীভূত করা উচিত। যতদূর সম্ভব হয়, হিন্দু ধর্মের নিন্দা করে যেতে হবে–হিন্দুত্ববাদ একগুচ্ছ কুসংস্কার, বর্ণ আর মূর্তিপূজা ছাড়া আর কিছুই নয়, সম্পূর্ণ সনাতন ধর্ম মিথের উপর নির্ভর করে আছে, এটি একেবারেই একটি প্রগতিশীল ধর্ম নয় এবং আরো অনেক কিছু। প্রত্যক্ষভাবে হোক বা পরোক্ষভাবে সনাতন ধর্মের একগুচ্ছ কলঙ্কপূর্ণ রীতি-নীতি প্রচার করা হয়েছিল।

সর্বোপরি, আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রতি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে শেখানো হয়েছিল। আমাদের বলা হয়েছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসকে সমন্বয়ের চোখে দেখতে। আমাদের বলা হয়েছিল যে আমাদের ঘাড়ে ইসলামকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য যে ক্রমাগত বর্বরোচিত স্বৈরাচার ঘটে চলেছে, তাকে উপেক্ষা করতে।

ভয়াবহ অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধ্বংসলীলা ও সকল গণহত্যাকে আমাদের ভুলে যেতে হবে। অথবা আমাদের মনে করে নিতে হবে যে এগুলি কিছু শাসকের ব্যক্তিগত মতিভ্রংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতের ইতিহাসকে একটি সমন্বয়ের ইতিহাস হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্যে বেশ কিছু কাল্পনিক ঘটনা গড়ে তোলা হয়েছিল যেমন – প্রাচীন যুগ থেকেই বিদেশীরা ভারতে আসত এবং এখানেই তারা ধীরে ধীরে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে থাকে। তারা একে অপরের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশে যেতে থাকে এবং এভাবেই একটি নতুন রাষ্ট্র গড়ে ওঠে, এভাবেই একটি নব সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তাই, আমাদের প্রকৃত অর্থে কোনো নিজস্ব জাতীয় সংস্কৃতি নেই, আমাদের কেবল একটি বিমিশ্র সংস্কৃতি আছে।

জাতীয়তাবাদের এই বিকল্প ধারণা অনুসারে হিন্দুরা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের চেয়ে বেশী কিছু নয় এবং ভারতের সমস্ত বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তারা সকলেই হিন্দুদের বিরুদ্ধে ছিলেন। এমনকি, এই দৃষ্টিভঙ্গির সর্বাপেক্ষা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যটি হিন্দু-বৈরিতার নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল কারণ ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর নামে যাকে হৃদয়ঙ্গম করা হচ্ছিল, তা আসলে পূর্ব স্থিরীকৃত হিন্দু-স্বার্থের উচ্ছেদ মাত্র। যেহেতু এই ধারণার প্রসারের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল জহরলাল নেহরুর চিন্তা ও পদক্ষেপ, তাই আপনি এই তত্ত্ব বা আদর্শকে নেহরুবাদ বলে নামাঙ্কিত করতে পারেন। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র নামে এই আদর্শবাদটির গুণগান করা হল, জয়ধ্বনি দেওয়া হল, প্রচার এবং প্রসার করে যাওয়া হতে থাকল, যতক্ষণ না এটি সমস্ত দুর্নামের ঊর্ধ্বে উঠে যায়, সমস্ত বিতর্ক ও আলোচনার ঊর্ধ্বে উঠে যায়।

এই আদর্শবাদের প্রতি নেহরুর কতটা গভীর বিশ্বাস ও দৃঢ় অঙ্গীকার ছিল তা তাঁর অসংখ্য বিবৃতি থেকে সহজেই প্রমাণযোগ্য। ১৯৪৯ সালে ফারুখবাদে একটি সভায় নেহরু বলেছিলেন যে, হিন্দু সংস্কৃতি ভারতীয় স্বার্থে আঘাত হানবে। ১৯৫১ সালে লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, “ হিন্দু ধর্মের আদর্শ বর্তমান ভারতের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একেবারে বেমানান এবং একে যদি আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দেওয়া হয় তবে এটি আমাদের দেশকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেবে”। ১৯৫৩ সালে কৈলাশনাথ কাটজুকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “ বস্তুতঃ এই এক-একজন ব্যক্তি ( হিন্দু) যে কোনো দেশের প্রায় সব মানুষের চেয়ে বেশি অসহিষ্ণু ও সংকীর্ণ মনোভাবাপন্ন”। ১৯৪৭ এর অব্যবহিত শুরুতেই তিনি একটি জনসভায় গর্বভরে ঘোষণা করেছিলেন যে, “ যতদিন পর্যন্ত আমি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষে আছি, ভারতবর্ষ কিছুতেই একটি হিন্দু রাষ্ট্র হতে পারবে না”। আপনি অবশ্যই জানবেন যে নেহরু তাঁর নিজের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন যে তিনি শিক্ষায় একজন ইংরেজ, মতাদর্শে একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী, সংস্কৃতিতে তিনি একজন মুসলমান এবং কেবল দুর্ঘটনাচক্রে জন্মসূত্রে তিনি একজন হিন্দু। এই সমস্ত প্রমাণসহ, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে নেহরুর হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু সমাজ ও সর্বোপরি সকল হিন্দুদের প্রতি গভীর অবজ্ঞা ছিল।

১.৬ সত্য বনাম মিথ্যাচার

এভাবে আমাদের সম্মুখে আমাদের রাষ্ট্র সম্পর্কে দুটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি ছিল – একটি স্বামী বিবেকানন্দের ও অপরটি জহরলাল নেহরুর। অনেকে বলেন যে আপনার জাতীয় জীবনের সারাংশ হল হিন্দু ধর্ম। যদি আপনি চান আপনার দেশ টিকে থাকুক, তবে আপনি এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত থাকুন, নতুবা আগামী আপনি তিন প্রজন্মের মধ্যে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারেন। অপরজনের মতে, যিনি প্রায় ৫০ বছর পর এসেছেন, তিনি বলছেন যে, হিন্দু ধর্ম যদি প্রতিষ্ঠালাভ করে, আমাদের দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। একজন বলছেন যে, হিন্দু সংস্কৃতি আমাদের জাতির জীবন-প্রবাহ, আবার অপরজন বলছেন, সামান্য হিন্দু সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করলেও রাষ্ট্রের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। স্বামীজি ঘুরে ঘুরে সমগ্র বিশ্বকে বলে গেছেন যে যদি কোনো ব্যক্তির প্রমাণিত সহনশীলতার নজির থাকে, তবে তা হিন্দুরাই। কিন্তু নেহরুর মতে, হিন্দুরা পৃথিবীর সবচেয়ে অসহনশীল জাতি।

স্বামীজি অত্যন্ত দৃঢ় গলায় বলেছেন যে তিনি নিশ্চিত যে ভারত তার শিষ্টাচার এবং হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু সংস্কৃতির মাধ্যমে জগৎসভায় পুনরায় শ্রেষ্ঠত্বের আসন অধিকার করবে। কিন্তু নেহরু বিশ্বাস করতেন বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি বড়ই বেমানান। একজন হিন্দু হিসেবে অত্যন্ত গর্ববোধ করতেন, অপরজন হিন্দু হিসেবে ভীষণ লজ্জাবোধ করতেন এবং একে জন্মগত দুর্ঘটনা বলে প্রমাণ করে প্রত্যাখ্যান করতে চাইতেন।

অবশ্যই, এই দুটি চিন্তাধারা কখনোই একত্রে সঠিক নয়। এই দুটির মধ্যে কোনটি সত্য এবং কোনটি মিথ্যে, তা আমাদেরই বিচার করতে হবে।

এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে ১৯৪৭ সাল থেকে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকল্প ধারণা অর্থাৎ নেহরুবাদী চিন্তাধারা আপামর জনসাধারণের মনে প্রোথিত হয়ে গেছে। এখন আপনি স্বয়ং বিচার করুন যে এই মতবাদে আদৌ সত্যের লেশমাত্র উপস্থিত আছে কিনা। আমি আগে যা বলেছি অর্থাৎ বাস্তবিক অর্থেই মহাত্মা গান্ধী ছিলেন এই চিন্তাধারার জনক তথা প্রতিষ্ঠাতা – কিন্তু সারাজীবন এই ঋষিতুল্য মানুষটির নিরলস প্রচেষ্টার পরেও তিনি এই উপলব্ধিকে বাস্তব রূপ দান করতে পারেননি। ৩০ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেও মহাত্মা নিজের সমস্ত কাজে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন এবং পাকিস্তানের জন্ম হয়। এই একটি ঘটনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে ‘সমন্বিত’ ভারতীয় জাতির চিন্তাধারা কেবল অলীক কল্পনা ব্যতীত আর কিছুই নয়। আমার এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে ‘সমন্বিত’ ভারতের যে ধারণা ছিল তা গান্ধী-নেহরু যুগে আমাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল – যে ধারণা বিগত ৫০ বছর ধরে রাষ্ট্র-শাসনব্যবস্থার সমস্ত নীতি নির্ধারণ করেছে, তা আসলে একটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। এই ধারণা একটি অলৌকিক কাহিনী ও আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অতীতে এমন কোনো রাষ্ট্র বিদ্যমান ছিল না, বর্তমানেও নেই এবং ভবিষ্যতেও সম্ভবত থাকবে না।

 

পাদটীকা

১। ৩১ শে জুলাই, ১৯৯৪ সালে মহাজাতি সদন, কোলকাতায় পূর্বাঞ্চল কল্যাণ আশ্রম ও ফ্রেণ্ডস অফ ট্রাইবাল সোসাইটির পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত একটি বক্তৃতার পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ।

২। শ্রী অরবিন্দ ১৯০৯ সালে প্রায় একই রকমের কিছু কথা বলেছিলেন যখন তিনি আলিপুর জেলে থাকাকালীন যোগব্যায়াম সংস্থার বার্তা পেয়েছিলেন : “ আমি সেই ধর্মকে বিশ্বের সম্মুখে আনছি, যাকে আমি ঋষি, সন্ন্যাসী ও অবতারদের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে বিকশিত করে তুলতে পেরেছি এবং এখন আমার কাজ হল সমগ্র জাতির মধ্যে এটিকে তুলে ধরা। আমি আমার কথাকে কার্যকরী করে তোলার জন্য এই জাতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি”।

৩।  শ্রী অরবিন্দের কাছেও ভারতবর্ষ ও সনাতন ধর্ম অভিন্ন ছিল। ১৯০৯ সালে তাঁর বিখ্যাত উত্তরপাড়া বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “যেখানে বলা হচ্ছে যে একদিন ভারতের উত্থান হবে, তার অর্থ একদিন সনাতন ধর্মের উত্থান হবে। যখন বলা হয় যে ভারতবর্ষ একদিন শ্রেষ্ঠ হবে, তখন বোঝানো হয় যে সনাতন ধর্ম একদিন শ্রেষ্ঠ হবে। যখন বলা হয় যে ভারতবর্ষ নিজের বিস্তার স্বয়ং করবে, তখন আসলে বলা হয় যে সনতন ধর্ম বিকাশলাভ করবে ও নিখিল বিশ্বে নিজেকে ব্যপ্ত করবে। ইহা কেবল ধর্মের জন্য এবং ধর্মের জন্যই ভারতবর্ষের অস্তিত্ব আছে… আমি তাই বলি যে সনাতন ধর্মই আমাদের জন্য জাতীয়তাবাদ”।

(ক্রমশঃ)