আবার লকডাউন: ঝড়ের পূর্বাভাস নয় তো?

পশ্চিমবঙ্গে আবার পুরোপুরি লকডাউন চালু হচ্ছে। কোভিড-19 পরিস্থিতি মোকাবিলাই ঘোষিত কারণ। কিন্তু মন কু গাইছে। কারণ দুই খান কথা আসে।

এক, লকডাউন শিথিল হওয়ার কারণে ত্রাণ বণ্টনে তৃণমূলের একচেটিয়া আধিপত্য ও প্রচারে বাকি রাজনৈতিক দলগুলো ভাগ বসাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক দোসর সিপিএম ও প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপিও সাহায্য করে মানুষের কাছে আসার সুযোগ পাচ্ছিল। এই সুযোগে তাদের আবার প্রশাসনিক বলে তাদের ময়দান থেকে কোটরে ফেরানো যাবে। সামনে ২০২১; মানে বিধানসভা নির্বাচন। তাই যেকোনও অজুহাতের সদ্ব্যবহার হবে।

দুই, সমান্তরালভাবে সাম্প্রদায়িক জনানুপাত উল্টে দেওয়ার চেষ্টাও কিন্তু থেমে নেই। এই লকডাউন আসলে যারা নিয়ম মানবে না তাদের দ্বারা যারা নির্দেশ মানবে তাদেরকে নিয়মে বেঁধে মারার চাল নয়তো? সোজা কথায় তথাকথিত সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগুরু করে তোলার পরিকল্পনা নয় তো?

গত সাড়ে তিন মাসে এত কিছু বন্ধ-ছন্দের মধ্যেও হিন্দু মেয়ে অপহরণ, প্রেম জেহাদ ও ধর্মান্তরণের ব্যপকতা, রেশন দুর্নীতি, কিছু মানুষকে ন্যূনতম ক্ষুন্নিবৃত্তিও করতে না দিয়ে গোষ্ঠীবিশেষকে পদাঘাত হজম করেও মাত্রাতিরিক্ত সাহায্য, পুলিসের বেছে বেছে কোথাও নিষ্ক্রিয়তা ও কোথাও অতি সক্রিয়তা ইত্যাদি কিন্তু এমনটাই বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রথম দফার লকডাউনের গতিপ্রকৃতি দেখে এই জাতীয় আশঙ্কা আমি অনেক আগেই করেছিলাম। দেখলাম যতটা ভেবেছিলাম, দ্বিতীয় দফা থেকে অরাজকতা তার চেয়ে খানিক বেশিই হয়েছে। তাই মনে হচ্ছে, এমন নয় তো, কিছু মানুষ বড়সড় প্রস্তুতি নিয়ে ময়দানে নামতে চলেছে? কারণ কোভিড হাউজ়িং সোসাইটির আবাসিক, স্ট্যান্ড অ্যালোন ফ্ল্যাটবাসী ও পাকা বাড়ির বাসিন্দাদের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যায় হচ্ছে, যেখানে ঘিঞ্জি এলাকায় পরিসংখ্যান তাৎপর্যপূর্ণ নয় — এই ঘোষণাটি ‘সততার প্রতীক’ নয়, কেমন যেন সন্দেহজনক লাগছে। উপরন্তু একটি খবর সেই সন্দেহকে প্রত্যয়ের রূপ দিচ্ছে।

নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলায় অরক্ষিত জমিতে পা পড়ছে বাংলাদেশীদের। স্থানীয় কৃষিজীবী মানুষের অভিযোগ, বিএসএফের বাধায় ওই বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষ করতে যাওয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেই সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ থেকে অনুপ্রবেশকারীরা প্রায় বিনা বাধায় জমি দখল করে চলেছে । কোথাও সশব্দে কোথাও বা নিশ্চুপে, দখলদারি চলেইছে।

গত বর্ষায় পদ্মার ভাঙনে সীমান্ত থেকে সরে এসেছিল বিএসএফ । নদী ফের খাত বদলে সরে গেলেও বিএসএফের ক্যাম্প সরেনি । ফলে সীমান্তে কয়েক হাজার একর প্রায় জমি অরক্ষিত। তাই নিয়ে পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক মুর্শিদাবাদের ডোমকল মহকুমার সীমান্ত জুড়ে। স্থানীয় কৃষিজীবীদের অভিযোগ, বিএসএফের বাধায় ওই বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষাবাদের জন্য তারা যেতে পারছে না। নিজের দেশের সীমান্তরক্ষীদের কারণেই ভারতীয় চাষীদের ওইসব জমিতে চাষাবাদ লাটে উঠেছে । অনেক সময়ে মাঠ থেকে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখার অভিযোগও মিলেছে । সীমান্তে রানীনগর ১ এবং ২ ব্লক ও জলঙ্গী জুড়ে প্রায় ২২ হাজার একর জমি টহলদারির অভাবে অরক্ষিত। সেই সুযোগে বাংলাদেশীরা ভারতীয় আবাদি জমি বেদখল করে ঐ সমস্ত জমি বাংলাদেশের বলে দাবি করছে সে দেশের সীমান্তবর্তী গ্রামবাসীরা। গত কয়েক মাসে ওইসব এলাকায় মৎস্যজীবীদের পদ্মায় মাছ ধরাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলেও অভিযোগ।

বিএসএফ অবশ্য মানতে চাইছে না। বহরমপুর রেঞ্জের ডিআইজি কুণাল মজুমদার দাবি, ‘‘ওই এলাকায় নদী-নালার জন্য বর্ষাকালে একটা বড় সমস্যা তৈরি হয় ঠিকই তবে টহল চলছে। শুখা মরসুমে একেবারে সীমান্ত ঘেঁষে আমাদের জওয়ানেরা টহল দিয়ে থাকেন । তবে জল বাড়লে তা কিছুটা সমস্যা হয়।’’ ওই এলাকার সীমান্ত জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় বাংলাদেশীরা অনায়াসে চর উজিয়ে একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা ভারতীয় গ্রামগুলিতে ঢুকে পড়েছে। দিন কয়েক আগে দু’জন বাংলাদেশী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় এলাকায় চলে আসায় তাদের আটক করেছিল বিএসএফ । ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে মুক্তিপণ হিসেবে রানিনগর সীমান্তের গ্রাম থেকে দুই গ্রামবাসীকে তুলে নিয়ে যায় বাংলাদেশী দুষ্কৃতীরা । রানীনগরের বাসিন্দা মুজিবর রহমানের দাবি, ‘‘কেবল চাষের মাঠ নয়, পদ্মায় মাছ ধরাও বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। মেছো নৌকার উপরে রীতিমত দাদাগিরি শুরু করেছে বিজিবি (বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ)।’’ জলঙ্গীর ইরফান আলির বক্তব্য, ‘‘বিজিবি সব সময়ে বাংলাদেশি গ্রামবাসীদের পাশে থাকে। ঠিক উল্টো ব্যবহারটা করে বিএসএফ, আমরাই যেন অনুপ্রবেশকারী!’’। রানিনগর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের শাহ আলম সরকারের মতে, রানীনগর ২ ব্লকের ১৭ কিমি এলাকা জুড়ে ৯,৬৫৪ একর জমি অরক্ষিত পড়ে আছে সীমান্ত এলাকায়। তিনি জানান, ‘‘বিএসএফের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে দফায় দফায় বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনায় বসেছি। আমরা আবেদন জানিয়েছি, সীমান্তের শেষ সীমানায় বিএসএফে যেন টহল দেয়, না হলে এই অনুপ্রবেশ ক্রমশ বাড়বে।’’

এই ইরফান, মুজিবররা নিজেরাই অনুপ্রবিষ্ট কিনা জোর দিয়ে বলা যায় না। অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশীদের এ রাজ্যে স্বাগত জানানোর মতো লোকের তো অভাব নেই। তার ওপর সীমা সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীও যদি টহলদারি শিথিল করে বিনাযুদ্ধে দেশের জমি শত্রুদেশকে অধিকার করতে দেয়, তাহলে তো আশঙ্কা বাড়বেই।  পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলোর যা জনবিন্যাস, তাতে সেখানকার অধিকাংশ গ্রামবাসীরা নিজেরাই বাংলাদেশের আগ্রাসনকে সাহায্য করে বিএসএফের ঘাড়ে দোষ চাপালেও আশ্চর্য কিছু নেই।

তবে দায় যারই হোক, এ রাজ্যে জঙ্গি সম্প্রদায়টি যে গোলমাল পাকানোর মতো যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছে, তা নিশ্চিত। উদ্ভূত করোনা পরিস্থিতিকে সামনে রেখে রাজ্য সরকারের হঠাৎ লকডাউন নিয়ে কড়াকড়ি এবং ঘিঞ্জি এলাকাগুলোয় সংক্রমণ কম ঘোষণা – এই ঘোষণা মনে হচ্ছে সেই সঞ্চিত শক্তিকে মদত দেওয়ারই পরিকল্পনা। তবলিগী জামাতিদের অসভ্যতা, চন্দননগরের কাছে তেলেনিপাড়ার দাঙ্গা ইত্যাদি নিয়ে হৈচৈ থেমে যাওয়ার পর নিঃশব্দে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে হিন্দু মেয়েদের দখল করার কাজটা অব্যাহত থাকলেও কোনও বড়সড় গোলমালের খবর আসেনি। এই নিস্তব্ধতা ঝড়ের পূর্বাভাস নয় তো?

প্রতিবেদনটির সব বক্তব্যের দায়িত্ব লেখিকার, বঙ্গদেশ পত্রিকা এর কোনোরকম দায়ভার গ্রহণ করে না।