মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী আর কত নাচাবেন?

পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা বিনিময় হল না কেন? পাঞ্জাবে কিন্তু হয়েছিল। দেশ ভাগ হল, মুসলিমরা এখানেই থেকে গেল। আবার মুসলিম দেশ থেকে মেরে বের করে দেওয়া হল হিন্দুদের। কাজেই হিন্দুরা এই দেশে শরণার্থী হয়ে ফিরে এল। আমরা শরণার্থীদের থাকতে দিলাম, নিজের দেশের ভাগ দিলাম, রুটি রুজি ভাগ করে নিলাম। এই শরণার্থীদের এত কষ্ট কি হত যদি ওরা আমাদের জায়গায় না থেকে জনসংখ্যা বিনিময়ের পরে মুসলিমদের জায়গায় থাকতে পারত? জমির চাপ এত বাড়ত না। আমাদের রুটি রুজিও ভাগ করে নিতে হত না। এর উপর আবার গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত মুসলিম অনুপ্রবেশকারীতে দেশ ছেয়ে গেল। আমরা “একি বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু মুসলমান” গেয়ে আমাদের দরজা খুলে দিলাম। বিনিময়ে ওরা আমাদের কয়েক দশকের মধ্যে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে সংখ্যালঘু করে দিল। এত এত লোক কিন্তু জমি তো আর আলাদিনের ম্যাজিক নয় যে বেড়ে যাবে। রোজগার বাড়াও সম্ভব হল না বামপন্থীদের সাঙ্ঘাতিক কর্মনাশা রাজনীতির কারণে। যা কলকারখানা ছিল সব বন্ধ হল। কাজেই এই রাজ্য যে চোরেদের স্বর্গরাজ্য হবে এতে আর আশ্চর্যের কি আছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো দেখলেই বোঝা যায় যে অপরাধী বেশির ভাগই মুসলিম। যত রিকশা চালক, টোটো চালক, ভ্যান চালক, মুটে মজুর, লোকের বাড়ির কাজের লোক সব বলতে গেলে মুসলিম। দিল্লী, গুঁড়গাও, মুম্বায়ের মত বড় শহরে কাজের লোক মানেই বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী, রিকশাওয়ালা মানেই বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী।

মনে আছে ঋভু হবার পরে কিন্নর আসার কথা। তখন গুঁড়গাওতে সেক্টর ৩১ এ থাকি। বিরাট BMW করে এক জন উচ্চ শিক্ষিত কিন্নর এসে নামলেন। ঋভুকে দেখেই ৫৫ হাজার টাকা চাইলেন। ভেবেছিলেন প্রথম পুত্র সন্তান, ওটাই তখন রেট চলছিল। তা যাই হোক আমি বললাম, না দ্বিতীয় পুত্র সন্তান। খুব বিমর্ষ হয়ে ১৮ হাজার টাকা চাইলেন। স্বাভাবিক ভাবেই আমার কাছে এত টাকা ক্যাশ ছিল না। আমি ওদের দেবার জন্য ১০ হাজার টাকা রেখেছিলাম। সেটা বলতেই পুরো ফেটে পড়েছিলেন রেগে। তারপর বলেছিলেন “ভিখারী বাংলাদেশী, তোরা এখানে আসিস কেন, আমাদের দেশকে নোংরা করতে?”। আমি অসম্ভব কঠোর গলায় প্রতিবাদ করে পুলিশ ডাকব বলেছিলাম। বাঙ্গালী সম্বন্ধে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ না করার কারণ কিন্তু অবৈধ বাংলাদেশীরা।

বাংলাদেশের মানুষ বাঙ্গালী নয়। ভাষা দিয়ে জাতীয়তার বিচার হয় না। বাংলা ভাষায় কথা বললেই কেউ বাঙ্গালী হয়ে যাবে না। তবে ইংরেজীতে কথা বলা সবাই ইংরেজ হয়ে যেত, আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান বলে কেউ থাকত না।

এই রাজ্যের সব কিছুই অদ্ভুত, বরং বলা ভাল, বিপরীত। তাই গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে সব সংজ্ঞা। শরণার্থী আর অনুপ্রবেশ দুটো একেবারে ভিন্ন বিষয়। যে নিজের এথনিসিটির ভয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যাচ্ছে আশ্রয়ের খোঁজে, একটু নিরাপত্তার খোঁজে, সে শরণার্থী। আন্তর্জাতিক শরণার্থী শিবির অনেক আছে। বহু গৃহযুদ্ধের কারণে বা অন্য রাজনৈতিক কারণে গৃহহীন মানুষ অন্য দেশে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে। কোন মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে যেতে চায় না। তারা আজীবন সেই ট্রমা থেকে বেরোতে পারে না। নতুন দেশে মানিয়ে নেওয়া তো আছেই, সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ জীবিকার সন্ধান করা।

কাজেই আমাদের রাজ্যে যারা শরণার্থী হয়ে এল তাদের যে অসম্ভব অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, এটা খুব স্বাভাবিক। এই শরণার্থীদের সিপিএম নিজের দিকে টানতে পেরেছিল কংগ্রেসকে দেশভাগের কারণ দেখিয়ে। শরণার্থীদের মধ্যে অ্যান্টি কংগ্রেস অনুভূতি যে প্রবল হবে সেটা অনুমেয়। আর সেটাকেই সিপিআইএম তাদের রাজনৈতিক পুঁজি করে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এল।

বাঙ্গালী শরণার্থী ভুলেই গেল ঠিক কি কারণে তারা দেশছাড়া হয়েছিল। নানা দুর্যোগের মধ্যেও তারা সম্মানের সঙ্গে টিকে গেল কেবল পরিশ্রম করার সুবাদে। বুদ্ধি বাঙ্গালীর বরাবর আর সবার থেকে বেশিই ছিল। তাই পড়াশুনা করে বড়সড় চাকরি পাওয়া সহজ হয়ে গেল। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে জমির মালিকানা কিন্তু শরণার্থীরা পেল না। অর্থের অভাব একটা কারণ হলে আরেকটা কারণ অবশ্যই জনসংখ্যা বিনিময় না করা। ওই দেশে শত্রু আইনের কৌশলে হিন্দুদের জমি জায়গা কেড়ে নিয়েছিল বলে জমির যে পুঁজি, সেটা হারাতে বাধ্য হল এরা। ভেস্টেড জমি সরকার থেকে বসবাসের জন্য দেওয়া হল। অন্য রাজ্যে ভেস্টেড জমিতে কারখানা বানানোর কাজ চলছিল আর আমরা মানুষের মাথায় ছাদ দিতে ব্যস্ত থাকলাম মানে থাকতে বাধ্য হলাম। পিছিয়ে পড়া শুরু হল একটু একটু করে। কংগ্রেসের রাজনীতির বিরোধিতা করতে শুরু হল বুর্জোয়া বিরোধী আন্দোলন, শ্রেণীশত্রু বলে চিহ্নিত হতে লাগল কলকারখানার মালিকরা। আত্মঘাতী বাঙ্গালী ধ্বংসাত্মক রাজনীতি শুরু করল, ধীরে ধীরে সব বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। সিপিআইএমের বর্গা আন্দোলন আরেকটা মিথ্যার ফানুস। নিজেদের ক্যাডারদের পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। ভূমিহীন শরণার্থী জমির মালিকানার জন্য সিপিআইএমের এই বর্গা আন্দোলন সমর্থন করবে এটা তারা বুঝেছিল। এই ভাবে গ্রামের দিকে সরকারী জমি বা যার বেশী জমি ছিল, বর্গা হয়ে গেল আর বর্গাদার সিপিআইএম সমর্থক শরণার্থীর দল। কাজেই কেন সিপিএম এত দীর্ঘদিন রাজত্ব করে এসেছে বোঝা যায়।

সিপিআইএমের ভোট ব্যাঙ্ক শরণার্থী ছিল, তাদের টার্গেট করেই পলিসি নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র এদের দিয়ে তো ভোটে একক গরিষ্ঠতা সম্ভব ছিল না। তখন টার্গেট হল অবৈধ মুসলিম অনুপ্রবেশকারী। তাদের জন্য রেশন কার্ড দেওয়া হল ঢালাও। অসংগঠিত কাজ পুরোটাই তাদের জন্য বরাদ্দ করা হল। যত রাজমিস্ত্রী, ঘরামী, পাইপের মিস্ত্রী, রিকশাওয়ালা, সাইকেল সারাই সব এরাই করতে শুরু করল। এদের ভোট চাই বলে ধর্মীয় তোষণ চালু হল দৃষ্টিকটু ভাবে। মাদ্রাসায় পড়ে যে ভাল সরকারী বা বেসরকারী চাকরি পাওয়া যাবে না, সেটা সিপিআইএমও জানত। কিন্তু ভোট পাওয়া সহজ হয়ে গেল।

সিপিআইএমের বিরোধিতা করে উঠে এলেন যুব কংগ্রেস সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যার রাজনৈতিক জীবনের উত্থান হল সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে লোকসভা ভোটে হারিয়ে। ব্যস আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সিপিআইএমের ফেলা পায়ের ছাপে সন্তর্পণে পা ফেলে এগিয়ে গেছে তার স্ট্রাটেজিক লড়াই। ২০০৫এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লোকসভায় হাঙ্গামা করছেন অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ে। কারণ তারা তখন সিপিআইএমের সমর্থক। সেই সময় স্পীকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। লোকসভায় বলার অনুমতি মেলে নি মমতার। আজ সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসাম থেকে বাতিল হয়ে যাওয়া 40 লাখ অবৈধ মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সেদিন মমতা চিৎকার করত সিপিআইএমের বিরুদ্ধে আর আজ করছে বিজেপির বিরুদ্ধে। যদিও আসামে নাগরিকপঞ্জী কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত, সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত। আসাম রাজ্য সরকার এখানে প্রশাসনিক সহযোগিতা করছে মাত্র।

অন্য দিকে আসামে কর্মসূত্রে অনেক বাঙ্গালী থাকে অনেক বছর ধরে। তাদের ডিটেইলস জানার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আসাম সরকার যোগাযোগ করেছিল। সরকারী যোগাযোগ করার প্রচেষ্টাকে সব ধরনের অসহযোগিতা করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কারণ খুব স্পষ্ট। অনুপ্রবেশকারী ও শরণার্থীর মধ্যে গুলিয়ে দিতে মমতার দরকার ছিল বাতিল অনুপ্রবেশকারীদের তালিকায় হিন্দু নাম। সেটা হয়েছে মমতার সুকৌশলে, সুপরিকল্পনায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অসহযোগিতায় অসংখ্য হিন্দুর নাম নেই। তাদের খেপিয়ে আন্দোলনের নামে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার আরও অবনতির কারণ হতে চলেছে। নিজের স্বাধীন দেশের রাজ্যের প্রশাসনিক কর্ণধার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকেও কোন যুক্তিতে গৃহযুদ্ধের ডাক দিচ্ছেন, ভগবানও হাসছেন।

আসলে ক্ষমতা বড় বালাই। তাই কাশ্মীরের ভূমিপুত্রদের জন্য মন কাঁদে না। পাকিস্তানের হিন্দুদের জন্য প্রাণ কাঁদে না। তসলিমা নাসরিন মুসলিম, নিজের দেশ ছেড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছেন মৌলবাদীদের জন্য, তাকেও আশ্রয় দিতে পারে না। কিন্তু মায়ানমার থেকে উৎখাত হওয়া রোহিঙ্গাদের ডেকে এনে বসবাসের জায়গা দিতে পারে। ৪০ লাখ লোক আবার এই রাজ্যে এলে যে পরিকাঠামো ধ্বসে যাবে সেটা নিশ্চিত। তবুও বাঙ্গালী সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলে যাচ্ছে। ওই বাঙ্গালীর ভাষা পর্যন্ত আজ শুদ্ধ বাংলা নেই। সংস্কৃত শব্দ বাদ না দিলে নাকি বিশুদ্ধ ইসলাম কায়েম হবে না। কাজেই ক্রমাগত আরবী, ফারসি শব্দ ঢুকছে ওই বাংলা ভাষায়। কথায় আছে না, মুর্খের অশেষ দোষ। তাই শব্দের উৎপত্তি না জেনেই বাতিল হয়ে যায় বাবা শব্দটি যেটা আসলে আরবী শব্দজাত। আব্বা শব্দ চলে আসে। বাতিল হয় হাজারো শব্দ। তবুও তারা নাকি বাঙ্গালী। তাদের নিজেদের দেশ আছে যেখানে তাদের ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম করা হয়েছে।

আমাদের লাভের হিসেব করেছে কি কেউ? দেশভাগ হল, জমি হারালাম, দাঙ্গায় স্বজন হারালাম, শরণার্থীর চাপে এখানে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ হল না, অনুপ্রবেশকারীদের চাপে আমাদের নাভিশ্বাস উঠলো, সঙ্গে অবৈধ নাগরিকদের অপরাধের স্বর্গরাজ্য হয়ে গেল এই রাজ্য যা একদা তৈরি হয়েছিল ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অক্লান্ত এবং একক প্রচেষ্টায় বাঙ্গালী হিন্দুদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেব। আজ আমাদের হাতে কিছুই নেই। আছে কেবল রাজনৈতিক হিংসা, খুনোখুনি। রাজ্যের বেকার সংখ্যা ভয়াবহ, কাজের সংস্থান নেই, উদ্যোগও নেই। আর আছে একটা বিষম মানসিকতা সম্পন্ন মুখ্যমন্ত্রী যিনি একদা মুখ্যমন্ত্রী হবার জন্য জবরদস্তি তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর চেয়ারে বসে পড়েছিলেন। আর আজ প্রধানমন্ত্রী হবার বাসনায় মাওবাদী থেকে জামাতের মত জঙ্গী গোষ্ঠী থেকে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্তাবাদী থেকে বাতিল হয়ে যাওয়া আঞ্চলিক দল, সবার সঙ্গে জোট বাঁধতে বদ্ধপরিকর। আমরা সেই জটের দলদলে হাবুডুবু খেতে খেতে “হিন্দু একটাও যদি নাগরিকত্ব হারায়, তবে বিজেপির একদিন আর আমার একদিন” করে অবৈধ অস্ত্র কারখানায় তৈরি দেশী পিস্তলের ট্রিগার টিপছি। বেশী খেয়ে বদহজম হলে দক্ষিণ ভারত ছুটছি ঢেকুর তুলতে।

বাঙ্গালী হিন্দুর চাই নতুন দিশা, নতুন রাজনৈতিক ভাবনা।

ফীচার: Time 8; ছবি প্রতীকী