গজাদা ও মাকুকাকু

গজানন নস্কর বললেন,
“সকালে গেছি বাস স্ট‍্যান্ডের পল্টাদার দোকানে চা খেতে। দেখি অনুকাকা চোখ গোল গোল করে হাত পা নেড়ে কি যেন বোঝাচ্ছে। এতই বোঝানোর বেগ যে চা উল্টে পড়ে গেলেও তার হুঁশ নেই মনে হচ্ছে। হাড় কিপটে লাল পার্টির বুড়োর এত উত্তেজনা কিসে দেখার আগ্রহে একটু পা চালিয়েই পৌঁছালাম দোকানে। আর দোকানে পৌঁছেই দেখি আসাম।
মানে আসামের এনআরসি।

এখন গোটা পশ্চিমবঙ্গই আসাম হয়ে গেছে, বুঝে না বুঝে, গাণ্ডু, উদগাণ্ডু, হাফগাণ্ডু সকল বাঙালিই অহমীয়া হয়ে গেছে। অনুকাকু তো হবেই। আমি ঢুকতেই অনুকাকু থেমে গিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল। স্বাভাবিক। আমি লালধর্মত্যাগী মুর্তাদ। আর ক্ষমতায় থাকলে আমার প্রাক্তন পার্টি মুর্তাদদের সাথে সেই ব্যবহারটাই করে যেটা চৌদ্দশ বছর আগে থেকেই লেখা আছে। কিন্তু যেহেতু এখন তারা ক্ষমতায় নেই ফলে আমার অভিজ্ঞতাবলে আমি জানি যে তারা এখন গণতন্ত্রের পুজারী। তাই ভ্রূকুটিকে পাত্তা না দিয়ে ঢুকে চায়ের অর্ডার করে বসে শুনতে লাগলাম…

অনুকাকু বলছে, “…. তারপর… হ্যাঁ যা বলছিলাম… আরে এটা তো বিজেপির পাতি কমিউনাল গেম। এইসব এনারসি টেনারসি করে দাঙ্গা বাঁধাবে। হ্যাঁ… আরে বুঝতে পারছিস তো, এই যে পনেরো লাখ হিন্দু বাদ গেল, হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলল, হ্যাঁ? তো তাহলে হিন্দুর উপর যে বিজেপির কোন ইসে নেই বুঝতে পারছিস না তোরা? দ্যাখ এই যে আমি। আমিও তো হিন্দুই নাকি? হ্যাঁ? এখন ওসব এখানে হলে আমি এই বুড়ো বয়সে কোথায় যাব বল। একবার সব ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছি….”

আমি দেখলাম সহজ লোপ্পা বল, বললাম “সে কি?! একবার সব ছেড়ে আসতে বাধ্য হলে কেন?”

আমার দিকে কিছুক্ষণ বিরক্তিভরা চোখে চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে অনুকাকু বলল, “তোকে দেখলে লজ্জা হয়। কি ছিলি আর কি হলি, হ্যাঁ?”

আমি হেসে ফেললাম। মুর্তাদ হবার অনেক জ্বালা। আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান.. ইত্যাদি। বললাম, “লজ্জা হোক অনুকাকা। কিন্তু লজ্জা নিয়ে তো আলোচনা হচ্ছিল না। আসাম নিয়ে হচ্ছিল। আর তোমার সব ছেড়ে চলে আসা নিয়ে। সেটা নিয়ে আলোচনা হোক। এরা শুনুক। ঠিক করুক।”

দোকানে জমা ম্যাক্সিমাম ছেলেপুলেই আমার থেকে ছোট। তার থ্রি ফোর্থ বেকার। কেউ টিউশন পড়ায় কটা। কেউ বা ছোট খাটো ব্যবসা কোনমতে। কেউ বড়বাজারের গদিতে কাজ করে টেম্পোরারি। দুজন হকার। আর দুজন সরকারি চাকুরে। মোটামুটি এইরকম একটা শ্রোতৃমন্ডলীর সামনে প্রবীণ লালধরকে চ্যালেঞ্জ করার একটা মজা হচ্ছে এই যে এরা প্রথমেই ধরে বসে থাকে বৃদ্ধ প্লাস রাজনৈতিক নেতা যখন তখন সে সব তথ্য জানে। ফলে আমি যদি তর্কে না পারি তাতে আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু অনুকাকা যদি ধ্যাড়ায়, তাহলছ অনুকাকার প্রজ্ঞার বারোটা পাঁচ। ফলতঃ অ্যাজ এক্সপেক্টেড, শ্রোতৃমণ্ডলী থেকে আওয়াজ উঠল, “হোক হোক।” তারাও মজা দেখতে চায়।

অনুকাকা দেখি কিছু না বলে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ে চুমুক দিল।

আমি বললাম, “কি অনুকাকা, সব ছেড়ে চলে আসতে হল কেন বললে না?”

অনুকাকা বলল, “তোদের ঐ শ্যামাপ্রসাদের থেকে জানতে চা। এভাবে দেশটাকে ভাগ না করলে তো আসতে হত না।”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “তা তো বটেই। কিন্তু দেশভাগ হল কেন?”

কাকা বলল, “এই শ্যামাদের মতো কিছু কমিউনাল জানোয়ারের কারণেই। আর কি?”

আমি বললাম, “কিন্তু জিন্নার পাকিস্তানের দাবীটা কি আগে নয়? মানে ধরো জিন্নাসাব যখন বলল, সব মুসলমানের হৃদয়ে পাকিস্তান, সেটা?”

অনুকাকা বুঝল কথা কোনদিকে যাচ্ছে। এগিয়ে এসে অ্যাগ্রেসিভ খেলল, যাতে প্রথমেই বলের টার্ণটাকে মেরে দেওয়া যায়। বলল, “তোর লেভেল কোথায় নেমেছে ভাব। আমি কি শুধু শ্যামা বলেছি? ওর মত জানোয়াররাও দায়ী। তর্ক করতে এলে কথা বুঝে করবি।”

আমি বললাম, “তার মানে জিন্নাও জানোয়ার বলছ? নেহেরু?”

অনুকাকা গোঁ গোঁ করল, তারপর বলল, “এর সাথে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক কি? তারা তো বাংলাভাগ চায়নি।”

আমি বললাম, “বাংলা ভাগ হল বলেই তোমাদের চলে আসতে হল?”

অনুকাকা লাফিয়ে উঠে বললেন, “আলবৎ। ভাগ না হলে কখনোই আসতে হত না। ধর্মের ভিত্তিতে উসকে ভাগ করা হল বলেই তো ওপারের মুসলিম ভাইরা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। তারা তাদের জমি তাদের মালিকানাতে চাইল। হতে পারে মরালি এটা ভুল, কিন্তু বাস্তবে তো তা বলতে পারি না। ধর্মের ভিত্তিতেই যখন দেশটা ভাগ হয়েছে, তখন তারা প্রতিক্রিয়া দেবে না? সেই প্রতিক্রিয়াতেই তো আমরা…”

আরো ভাষণ দিতে যাচ্ছিল। আমি থামালাম। বললাম, “অনুকাকা কুল। আমি মেনে নিচ্ছি বাংলা ভাগ হবার জন্যই ওপার থেকে তোমাদের তাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীর কি ভাগ হয়েছে?”

অনুকাকা হঠাৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “অ্যাঁ?”

আমি বললাম, “স্বাধীন ভারতে একটি মাত্র স্টেট যেখানে বাকি ভারতের সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরু। সেই স্টেটে হিন্দুদের, মানে একটু আগে তুমি যেহেতু বলছিলে শুনলাম তুমিও হিন্দু, তা সেই কাশ্মীরে হিন্দুদের উৎখাত হতে হল কেন? মানে সেটা তো ভাগ হয়নি….”

অনুকাকা বুঝে ফেলেছিল কথা বিপজ্জনক মোড় নিচ্ছে। কিন্তু সরাসরি কাউন্টারে গেল না। উল্টে রাগ দেখাল, “প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছিস কেন? হ্যাঁ? প্রসঙ্গ কেন পাল্টাচ্ছিস? কোথায় কাশ্মীর আর কোথায় বাংলা। পরিস্থিতি মেলে কখনো, অপদার্থ। তুলনায় আসে কি করে?”

আমি বললাম, “শান্ত হও। তুলনায় আসে। কারণ যদি অবিভক্ত বাংলা ভারতে থাকত, তাহলে কাশ্মীরের মতোই অবিভক্ত বাংলাতেও বাকি ভারতের সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘু হত। এবং তাদেরও ঠিক কাশ্মীরের মতই উৎখাত হতে হত না একথা তুমি শিওর হলে কোথা থেকে? ডাইরেক্ট অ্যাকশন কারা করেছিল? নোয়াখালী কি দেশভাগের পরে? আর যদি অবিভক্ত বাংলা ভারতে না থাকত তবে, এককালে ইসলামী পুর্বপাকিস্তান যেমন “সেকুলার”ছাপ বাংলাদেশ হবার পরও সংখ্যাগুরুর গণদাবীতে বিসমিল্লাহির রহমানুর রহিম লাগিয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে সংখ্যালঘু ঠেঙিয়ে তাড়াল, এক্সাক্টলি সেটাই হত।”

অনুকাকা খেই হারিয়ে বলল, “তুই কি বলছিস আমি বুঝলাম না।”

আমাকে বলতে হল না, শ্রোতাদের মধ্যেই একজন বলল, “কাকা ও বলতে চাইছে, বাংলা ভাগ হোক চাই না হোক, যেহেতু ওখানে আপনারা সংখ্যালঘু ছিলেন, আপনাদের ভাগতেই হত। যেমন কাশ্মীর ভাগ না হয়েও হিন্দু পন্ডিতদের ভাগতে হয়েছে।”

আমি দাঁত বার করে বললাম, “ঠিক এইটাই বোঝাতে চাইছি। তার সাথে এটাও বোঝাতে চাইছি যে তখন পালিয়ে এসে বাংলা বলার জায়গাও অনুকাকারা পেতেন না। ধানবাদে গিয়ে হিন্দিতে বিশ্বভ্রাতৃত্ব কপচে লালু কিম্বা নীতিশের খাটালে রাত কাটাতে হত। এখন শ্যামাকে অন্ততঃ বাংলায় গালিটা দিতে পারছে অনুকাকারা। তা অনুকাকা, কারা তাড়াল তোমাদের?”

অনুকাকা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। মনে মনে গুছিয়ে নিল। তারপর বলল, “ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলে তো এরকম হবেই। অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে পড়বেই মনের মধ্যে। পারস্পরিক একটা অবিশ্বাস…”

আমি আবার থামালাম। বললাম, “বেশ বেশ বুঝেছি। তোমার কথা হল, যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছে। তাই সোরাবর্দীরা ওপার থেকে ধর্মের ভিত্তিতে তোমাদের এপারে তাড়িযে দিয়েছে। তাই তো?”

অনুকাকা বলল, “অবশ্যই তাই। একশোবার। এটা তো স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। মানে যতই অমানবিক হোক, বাট মাসকে যখন সেটাই একবার বোঝানো হয়েছে…”

আমি বললাম, “আর তোমার কথা অনুযায়ী এপারে শ্যামারাও সেভাবে ভাগ করেছিল, যেভাবে জিন্নারা ওপারটাকে?”
অনুকাকা তর্কের গতিতে বলল, “একদম। একই মূদ্রার দুই পিঠ তো এরা। ওরা মুসলমান বলে ভাগ করেছে, এরা হিন্দু বলে।”

আমি বললাম, “বেশ, তাহলে এপার থেকে কতজন ধর্মের ভিত্তিতে তোমাদের মত কপর্দকশূন্য হয়ে, বাড়ির মেয়েদের আব্রু বন্ধক রেখে ওপারে যেতে বাধ্য হয়েছে?”

অনুকাকা বুঝে ফেলল যে ভালোভাবে ফেঁসে গেছে। তাড়াতাড়ি চিৎকার করে বলল, “এ ধরণের কমিউনাল কথা.. ছি ছি আমি ভাবতেই পারছি না। তোর বাবাকে আমি চিনতাম। হ্যাঁ। তার ছেলে কিনা সাম্প্রদায়িক…”

আমার বলতে হল না। শ্রোতৃমণ্ডলীর একজনই অনুকাকার হাত পা ছোঁড়া দেখে মুখ টিপে হেসে বলল, “কিন্তু কাকা, প্রশ্নটার উত্তর কি হবে? ধর্মের ভিত্তিতে যখন ভাগ হল, আর ওপার থেকে যখন সেই কারণেই তোমাদের মার খেয়ে চলে আসতেই হল, তাহলে এপার থেকেও নিশ্চয়ই কারো ওপারে যাবার কথা। কারা গেছিল? নাকি তাড়ানোটা শুধু একপাক্ষিক?”

আমি হাসতে হাসতে পল্টাদাকে চা দিতে বললাম। অনুকাকার মুখখানা দেখার মত হয়েছিল। বললাম, “ছাড়ো কমরেড। অন্য আলোচনা করি। চা হবে নাকি এককাপ? তখন তো ভুংচুং লেকচার দিতে গিয়ে ঠাঁণ্ডা করে ফেললে। তুমি আমার বাবার বন্ধু। চা’ই খাও?”

অনুকাকা গম্ভীর হয়ে বসে রইল। শ্রোতৃমণ্ডলী অনুকুল হলে এতক্ষণে আমাকে পেড়ে ফেলত নির্ঘাৎ। খোদায় বাঁচাইসে আম্রে….
চা নিলাম দুটোই। কিপ্টেকমি। তাই আপত্তি করল না।

বললাম, “হ্যাঁ, তা এনআরসি নিয়ে কি বলছিলে যেন…”

মরিয়া অনুকাকা এইবার যেন নতুন উদ্যম পেল। বলল, “বেশ। মেনে নিলাম। শুধুমাত্র হিন্দু হবার কারণে আমাদের অত্যাচারিত হতে হয়েছে। এখন তাহলে তথাকথিত হিন্দু দল নামে পরিচিত এই বিজেপি এই এনারসি করে তাদের বাদ দিল কেন? বাঙালি বলে?”

শ্রোতৃমণ্ডলীতে দেখলাম বাঙালী তাস ভালোই জনপ্রিয় হয়েছে। এটা আমি জানতাম। কারণ বিজেপি, বেসিক্যালি বাংলা বিজেপির মত অপদার্থ কালিদাসমার্কা দল আমি দুটো দেখি নি। এরা যে ডালে বসে থাকে সেই ডালই কাটার চেষ্টা আপ্রাণ ভাবে করে থাকে। আর একে বর্তমানে কালিদাসকেস না বলে ভিরাটহিন্দুকেস বলা হয়ে থাকে। তা তাদের উৎপাতে বাঙালী তাস, বাঙলার সীমানা পেরিয়ে সাহারা মরুর মধ্যিখানেও পৌঁছে গেছে। প্রপার কাউন্টারের কোন ইচ্ছা বা সক্ষমতা কোনটাই এদের নেই। ফলে এখানকার শহর ও শহরতলীর বিস্তৃত অংশে ডান বাম পোল ছাড়াও আরেকটি স্পনসর্ড পরিস্থিতি তৈরী হচ্ছে, যেটা এই “বাঙালী কার্ড প্লে”.. বাঙালী কার্ডের মজাটা হল, এখানে আধা আরবীও ইনক্লুডেড। ফলে স্পনসর পেতে সমস্যা হয় না। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত ৮০% জনগণ, যারা পক্ষে নৃত্যরত বা যারা বিপক্ষে ক্ষিপ্তমতো তাদের উভয়পক্ষই জানেনা যে কদিন আগেও এনআরসি ছিল সর্বদলীয় দাবী এবং শুধু বিজেপি এর বিরুদ্ধে ছিল, এমনকি সিপিয়েম পর্যন্ত এনআরসি দ্রুত করতে কেঁদে ভাসাচ্ছিল, হঠাৎ ম্যাজিকের মতো সিনারিও পুরো পাল্টে গেল ২০১৬র পর থেকে। আর যারা ম্যাজিকটার আসল গল্পটা জানে তারা মূলতঃ বিরোধী। ফলে তারা সুকৌশলে এনআরসিকে বিজেপির ঘাড়ে চাপাচ্ছে। এবং ভক্তরা সাধারণত যেহেতু উদ্গান্ডু হয়, তারাও সেধে ঘাড় পেতে ক্রুশ তুলছে।

যাইহোক। আমি আপাতত এসবে যাব না। আলোচনাটাই বলি।

আমি বললাম, “প্রথমতঃ বিজেপির সাথে এনআরসির সরাসরি কোন সম্পর্ক আছে বলে জানি না। কারণ কদিন আগেও বিজেপি এর বিরোধিতা করে এসেছে। আর যদি থেকে থাকে, তবে যেটুকু আছে, আমার সাথে বিজেপির বাস্তবে সেটুকু সম্পর্কও নেই। ফলে বিজেপি কেন করছে কিম্বা কি করছে এর পুরোটাই আমার ধারণা করা এক্সটার্নাল ডেটা থেকে, যেগুলো বিভিন্ন সংবাদপত্র বা দলীয় দাবীপত্র থেকেই জানা। বলব সেগুলো, কিন্তু তুমি আমাকে আগে বলো এনআরসিটা কি?”

অনুকাকা ফের ফেঁসে যাবার ভয়ে নিজে বলল না। চায়ে চুমুক দিয়ে আমাকে বলল, “তুই বল।”

“আমি কিছু বলার আগেই আরেকটি ছেলে বলল, “দেখো দাদা, এটা কিন্তু ঘটনা যে ওপার থেকে মার খেয়ে এসে এপারেও মার খাওয়াটা ঠিক কেমন হল? বাঙালিরাই তো মার খেয়েছে, মুসলমানরা তো নিজেদের দেশ নিয়েইছে। তারা এপারে অন্যায়ভাবে এলে নাহয় বলা যায়, কিন্তু বাঙালিরা কি করবে? দুদিকেই মার খাবে?”

আমার হাসি পেল। হাসলাম না। আমি জানি সাধারণ শহরতলীর অল্প ও মধ্যশিক্ষিত বাঙলাভাষী বাঙালি বলতে হিন্দু বোঝায়। ইভেন বাংলাভাষী মুসলমানের ঐ স্তরটাও একইরকম। তাদের ধর্মীয় নেতাদের অনেকেই এ শিক্ষাটা দেয় যে ইসলামী আইডেন্টিটি থাকলে অন্য আইডেনটিটির অনুসারী হওয়া মানে পথচ্যুত হওয়া। তারা ঠিক না ভুল সেসব দীর্ঘ আলোচনা। ওতে ঢুকলাম না। বললাম, “তোমাদের কি মনে হয়? অসমে ঠিক কি হচ্ছে?”

ছেলেটি বলল, “ঐ তো এনআরসি হচ্ছে। তাতে যাদের কাগজপত্র নেই তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।”

আমি বললাম, “কে করছে?”

ছেলেটি শুধু না। অনেকেই হাসল। অনুকাকুও খুঁক করছ নাক দিয়ে হেসে চুমুক মারলেন গ্লাসে।

অতঃপর একজন, যে কিনা হকারি করে থাকে, বলল, “তুমিও অনুকাকার মতোই হয়ে যাচ্ছ। অনুকাকা সিপিয়েমের দোষ আড়াল করে, তুমি বিজেপির আড়াল করছ।” বলে হাসতে থাকল।

আরেকজন রসিকতায় আরেকটু এগোলো, বলল, “অনুকাকার দলেরই পুরোনো কমরেড তো। তাই প্যাটার্ন একই।”

ওদের হাসিতে আমিও যোগ দিলাম। অনুকাকা প্রতিবাদ করতে গেছিল যে সে নাকি সিপিয়েমের দোষ দিব্যি দেখতে পায়, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সিপিয়েম দোষই করে না। তাই বাস্তবে দোষটা দেখা আর হয় না। তাতে সবাই এমন হাসাহাসি করল যে অনুকাকা বিরক্ত হয়ে সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে অন্যদিকে তাকাল।

আমি বললাম, “তাহলে তোদের ধারণা এনআরসি বিজেপি করাচ্ছে? বেশ আমি মেনে নিলাম। এবার বল এই যে নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছে, তা কিসের ভিত্তিতে?”

একজন বলল, “কি সব কাগজের ভিত্তিতে যেন।”

আমি বললাম, “অবশ্যই কাগজের ভিত্তিতে। কিন্তু সেই কাগজ ভিত্তি ডিক্লেয়ার করা আইন থাকবে তো।”

ওরা দেখলাম চুপ হয়ে গেল। বুঝলাম এইসব বিষয় অনুকাকার লেকচারে ছিল না।

আমি বললাম, “শোন তাহলে। আমি বলি। ভুল হলে অনুকাকা খপ করে ধরবে নাহয়। ওকে?”

সকলে সম্মতি দিল। অনুকাকা গোঁ গোঁ করে কি যেন বলল।

আমি শুরু করলাম:
এন আর সি, মানে ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস যা কিনা ভারতের বৈধ নাগরিকদের তালিকা নিবন্ধীকরণ করে। ওকে? এই এনআরসি প্রথয় পাবলিশ হয় যখন আসামের বেশ কিছু অঞ্চল পুর্ব পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়া হয়। এটা ১৯৫১ সালের জনগনণার সময়কার কেস যদ্দুর জানি। ও হ্যাঁ, যে অঞ্চলগুলো দেওয়া হয়েছিল তা বাঙলাভাষী অঞ্চল ছিল। অহমীয়া কংগ্রেস নেতারা…. পয়েন্ট টু বি নোটেড ব্রাদার্স, তখনো বিজেপি ইউরেনাস থেকে পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করেনি, লাদেন জন্মায়নি, বাঘশিকার নিষিদ্ধ হয়নি ইত্যাদি… তখন অহমীয়া এবং দিল্লির কংগ্রেস নেতারা মনে করেছিল ওসব অঞ্চল ভাগিয়ে দিলে শুধুমাত্র অহমীয়া দিয়ে রাজ্য গড়া যাবে। যেমন এখন বেশ কিছু পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাঙালি ভাবার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তো এই হল এনআরসির প্রথম প্রকাশ। তো দোস্তো এইখানে বিজেপি কোথাও আছে?”

সকলে হাসল। মাথা নাড়াল দুদিকে। বললাম, “অনুকাকা, সেদিন বিজেপি ছিল না। তুমিও ছিলে না এদেশে। ওপারেই ছিলে। ভারতের আরো এক খাবলা পুর্বপাকিস্তানে ঢুকতে দেখে কি মনে হয়েছিল? অবশ্য তখনো তুমি খুবই ছোট। বাদ দাও। বিজেপি না থাকলেও তোমার পার্টি ছিল। তোমার পার্টির বাঙালি হিন্দুর প্রতি প্রেমওয়ালা কোন বাণী ও রচনা ছিল কি?”

অনুকাকা যথাবিধি গোঁ গোঁ করলেন। বাকিরা হেসে উঠল। আজকা সিপিয়েমের সে এলসিও নেই, সে লেনিনও নেই। বেচারারা জোরগলায় বিশ্বমানবতার কথা বলতেও পারে না। প্যাঁক খেয়ে যায়।

একটি ছেলে বলল, “ইতিহাস জেনে কি করব। এখন তো যেটা হচ্ছে সেটা বিজেপিই করাচ্ছে।”

আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, “এখন যেটা আসামে হচ্ছে সেটা হল, সুপ্রীম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে আসামে যেসব বাঙলাদেশী রয়েছে, তাদের শনাক্ত করা, যারা ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ মিডনাইটের পরে ঢুকেছে। কি অনুকাকা, ভুল বললাম?”

অনুকাকা নাক দিয়ে বলল, “ঘুঁক…” মানে এসব তুচ্ছ কথায় তার আগ্রহ নেই।

একটি ছেলে বলল, “এই ডেটই কেন? কে ঠিক করল? বিজেপিই তো?”

আমি অনুকাকার দিকে তাকালাম। বললাম, “কি অনুকাকা? বিজেপিই তো?”

অনুকাকা ঘাঘু লাল। সে বুঝে ফেলেছিল গল্প কি হতে যাচ্ছে। সে পল্টাদাকে বলল, “কিরে পল্টা, কত হল?”

শ্রোতৃমণ্ডলীর এতেই একটা কিছু সন্দেহ হল। ঐ ছেলেটি, যে প্রশ্ন করেছিল, সে’ই আবার বলল, “বিজেপি না?! তাহলে কেসটা কি আসলে?”

আমি ঘাড় নাচিয়ে বললাম, “আমার কাছে কেন, বিখ্যাত বাঙালি হিন্দু সর্বহারা অনুকাকাই বলুক।”

একজন দাঁত বার করে বলল, “অনুকাকা বলবে না আর। ঘোটালা আছে নিশ্চয় কিছু একটা।”

আমি বললাম, “ওকে আমি বলছি। কিন্তু অনুকাকা তো কেটে পড়ছে তোরা নাহয় নিজেরাই খোঁজখবর করিস। শোন, এই ডেটটা ফিক্সড হয় ১৯৮৫র আসাম অ্যাকর্ডে। কাদের মধ্যে হয় জানিস বা জানো তোমাদের মধ্যে কেউ?”

দেখলাম কেউই জানে না। মানে অনুকাকার লেকচারে এসব কিছুই ছিল না।

একজন বলল, “তখন বিজেপি পার্টি ছিল না?”

আমি কান চুলকাতে চুলকাতে বললাম, “ছিল হয়তো কিম্বা নাও থাকতে পারে, সংসার মায়া, প্রপঞ্চ মাত্র। কিন্তু রাজীব গান্ধী কি বিজেপিতে ছিল?”

সবাই দেখলাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইল। যে দুজন সরকারি চাকুরে তাদের একজন বলল, “ঐ অ্যাকর্ড কংগ্রেসের সাথে হয়েছিল?”

আমি বললাম, “ইয়েস। কংগ্রেস ও এএএসইউ। তাতে স্পষ্ট করা ছিল যে চব্বিশে মার্চ ১৯৭১ এর আগে যাদের ভারতে থাকার কাগজ নেই তারা হিন্দু মুসলিম, মতুয়া বাওন, খোট্টা চোট্টা নির্বিশেষে গাধার গাঁ… মানে ঘাড়ধাক্কা খাবে অবৈধ হিসাবে। এবং মানুষের প্রাণের প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান প্রগতিশীলদের নয়নের মনি গান্ধীপরিবারের কুলতিলক রাজীব তাতে আপন হস্তাক্ষরে সই করেছিলেন। শুধু তাই নয়, এই জাস্ট কদিন আগেও এমনকি সিপিয়েম পর্যন্ত এনআরসি দ্রুত করার জন্য লাফিয়ে এসেছে। এখন কথা হল, রাজীবজী কি তখন বিজেপি কোত্তেন?”

এইবার জনগণ ক্ষুব্ধ হল। তারা যে ভাষা আলোচনা শুরু করল তাতে রাজীব, অনুকাকু, কংগ্রেস, সিপিয়েম, অহমীয়া কেউই বাদ পড়ল না। তাই অনিবার্য কারণে এই অংশ সেন্সর করা হল।

আমি থামাতে চাইলাম, বললাম, “আহা গল্প তো এখানেই শেষ নয়। দুহাজার ষোলোর আগ অবধিও এনআরসি একটি সর্বদলীয় সিদ্ধান্ত। সবাই আসাম এনআরসি চায়। কিন্তু বিরোধী একা বিজেপি। তাদের বক্তব্য ছিল মার খেয়ে আসা হিন্দুদের ক্ষেত্রে ঐ ডেট মেনে এনআরসি ইম্প্লিমেন্ট চলবে না। তারা তখনও গাল খেত।”

এইকথা শুনে জনগণ প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইছিল না। তারপর তাদের ২০১৪ সালের চৌঠা এপ্রিলের “দি হিন্দু”র আর্টিকেল দেখানোর পর তারা আরো উত্তেজিত হয়ে উঠল।

কিন্তু একজন বলল, “যে বিজেপি তখন হিন্দুদের কথা বলল, এখন ক্ষমতায় এসে পাল্টি খেল কেন? এটাও তো ঠিক নয়।” ছেলেটি বড়বাজারে কোথাও একটা কাজটাজ করে। প্রশ্নটা বেশ ভালো লাগল আমার। ঝাঁকের কই নয়। প্রশ্ন করতে জানে।

আমি বললাম, “এইখানেই লেটেস্ট ম্যাজিক। যেটা অনুকাকা, মিনুপিসি, হনুমামা কেউই কখনো ডিসক্লোজ করতে চাইছে না। অনুকাকা, মিনুপিসিদেরটা তাও বোঝা যায়। হনুমামারা যে কেন সেধে শাল নিয়ে গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে, বিশ্বাস কর, আমি বুঝতে পারছি না। ম্যাজিকটা কি বলতো?”

ওরা বলল, “বলো শুনি। এখানে তো প্রচুর ঘোটালা দেখছি।”

আমি বললাম, “ঘোটালা বলে ঘোটালা, পুরো সাররিয়াল ঘোটালা। পাল্টি শুধু বিজেপি খায়নি, বিরোধী সবাই মিলে খেয়েছে। যারা তখন দ্রুত এনআরসি চাইছিল, তারা এখন হিন্দু বাঙা দেখে ভেউ ভেউ কেঁদে এনআরসির শ্রাদ্ধ করছে বিজেপির ঘাড়ে ক্রুশ রেখে। আর বিজেপি ভক্তরা কি করছে তা তো তোরা জানিসই। এনআরসির নির্দেশ সুপ্রীম কোর্টের। ফলে আসাম সরকার তা এক্সিকিউটও করছে। কিন্তু এই যে টোটাল সাররিয়াল পাল্টি। এর পিছনে একখানা ম্যাজিক আছে। সেটা বলতে গেলে আরেকটু বলতে হবে। সময় আছে হাতে? নাহলে পরদিন।”

সবাই বলল, “না না, আছে সময়।” ছোকরা বয়স সব। এনার্জি আছে। ছুটির দিন, ফলে আমারও চাপ নেই। তাই বসেই গেলাম।
বললাম, “ডেট ছাড়াও আরো একটা প্রশ্ন আমি আশা করেছিলাম তোমাদের মধ্যে থেকে। এই যে ডেটের মধ্যে থাকা, মানে ২৪ মার্চ, ১৯৭১ মিডনাইটের আগের ব্যাপারটা, এটায় যেসব প্রমাণাদি লাগবে তা কে ও কীভাবে ঠিক করছে।”

একজন বলল, “কেন এটা তো সোজা। এখন, কেন্দ্রে আর আসামে দুইই বিজেপি। তাহলে এটা নিশ্চয় তারাই ঠিক করছে। চেক তো করছে তারাই। যদি এটাও অস্বীকার করো তাহলে তুমিও অনুকাকার মতোই দল বাঁচাচ্ছ।”

আমার বলার কিছু ছিল না। আসলে এগুলো আমার বলার কথাও নয়। ভারত একটা এতবড় দেশ। এত নাগরিক। অথচ নাগরিকরা এখনো তাদের সাংবিধানিক অধিকারগুলো সম্পর্কেই সচেতন নয়। সচেতন করারও কেউ নেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “শোনো, ভাই। প্রথমতঃ আমার কোন দল নেই, দ্বিতীয়তঃ যদি থাকতও তাহলেও সে দলকে বাবা ভাবার মানসিকতা আমার নেই। তাহলে তো অনুকাকার সাথেই থাকতাম এবং এ কথাগুলো বলতামই না। কেন্দ্রে ও রাজ্যে, যারাই থাকুক, তারা রাজতন্ত্র কায়েম করেনি। চাইলেই তারা ইচ্ছামতো ঠিক করে দিতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট অ্যাক্ট লাগে যা সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হতে হয়। মোদী কেন মোদীর বাপ ঠাকুর্দা এসেও তা পারবে না। ইন্দিরার মতো জঘন্য অটোক্র‍্যাট পর্যন্ত পারেনি।”

ওরা চুপ করেই রইল। সব কথা পছন্দ হয়নি হয়তো। একজন বলল, “তাহলে গ্রাউণ্ডটা কি?”

আমি বললাম, “সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট। ১৯৫৫। এটা অনুযায়ী যারা ভ্যালিড পাসপোর্ট বা জাল ডকুমেন্টস দিয়ে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের টেরিটরিতে ঢুকেছে, অথবা ঢোকার পরও বৈধ ভিসার মেয়াদ শেষ হবার পরও এদেশে রয়ে গেছে, তারা, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী।”

একজন বিস্ময়ের গলায় বলে ফেলল, “হিন্দুরাও?!”

আমি হেসে ফেলে বললাম, “ইয়েস। ধর্মনির্বিশেষে। এখন এখানে কার কার মনে হয় যে ১৯৫৫তে মোদী কিম্বা বিজেপি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিল?”

ওরা হাসল না, হাঁ করে রইল। একজন হতভম্ব গলায় বলল, “এ.. এসব… মানে তুমি যা বলছ তা সব সত্যি? কই অনুকাকা তো বলেনি এসব।”

আমি তার দিকে তাকিয়ে কি বলব ভেবে পেলাম না প্রথমে। তারপর বললাম, “স্পেসিফিক্যালি আমি যা বললাম লিখে রাখ। তারপ‍র টু দি পয়েন্ট প্রশ্ন করিস। বুঝে যাবি। আরেকটা কথা, গত ছাব্বিশে মে দি হিন্দুতে দেবশী পুরকায়স্থর আর্টিকেলটা পড়ে দেখতে পারিস। ওখানে সবগুলো সম্পর্কে ব্রিফ করা আছে। দি হিন্দু বিজেপির পেপার নয় নিশ্চয় জানিস?”

সবাই হতবাক হয়ে রইল। যা শুনছে তা তারা আগে শোনেনি। আমিও জানতাম যে সবটা শোনানো হলেই বিষয় উল্টো হবে। কিন্তু শোনানো তো আমার দায় না। আমি ভোটেও দাঁড়াব না। পয়সাও দেবে না কেউ আমার বিপদে। আজ নেহাত অনুকাকাকে পেয়ে গেলাম…

বললাম, “তোমাদের আগে বলেছিলাম ২০১৬ নাগাদ একখানা ম্যাজিকে এনআরসিপক্ষ এনআরসি বিপক্ষ হয়ে গেল, আর বিপক্ষরা পক্ষ। খেয়াল আছে?”

মাথা নাড়ল দু একজন।

বললাম, “ঐ ম্যাজিকটার নাম হল সিটিজেনশিপ বিল অ্যামেন্ডমেন্ট। ২০১৬র পঁচিশে জুলাই ঐ বিল লোকসভায় পেশ করে বিজেপি সরকার। ঐ বিলের বয়ান অনুযায়ী, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশের যে কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘু, কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে ভারতীয় ভুখন্ডে আশ্রয় নিতে চাইলে তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলা হবে না এবং সিটিজেনশিপ দেওয়া হবে।”

যারা শুনছিল, তাদের মধ্যে এবার উত্তেজনা দেখা গেল। আমি আসার আগ পর্যন্ত তাদের যা গেলানো হয়েছে তাতে এই এনআরসি ঘটিত সবকিছু উৎপাত বিজেপি করছে বলেই তারা জেনে এসেছে। এই সিটিজেনশিপ বিলের গল্পটা তারা জাস্ট জানতই না।

উৎফুল্ল গলায় একজন বলল, “তাহলে তো ঠিকই আছে। বাপু দেশ ভাগ করে নিয়েছ, সেখানে থাকো। তাদের আরো জমির ভাগ দেব কেন? যারা অত্যাচারিত তারা পেলেই হল। তাদের তো কোথাও যাবার জায়গা নেই।”

আমি জানি কঠিন ইকোনমিক ভিউপয়েন্টে একটা এরকম উচ্চ জনঘনত্বপূর্ণ দেশে সেটাও কতটা বিপজ্জনক। কারণ লোকের আসাটা সেক্ষেত্রেও একমুখীই। তবু সেসবে গেলাম না। বললাম, “নাহ্ বিষয়টা এতটাও সোজা না।”

ছেলেটি বলল, “কেন? এতে কি সমস্যা?”

আমি বললাম, “এই বিলটাকে আটকে দিয়েছে বিরোধীরা। ফলে এখনো এটা পাশ হয়ে বেরোয়নি। এদিকে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে আসাম অ্যাকর্ড অনুযায়ী এনআরসির। সেখানে প্রতিবেশী দেশের অত্যাচারিত সংখ্যালঘুর কোন এক্সেম্পশন নেই। এমনকি বিজেপির সহযোগী অগপ এবং মেঘালয়ের দলেরাও বিজেপিকে হুমকি দিচ্ছে ঐ বিল আনলে তারা সমর্থন দেবে না।”

ওরা হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। মজা পেলাম আমি। বুঝুক যে রাজনীতি একমাত্রিক নয়। বললাম, “অগপ বা মেঘালয়ের স্থানীয় সংগঠনগুলির দাবী কিন্তু খুবই পরিষ্কার। তারা তাদের জমির অধিকার ছাড়তে চায় না। তাদের জমিতে মানবিকতার ছিদ্র দিয়ে প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকুক, আর ভুমিপুত্রদেরই জীবন কঠিন হয়ে উঠুক তারা তা চায় না। তোরাই বল, যারা ব্যবসা করিস, একই ব্যবসা যদি আরো দশজনে করতে লেগে যায় তাহলে লস হবে না তোদের? যারা চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিস, ক্রমশঃ যদি লোক বাড়তে থাকে তাহলে টাফ হবে না প্রতিযোগিতা? আর এই পুরো ব্যাপারটাই যদি হয় বাইরের থেকে আসা তখন নিজের পেটের তাগিদে লোকে নিজেকে সিকিওর করতে চাইবে না কি? আমি জানি না, খিদে বড় না মানবতা। তোরাই ঠিক কর। অহমীয়ারা আগে নিজেদের দিকটা দেখছে। এরকম হেভিলি পপুলেটেড দেশে তাদের চিন্তাভাবনাও কি অস্বাভাবিক? আমি নিশ্চিত নই। তবে এটুকু বলি, বিজেপির একশো আটটা কি তারচেয়েও বেশী অপদার্থতা আছে। তাদের গুচ্ছ জুমলাবাজি আমার কাছে অত্যন্ত ঘৃণিত, বিশেষতঃ ঐ ওআইসির পশ্চাতে তৈলমর্দনের মত ঘটনাগুলো। ডিমানিটাইজেশনও কাইন্ড অফ ফ্লপ। এই এনআরসিও হয়তো এই পাকেচক্রে তাই’ই হয়ে দাঁড়াবে। কিন্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ঐ সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্টে বিল এনেছে তারাই। এই যে এনআরসি নিয়ে হল্লাটা করা হচ্ছে এটা ঐ সিটিজেনশিপ বিলের কেসটা যাতে প্রচারে না আসে তার জন্য।”

“কিন্তু সেদিন যে বিজেপিরই একজন বলল, এখানে আসলেও এনআরসি করবে। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়াবে। এখন তোমার কথা ঠিক হলে তো এনআরসি বিজেপির ইস্যূই না।”

আমি কি বলব এ কথার। আমি তো ভেবেই পাই না কোন রাজনৈতিক চেয়ারের বক্তব্য এরকম উদ্ভট দায়িত্বজ্ঞানহীন অগোছালো হয় কি করে। দাঁত বার করে বললাম, “এইটা ভালো প্রশ্ন করেছ। ঐ বিজেপি নেতাকেই গিয়ে বরং জিজ্ঞাসা কোরো যে তিনি ঘাড়ধাক্কা কি আফটার সিটিজেনশিপ বিল অ্যামেন্ডমেন্ট দেবেন, নাকি বিফোর? তাছাড়া ঐ ২৪ মার্চ, ১৯৭১ ডেটটা তো আসাম অ্যাকর্ড, অহমীয়াদের সাথে। বাংলায় হলে ভূ-রাজনৈতিক কারণেই সে ডেট আলাদা হবে। তার জন্য বেঙ্গল অ্যাকর্ড লাগবে। তার সম্পর্কে ঐ নেতা আলোকপাত করেছেন কি? একটি চেয়ারে থেকে হুব্বা মস্তানের মত কথা না বলে এসব বিষয়ে বক্তব্য রাখলে ও প্রচারে জোর দিলে লোকে বেটার জানতে পারত আর কি। কিম্বা হয়তো এখানেও ব্রেনে অক্সিজেন কমার কোন কেস। আমি কি করে জানব ভাই?”

প্রায় সকলেই হেসে উঠল। কিন্তু….

“তাহলে এখন কি হবে যেসব হিন্দুর নাম বাদ গেল তাদের?” হঠাৎ যে ছেলেটি এটা জিজ্ঞাসা করল তাকে আমি চিনি। এতক্ষণ সে একটাও কথা বলেনি। গরীব ঘরের ছেলে। খুব বেশী তো এপারে এসেছে বছর সাতেক। পালিয়ে আসার আগের দিনই হুমকি শুনেছিল, জমিটা বেচে না দিলে ওর দিদিকে তুলে নিয়ে যাবে। পরদিন মৌখিক চুক্তিতে নামমাত্র দামের আশ্বাসে জমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসে এপাশে। বাপ জন মজুরী খাটে। মা আর দিদি বাসন মাজে। আর ছেলেটা ট্রেনেবাসে হকারি করে টুকটাক।
ছেলেটার চোখদুটো দেখে মায়া হল। বাচ্চা ছেলে। কলেজে পড়ার বয়স। ঐ বয়সে আমি যখন ভাবছি ফারদার ডিগ্রির জন্য ইউকে ভালো, না ইউএস, জিআরই না টোয়েফেল, তখন এ ভাবছে…. ধাক্কা খেলাম একটা। এতক্ষণ যত সহজভাবে বলে যাচ্ছিলাম, পারলাম না। ডেকে বললাম, “এদিকে আয়।”

এল। বললাম, “যদি তোদের নাম কখনো বাদ পড়ে, আমার বাড়িতে এসে থাকিস। আমি বেঁচে থাকতে ডিটেনশন ক্যাম্পে তোদের পরিবারটার অন্ততঃ যেতে হবে না।”

এরপর আর আলোচনা করতে পারিনি। জানিনা সিটিজেনশিপ বিলটা পাশ হবে কিনা। হলে এই ছেলেগুলোর দুচোখের ভয়টা কাটত।

আমি নাস্তিক। তবু ফেরার পথে আকাশের দিকে তাকালাম একবার।

যদি কেউ থাকে….”

ফীচার: The Indian Express