ভাষার সংকোচন: জাতির নৈতিক অধঃপতনের একটি মূল্যবান সূচক

0
790

বহুদিন হ’ল লোকে বাংলা ভাষার অফুরন্ত শব্দরাজির ব্যবহার করা একরকম ছেড়েই দিয়েছে। আজকাল স্রেফ দুচারটে বাঁধাধরা কথার মধ্যেই কথ্য এবং সাহিত্যের ভাষা (এমনকী গানেরও) ঘোরাঘুরি করে। এর সবচাইতে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে: “আশা করি কিছু মনে করবেন না!” পরিচিতেরা তো বটেই, এমনকী অপরিচিত লোকেও আজকাল উদ্ভট প্রস্তাব রাখতে গিয়ে কিংবা খুব ব্যক্তিগত কিছু জিজ্ঞেস করবার আগে এই বাঁধা বুলিটি সতর্কীকরণ জারি করবার মতো ক’রে একবারটি আওড়ে নেয়। বলি, আশা করবেন কোন ভরসায়? আপনি মশায় আদৌ কতটা চেনেন-জানেন আমায় বলুন দেখি? এত আশা করেনই বা কেন — যত বেশি আশা করবেন আশাভঙ্গের সম্ভাবনাও যে ততটাই বেড়ে যাবে — এই সহজ হিসেবটুকুও কি বোঝেন না! তার চেয়ে একটু সেকেলে শোনানোর ঝুঁকি নিয়ে একবার বলেই দেখুন না — “দয়া ক’রে কিছু মনে করবেন না” অথবা আরো বিনম্র শোনাবে যদি বলেন “দয়া করে অপরাধ নেবেন না”; “দয়া ক’রে” বলতে যদি অহংবোধে বেধে যায় তাহলে শুধু “যদি অপরাধ না নেন” কিংবা “যদি অভয় দেন তো বলি”; অথবা স্রেফ “যদি কিছু মনে না করেন” ইত্যাদি। “অনুগ্রহ ক’রে আমায় যদি একবারটি দেখা দেন/দাও” বললে আকুতি এবং নম্রতা দুটোই কী পরিষ্কার ফুটে ওঠে — যার উদ্দেশ্যে বলা তার পক্ষেও অনুরোধ ফেরানো ভারী মুশকিল হয়ে পড়ে। ওই কথাগুলি শুনতে যেমন মিষ্টি, তেমনি অর্থবহ এবং বিনয়ের পরাকাষ্ঠাও বটে। বরং এই শব্দবন্ধগুলি ব্যবহার না ক’রে ক’রেই এদেরকে বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে — আর আপামর পোলাপান জনসাধারণকে ছেলেভুলানোর মতো ক’রে একেবারে ইস্কুলস্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ইস্তক শেখানো হয়ে আসছে যে “এসব খুব সেকেলে শোনায়।” অথচ এগুলি এই সেদিনও, মানে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়েও লেখা বা বলায় ঢালাও ব্যবহৃত হ’ত, অর্থাৎ খুব বেশিদিনের কথা নয়। আসল কথাটি হ’ল: বিগত কয়েক দশকে বাঙালি কথ্য অথবা লেখ্য যোগাযোগের প্রয়োজনে নিজের ভাষাটি এত কম ব্যবহার করেছে যে মাতৃভাষার শব্দভান্ডারটি বাড়াবার কাজেও চরম অবহেলা হয়েছে — সোজা কথায় বলতে গেলে, বাঙালি তার ভাষাটিকে দুর্বল এবং ভোঁতা ক’রে ফেলেছে নিজেরই আলস্যের কারণে। বাংলা ভাষা তার শ্রী আর সৌকর্য হারিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই যা হবার তা হয়েছে — বিগত কয়েক দশকে দুনিয়াজোড়া অভিবাদন পাবার মতো, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করবার মতো সাহিত্য বাংলায় লেখা হয়নি। একজনও অরহান পামুক কি গার্সিয়া মার্কেজ — এমনকি নিদেনপক্ষে একপিস ড্যান ব্রাউন বা রাউলিং-ও বেরোয়নি বাংলা সাহিত্যের সস্তা বাজার থেকে।

আরেকটি কঠিন সত্যও এই ক্ষণে স্বীকার ক’রে নেয়া শ্রেয়, সেটি হচ্ছে যে ‘দয়া ক’রে/অনুগ্রহ ক’রে’ জাতীয় কথাগুলি বলবার মত শ্রদ্ধা আর বিনয় বাঙালি আজ হারিয়েছে। যা ছিল তার জাতিগত-মজ্জাগত-স্বভাবজ অলংকার, যে যে গুণাবলীর কারণে ভূভারতে তার সুখ্যাতি ছিল, তা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাতিল অকেজো সরঞ্জামের মতো। (এপ্রসঙ্গে নচিকেতার গান মনে প’ড়ে গেল। নচিকেতার গান আমার মোটেই রোচে না, তবে লোকটা নিজের গানের কথায় অত্যাধুনিক বঙ্গজীবনের কিছু নির্ভেজাল সত্যি কথা ধ’রে রেখেছে। তাই লোকে তার গান শুনে এত আকৃষ্ট হয় — তাদের মনে হয় দাড়িওলা সাধারণ চেহারার যুবকটি ঠিক যেন মনের কথাখান গেয়ে উঠল!) বিনয়, যা ফলভারে অবনত বৃক্ষের মতো সুভদ্র গুণীজনকে বিনয়াবনত ক’রে রাখে ব’লে কথিত আছে, সেই গুণটিকে — এবং ভারতীয় সমাজচরিত্রে যা বরাবর অতুলনীয় দৃঢ়তা ও বিশিষ্টতা প্রদান ক’রে এসেছে সেই শ্রদ্ধাকে — বিসর্জন দিয়ে বাঙালি কি ঘোষণা করল? না, একটি পাঁড় মাতাল চলচ্চিত্র পরিচালকের খামখেয়ালি এবং অনেক ক্ষেত্রেই অভব্য আচরণের উদাহরণগুলিকে রাজার সিংহাসনে বসিয়ে সে শ্রদ্ধা এবং বিনয়কে ভুলতে চায়, নিদেনপক্ষে বিনয়কে স্পর্ধা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায়। অভব্যতা আর বোহেমিয়ান খামখেয়ালিপনার উশৃঙ্খলতাকে রোম্যান্টিক ও শ্রেষ্ঠ প্রতিভার নির্ভুল লক্ষণ হিসেবে মগডালে তুলে ধ’রে গেছো বাঙালি সদর্পে (এবং যথার্থই মূর্খের মতো) বাংলা কাব্যকে ঢাল ক’রে ব’লে উঠেছে: “তুমি গেছো, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে”! যেন বিনয় তার আগে এ পোড়াবঙ্গদেশে ছিল না! যেন বিনয় গেলে সে অপূরণীয় ক্ষতিপূরণ সব ব্যাপারে স্পর্ধা দেখিয়ে সমাধান করা যায়! শেষে কবিতার আড়ালে লুকিয়ে থেকে আজকাল আমাদের স্পর্ধা/বিনয়ের জন্য কুমীরের কান্না কাঁদতে হচ্ছে — আর সে কান্নাকে আমরা শ্রেষ্ঠ কাব্য ব’লে চালাচ্ছি। কোনো কিছু তলিয়ে দেখবার ইচ্ছা আর উদ্যম আমাদের বাঙালিদের মধ্যে অনুপস্থিত। সেই অনুপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে হাজারটা চুটকুলা খাওয়াচ্ছি, আর তার বদলে আবোল-তাবোল স্বপ্ন বেচছি। এ হ’ল নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে, বেচে দিয়ে তার বদলে নীতিহীনতাকে সাড়ম্বরে ডেকে আনবার উত্তর-আধুনিক রোগ। মরবার আগে প্রায় সব জাতির দেহে-মনেই এই অবক্ষয়ের, এই অধঃপতনের লক্ষণ ফুটে ওঠে। সেক্ষেত্রে সেই লক্ষণগুলোকে মাথায় তুলে নাচানাচি করবো, না চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হবার চেষ্টা করবো সে সিদ্ধান্তটাই ঠিক করে দেবে রোগী আদৌ বাঁচবে কি না।