রেজাংলায় চীন-ভারত যুদ্ধে মেজর শয়তান সিংহের বীরগাথা

১২৩ জন ভারতীয় সৈনিক ৩০০০ উন্নত মানের অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ চীনা সৈনিককে বিধ্বস্ত করে

0
1310

 

— মেজর গৌরব আর্য

রেজাংলার যুদ্ধে ১২৩ জন ভারতীয় সৈনিক ৩০০০ উন্নত মানের অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ চীনা সৈনিকের সাথে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়েছিল। ভারতের ইতিহাসে এরকম শৌর্যের কাহিনী আর কখনও তৈরী হয়নি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের কাছে প্রায় অজানাই রয়ে গেছে রেজাংলার সেই রাতের কথা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাইরে রেজাংলার এই অসাধারণ লড়াইয়ের কথা এতদিন পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি। নিঃসন্দেহে আমাদের কাছে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়।

রেজাংলার সেই রাতে ১৩, কুমায়ুন ব্রিগেডের ১২৩ জন সৈনিক মেজর শয়তান সিংহের নেতৃত্বে প্রায় ৩০০০ চীনা সৈনিককে প্রায় হারিয়েই দিচ্ছিল। কিন্তু শীতে ফ্রস্ট বাইট, অনাহারজনিত কারণে ক্লান্তি ও সংখ্যা কম থাকার কারণে সাফল্য পায় নি। কিন্তু তাদের শৌর্যের কাহিনী আজও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে কিংবদন্তির মর্যাদা পায়।

লাদাখের যুদ্ধ, ১৯৬২

অক্টোবর ১৯৬২ পর্যন্ত লাদাখের দৌলত ওল্ডি বেগ অঞ্চল ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনেই ছিল। কিন্তু নভেম্ব্রের শুরুতেই অস্ত্রশস্ত্র ও উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী চীনা সেনাবাহিনী কারাকোরাম রেঞ্জ হয়ে ড্যামচোক পেরিয়ে লাদাখে ঢুকে পড়ে। এরপরেই তারা চুশুল পোষ্ট দখল করে নিলো। চুশুলের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল ১১৪ ব্রিগেডের হাতে। অর্থাৎ একটা ব্যাটেলিয়নের চেয়েও কম। সাধারণত একটা ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডে ৩ ব্যাটেলিয়ন থাকে। ১১৪ ব্রিগেডে ছিল ১/৮ গোর্খা রাইফেল আর ৫ জাঠ রেজিমেন্ট। যখন চুশুলের বিপদটা টের পাওয়া গেল, তখন ১৩ কুমায়ুন বারামুল্লা থেকে ১১৪ ব্রিগেডকে সাহায্য করতে দৌড়ল।

১৩ কুমায়ুন ব্রিগেডের অন্যান্য কোম্পানি গান হিল, গুরুং হিল ও মাগার হিল দখল করে নিয়েছিল। এরপর মেজর শয়তান সিংহের নেতৃত্বাধীনে চার্লি কোম্পানি চুশুল থেকে ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত রেজাং লা গিরিপথে এসে গেল। রেজাংলার অস্বাভাবিক শীতল আবহাওয়া, উচ্চতার সাথে চার্লি কোম্পানি একেবারেই পরিচিত ছিল না। তার ওপর সেখানকার রাস্তা আর পারিপার্শ্বিক অবস্থাও তেমন সুবিধার ছিল না। সমুদ্রতল থেকে ১৬,৪০৪ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত রেজাংলায় যুদ্ধ করা সত্যিই খুব কঠিন ছিল। শয়তান সিংহের নেতৃত্বে চলা চার্লি কোম্পানির অধীনে ছিল সপ্তম, অষ্টম ও নবম প্ল্যাটুন সেনা। রেজাংলার ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই বাকি ব্যাটেলিয়ন থেকে চার্লি কোম্পানি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

ভাল শীতকালীন বস্ত্র ছিল না, অস্ত্রও ছিল না, রসদও ছিল না

একে তো নভেম্বরের প্রবল ঠাণ্ডা, তার ওপর তুষারপাত হচ্ছিল। এতে চার্লি কোম্পানির খুব সমস্যা হচ্ছিল। কেননা তাদের কাছে ঐ ঠাণ্ডার উপযোগী গরম বস্ত্র বা বর্ম কিছুই ছিল না। এই কারণে যুদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল। এর ওপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক অদ্ভুত নিয়ম তাদের সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আর সেটা হল ‘ক্রেস্টেড টু আর্টিলারি’। অর্থাৎ ভারতীয় আর্মির গোলন্দাজ বাহিনী যখন গোলাবর্ষণ করবে, তা থেকে বাঁচতে হলে যে বর্ম পড়া দরকার, সেটা চার্লি কোম্পানিকে পড়তে দেওয়া হত না। তবে ১৯৬২ সালের বিপর্যয়ের পর সে নিয়ম পাল্টে দেওয়া হয়েছে।

একে তো নিরাপত্তার বালাই ছিল না, তার ওপর ভারতের গোলন্দাজ বাহিনী তাদের সেভাবে সাহায্য করেনি — সব মিলিয়ে চার্লি কোম্পানির অবস্থা বেশ খারাপ ছিল।

ঠিক এই সময়েই চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি চুশুল আক্রমণ করে বসল, যেখানে সপ্তম ও অষ্টম প্ল্যাটুন মোতায়েন করা ছিল।

ভোর পাঁচটা নাগাদ চার্লি কোম্পানি রাইফেল, মেশিন গান ও মর্টার খুলে চীনাদের পালটা আক্রমণ করে বসল। এই পাল্টা আক্রমণ এতটাই অপ্রত্যাশিত হল যে, অন্তত তিনশ জন চীনা সৈনিক মারা গেলেন। পিএলএ’র প্রথম আক্রমণ এভাবেই মাঠে মারা গেল।

সকাল পাঁচটা চল্লিশ নাগাদ পিএলএ চার্লি কোম্পানিকে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে বসল। অন্তত ৩৫০ জন চীনা সৈনিক নবম প্ল্যাটুনকে আক্রমণ করল। এতে হাল না ছেড়ে নবম প্ল্যাটুন আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগল। যখন পিএলএ বাহিনী মাত্র ৯০ মিটার দূরে এসে পড়ল, তখনই নবম প্ল্যাটুন সবরকম অস্ত্রই ব্যবহার করতে শুরু করল। পিএলএ ভাবতেও পারেনি এভাবে অত্যল্প সৈনিক নিয়ে চার্লি কোম্পানি তাদের পাল্টা মার দিতে পারে। এই ঘটনায় আরও তিনশ পিএলএ সৈনিক মারা পড়ল। এইভাবে দ্বিতীয় বার আক্রমণও মাঠে মারা গেল।

 

অস্ত্র ফুরিয়ে গেল, তারা হাতাহাতি শুরু করে দিল

সপ্তম ও অষ্টম প্ল্যাটুনের প্রতিটি সৈন্য়ই মৃত্য়ুবরণ করে। সেখানে একজনও বেঁচে ছিল না। নবম প্ল্যাটুনের অবস্থাও ভাল ছিল না। তাদের কাছে গুলিগোলা অবশিষ্ট ছিল না। বাধ্য হয়েই তারা ছুরি লাগানো বন্দুক দিয়ে সম্মুখ সমরে যায়। কিন্তু সেটাও ভেঙ্গে পড়ে। তাতেও মনোবল না হারিয়ে সৈনিকরা অতঃপর খালি হাতেই হাতাহাতি শুরু করে। নায়েক রাম সিংহ নেশায় ছিলেন কুস্তিগীর, তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবার আগে কয়েকজন চীনা সৈনিককে আছাড় মেরে খুন করেন। তার দৈহিক বল দেখে পিএলএ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

মেজর শয়তান সিংহ প্ল্যাটুন থেকে প্ল্যাটুনে পালা করে সরে গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এইভাবে যুদ্ধ চালাতে চালাতে এক সময়ে এমএমজি গোলার আঘাতে গুরুতর আহত হন। এই সময়ে তিনি সাথে থাকা দুই সৈনিককে বাঁচানোর জন্য় তাদের অস্ত্র নিয়ে চুপি চুপি পালাতে আদেশ দিয়ে আহত অবস্থাতেও চীনের সাথে যুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁর সাহস দেখে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল।

 

তারা পিএলএর সাতটি আক্রমণকে প্রতিহত করেছিল

পুরো চার্লি কোম্পানি চীনাদের তরফে টানা সাতটি আক্রমণকে প্রতিহত করেছিল। এই করতে গিয়ে পুরো ১৩ কুমায়ুন ব্রিগেড খতম হয়ে যায়।

২১ নভেম্বর ১৯৬২ সালে চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষ বিরাম ঘটে।

যখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান রেজাংলায় পরিদর্শন করতে এসেছিলেন, তখন দেখেন পুরো চার্লি কোম্পানি ধ্বংস হয়ে গেছে। মেজর শয়তান সিংহ বন্দুক হাতে রেখেই মারা গিয়েছিলেন। তার পাশে একজন সৈনিকও বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছিল। সে মেজর শয়তান সিংহের শুশ্রূষা করতে ব্যস্ত ছিল, তাঁকে সিরিঞ্জে করে টেটভ্যাক ইঞ্জেকশন দিচ্ছিল, যাতে গ্যাংরিন না হয়। তার হাতে তখনও সিরিঞ্জ ধরা ছিল। মর্টার সেকশন কম্যান্ডার হাতে একটা মর্টার ধরা অবস্থায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। কম্যান্ডার গোলাবর্ষণ করতে করতেই মারা গিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় ৭ মর্টার থেকে সব মিলিয়ে ১০০০ রাউন্ড গোলা ছোঁড়া হয়েছিল।

১২৩ জন সৈনিকের মধ্যে ১১৪ জন সৈনিকই মারা যায়। বাকী নয় জনের মধ্যে ছয়জন যুদ্ধবন্দী হিসাবে ধরা পড়ে। পরে ছয়জনই রহস্যময় পন্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

এই প্রকার অবিশ্বাস্য সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য স্বাভাবিক ভাবেই মেজর শয়তান সিংহ মরণোত্তর পরমবীর চক্র পান, যেটাকে দেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান হিসাবে গণ্য হয়। পুরো চার্লি কোম্পানি ৮টি বীর চক্র ও ৪টি সেনা পদক পেয়েছিল তাদের অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শনের কারণে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর চার্লি কোম্পানির নাম পাল্টে রাখা হয় রেজাংলা কোম্পানি।

আমি নিজেও কুমায়ুন রেজিমেন্টের সদস্য এবং আমি নিজে বহুবার রেজাং লা গিরিপথের ঐ জায়গায় গিয়েছি। এত বছর বাদেও আমি অবাক হই মেজর শয়তান সিংহের কথা ভাবলেই। তিনি ঐ রকম বীরত্বের অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছিলেন? আধুনিক সমরবিদ্যায় এমন বীরত্ব মোটামুটি অভাবনীয় বলা যেতে পারে।

আমি আজও জানতে পারিনি ভারত সরকারের কাছে রেজাংলার কোনও রণনীতিগত মাহাত্ম্য আছে কি না। কিন্তু এটুকু বলতেই পারি, নভেম্বর ১৯৬২ সালের ঐ ভয়ংকর রাতের পর রেজাংলা যুদ্ধক্ষেত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্রের সমান হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যেক নবীন সদস্য সেখানে যায়, বীরগতি প্রাপ্ত সৈনিকের সমাধিস্থল দেখে, তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে আসে। রেজাংলা এখন শুধু ‘জাতীয় সম্মানের জায়গা’ই নয়, সাথে এটা একটা ‘কিছু করে দেখানোর’ অনুপ্রেরণার জায়গাও বটে।

 

নাম ও নমক, নিশান

হরিয়ানার ১২২ জন আহির জাতের লোক রেজাংলার ঐ ভয়ঙ্কর রাতে প্রায় -৩০ ডিগ্রি ঠাণ্ডার মধ্যেই লড়েছিল যোধপুরের আদি বাসিন্দা মেজর শয়তান সিংহের নেতৃত্বে। অমানবিক ঠাণ্ডা, অত্যন্ত খারাপ গরম বস্ত্র (উলের সোয়েটার পর্যন্ত এদের জন্য বরাদ্দ ছিল না!), আরও খারাপ ক্যানভাস জুতো (যা পাহাড়ি জায়গার পক্ষে অনুপযুক্ত), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ভিন্টেজ ৩০৩ দিয়েই তারা কয়েক ঘণ্টা ধরে চীনের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র, অনেক উন্নত সামরিক উর্দি ও বর্মে আবৃত পিএলএ সৈনিকের বিরুদ্ধে লড়ে গেছে। ভাবলেও বিস্ময় জাগে বৈকি। প্রগাঢ় দেশপ্রেম ছাড়া এই জিনিষ সম্ভব নয়।

যখন গুলি ফুরিয়ে যায়, তারা বেওনেট দিয়েই লড়তে থাকে। যখন বেওনেট ভেঙ্গে যায়, তারা খালি হাতেই চীনাদের মারতে শুরু করে। হরিয়ানার ঐ ১২২ আহির যুবকরা রেজাংলার আগে সম্ভবত কোনও দিন হিমালয় দেখে নি, তারা এর আগে তুষারপাত কাকে বলে তাও বোধ হয় জানত না। সর্বোপরি, ঐ ঠাণ্ডার মধ্যে পাতলা শীতবস্ত্র নিয়ে লড়াই করাটা ছিল একটা অসম্ভব কাজ। তারপরেও তারা দেখিয়ে দিয়েছে ইচ্ছাশক্তি থাকলে সব কিছুই সম্ভব।

এই ১২২ জন সৈনিক ৩০০০ পিএলএ সৈনিকের বিরুদ্ধে লড়ে প্রায় ১৩০০ চীনাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল। ভাবলে রোমাঞ্চ জাগে বৈকি।

সেখানে রেজাং লাতে একটা স্মৃতিসৌধ গড়া হয়েছে, যা কিনা উক্ত ১১৪ সৈনিকের স্মরণে গড়া হয়েছিল। সেখানে লেখা আছে —

“কীভাবে একজন পুরুষ মারা যেতে পারে?

যেখানে সামনে ভয়ংকর শত্রু তার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে

সেখানে তার জন্য পিতার চিতাভষ্ম অপেক্ষা করে থাকে

আর তার জন্য দেবতারা অপেক্ষা করে থাকে।”

১৩ ব্যাটেলিয়ন, কুমায়ুন রেজিমেন্টের দ্বারা এই স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে।