রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের এক সরসঙ্ঘচালক রামকৃষ্ণ মিশনের এক সঙ্ঘাধ্যক্ষের নির্মিত

আজ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দ্বিতীয় সঙ্ঘাধ্য়ক্ষ গুরুজী গোলওয়ালকরের জন্মদিন।

শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ স্বামী অখণ্ডানন্দজী (১৮৬৪–১৯৩৭)-র মন্ত্রদীক্ষার প্রবল প্রভাব পড়েছিল নাগপুর কেন্দ্রিক মহারাষ্ট্রে। ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। ১৯২৮ সালে স্বামী ভাস্করেশ্বরানন্দ (বিপ্রদাস মহারাজ)-কে ভুবনেশ্বর মিশন থেকে তুলে মঠাধ্যক্ষ করে পাঠানো হল নাগপুরে। সেখানে তিনি নাগপুরবাসী বিশেষ করে ছাত্র ও যুব-সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামীজির ভাবধারা প্রচার করতে শুরু করলেন। ভাস্করেশ্বরানন্দজীর উদ্যোগে মারাঠি ভাষায় প্রকাশিত হল মাসিক পত্রিকা ‘জীবন বিকাশ’; সেই পত্রিকা সম্পাদনা করলেন মারাঠি যুবক সদাশিব থমব্রে  তিনিই স্বামী অখণ্ডানন্দের প্রিয় ‘Nagre’, পরবর্তীকালে স্বামী ব্যোমরূপানন্দ, (১৯১০–১৯৯৯) এবং ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত নাগপুর শাখার অধ্যক্ষ।

১৯৩৬ সালে নাগপুর মঠে মহাসমারোহে উৎযাপিত হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান। ভাস্করেশ্বরানন্দজীর আগ্রহে থমব্রে এই ১৯৩৬ সালেই লিখেছিলেন মারাঠী ভাষায় শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী।তখন (১৯৩৬ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় মঠাধ্যক্ষ স্বামী শিবানন্দের দেহাবসানের পর মার্চ মাস থেকে) বেলুড়ের মঠাধ্যক্ষ স্বামী অখণ্ডানন্দ। মারাঠি ভাষায় শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী হাতে পেয়ে তিনি থমব্রেকে লিখেছিলেন (১৪ই মে, ১৯৩৫),

“I hope many Marathi knowing people will be much benefitted by reading this short brochures. May Sri Ramakrishna shower his choicest blessings upon you.”
স্বামী ভাস্করেশ্বরানন্দের মাধ্যমে বহু মারাঠি দেশপ্রেমী যুবক জানতে পারলেন শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ ও মঠাধ্যক্ষ স্বামী অখণ্ডানন্দের নাম; জানলেন মাধবরাও সদাশিব গোলওয়ালকরও। উচ্চশিক্ষিত গোলওয়ালকর সেই সুবাদে নাগপুর মিশনে নিয়মিত আসতে শুরু করলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হল যুবক ব্রহ্মচারী আনন্দচৈতন্যের (অমিতাভ মহারাজ, সন্ন্যাস নাম স্বামী অমূর্তানন্দ)। ইনি ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত সারগাছিতে স্বামী অখণ্ডানন্দের সেবক ছিলেন, ১৯২৭ সালে তিনি নাগপুর আশ্রমে যান। এই অমিতাভ মহারাজে কাছ থেকে গোলওয়ালকর জানতে পারলেন প্রচার বিমুখ এক অন্তর্মুখী সাধু তথা ঠাকুর-মা-স্বামিজীর অতি প্রিয়পাত্র ‘গঙ্গাধর মহারাজ’ (স্বামী অখণ্ডানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম) বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার সারগাছি গ্রামে অবস্থান করছেন এবং একনিষ্ঠ সেবাব্রতে নিবৃত আছেন।

১৯৩৬ সালে হিমালয় স্পর্শ করে এই অমিতাভ মহারাজের সঙ্গেই গোলওয়ালকর চললেন সারগাছির সেই পবিত্র গ্রামে। গোলওয়ালকর জেনেছেন, দেবতাত্মা হিমালয়কে পরমেশ্বর জ্ঞানে শ্রদ্ধা করেন স্বামী অখণ্ডানন্দ। মারাঠি যুবক রঘুবীর ধৌঙ্গরি, যিনি ১৯৩৪ সালে নাগপুরের ধন্তৌলিতে মেধাবী দরিদ্র ছাত্রদের জন্য প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ আশ্রমের ছাত্রাবাসে ছিলেন, তিনিও সারগাছি যাত্রায় গোলওয়ালকরের সঙ্গী হলেন। ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে এই তিন যুবক মিলে শিয়ালদহ হয়ে সারগাছি স্টেশনে নেমে পাকা ধানের ক্ষেত পেরিয়ে আশ্রমে হাজির হলেন। গোলওয়ালকর তখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কার্যবাহ, ইতোমধ্যে সফলভাবে সামলেছেন আকোলাতে অনুষ্ঠিত আধিকারিকদের জন্য প্রশিক্ষণ বর্গ; যেমন বক্তব্য তেমনই তাঁর লেখনী। আরও অনেক বড় দায়িত্ব গোলওয়ালকরকে দেবেন ভেবে রেখেছেন প্রথম সরসঙ্ঘচালক ডাক্তারজী। কিন্তু বলা নেই, কওয়া নেই বাড়ি থেকে পালিয়ে, ডাক্তারজীকেও না জানিয়ে গোলওয়ালকর ভীড়লেন শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ রূপ এক মাস্তুলে, নোঙর ফেললেন সারগাছির পবিত্র আশ্রমে। ডাক্তারজী উদ্বিগ্ন। ২৩শে জানুয়ারি, ১৯৩৭ সালে একটি চিঠিতে নাগপুরের সদাশিব থমব্রে-কে স্বামী অখণ্ডানন্দজী জানাচ্ছেন তাদের কুশল সংবাদ,

“Raghuvir, Golwalkar, Amitav are all well here.”

আপনারা কি জানেন, RSS -এর এক সর্বোচ্চ নেতাকে নির্মাণ করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ এক সন্ন্যাসী?

মাধবরাও সদাশিব গোলওয়ালকর যখন সারগাছিতে পৌঁছেছেন তখন স্বামী অখণ্ডানন্দজীর বয়স প্রায় ৭২ বছর; প্রেসার, ডায়াবেটিস সহ নানান শারীরিক সমস্যায় প্রায় শয্যাগত। সারাজীবন সেবা দিয়ে গেছেন, কারো কাছ থেকে সেবাযত্ন নিতে চাননি। স্বামী গম্ভীরানন্দজী তাই স্বামী অখণ্ডানন্দের জীবনীতে লিখেছেন,

“বিদায়ের জন্য প্রস্তুত হইতে থাকিলেও আজীবন স্বাধীনচেতা স্বামী অখণ্ডানন্দ দীর্ঘকাল রোগশয্যায় শায়িত থাকার কথা ভাবিতেও শিহরিয়া উঠিতেন — তিনি অপরের সেবা করিবেন, সেবা লইবার অধিকার বা অভিপ্রায় তাঁহার নাই। অথচ বার্ধক্যজনিত অক্ষমতা ও যুবক ভক্তদের আগ্রহ-নিবন্ধন তাঁহাকে শেষ বয়সে বাধ্য হইয়া কিঞ্চিৎ সেবাগ্রহণ করিতেই হইত। আদর্শ ও বাস্তবের এই সংঘর্ষে তিনি ব্যথিতহৃদয়ে অনেক সময় বলিতেন, ‘এইসব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আমি নিঃসঙ্গ পরিব্রাজকরূপে বিজন দেশে ঘুরে বেড়াব।'”

গোলওয়ালকর(যিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে ‘গুরুজী’ নামে পরিচিত)-এর আন্তরিক ইচ্ছায় স্বামী অখণ্ডাননন্দজী তার সেবা নিতে রাজি হলেন। গুরুজীর জীবনীকার এইচ.ভি.শেষাদ্রি (Shri Guruji Golwalkar — Biography by H.V. Sheshadri, April 18, 2011) লিখছেন,

“Shri Guruji would daily bathe him, wash his clothes, offer him tea and meals, put him to bed. Often Shri Guruji would sit through the night at his bed-side and serve him. About six months passed in this manner.”

স্বামী অখণ্ডানন্দ নিজে একটি চিঠিতে সম্ভবত গোলওয়ালকরের সেবাকর্মের উল্লেখ করেছেন, “অমূল্য (স্বামী শঙ্করানন্দ, ১৮৮০ — ১৯৬২, রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের সপ্তম অধ্যক্ষ) ৮ দিন Infuenza-য় ভুগিয়া কয়দিন পথ্য পাইয়াছে।..নাগপুর হইতে একটি ছেলে আসিয়া সকল রকমে তার কত সেবাই না করিতেছে।”  চিঠিটি স্বামী অখণ্ডানন্দ লিখেছিলেন ১৩ অক্টোবর, সোমবার ১৯৩৬ সালে, প্রাপক ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরে যিনি স্বামী নিরাময়ানন্দ (১৯১১ — ১৯৮৪) নামে পরিচিত হয়েছিলেন এবং উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক এবং মনসাদ্বীপ, চেরাপুঞ্জি, আসানসোল, যোগদ্যান ও বোম্বাই মিশনের প্রধান হয়েছিলেন।

জানা যায়, বহু মারাঠি যুবককে স্বামী অখণ্ডানন্দজী পত্রে ও সাক্ষাতে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তার নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতেন গোলওয়ালকর। স্বামী অখণ্ডানন্দ নাগপুর মঠের অধ্যক্ষ স্বামী ভাস্করেশ্বরানন্দকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রয়োজনমত নাগপুরের মারাঠি দেশপ্রেমী যুবকদের মানসিক ও শরীরিক উৎকর্ষতার পরামর্শ দিতে।

মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা নিবাসী বিনায়ক চেপে ছিলেন এমনই একজন যুবক, যিনি পরবর্তী কালে স্বামী অকামানন্দ নামে পরিচিত হয়ে ছিলেন (১৯৩৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর সারগাছিতে অখণ্ডানন্দের কাছে দীক্ষা, পরে স্বামী বিরজানন্দের কাছে সন্ন্যাস নেন; রাচী ও কানপুর মিশনের পূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন; সম্প্রতি পরলোকগমন করেন)। এই মারাঠি বিনায়ককে স্বামী অখণ্ডানন্দ ‘চাপরে’ নামে ডাকতেন। ১৯৩৫ সালের ১৩ই আগষ্ট একটি চিঠিতে তিনি চাপরে-কে লিখছেন,

“I hope you are taking good care of your health. I can’t understand at this distance why you don’t have sound sleep. You will do well to consult Bhaskareswarananda. He will surely help you with his general instructions…. Don’t meditate morning and evening too hard for sometime, till you are free from sleeplessness.”

স্বামী অখণ্ডানন্দ এইভাবে মারাঠি দেশপ্রেমী ও মানবপ্রেমিক যুবকদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন, সেই সঙ্গে আধ্যাত্মিক গুরু হয়ে উঠলেন গোলওয়ালকরের, পরবর্তীকালে যিনি সঙ্ঘের ‘গুরুজী’।