ঝুলনযাত্রা ও রক্ষাবন্ধন উৎসবের তাৎপর্য

0
1057
585297676

ঝুলনযাত্রা উৎসব প্রকৃতার্থে সূর্যের দক্ষিণায়ন যাত্রার প্রারম্ভের দিবস। এই দিনটির বৈশিষ্ট্য হল – দিনের পরিমাণ হয় বৎসরের মধ্যে সর্বাধিক (১৩ ঘন্টা ২৩ মিনিট)।  এই দিন পর্যন্ত সূর্যের উত্তর অভিমুখে গমন থাকে এবং এইদিনই তা শেষ হয়। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গতিপথটি দীর্ঘতম হওয়ায় দিনের পরিমাণ হয় সর্ববৃহৎ। ওই দিন থেকেই সূর্য তার গতিপথ পরিবর্তন করে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করে। তাই এই বিশেষ দিবস দক্ষিণায়ন যাত্রা দিবস রূপে পরিচিত। হিন্দুরা এই দিনটিকে শ্রীকৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা হিসাবে উদযাপন করতো। যেহেতু তৎকালে বিষুবমিলন তত্ব অনুসারে ঈশ্বর কৃষ্ণনামে উপাসিত হতেন, তাই ঝুলনযাত্রার দেবতা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু শুধু কৃষ্ণ, রাধা নয় কারণ রাধা ছিলেন পূর্বকল্পের দেবতা এবং প্রায় ১৬, ০০০ বৎসর পূর্বের উপাস্য। বেদবিভাগ কর্তা ঋষি দ্বৈপায়ন বা বেদব্যাসের যুগে পূর্বকল্পের দেবতা উপাসনার ভ্রান্তি স্বীকৃত হতোনা। এমনকী তিনি মহাভারতে পূর্বতন দেবতা রামকেও বলরাম নাম দিয়ে গুরুত্বহীন হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।

রাধাকে যে কৃষ্ণের প্রেমিকারূপে বর্ণনা, এটির উৎস আধুনিক যুগে জয়দেব বিরচিত বৈষ্ণব কাব্য এবং চৈতন্য পরবর্তী যুগে চৈতন্য ভাগবত। এই বৈষ্ণবকাব্যগুলিতে রাধাকৃষ্ণকে প্রেমিক-প্রেমিকারূপে বর্ণনা করে রাধাকৃষ্ণের অশালীন ও আদিরসাত্মক প্রেমলীলার কাহিনী সৃষ্টি হয়েছিল। এক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের মূল প্রতীক ত্রিভঙ্গরুপের সাথে সংযোজন করা হল; ১৬, ৫০০ বৎসর পূর্বে উপাসিত ‘হরে’ দেবতার মুরলী হয়ে গেল একই সাথে বংশীধারী – ত্রিভঙ্গমুরারী রাধাপ্রেমিক শ্রীকৃষ্ণ। প্রণয় ও লাম্পট্য প্রকাশের রূপটি পূর্ণতা পেল। পুরাণকাররা  তাঁদের কদর্যরুচির পরিচয় দিয়ে লিখলেন মাতুলানী রাধার সাথে ত্রিভঙ্গ শ্যামের অবৈধ সম্পর্কের কথা। বলাবাহুল্য, এই অশালীন সম্পর্কের কাহিনী হিন্দুজাতিকে অন্য ধর্মের মানুষের কাছে মাথা নত করে দিয়েছে।  বাস্তবে কিন্তু কৃষ্ণ কোন জন্মগ্রহণকারী মানুষ নন।

কৃষ্ণনামের প্রবক্তা ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন তাঁর রচিত মহাভারতে কোথাও কৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত বা বৃন্দাবনলীলা লিপিবদ্ধ করেননি। মহাভারত লেখাই হয়েছিল ঈশ্বরের তৎকালীন কৃষ্ণনাম প্রচারের জন্য। পরবর্তীকালে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য শ্রীমদ্ভগবদগীতাতে ৭/২৪ ও ৭/২৫ নম্বর শ্লোকে স্পষ্টভাষায় বলা হল –

“অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ ।

পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্ ॥”

নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ ।

মূঢ়োহয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্ ॥

অর্থাৎ বুদ্ধিহীন ব্যক্তিগণ আমার সর্বোৎকৃষ্ট অবিনাশী পরমভাব না জেনে মন ও ইন্দ্রিয়ের অতীত পরমাত্মাস্বরূপ আমাকে সাধারণ মনুষ্যের ন্যায় ব্যক্তিভাবসম্পন্ন বলে মনে করে। নিজ যোগমায়ার দ্বারা আবৃত বলে আমি সকলের নিকট প্রকাশিত হইনা।  তাই এইসব মূঢ় ব্যক্তিগণ আমার জন্মরহিত অবিনাশী ঈশ্বরস্বরূপ জানতে পারেনা অর্থাৎ আমাকে জন্ম-মরণশীল মনে করে।

প্রসঙ্গক্রমে জানাই, গীতা স্বয়ং ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত উক্তি বলে যে ধারণা জনমানসে প্রতিষ্ঠিত তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ গীতা যে মহাভারত পরবর্তী যুগে সৃষ্ট উপনিষদের জ্ঞানের আধারে লিখিত এবং গীতার সপ্তম ও নবম অধ্যায়ে বেদসংহিতার পরম সত্য বিশিষ্ট অদ্বৈত তত্ব প্রকাশিত; তা প্রায় সমস্ত বেদ গবেষক স্বীকার করেছেন।

যাই হোক, বংশীধারী কৃষ্ণ সত্য না হলেও ত্রিভঙ্গ কৃষ্ণ সত্য এবং ৩, ০০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ২, ৪৪৮ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত তাঁর উপাসনার যুগটিও সত্য। সেই কারণেই তৎকালে যুগদেবতা কৃষ্ণকে দক্ষিণায়ন যাত্রা উৎসবের দেবতা রূপে ঝুলনযাত্রা উৎসবে উপাসনা করা হয়েছিল। ঐ যুগে শ্রাবণপূর্ণিমা তিথিতে দক্ষিণায়ন যাত্রা সংগঠিত হতো।

কিন্তু যেহেতু হিন্দুধর্মের অধিকাংশ পার্বণ জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্র নির্ভর, তাই সূর্যের অয়নচলন ও বিষুবমিলন তত্ব অনুসারে দিনটি প্রতি ৭২ বৎসরে একদিন করে এগিয়ে আসে। সেই হিসাবেই চৈতন্যদেবের সময়ে (১৫১২ খ্রী:) দক্ষিণায়নের দিনটি ছিল আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়াতে এবং চৈতন্যদেব প্রয়োজনীয় সংশোধন করে দক্ষিণায়ন দিবসকে ঝুলনযাত্রার পরিবর্তে আষাঢ়মাসের শুক্লা দ্বিতীয়াতে জগন্নাথের রথযাত্রা নামে উদযাপন করেন। গত ৫০০ বছরে আর ৭ দিন এগিয়ে বর্তমানে দক্ষিণায়ন যাত্রার দিনটি হল ২১ শে জুন। কিন্তু তারপর আর সংশোধন করা হয়নি। দক্ষিণায়ন যাত্রার দিনটির সংশোধন বর্তমানে হওয়া একান্ত আবশ্যক।

এবার আসি রক্ষাবন্ধন পার্বণ প্রসঙ্গে। রক্ষাবন্ধন আদপে ভাইবোনের কোন অনুষ্ঠান নয়।  এমনকী শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে দুই বঙ্গকে এক রাখার শপথ নিয়ে রাখী পড়িয়েছিলেন, এর সাথেও রক্ষাবন্ধন উৎসবটি সম্পর্কহীন। বাস্তবে রক্ষাবন্ধন শুরু হয়েছিল দক্ষিণায়ন যাত্রাকে অবলম্বন করে। জ্যোতিঃশাস্ত্রমতে দক্ষিণায়নের সময়কে প্রাচীন কাল থেকেই অশুভ মনে করা হতো। দক্ষিণায়ন কালটির মধ্যে বর্ষা, শীত প্রভৃতি কষ্টকর সময়কে অতিবাহিত করতে গিয়ে অনেকেই প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যুবরণ করতেন। দক্ষিণায়নে মৃত্যু স্বর্গলাভের পক্ষে অন্তরায় বলেও বিভিন্ন গ্রন্থে ঋষিরা লিখে গেছেন। মহাভারতে দেখা যায় পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত থেকে উত্তরায়ণ আসা পর্যন্ত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। তাই দক্ষিণায়ন কালে মৃত্যুকে এড়াতে ঋষিরা দক্ষিণায়ন শুরুর দিনটিতে প্রাণরক্ষার জন্য রক্ষাসূত্র পড়িয়ে রক্ষাবন্ধন প্রচলন করেছিলেন। এখন যে দিনে রক্ষাবন্ধন হয়ে থাকে, এটি সম্পূর্ণ ভুল। রক্ষাবন্ধনের দিন বর্তমানে ২১ শে জুন এবং এর সাথে ভাইবোনের কোন ভূমিকা নেই।