জাতীয় নাগরিক পঞ্জী নিয়ে রাজনীতি এবং বাঙালি হিন্দুর স্বার্থসুরক্ষা

0
669

ভারতবর্ষ একটি সুপ্রাচীন সভ্যতার চারণভূমি, তবে বর্তমান ভারত সেই অংশের থেকে অনেকটাই কুঞ্চিত। স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন বিদেশী আক্রমণের প্রভাবে আমরা আমাদের অনেক অংশ হারিয়েছি এই শক্তিগুলির কাছে। সর্বশেষ ঘটনা ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। দেশভাগ হয় ধর্মের ভিত্তিতে। সে সময় যুক্তবঙ্গ ছিল মুসলিম প্রধান রাজ্য, এবং একমাত্র রাজ্য যেখানে মুসলিম লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। স্বাভাবিকভাবে দাবী ওঠে পুরো বাংলাকেই পাকিস্তানের অংশ করার। পরবর্তীতে শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে ‘Bengali Hindu Homeland movement” আন্দোলন সংগঠিত হয়, এবং আমরা কিছুটা জায়গা বাঁচাতে সফল হই।

এসব তো বহুলচর্চিত বিষয়। কিন্তু বর্তমানে আবার তা উঠে আসছে আসামের জাতীয় নাগরিক পঞ্জী গঠনের প্রক্রিয়ার জন্য। ৭০’র দশকের আসাম আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করা মুসলমানদের কথা সকলের সামনে ছবির মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও শোচনীয় এই অনুপ্রবেশের ফলে, যদিও তার পূর্ণাঙ্গ কোন তদন্ত হয়নি এখনো পর্যন্ত। আসামে পূর্ববঙ্গ থেকে অসংখ্য মুসলিম কৃষককে এনে বসানো হয় তিরিশের দশকে সৈয়দ মহম্মদ সাদুল্লাহের মদতে, আসামে কৃষিকাজের উন্নতির যুক্তি দিয়ে। এর পরবর্তীতে বাংলাদেশের অনিয়ন্ত্রিত সীমারেখার কারণে অনুপ্রবেশ হয়ে আসছে অবাধে। আসামের মঙ্গলদৈ কেন্দ্রে ১৯৭৮ সালের উপনির্বাচনের সময় পরিলক্ষিত হয় যে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনের পরে অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে ভোটার সংখ্যা অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গিয়েছে। সেই থেকে সূচনা হয় আসাম আন্দোলনের। এর ফলশ্রুতিতে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আমলে আসাম চুক্তি সাক্ষরিত হয়, যা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের পরবর্তীতে আসা সমস্ত বাংলাদেশীকে বিতারন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই চুক্তি রূপায়ণের একটি অঙ্গই হল বর্তমান জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা NRC(national register of citizens)।

আবার সাথে সাথে ভারতের পার্শ্ববর্তী দুই রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন চলে এসেছে অনবরতভাবে। ফলে স্বাভাবিকভাবে এই দুই দেশ থেকে হিন্দুরা ভারতে শরণার্থী হিসাবে আসছে সেই ১৯৪৭ থেকেই। বিশেষ করে উল্লেখ করা যায় আসামের কথা কারণ সেখানে একটি অংশ বরাক উপত্যকা ছিল অবিভক্ত সিলেটের অংশ। আশ্চর্যভাবে সিলেটের গণভোট করে তাকে পুরোটাই বাংলাদেশে পাঠানোর চক্রান্তও হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, যদিও আসামের অন্যান্য জেলায় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। এর পরবর্তীতে বঙ্গাল খেদাও, আসাম আন্দোলন ইত্যাদির সময়েও হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়েছে, এবং অনেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। আসামে বাঙালির বাস চিরকালীন, অনেক অসমীয়া জনগোষ্ঠীর বহু আগে থেকেই সেখানে বাঙালিরা থেকে আসছে। তন্ত্রের এবং বৈষ্ণবধর্মের চর্চার কারণে দুই জায়গার মধ্যে প্রবল সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বহুদিনের। বাঙালিরা তাই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেও ভূমিপুত্র হিসাবে বসবাস করে এসেছে।

জাতীয় নাগরিক পঞ্জী নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে, যার মূল লক্ষ্য অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর ভোট সংগ্রহ করা। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে অসমীয়া জাতীয়তাবাদী দলগুলি, অসমের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় কংগ্রেস ইত্যাদি দল যারা হিন্দু বাঙালিদের বিতাড়ণের পক্ষে। এই দুই মেরুর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে আসামের বাঙালি হিন্দুরা। বিভিন্ন সময়ে নিজেদের স্বার্থে নিজেদের অসমীয়া পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার অলিন্দে ঢুকে গিয়েছে অসমের বাংলাভাষী মুসলিমরা। জাতীয় নাগরিক পঞ্জী গঠনের মধ্যেও দেখা গিয়েছে যে সংখ্যায় অনুপ্রবেশকারীর হিসাব আলোচিত হয়েছিল তার তুলনায় সামান্যই হয়েছে খসড়ায়। বরং সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন হিন্দুরা, মাইগ্রেশন বা বিবাহের নথিপত্র গৃহীত না হওয়ায়। আসাম সরকারের মন্ত্রীরাও তাদের ধর্মনিরপেক্ষ মুখ বজায় রাখতে হিন্দুদের নাগরিক পঞ্জী থেকে বাদ দেওয়া নিয়ে গর্ব করেছেন। এর সাথে সাথে আসামে আন্দোলনের কারণে পিছিয়ে গিয়েছে ২০১৬ নাগরিকত্ব বিল, যার মাধ্যমে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। বিজেপির জোটসঙ্গী অসম গণ পরিষদ বিশেষ করে এই বিলের বিরোধী। উড়িষ্যার বিজু জনতা দল আবার এই বিল থেকে বাংলাদেশের হিন্দুদের বাদ দিয়ে কেবল পাকিস্তান এবং আফঘানিস্তানের হিন্দুদের জন্য নাগরিকত্ব চায়। অতএব সমস্ত দিক দিয়ে সমস্যায় বাঙালি হিন্দুরা। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে ভাষাবাদী বাঙালির দল হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে নাগরিকত্ব প্রদানের পক্ষে মাঠে নেমে পড়েছে, যাদের মূল লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশকারী অবৈধ মুসলিম বাংলাদেশীদের লালন, এবং পশ্চিমবঙ্গকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করা। কাজেই সেই দলগুলির সাথেও দূরত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই সময়ে দাঁড়িয়ে। ১৯৪৬ সালের কলকাতা ও নোয়াখালী দাঙ্গা, পরবর্তীতে ঢাকা বরিশাল এবং খুলনার দাঙ্গার কথা আমাদের স্মৃতিতে এখন ধূসর। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফের কালিদাস বানানোর প্রক্রিয়া আবার চালু হয়ে গিয়েছে। শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায় বা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলদের পাওয়া এমন কিছু দুষ্কর নয়। সাথে সাথে আছে তাদের নিরবিচ্ছিন্ন প্রয়াস এবং অর্থের সরঞ্জাম। এই নাগরিক পঞ্জী নিয়ে আন্দোলন হয়তো তারই এক পদক্ষেপ।

বর্তমানে আমাদের সমস্ত সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রিত একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বারা, কাজেই বিভ্রান্তি তারা ছড়াবেই বাঙালির মধ্যে। হিন্দু শরণার্থীর জন্য বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না দেখিয়ে তাদের লক্ষ্য বরং বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীদের জন্য লাল কার্পেট বিছিয়ে রাখা। শরণার্থী এবং অনুপ্রবেশকারীর মধ্যে পার্থক্য খুব সুস্পষ্ট, তা যে তারা জানে না এমন নয়। দেশভাগের ইতিহাস সম্পর্কেও তারা ওয়াকিবহাল। কিন্তু তাদের মতাদর্শগত অবস্থানের জন্যই তাদের কাছ থেকে তাদের বর্তমান ন্যারেটিভের বাইরে অন্য বক্তব্য আশা করা বাতুলতা। বুদ্ধিজীবীদের সার দিয়ে দাঁড় করিয়েও তারা এই শরণার্থীদের অনুপ্রবেশকারীর সাথে মিলিয়ে মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার ঘটাতে বদ্ধপরিকর। এবং সেই সাথে অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের বক্তব্য এই আগুনে ঘৃতাহুতির পক্ষে যথেষ্টই সুবিধাজনক। জাতীয় নাগরিকপঞ্জীতে অনেক হিন্দুর স্থান না পাওয়াও সুবিধা করে দিয়েছে এদের। এই অবস্থায় হিন্দুদের পক্ষে দাঁড়ানো এবং মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরণ করে বহিষ্কারের দাবী আমাদের নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতেই হবে জাতির অস্তিত্বসঙ্কটে। সেখানে কোন দল বা রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি হিন্দুজাতির স্বার্থই হওয়া উচিৎ একমাত্র লক্ষ্য। এই যুগসন্ধিক্ষণে আমাদের আমাদের সঙ্কট থেকে উদ্ধার করার মত কোন যুগপুরুষের অভাব তাই আমাদের বড়ই তাড়িত করে।

 

ফীচার: India Today