নাম বিতর্ক ও ইতিহাসের উত্তরাধিকার

0
859

ইংরেজ কিংবদন্তী উইলিয়াম শেক্সপিয়র বলতেন নামে কিই বা এসে যায়; গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক তার সুবাস একই থাকে। আবার প্রাচ্যে রবীন্দ্রনাথ নামকরণকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করতেন। কিন্তু আজকের আলোচ্য বিষয়ের নাম সাধারণ কোন নাম নয়, একেবারে খোদ রাজ্যের নামকরন। বোধহয় সেজন্যই অধুনা বঙ্গের কর্ত্রীর সরকারি প্রকল্পের ধারা মেনে ‘বঙ্গশ্রী’ জাতীয় কিছু রাখলেই চলবে না তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত স্বীকৃতি চাই। এহেন পরিস্থিতিতে খণ্ডিত বঙ্গের পশ্চিম পাড়ের নাম পরিবর্তন বিশেষ বিতর্ক বা কুনাট্যের সূচনা করেছে। আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে একবিংশ শতাব্দীর নবতম সংযোজন সোশ্যাল মিডিয়া যার দৌলতে এখন আকবর বাদশা থেকে হরিপদ কেরানি সকলেই বিশিষ্ট। তবে গুটিকয় বুদ্ধিজীবীর পোশাকে থাকা স্বার্থান্ধের বাইরে বিভিন্ন বিতর্কে জনমানসের এই সক্রিয় অংশগ্রহন এক হিসেবে গণতন্ত্রেরও প্রকাশ ও বিস্তৃতি। বস্তুতঃ নাগরিকসমাজ মানে শুধু সরকারপন্থী পেটোয়া বুদ্ধিজীবী বা সরকার বিরোধী দলদাস বোঝায় না, তার একটা উদীয়মান প্রতীক সামাজিক মাধ্যমের বাড়ন্ত পরিসর।

রাজ্যের নাম পরিবর্তন বিতর্কে যদি আমরা ইতিহাসে ফিরে দেখি তো দেখব ঔপনিবেশিকতা মুক্তির প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বার্থে পঞ্জাব ও বাংলা বিভক্ত হয়। বাংলার বৃহত্তর অংশ পূর্ব পাকিস্থান নামে নবগঠিত ডোমিনিয়ন পাকিস্থানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং দেশ ভাগের স্মৃতি বুকে নিয়ে বাকি অংশ ঔপনিবেশিক আমলের বংভঙ্গের উত্তরাধিকার মেনে পশ্চিমবঙ্গ নাম নিয়ে ভারত ইউনিয়নে অঙ্গরাজ্যে হিসেবে যুক্ত হয়। পরবর্তীকালে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সামান্য কিছু ভৌগলিক পরিবর্তন হলেও মোটামুটিভাবে রাজ্যের কাঠামোটি একই ছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই খাপছাড়া নামটা নিয়ে নানা সময়ে নানা প্রশ্ন উঠলেও প্রশাসনিক ভাবে রাজ্যের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব ওঠে বাম আমলে মধ্যগগনে। যদিও সেক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক বিষয় ইস্যু ছিলনা, রাজ্য সরকার প্রশাসনিক ও কার্যগত সুবিধের জন্য ইংরেজি বর্ণানুক্রম ধরে রাজ্যসমূহের মধ্যে এগিয়ে আসতে চেয়েছিল। অর্থাৎ ইংরেজি ওয়েস্টবেঙ্গল নামের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সম্মেলন ও বৈঠকে রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ আসে সকলের অন্তে, ২৯টি রাজ্যের মধ্যে শেষ বক্তা ও উপস্থাপক হওয়ার ফলে রাজ্যের বক্তব্য শোনার ধৈর্য স্বাভাবিক ভাবেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও আমলাদের থাকে না, এই সমস্যার প্রতিকার আশু প্রয়োজন। আশ্চর্যজনক ভাবে বাম সরকার এই প্রস্তাব নিয়ে বেশীদূর এগোয়নি, কিন্তু পরিবর্তনের পর নতুন জোট সরকার আবার কোমর বেঁধে এই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয়। রাজ্য মন্ত্রীসভায় আলোচনা সাপেক্ষ রাজ্যের তিন ভাষায় তিনটি নাম যথা বাংলা, বেঙ্গল ও বঙ্গাল ঠিক করে অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু একটি রাজ্যের তিনটি নাম অধিকতর প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি করবে যুক্তি দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তাবটি ফেরত পাঠায় এবং একটি নামের প্রস্তাব পাঠানোর অনুরোধ জানায়। বিগত ২৬শে জুলাই রাজ্য মন্ত্রীসভায় কার্যত সর্বসম্মতিক্রমে রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ করার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। অতঃপর ভারতের সংবিধানের ৩ ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইনসভায় গৃহীত হলেই সাতদশক পর পশ্চিমবঙ্গ ‘বাংলা’ নামে পরিচিত হবে।

এইসব প্রশাসনিক আকচাআকচির বাইরেও কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্কের সম্ভাবনা থেকেই যায়। বস্তুতঃ হঠাৎ ইতিহাস সচেতন হয়ে ওঠা তর্কপ্রিয় জাতির বিভিন্ন স্তরে এই নিয়ে বিস্তর চাপান-উতোর চলছে। এরই মাঝে লক্ষ্য করার বিষয় রাজনৈতিক ভাবে রাজ্যের শাসক ও বিরোধী শিবির ‘বাংলা’ নামের বিষয়ে একমত। অপরপক্ষে দলের মধ্যে একাধিক অন্তর্বিরোধ রইলেও বিজেপির সংসদীয় দল বিধানসভায় নাম বদলের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেনি, বরং কৌশলে আলোচনা এড়িয়ে গেছে। কিন্তু রাজ্যের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই মুহূর্তে বিজেপি একটি হিমশৈল যার বাইরে মাত্র তিনজন বিধায়ক থাকলেও জনসমর্থনের ভিত্তি বেশ গভীর, ভোটের নিক্তিতে তা কুড়ি শতাংশ পার করেছে। আবার সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল মাথায় রাখলে বিজেপিই রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল। এখন বিজেপি ও বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর তরফ থেকে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে রাজ্যের নাম থেকে পশ্চিম শব্দটি মুছে ফেলার অর্থ ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে সন্তর্পণে ছেঁটে ফেলা। কারণ এই নামের সাথে পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সংগ্রাম ও স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বস্তুতঃ যে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বঙ্গের বিভাজন হয়েছিল তা বাঙ্গালী হিন্দুর ইতিহাসে চিরস্থায়ী সঙ্কট রেখে গেছে তাই আজও নিরন্তর ওপার থেকে পরিচিতির সঙ্কট মাথায় নিয়ে ভারতভূমে শরণ নেওয়া চলছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যতবার ‘পশ্চিম’ শব্দটির সাথে সংযুক্ত হবে ততবার সে পূর্ববঙ্গের না থাকার এবং পূর্ববঙ্গ থেকে তার পূর্বপুরুষের ছিন্নমূল হওয়ার যন্ত্রণা অনুভব করবে। কে বলতে পারে এই যন্ত্রণা হয়তো, একদিন জার্মানি বা ভিয়েতনামের মতো দুই বাংলাকে ফের একত্রিত করবে না? উত্তর আধুনিক চিন্তকরা বলেন, ইতিহাস সরলরৈখিক নয়; ইতিহাসের গতি মার্ক্সীয় নির্ধারণবাদের কায়দায় নির্দিষ্ট করা যায় না। তাই বৃহত্তর বাংলার স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে ‘পশ্চিম’ বাংলার সাথে জুড়ে থাক। এদের দৃষ্টিতে ‘পশ্চিম’ বাঙ্গালীর পরিচিতি নয়, ইতিহাসের উত্তরাধিকার।

ব্যক্তিগতস্তরে আমি এই যুক্তির সাথে অসহমত নয়, তবে যুক্তিবাদীদের বাস্তববাদী হওয়ার আবেদন করছি। বাংলা নামের থেকে ‘পশ্চিম’ শব্দটি মুছে গেলেই জাতির ইতিহাস মুছে যাবে এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে মানুষ ভুলে যাবে এমনটা ভাবা সরলীকরণ, বস্তুতঃ ইতিহাস কোন শব্দের মুখাপেক্ষী নয়। তাছাড়া কোন একটি ভাবগোষ্ঠী যদি এমন বলে তবে স্পষ্ট বুঝতে হবে সেটি একটি রাজনৈতিক কর্মসূচী, জনস্বার্থের মূলধারার সাথে তা খাপ খায়না। ইতিহাস মুছে যাবে এই যুক্তি দিয়ে উন্নয়নের রথ রোধকরে রাখা মানসিক দৈন্যতা। ভেবে দেখা হোক যে জাতি নিজের ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নয়, কেবল একটি শব্দকে তার ইতিহাসের বার্তাবাহক মনে করে তাদের পক্ষে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভেদের গণ্ডি পেরিয়ে পুনর্মিলন সম্ভবনা কতটা ? ভিয়েতনাম বা জার্মানির ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, এই দুই রাষ্ট্রের সংযুক্তি একটি বৃহত্তর জাতীয়তাবাদের নিরন্তর সংগ্রামের ফলশ্রুতি। বিগত সত্তর বছরে এমন কোন উদ্যোগ বা আন্দোলন দুইবাংলার কোন প্রান্তেই দানা বাঁধেনি।

সর্বশেষ বিষয় রাজ্যের নাম তবে কি হওয়া উচিত। বঙ্গ জাতীয়তাবাদী হিসেবে আমারও ‘বঙ্গপ্রদেশ’ রাজ্যের নাম হিসেবে প্রথম পছন্দ, কিন্তু সার্বিক ঐক্যমত্যের স্বার্থে ‘বাংলা’ মেনে নিতে কোন অসুবিধে নেই। বস্তুতঃ বাঙ্গালীর সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তার মূলবাহক বরাবর এপার বাংলা বা পশ্চিমবঙ্গ। বাংলাদেশ নামের মধ্যে ‘বাংলা’ শব্দটি আছে এই ছেঁদো যুক্তিতে আমরা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর অধিকার ছেড়ে দিতে পারিনা। এক্ষেত্রে ‘বাংলা’ প্রদেশ হিসেবে ভারত ইউনিয়নে এবং বাংলাদেশ সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থিত থাকলে কোন জটিলতা সৃষ্টি আশঙ্কা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত খুঁজলে এমন হাজারো উদাহরণ আকছার পাওয়া যাবে। নামকরণের অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে সময় নষ্ট না করে আমরা বাঙ্গালীর আধিপত্য ও গরিমা পুনুরুদ্ধারে যদি মনোনিবেশ করি তবে এই সঙ্কট পেরিয়ে নিজেদের নতুন ভাবে মেলে ধরতে পারব। বিভক্তির সেই কালো ইতিহাসের আরেকপ্রান্ত পঞ্জাবকে লক্ষ্য করুন। আজও দুই দেশেই পঞ্জাব নামে প্রদেশ থেকে গেছে, তবু তারা নিজেদের ইতিহাস বিস্মৃত নয়। বরং দুই রাষ্ট্রেই তারা সবচেয়ে সফল ও প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে সুদূর কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্নপ্রান্তে তাদের প্রতিষ্ঠা আকর্ষণীয়। একটি আলোকপ্রাপ্ত, শিক্ষিত, প্রগতিশীল, বিতর্কপ্রিয় জাতি হিসেবে দুনিয়াব্যাপি আমাদের যে প্রতিষ্ঠা ও গরিমা আছে তা থেকে সরে গিয়ে ক্রমেই আমরা একটি স্রোতহীন বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হচ্ছি। তাই পশ্চিম-পূর্ব বিতর্কে কালযাপন না করে ‘বাংলা’র প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করা হোক, তাতেই জাতির প্রকৃত মুক্তি।