মোদিজীর বিদেশনীতিতে নেতাজীর লিগাসি

0
932

২০২১ সাল ভারতমাতার অনন্য সন্তান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫ জন্মবার্ষিকী উদযাপনের বছর। নেতাজী সুভাষ হলেন সেইরূপকথার নায়ক, যিনি তথাকথিত আদর্শবাদ তথা পরিস্থিতিগত বাধা পেরিয়ে স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে কোনোভাবেই কোনো নির্দিষ্ট ছকে বিচার করা যায় না। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিদেশনীতিতেনেতাজি সুভাষের ‘রাজনৈতিক প্রয়োগবাদ’ বা পলিটিকাল প্রাগমাটিজমের লিগাসি বা উত্তরাধিকার নিয়ে পর্যালোচনা করা যায়।

নেতাজী সুভাষের জীবনের শেষ পর্যায় ১৯৩৭-১৯৪৫ বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অন্য কোনো ‘ইজম’ বা বাদ/তত্ত্ব নয়, একমাত্র ‘জাতীয়তাবাদ’ই তার রাজনৈতিক প্রয়োগবাদের ভিত্তিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি তখন এমন একজন জাতীয় স্তরের নেতা হয়ে উঠেছিলেন যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতমাতাকে যে কোনো উপায়ে শৃংখলমুক্ত করা, এমনকিতা সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে হলেও।

১৯৩৯ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দলের সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হলেও গান্ধীজীর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের জন্য নেতাজীসুভাষ সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তারপর তিনি নিজস্ব দল সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করলেন, যাতে করে তার শর্তহীন স্বরাজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারেন।

সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য উপযুক্ত পথের সন্ধানের ক্ষেত্রে নেতাজী সুভাষের চালিকাশক্তি ছিল একদিকে প্রাচীন ভারতেরঅসাম্প্রদায়িক ধর্মগ্রন্থগুলি যেমন ভগবদগীতা, অন্যদিকে আধুনিক ভারতের যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের সর্বজনীন মনুষ্যত্ববোধ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়াকে সরাসরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষ হিসেবে অংশগ্রহণকারী হিসেবে ঘোষণা করল। ঠিক সেই জটিল বিভ্রান্তকর সময়ে যখন সবাইহতবুদ্ধি, তখন নতুন পথের সন্ধানে সুভাষচন্দ্র এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন যার ভিত্তি ছিল বাস্তববোধ ও রাজনৈতিক প্রয়োগবাদ।

ভারত থেকে ‘মহানিষ্ক্রমণের’ আগে বীর সাভারকারসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নিয়ে নেতাজী আলোচনা করেছিলেনএবং তার বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি বুঝলেন যে, এক নতুন পথ তাকে বেছে নিতে হবে। তাই তিনি ভারত থেকে বেরিয়ে যাওয়ারপরিকল্পনা করলেন। মহামতি কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রের’ বিখ্যাত চাণক্যনীতি: ‘আমার শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’- সেই নীতির উপরভিত্তি করে তিনি ব্রিটিশরাজ বিরোধী অক্ষশক্তিকে ব্যবহার করে তাদের সামরিক বাহিনীর সাহায্যে ভারতকে স্বাধীন করার পথে এগিয়েচললেন।

ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের ভারতে মোদি সরকারের বিদেশনীতির পর্যালোচনা করা খুবই প্রাসঙ্গিক। নেতাজী সুভাষের মতোই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোনোরকম আদর্শগত অচলায়তন থেকে নয়, শুধুমাত্র জাতীয় স্বার্থের সাপেক্ষে একমাত্র ইজম অর্থাৎ ন্যাশনালিজম বা জাতীয়তাবাদকে মাথায় রেখে বিদেশনীতি গ্রহণ করে চলেছেন। বিগত বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’অবসানের পর এবং একবিংশ শতাব্দীতে বহুমুখী বিশ্বের উত্থানের পর আজকের বিশ্ব রাজনীতিতে কোনো ধরনের আদর্শগত অবস্থানের প্রাসঙ্গিকতা নেই। এই পরিপেক্ষিতে ‘নির্জোট আন্দোলনের’ আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই এবং মোদি সরকার সেই অপ্রাসঙ্গিকতাকে বুঝে নিয়ে শত্রু দেশের মোকাবিলায় কোন আদর্শগত পিছুটান না রেখে অত্যন্ত বাস্তবোচিত প্রায়োগিক বিদেশনীতি গ্রহণ করে চলেছে।

মোদিজীর বিদেশনীতির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই বিদেশনীতি মূলত ‘নন-নর্মাটিভ’ যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ‘ফ্যাকটস্’এর উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। পাক-চিনা শয়তানি অক্ষকেমোকাবিলা করার জন্য মোদি সরকার রাজনৈতিক প্রয়োগবাদের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক-সামরিক ব্যবস্থা নিয়েছে।চৈনিক বিস্তারবাদী আগ্রাসনকে রুখতে ভারত সরকার একদিকে যথোপযুক্ত সামরিক ব্যবস্থা নিয়েছে, অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যেমন ‘কোয়াড’ ও ‘আসিয়ান’ দেশগুলির সঙ্গে যৌথ-অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে।

জাতীয় সুরক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে মোদি সরকারের বিদেশনীতি এতোটাই প্রাগমাটিক যে ভারত নিজেকে বিশ্বের এক ‘লিডিং গ্লোবাল পাওয়ার’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এবং জন্মশত্রু পাকিস্তান ও তার প্রভু চীনকে রোখার জন্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্তরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব বা পার্টনারশিপ গড়ে তুলছে। শুধু তাই নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত নতুন ভাবে ‘অস্ত্র কূটনীতি’ গ্রহণ করেছে এবং কিছু দেশে ভারত তার নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে, যাতে এতোদিনের ‘সফট ইন্ডিয়া’র তকমা ঘুচে যাচ্ছে।

১৯৮০ দশকের শেষে প্রফেসর জোসেফ নয়ে ‘সফট পাওয়ার’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন। এই সফট পাওয়ার হচ্ছে সেই ক্ষমতা যা একজন ব্যবহার করে অন্যদের স্বাভাবিক বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করে তাদেরকে নিজের মত-পথে নিয়ে আসে। নেতাজী সুভাষ সেই সফট্ পাওয়ার প্রয়োগ করেছিলেন যখন তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে আজাদ হিন্দ ফৌজের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য ‘দিল্লি চলো’ ডাক দিয়েছিলেন। সেই লিগাসিকে অনুসরণ করেই মোদিজী ভারতবর্ষের আবহমান কালের হিন্দু-বৌদ্ধ ধার্মিক ‘সাংস্কৃতিকযোগের’ পরম্পরাকে এশিয়াতে, বিশেষ করে আসিয়ান দেশগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন।

নেতাজি সুভাষ যেমন  কোন  আদর্শের অন্ধ অনুকরণ না করে মাতৃভূমির জন্য রাজনৈতিক প্রয়োগবাদকে ব্যবহার করেছিলেন; ঠিক তেমনি আজকের বহুমুখী বিশ্বে মোদিজীর নেতৃত্বে ভারত বিদেশনীতিতে এক অভূতপূর্ব ‘ট্রান্সফরমেটিভ অ্যাপ্রোচ’ গ্রহণ করেছে, যারভিত্তিস্বরূপ হচ্ছে জাতীয় স্বার্থরক্ষায় বাস্তবোচিত রাজনৈতিক প্রয়োগবাদ।