গণনাট্য সংস্থা: অবক্ষয়ের মাধ্যমে ভারতীয় নান্দনিক ঐতিহ্যের ধ্বংস

0
1074

একজন কম্যুনিস্ট আদপে একটা ধর্মান্ধ, তাঁর বিশ্বাসের তীব্রতার ভরে বা পার্টির আনুগত্যে আত্মহীন হয়ে আন্দোলনের কান্ডারীপ্রতিম নবী হওয়াই তার প্রধান লক্ষ্য। (জিন এবং উইন্ডমিলার )

এর চেয়ে খাঁটি সত্য কথা বোধ হয় আর কোথাও বলা হয়নি। মানুষের মৌলিক আবেগ যদি পরীক্ষা করা হয়, একটা কমিউনিস্ট আসলে সর্ব-প্রথমে একটি গভীরভাবে অসন্তুষ্ট, ক্রমাগত ক্ষুব্ধ এবং আত্মঘৃণাতে জর্জরিত জীব। এই আত্মঘৃণা যখন নিখুঁত রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে, তখন এটি চক্রীয় গণহত্যার পরিণত হয়। স্ট্যালিন এবং মাওদের গণহত্যা এই সত্যকে যথাযথভাবে প্রমাণ করে। তবে এই ভয়ংকর মাপের রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য জনসাধারণের মধ্যে যে পরিমান আত্মঘৃণা ও অসন্তোষ প্রবর্তন করা প্রয়োজন, তা হয় গোপনে অন্তরালে, এবং যখন
সুবিধাজনক, তখন সর্বসমক্ষে । পুরোটাই মতাদর্শের মলাটে সুন্দর করে মুড়ে পরিবেশিত হয়।

ভারতে কমিউনিস্টদের কৌশল হয় agitprop. agitation অর্থাৎ আন্দোলন ও propaganda অর্থাৎ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনগণের মানসে নিজেদের জায়গা তৈরী করে নেওয়া।

শব্দগুলির একটি ভাল একাডেমিক ব্যাখ্যা এখানে দিয়ে রাখা ভালো: কমিউনিস্টদের ব্যবহারে propaganda শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে এবং এটি agitation থেকে পৃথক হয়। খুব সরল করে বলতে গেলে, সাধারণ এবং বিশেষের মধ্যের পার্থক্য। Propaganda হল বাছাই করা শ্রোতাদের কাছে জটিল চিন্তাধারার প্রচার; agitation হল সাধারণ দর্শকদের কাছে সোজা সাধারণ ধারণা যা কখনো নিতান্তই স্রেফ স্লোগানের মাধ্যমে প্রচার করা হয়।

প্রতিটি পার্টির সদস্য একজন পূর্ণকালীন agitationist এবং propagandist।

সুতরাং, এটি কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয় যে শুরু থেকেই, কম্যুনিজম নিজের প্রচারের জন্য বেছে নিয়েছিল জনজবীনের প্রতিটি অঙ্গ । পার্টির তত্ত্ববধানে যে পরিমান জার্নাল, ম্যাগাজিন, পুস্তিকা, (বিশেষজ্ঞ) সংবাদপত্র, মনোগ্রাফ, পত্রিকা কমিউনিস্টরা প্রকাশ ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছে তা এক কথায় অগুনতি।

শব্দের ভোজবাজিতে চিরকাল-ই পটু কম্যুনিস্টরা প্রথমেই বেছে নেয় লেখনী। ১৯৩৬ সালেই তৈরী হয় প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশন (PWA বা IPWA )। তার প্রথম কাজ হয় আঞ্জুমান তারাকি পসন্দ মুসসানাফিন-এ-হিন্দ কে নিজের মধ্যে অবোধ করা। উপরোক্ত সংস্থাটি আলিগড়ের স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের মস্তিস্ক-প্রসূত। সেই বিকৃত নক্ষত্রমন্ডলীর মধ্যে আসে হামিদ আখতার, ফাইজ আহমদ ফাইজ, আহমদ নাদীম কাশ্মি, সাদাত হাসান মান্টো, ইসমাত চুঘতাই, মুল্ক-রাজ আনন্দ, হাজরাত মোহানী, কৃষ্ণ চন্দের, রাজিন্দের সিংহ বেদি, সাহির লুধিয়ানভি ও অমৃতা প্রীতম।

আর পরপরেই ১৯৪৩ সালে তৈরী হয় আইপিটিএ (IPTA) । তাদের সদস্যের মতে তারাই থিয়েটার আর্টিস্টদের প্রথম সংগঠন। বলাই বাহুল্য, কমিউনিস্ট বিষাক্ত মতাদর্শ ছড়ানো ছাড়া তাদের আর কোনো কৃতিত্ব নেই। বামপন্থী অজাচারের নিয়ম মেনে PWA -এরই বহু সদস্য ঢোকে IPTA তে। কয়েকটি উলেখযোগ্য নাম হলো বিমল রায় , এ. কে. হাঙ্গাল, আন্না ভাউ সাঠে, কে. সুব্রামানিয়াম, কে. এ. আব্বাস, আব্দুল মালিক, নিরঞ্জন সেন, নির্মল ঘোষ; সচিন সেন-গুপ্ত, পৃথ্বিরাজ কাপুর, বিজন ভট্টাচার্য, সলিল চৌধুরী, বলরাজ সাহনি, ঋত্বিক ঘটক, দেব আনন্দ, চেতন আনন্দ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সাহির লুধিয়ানভি, মাজরূহ সুলতানপুরী, প্রেম ধাওয়ান, শৈলেন্দ্র, কাইফি আজমী, নিরঞ্জন সিংহ মান, এস। তারা সিংহ চান, জগদীশ
ফরিয়াদি, খলিলী ফরিয়াদি, রাজেন্দ্র রঘুবংসী, সফদার মীর, হাসান প্রেমানি, অমিয় বোস, সুধীন দাসগুপ্ত এবং অবশ্যই উৎপল দত্ত। উৎপল দত্ত “একনিষ্ঠ এবং অত্যন্ত দক্ষ কর্মী” -র তকমা প্রাপ্ত ছিলেন।

আইপিটিএ-এর প্রবর্তনের সময়টি নিখুঁত ছিল: 1943 সালের মে মাসে বোম্বাইয়ে, সিপিআই প্রথম কংগ্রেস অধিবেশনের সাথে । এবং এটি দর্শনীয়  সাফল্য পেয়েছিল। ভ্রাম্যমান নৃত্য এবং নাটকের ট্রুপ সংগঠিত করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়েছিল। মার্কসীয় থিম সম্পর্কিত ব্যালে এবং নাটক সম্পাদন করার জন্যই পাঠানো হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি দাবি করে যে ১৯৪৩-৪৪ সালে একটি ভ্রমণকারী দল দেশ ভ্রমণ করে বাংলার দুর্ভিক্ষ ত্রাণের জন্য 200,000 টাকা জমা করে! ১৯৪৭ সালে আইপিটিএ জানায় যে এর আগের বছর তার ৪৪ টি শাখা সংগঠন ৫২ টি মঞ্চের প্রযোজনা এবং ৮০০ টি নতুন গান উপস্থাপন করেছে এবং পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি সংখ্যক শ্রোতাদের বিনোদন করেছে ।

আইপিটিএ নিজেকে কোনও রাজনৈতিক দলের সাথে অসম্পর্কিত, একটি স্বায়ত্তশাসিত এবং স্বাধীন সাংস্কৃতিক সংস্থা বললেও বাস্তবে এটি পুরোপুরি সিপিআই দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এই নিয়ন্ত্রণটি শুধু সংস্থা হিসাবে আইপিটিএ পর্যন্ত নয়, তাদের সদস্যদের ব্যক্তিগত জীবনেও প্রসারিত ছিল। লেখক-পরিচালক কে.এ. আব্বাস কে চিঠি লেখেন সোলি বাটলিওয়ালা । বাটলিওয়ালা প্রথম ১৯৪৩ সালে প্রথম কংগ্রেসে সিপিআই কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুবছরের মধ্যেই, বটলিওয়ালা তার ব্যক্তিগত জীবনে সিপিআইয়ের নাক-গলানোতেতিতিবিরক্ত হয়ে ১৯৪৫ সালে পার্টির সাথে পুরোপুরি সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

বাটলিওয়ালা চিঠি তে লেখেন;

আপনার (অর্থাৎ কে এ আব্বাসের) আইপিটিএতে থাকা কোন সহযোগী আইপিটিএর কাজকে নিজের ইচ্ছেতে নয়, বরঞ্চ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে আইপিটিএর দায়িত্বে থাকা সদস্যের কঠোর শৃঙ্খলার অধীনে থেকে করে । আমি জানি না কমরেড কৃষ্ণান আপনাদের এক্সেকিউটিভে আছে কিনা। তবে আপনার কম্যুনিস্ট সহকর্মী কেউ কোনও আলোচনায় একটিও সংশোধনী সমর্থন করতে পারবেন না যতক্ষণ না তাতে আপনার কার্যনির্বাহী করে যেন কে কৃষ্ণানএর অনুমোদন না থাকে।এটি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আপনার  নাটকগুলিতে অভিনয়কারী ব্যক্তিদের থেকে শুরু করে যারা বিভিন্ন ক্ষমতাতে সংগঠনের জন্য পুরো সময় কাজ করে থাকেন ।

এমনকি দুর্দান্ত অভিনেতা এবং তথাকথিত সিপিআইয়ের অন্যতম “অনুগত কর্মী” উৎপল দত্তকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। আইপিটিএর তৎকালীন প্রধানকে নিয়ে তাঁর নিজের স্বীকারোক্তি:

আমি তখন থেকে জানতে পেরেছি যে প্রধান যিনি আমাদের উপরে নেকড়ের মতো নেমে এসেছিলেন এবং কেন্দ্রীয় স্কোয়াডকে শহরের চার কোণে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন । ১৯৪৮-৪৯ এর ঝামেলার সময়ে তিনি সহজেই নিখোঁজ হয়ে ছিলেন …. তিনি কোনও সংগঠনকে সহ্য করতে পারতেন না যেখানে তিনি সর্বেসর্বা নন। তবে যেহেতু তিনি না পারেন লিখতে, না অভিনয় করতে, না গান করতে, না নাচতে, তাই তিনি কোনও সংস্কৃতি সংগঠনের নেতৃত্ব দেয়া দূরে থাক, তার অবক্ষয়ের পৌরোহিত্য নেমে পড়েন। আইপিটিএ-র ইতিহাস লিখতে বসে তিনি লিখে ফেলেন তাঁর আত্মজীবনী … সাম্প্রতিক একটি বইয়ে প্রধান এখনও নিরন্তরভাবে নিরঞ্জন সেন এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে ছোট করেছে। তবে, নিতান্তই দুঃখজনক তার লেখায় আইপিটিএর প্রথম সাধারণ সম্পাদিকাকে সাধারণ বেশ্যার বেশি আর কিছু মনে হয় না…… তার লেখা এর ইঙ্গিত দেয় যে পুরো কম্যুনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব তার সাথে দীর্ঘ আনন্দোচ্ছল সময় কাটিয়েছে।

বেশিরভাগ কমিউনিস্ট ক্রিয়াকলাপের মতোই আইপিটিএ ছিল নগ্ন প্রচারের জন্য একটি সম্মুখভাগ, যার অন্তঃসার নিপুন দক্ষতার সাথে লুকানো।
এর সাথে তুলনীয় সম্ভবত আর্থার কোয়েস্টলারের প্রশংসিত ক্লাসিক “ডার্কনেস এট নুন” এর সাথে যেখানে নৃশংস এবং উদ্দীপনার সাথে চরিত্রগুলি এই ধরণের নীতি কৌশল ব্যবহার করে থাকেন।

তবে গভীরতর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে, আইপিটিএর মতো ধ্বংসাত্মক সংস্থার উত্থানও সেই মেকলেবাদী শিক্ষার প্রত্যক্ষ পরিণতি। আদিম সনাতন ঐতিহ্যের খাঁটি নন্দনতত্ত্বের অধ্যয়নের পতনের ঠিক সমান্তরাল হয়েছিল – অবাধ আনন্দ প্রতিস্থাপিত হয়েছিল অদম্য আন্দোলন দ্বারা।
অতীতের সমস্ত কিছুর পুরোপুরি উৎখাত করার কমিউনিস্ট বিকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে এটা নতুন কিছুই নয়। তবে আইপিটিএ কে আবশ্যকভাবে নন্দনতত্ত্বের নতুন মান উদ্ভাবন করতে হয়েছিল তাদের বিকৃতি কে জনমানসে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। পেছনে ফিরে দেখলে দেখা যায় যে এই “নান্দনিকতার নতুন মান” কেবল শৈল্পিক অনুসরণের কিছু কমরেডের নিজেদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতার প্রতিচ্ছবি।। কন্নড় সাহিত্যের ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগ এবং বেশিরভাগ ৭০ এর দশকের মতাদর্শের লড়াইয়ের বিষয়বস্তু হল: পি লঙ্কেশ এবং তার কিছু সতীর্থরা সাথে প্রাক্তন গুরু ইউ আর অনন্তমূর্তির ব্যক্তিগত লড়াই।

যে ভাবেই হোক, স্বাধীনতার পর, ১৯৫৩ সালে, আইপিটিএ আরও বেশি সাফল্য অর্জন করেছিল এবং এডভোকেট, বিচারক, যুগ্ম সচিব এবং রাজনীতিবিদ ও সমাজের প্রভাবশালী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছিল। আইপিটিএর দুটি উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক শাখার মধ্যে গুরুত্ব পায় কর্ণাটকের সামুদায় ও (অবিভক্ত) অন্ধ্রের প্রজা নাট্য মণ্ডলী। এই বিস্তারে এটি সাহায্য করেছিল যে ততদিনে কম্যুনিস্টদের নিজের লোক নবাব নেহেরু ভারতের নেতৃত্বে ছিল। তাদের পানিপ্রার্থনাতে নবাব নেহেরু সদয় হন; ১৯৫৭ সালে আইপিটিএ সঙ্গীত নাটক আকাদেমির দ্বারা সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে। অন্য ভাবে বলতে গেলে , সংস্থাগুলি নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস সুক্ষভাবে চলে আসে আইপিটিএর হাতে, যেখানে বসে তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারে যে “ভাল শিল্প” কী এবং কী নয়; যারা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ, তারা হলেন হয় উপেক্ষিত নয়তো ধ্বংস।

এরপর থেকে সিনেমায় রূপান্তর ছিল মসৃণ। এই প্রবন্ধেই তালিকাভুক্ত লেখক, অভিনেতা, সংগীত পরিচালকের নাম পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। পরবর্তী ত্রিশটি বছর বামপন্থীদের আধিপত্য প্রায় সম্পূর্ণ ছিল। এই আধিপত্যের আর এক প্রতিফলন অবশ্যই এই তথ্য যে ভারত সরকার আইপিটিএর সম্মানে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

সেই আধিপত্য আসলে এখনও বাস্তব।

মূল প্রবন্ধটি Dharma Dispatch পত্রিকায় প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন দেবতনু।